ভবঘুরে পর্বঃ০৮
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
উরবির বাচ্চামি-সূলভ ন্যাকা কান্না দেখে আবিদের যেন পিত্তি জ্বলে যায়। সে আত্মসংবরণ করতে ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে থমকে উঠে বলল,
– ‘আহা থামুন তো। আপনি পোকার মা হন আর বিড়ালের মা হোন। তাতে আমার কি যায় আসে? আপনি এগুলো মুছে দিন।’ শেষের কথাটা শার্টের সঙ্গে সেঁটে থাকা হলুদাভ রঙের লালা-মিশ্রিত আমগুলো দেখিয়ে দিয়ে বলল আবিদ।
পুরাতন রেডিওগুলোর সুইচ টিপ দিলে যেভাবে গানবাজনা থেমে যায় ঠিক সেভাবে ধমক খেয়ে উরবি কান্না সেভাবে থেমে গেল নিমেষে। তন্বী পুতুলের মতোন ঠোঁট,নাক, কপোল আর শকুনে পাখনার মতোন ভুরু এর নিচে ডবডবে চোখদুটো পিটপিট করে ক্রূর দৃষ্টি মেলে তাকাল আবিদের দিকে। এতক্ষণ সে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিল ঠিক, কিন্তু তার চোখের পানি যেন ঝরতে বড্ড কার্পণ্য করে। একফোঁটা পানির দেখা মিলল না চোখের বারান্দায়। আবিদ সেই ক্ষমাসূচক আহ্লাদিত চাহনি উপেক্ষা করে আবার শার্টের দিকে ইঙ্গিত করল মুছে দেবার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে উরবি একহাত ঝাড়া আরেকটা আম দাঁতে ছিলতে ছিলতে বলল ,
– ‘ওগুলা মুছতে আমার বয়ে গেছে। যান পুকুরে ডুব দিয়ে আসুন।’
আবিদ হাঁ করে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর আবার মুখ বন্ধ করে ঠোঁটে একটু বিরক্তি নিকিয়ে বলল,
– ‘আমি এই সন্ধ্যায় পুকুরে ডুব দিতে যাব আবার?’
– ‘কেন, ভূতের ভয় পাইতেছেন?’ উপরের পাটির দাঁত দিয়ে আমের ছাল ছিলতে ছিলতে তেড়ছা চোখে বলল উরবি
– ‘ভয় পাবার কী আছে?’
– ‘সেটাই তো,ভয় পাবার কী আছে? যান যান ডুব দিয়ে আসেন।’ নিজস্ব কাজে রত থেকে পুকুরঘাটে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিল উরবি।
আবিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– ‘বেহায়া মেয়ে কোথাকার’
পলকে উরবির চোখ বিস্ফারিত হল,
– ‘কী বললেন?
– ‘বেহায়া বললাম।’ উদ্যমহীন নিঃশঙ্ক স্বীকারোক্তি আবিদের।
হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠল উরবি,
– ‘সেদিনও আপনি আমাকে বেহায়া বলছেন। সমস্যাটা কী আপনার? আপনাকে থাকতে দিছি বলে কি যা তা বলবেন?’
– ‘আমিতো চলেই যাচ্ছিলাম। আপনিই তো হাতেপায়ে ধরে নিয়ে এলেন আবার। বেশ তো, অনেক হল। আমি একটা কাজে এসেছি, এভাবে চাপ নিয়ে তো থাকা যায় না। এবার আর জানিয়ে যাব না। হুট করে উধাও হব। তখন স্বাধীনভাবে থাকিয়েন।’
কথাগুলো বলেই আবিদ উরবিকে পাশ কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরল। উরবি পেছন থেকে উল্লুক, বাঁদর, টিকটিকি, তেলাপোকা,তক্ষকসহ জানা অজানা প্রাণীর নাম ধরে ডেকে আবিদের দৃষ্টি আকর্ষণে চেষ্টা করল। কিন্তু একগুঁয়ে স্বভাবের আবিদ উরবির সাড়া দেওয়া তো দূর ফিরেও তাকাল না একপলক। দ্রুতপদে খসখস করে আমবাগানের মরা পাতাগুলো মাড়াতে মাড়াতে আবিদের ভেতরটা উল্কাপিণ্ডের মতো জ্বলতে লাগল। এই মেয়েটা দিবানিশি তার পিছনে আঠার মতো লেগে আছে। প্রতিটা দিন একটা না একটা অনিষ্ট তার দ্বারা হবেই এতে সন্দেহের জো নেই। কোনো কারণ ছাড়াই পরিষ্কার শার্টে আধ-চিবানো আম থুথু-সমেত ছোঁড়ার কোনো মানে হয়? মানুষ এমন অভব্য, অবিবেচক, দুর্মদ হতে পারে? আবিদের মাথায় আবার অন্যচিন্তারা ঠুকাঠুকি করে… আসলেই কি মাথায় ছিট আছে মেয়েটার? নাকি নিছক মজার নেওয়ার নিমিত্তেই এসব কুকর্মের ভাগিদার হওয়া? কে জানে হতেই পারে! অজ্ঞাতকুলশীল একজন লোকের সাথে মজা লুটা’টা তার মতো উড়নচণ্ডীই বা ছেড়ে দিবে কেন? দিনকে-দিন মেয়েটার উদ্ভুট্টি আচরণের বেগ তাল দিয়ে বেড়েই চলেছে। নাহ,আরো শক্ত হতে হবে। এভাবে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। ক’ ঘা বসিয়ে দিয়ে শায়েস্তা করতে হবে… বিভিন্ন ছলেবলে নিজেকে নিজে বোঝ দিল আবিদ।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
বাগান থেকে হাঁড়িপানা মুখে ফিরে এসে বাবার ঘরে গেল উরবি। ইশতিয়াক সাহেব নিজ কক্ষে বসে একমনে খাতার ওপর খসখস করে কলম চালিয়ে কি যেন গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখছিলেন। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বড় চায়ের মগটা টেবিলের এককোণে রেখে কোনোপ্রকার কথোপকথন ছাড়াই রান্নাঘরের দিকে ছুটছিল সালমা। পেছনে ঘুরতেই উরবিকে বিষণ্ণবদনে ঘরে ঢুকতে দেখে সে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– উরবি? কিছু হয়েছে?
উরবি কিছু না শোনার ভান করে অবিচলিতভাবে বাবার পাশের চেয়ারটা টেনে বসল। সালমা চোখ ঘুরিয়ে, ঠোঁট টিপে সদ্যপ্রাপ্ত ছোট অপমানটা মহাশূন্যে উধাও করে দিয়ে ভাত পুড়ে যাওয়া ঘ্রাণ অনুসরণ করে রান্নাঘরের দিকে ছুটল। মুখে বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করল, এই রে ভাত পুড়ে গেল। বলা বাহুল্য, এই বাড়িতে রান্নাবাড়ার কাজ উরবির ছোটমামি সালমাই করে থাকে। রান্নার হাত তার উঠন্তি কিশোরী বয়স থেকেই পরিপক্ব ছিল। সেই সংবাদ যখন এই বাড়িতে এসে পৌঁছায় তখন থেকেই বাড়ির রন্ধনকতৃর চাকরি হারাতে হল।
– ‘কী রে? মুখ চুন করে বসে আছিস কেন? মুখ থেকেও তো আমের গন্ধ আসছে। সারাদিন এতো আম খাস কেমনে বলতো। যা মুখ ধুয়ে আয়।’
উরবি কটমট করে তাকাল বাবার দিকে। মেয়ের সেই তীব্র কটাক্ষে ইশতিয়াক সাহেবের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। তিনি একটু চমকানোর ভান করে কপট হেসে বললেন,
– ‘কী হয়েছে বলতো? মন-মেজাজ খারাপ কেন? আবারো পোকা-খাওয়া আম খেয়েছিস নাকি?’
– ‘হ্যাঁ’, মুখখানা হাঁড়ির মতো করে মাথা নিচু করল উরবি।
– ভালো হয়েছে। আরো কয়েকটা খা গিয়ে।
উরবি মাথা তুলে খ্যাঁক করে উঠল,
– ‘হ্যাঁ ভালো তো হবেই,না? আর কথা বলবা না তুমি।’ এটুকু বলে উরবি নিজেকে সংযত করে নিল৷ আবার বলল,
– ‘বাবা, আমি ঢাকা যাব। বন্ধুদের মিস করতেছি।
– বেশ তো। কোথায় উঠবি?
– কেন? মামণির বাবার বাড়িতে।
– নাহ,ওখানে উঠবি আর তোর মামিকে নিয়ে যাবি না এটা কি হয়? তুই বরং তোর বেদুরা ফুফুর বাস উঠ।
উরবি সন্ত্রস্তা হয়ে গুরুতর গলায় বলল,
– বেদুরা ফুপির বাসায়? মাথা খারাপ। ঐ বুড়ি তো আমার চেয়েও ডেঞ্জারাস। ঘর থেকেই বেরুতে দিবে না। একবার গিয়ে দশদিন গৃহবন্দী ছিলাম মনে নেই?
ইশতিয়াক সাহেব চিন্তিত মনে আধটেকো মাথাটা চুলকে বলল,
– তাহলে তোর মামিকে সহ নিয়ে যা। তুই একা গেলে খারাপ দেখায়৷
উরবিও এবার চিন্তায় পড়ে যায়। বলল,
– তুমি কি তাহলে একা থাকবে বাসায়? খাবে কী?
– দুই-তিন দিন বেড়িয়ে তো চলে আসবিই। বাইরে কোথাও খেয়ে নিব।
এবার উরবি কঠিন অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
– নাহ্ তা হচ্ছে না। তুমিও চলো আমাদের সাথে।
– আহা, আমি বুড়ো একটা লোক, ওখানে তোর মামির বাপের বাড়ি গিয়ে থাকব? কেমন অস্বস্তিকর ব্যাপার ভাবতে পারিস?… অবশ্য একটা উপায় আছে।
– কী? সোৎসাহে বাবার মুখের ওপর তাকিয়ে শুধায় উরবি।
– আমার একটা কলিগ ছিল, খুব ক্লোজ ছিলাম আমরা। ও বারবার বলছিল একবার ঘুরে আসতে। এবার বুঝি সুযোগ হয়ে গেল।
– তাহলে তো হয়েই গেল। কিন্তু বাবা… ঐ জংলিটা এখানেই থাকবে?
ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের দিকে অতৃপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
– থাকতে সমস্যা কী? ছেলে ভালো। সৎ। তাছাড়া দারোয়ান, কেয়ারটেকার তো আছেই। মকবুলের মা’কে( আগের বুয়া)বলে দিয়ে যাব যাতে কয়টা দিন এখানে রান্না করে একজনের জন্য। চাকরি নট হলেও আমার কথা সে ফেলতে পারবে না। হুঁ।
– ‘ঠিক আছে তাহলে। ডান।’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল উরবি। ব্যস্ততার ভঙ্গিতে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে শব্দ করে বলল,
-‘ দুইদিনের মধ্যে টিকিট কেটে ফেল। আমি রেডি।’
– হ্যাঁ তুই মুখ ধো গিয়ে। বিড়ালের মতো লাগছে দেখতে। উফ্ সারাদিন আম খায় মেয়েটা।
উরবি বাবার কথায় ঘরময় তীক্ষ্ণ খলখল হাসির তরঙ্গ বইয়ে দিতে দিতে তিড়িংতিড়িং করে দুই-তিন লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়া কিশোরী যেন সে!
…………………………………………..
সকাল থেকেই কোনো কারণ ছাড়াই উরবির মন বেশ ফুরফুরে। সাধারণ কথাতেই হাসছে,রসিকতা করছে গুনগুনিয়ে স্বরচিত গান গেয়ে চলেছে,
“মন সারণীর বাঁকে,
হঠাৎ তোমায় দেখে
বিভোর আমি, মাতাল আমি
তোমারি সুখে।
এ যেন অসীম বাড়াবাড়ি করছি আমি…
পারছি না সামলাতে…
আমার অধ্যুষিত মনের তুলিতে
তোমারি ছবি আঁকছি।
আবার সেই ক্যানভাসকেই,
আনমনে তুমি ভেবে ছুঁতে গিয়ে
লাজে আবির মেখে ফিরছি।”
গান শুনে জিসান বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
– আমি তো হুদাই গান শুনি রাইতের বেলা। মেলা শিল্পির গান হুনি। তয়, এই গান তো হুনলাম না কহনো।
উরবি হেসে বলল,
– এই গান আমার লেখা। ভার্সিটিতে থাকতে একদিন রাতে হঠাৎ করে লিখে ফেলছিলাম। এরপর অবশ্য আরো দুয়েকটা লিখছি। এরপর আর হয় নাই। বুঝলে। ইউটিউবে আছে। সার্চ দিয়ে দেখলে পাবে।
অক্ষরজ্ঞানহীন জিসান এতোকিছু বুঝল না। সে শুধু বুঝল গানের কথাগুলো উরবির লেখা। গানটা তার খুব ভালো লেগেছে। সে আবদারের গলায় বলল,
– গানডা আমার ফোনে ঢুকাই দিবানি?
– নিজেই ডাওনলোড করে নিও।
জিসান বোকার হাসি দিয়ে বলল,
– পারি না তো।
উরবির মুখে হাসি লেগেই আছে। সে লেগে থাকা হাসিটা প্রশস্ত করে বলল,
– আচ্ছা ঠিক আছে। দিব পরে।
জিসান আর উরবি ভরদুপুরে সদর থেকে ফিরছিল। চারিপাশ তখন সুনসান নীরবতা বিরাজমান। মাটির রাস্তার দুইপাশে ফসল-শূন্য ধূ ধূ মরুভূমির মতোন খর তাপে শরীর বিদীর্ণ শুকনো বিল। রাস্তার দু’ধারের সারি সারি লাগানো গাছের পাতাগুলো ঘুমচ্ছে পরম নিশ্চিন্তে। জনমানুষকে বাতাস দেওয়ার মতোন জরুরি কাজটা যেন তারা ভুলে গিয়ে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই রাস্তা ধরেই দু’জনে হেঁটে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন। পথ যেন ফুরোয় না। মাথার ওপর সূর্যটার প্রখর তেজ আজ। বেসামাল দীপ্তিতে সর্বদায় কপাল কুঁচকে রাখতে হয় এমন অবস্থা। জিসান গিয়েছিল কি একটা জরুরি কাজে সদরে। উরবি গিয়েছিল উপজেলা নিজের ভোটার আইডি কার্ডে নিজের প্রয়াত মায়ের নামের ভুলটা সংশোধন করতে। ব্যস, আচানক দেখা হয়ে গেলে জিসান আর ছাড়তে রাজি হয় না তাকে। এক সঙ্গে বাড়ির দিকে ফিরবে বলে জোঁকের মতো লেগে ছিল উরবির পিছনে। এরপর উরবির কাজ যখন সমাধা হয়, দু’জনে তখন একসঙ্গে হেঁটে ফেরার পথ ধরে৷ হেঁটে আসার প্রয়োজন ছিল না অবশ্য। আগে ভ্যান পাওয়া গেলেও ইদানিং বাড়ির কাছের বড় কালভার্টটার একটা অংশ খসে পড়ায় গাড়ি চলাচল স্থগিত আছে আপাতত। জিসানের এহেন আচরণে উরবি অবশ্য অতোটা বিচলিত হয় না। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে জিসানের সঙ্গে। কিন্তু জিসানের অবাঞ্ছিত স্থূল দৃষ্টি উরবির শরীরে অস্বস্তিরা জমাট বাঁধতে শুরু করে। সেই চাহনি মনে করেই একনিমেখেই দূরে হটে যায় সে।
– তুমি চাকরি-বাকরি কিছু করবা না? অনেক্ষণ নিশ্চুপ থাকার কর প্রশ্ন করল উরবি।
জিসান দাঁত ক’পাটি বের করে হেসে বলল,
– নাহ্। কেলাস টেন পর্যন্ত পড়ছি৷ কেডা চাকরি দিবো আমারে, কও?
উবরি অস্বাভাবিক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– ‘কেন? পড় নাই কেন?’
– ‘হুদাই। শয়তানি করছিলাম। তোমার মতো মেম সাহেবের লগে প্রেম করুম জানলে কমছে- কম ইন্টার পয্যন্ত পড়তাম৷’ বলে ত্যাড়া চোখে উরবিকে পূর্বের দৃষ্টিতে দর্শন করে নিল জিসান। উরবির ক্ষীণ পাতলা দেহে জড়িয়ে আছে একটা মোটামুটি রকমের ঢিলা শার্ট আর জিন্স। চুলগুলো আঁট করে বেঁধে ঝুলানো পিঠের ওপর। চোখে-মুখে হালকা প্রসাধনের প্রলেপ। রোদে কুঁচকানো বাঁকা ভুরুর শোণিত ধারে জিসানের ভেতরটা যেন ফালাফালা হয়ে যায় একটু ছুঁয়ে দেবার জন্য।
উরবি সেই দৃষ্টির গূঢ়তত্ব বুঝতে পেরে একটু ধমকে ওঠে।
– কী দেখো?
– তোমারেই তো দেহি। দ্যাখতে মানা আছে নাহি?
– না দেখা যাবে না এভাবে।
– কেন?
– আমি বলছি তাই।
জিসান শঠ বোকার মতো হেসে চুপ করে যায়। পরক্ষণেই ক্রোধে মদির রক্তচক্ষু দু’টো বেরিয়ে আসতে চায় তার। সে জানে উরবির আর যাইহোক, ভীষণ রুক্ষ মেজাজের মেয়ে। একে এতো সহজে বাগে আনার চিন্তাকে ঘোড়া রোগ বলে। অনেকটা পথ হাঁটার পর ক্লান্তির নাম করে রাস্তার কিনারায় বাঁশের তৈরি একটা বৈঠকখানায় লাফিয়ে বসল জিসান। ক্লান্তিবশত উরবিও বসে পড়ল। অনেকটা পথ হাঁটার শ্রান্তিতে সকাল হতে লেগে থাকা মুখের হাসিটাতেও কিঞ্চিৎ মলিনতা এসেছে। জিসান বলল,
– আচ্ছা, তোমাগো বাড়িতে ঐ লোকটা ক্যাডা?
উরবি ইঙ্গিত বুঝতে পেরেও স্বভাবসুলভ প্রশ্ন করে,
– কোনটা?
জিসান বর্ণনা দেয়,
– ঐ যে লম্বা চুল,দাড়ি। হাতে দামী ক্যামরা নিয়ে ঘুরে। ঐ আরকি। তোমাগে বাড়িতে থাহে দেখলাম।
– আমাদের বাড়ির ওপর নজরদারি করতে কে বলল তোমাকে?
জিসান যেন অমূলক লজ্জায় বিগলিত হয়ে মাথা নুইয়ে হাসে। উরবি ঠোঁটের কোণে একচিমটি বিরক্তি মাখিয়ে বলল,
– আর যেন না শুনি।
জিসান অনুগত হয়ে মাথা নেড়ে বলল,
– শুনবানা। কিন্তু লোকডা ক্যাডা।
উরবি আবার মুখ ফিরিয়ে অন্যত্র তাকিয়ে সংক্ষেপে বলল,
– চিনবা না। দূর থেকে আসছে,মুসাফির।
– ও…
– হুঁ, কেন? ওকে নিয়ে এতো কৌতুহল হঠাৎ?
– নাহ্ লোকটারে জায়গায়-অজায়গায় যাইতে দেহি তাই…
জিসানের কথা শেষ হতে না হতেই উরবি তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে রূঢ় চাহনি-সমেত উদ্দীপনা নিয়ে বলল,
– কোথায় যায়?
জিসান ভেতরে ভেতরে অধীর হয়ে যায়। আবিদের কথা শোনার পর উরবির এমন চাঞ্চল্যতায় সে বিশেষ সন্তুষ্ট হতে পারে না। কি এক অন্তর্দহনে পুড়তে থাকে সমস্ত অন্তঃকরণ। ছাইগুলো কেবল রাশীকৃত হয়ে থাকল পোড়া হৃদয়ে। দুপুরের থমথমে আবহাওয়াটা কেটে গেলেই হয়তো ভস্মিত ছাইগুলো দমকা বাতাসে উড়ে যাবে। আর পুরো কথাটা বলতে পারে না সে। নানান ছলে বলে কৌশলে অন্য আলোচনায় পড়ে৷ কিন্তু উরবির যেন সেদিকে মন নেই৷ কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না।
আবার পথ হাঁটা শুরু করল দুজনে। পথে আর কোনো কথা হল না দুজনের মধ্যে। মিনিট বিশেকের মধ্যে দু’জনেই যার যার বাড়িতে পৌঁছে গেল এবং বিদেয় নিল।
পুকুরের উপরিভাগের ঈষদুষ্ণ পানিতে চিত-সাঁতার কাটতে কাটতে উরবি ভাবছে জংলি লোকটার কথা। জিসান আজকে কিছু একটা ইঙ্গিত করতে গিয়েও এড়িয়ে গেছে তা সে স্পষ্ট লক্ষ্য করেছে। নারীজাতি সঠিক ভালোবাসাটা টের না পেলেও পাশের মানুষটার এড়িয়ে যাওয়াটা বিচক্ষণতার সঙ্গে বুঝে নিতে পারে৷ তবুও সে চুপ করে নিজস্ব ভাবনায় মগ্ন ছিল৷ এখনো সেই একরোখা অসংলগ্ন ভাবনাগুলো মস্তিষ্কের এফোড় ওফোড় চষে বেড়াচ্ছে। বেড়াতেই থাকবে…যতক্ষণ না উত্তর না মেলে। লোকটা এখানে কেন এসেছে? কী উদ্দেশ্যে এসেছে? দিনভর সে থাকে কোথায়। কোথায় বা সে ঘুরে বেড়ায়? জিসানের অস্পষ্ট ইঙ্গিতটা কী ছিল? এসব অজ্ঞাত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে ফিরে সাঁতার কাটতে কাটতে পুকুরের ওপারে বুকসমান পানিতে পঙ্কিল মাটির ওপর ভেসে দাঁড়াল সে। একজোড়া পুঁটিমাছ তার পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিয়ে দ্রুত পালাল। সঙ্গে সঙ্গে সে কাদামাটি থেকে পা উপরে তুলে ভেসে শিশুর মতোন খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই তীক্ষ্ণধার হাসির দুর্লঙ্ঘ ঊর্মি এঁকেবেঁকে পৌঁছাল নিচতলায় পুকুরঘাট-সংলগ্ন পাকঘরে ছোটমামির কানে। সেখান থেকেই সালমা চেঁচিয়ে উঠল,
– ‘উরবি, সময়টা ভালো না। তাড়াতাড়ি পুকুর থেকে উঠে আয়।’
উরবিও চেঁচিয়ে জানান দিল,
– ‘হ্যাঁ আসতেছি। তুমি ততক্ষণে ভাত বাড়ো আমার জন্য। খুব খিদে লাগছে।’
এরপর দ্রত গোসল সেরে উঠে উরবি নিজের ঘরে যাওয়ার আগে একবার আবিদের ঘরে উঁকি দিল। ফলাফল শূন্য৷ বিজন ঘরটা লোকাভাবে খাঁখাঁ করছে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল লোকটা ইদানিং সারাদিন বাইরের ঘুরঘুর করে এলোমেলো পরিশ্রান্ত হয়ে বিকালবেলায় ফিরে। আবারো মস্তিষ্কে চাপা পড়া প্রশ্নগুলো দলবেঁধে উঁকিঝুকি দিল। একটা দীর্ঘশ্বাসে সেসব প্রশ্ন আবারো ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়াস করে সেখান থেকে প্রস্থান করল সে।
……………………………………………
রাতের আকাশটা স্বচ্ছ আজ। আকাশের কাঁটাতারে ঝুলে আছে অসংখ্য দেদীপ্যমান তারকারাজি এবং গোল বৃত্তের মতোন চাঁদ। তল্লাটজুড়ে চন্দ্রিমার মিষ্টি আলোয় ভরপুর সঙ্গে গা জুড়ানো ঝিরি হাওয়া। অদূরে জারুল গাছের মাথায় ঝিকিমিকি জ্বলছে জোনাকির আলো। ঘরের ভেতরে ভ্যাপাসা গরম বলে ছাদে এসে উঠেছিল আবিদ। এসেই দেখে কোন্দলিয়া মেয়েটি হেডফোন কানে গান শুনছে হেলেদুলে। আবিদ ঝঞ্ঝাট এড়াতে চলে যেতে উদ্যত হতেই পেছন থেকে ডাক পড়ল উরবির। মেয়েটা ডাকলেই মনে হয় যেন ঝগড়া করছে। তরিবত কি শেখেনি মেয়েটা?একটু কোমলতা কি নেই তার ভেতরটায়? মেয়ে মানুষ এমন পাষাণে গড়া হলে তে বিপদ! ভাবতে ভাবতে কল্মাষ আঁধারে উরবির দিকে এগোয় আবিদ।
কাছে যেতেই উরবি কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্ন ছুঁড়ে,
– আপনি এখানে কী উদ্দেশ্যে আসছেন বলুন তো।
আবিদ শুরুতে কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বেপরোয়া গলায় বলল,
– সেটা জেনে আপনার কাজ কী?
– আপনার নামে অনেক অভিযোগ শুনতে পাই আজকাল।
– কীরকম?
– বলব, তার আগে আপনি বলুন। আপনার উদ্দেশ্যটা কী?
– মেয়ে ধরা।
– কী?
– মেয়ে ধরা বললাম, মেয়ে।
– মেয়ে ধরে কী করেন ওদের?
– আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নই?
– বুঝতে পারলেও কিছু করার নাই। আপনার উদ্দেশ্যটা আমার জানতে হবে।
– আমিই বা বলতে বাধ্য কেন?
– অবশ্যই বাধ্য।
মাথার ওপর পূর্ণিমা চাঁদের ভরা জ্যোৎস্নায় ছাদ-ঘেঁষা আমগাছের ছায়া এসে পড়েছে ছাদে। আমগাছের ডালপালা আর পাতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁক গলে ছাদের ওপর যেন জ্যোৎস্নার বৃষ্টি হচ্ছে। উরবি আবিদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে শান্ত-মৃদু কণ্ঠে বলে,
– আপনি এমন কেন বলুন তো!
আবিদও ঘুরে তাকিয়ে বলে,
– কেমন?
উরবি একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মিনমিন করে বলে,
– ঘাড়ত্যাড়া, বদ, আলুবাজ।
আবিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে ভারি দারুণ ভঙ্গিতে শ্লেষের হাসি হাসল। বলল,
– ঠিক আপনার মতো।
চলবে…
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share