ভবঘুরে পর্বঃ০১
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
-‘ আপনাদের প্রধানমন্ত্রী হলেন একজন অত্যাচারী মহিলা। বুঝলেন? এখন এটা জিগাইয়েন না যে কেমনে কেমনে অত্যাচারী কইলাম। সব আপনাদের চক্ষের সামনেই হইতেছে।
বলতে বলতে দোকানদার মজিদ চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয় মনসুরের দিকে। মনসুর সন্তর্পণে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ে।
-‘হ, মিয়া,তুমি আমার বালডা বুঝো। কেমনে জিজ্ঞাইলে তো মুখে তালা পড়বো। এইজন্য আগেত্তে কয়ে রাখতেছ। চা বেচতাছো বেচো। বেশি পকপক করলে দোকানসহ উঠাই দিমু।’
একমাত্র জীবিকার সম্বল দোকানটা উৎখাতের কথা শুনে মজিদের মুখ শুকিয়ে যায়। সে আর টুঁ শব্দ করে না। আপনমনে চা প্রস্তুত করতে থাকে দোকানের অপেক্ষমাণ মানুষগুলোর জন্য। বেগার আলাপে নিজের ক্ষতি নিজে ডেকে আনার মানে হয় না। মনসুর এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের একজন। গা-গতরে বিশেষ কেউ মনে হয় না;নিতান্তই খর্বাকৃতির হোঁদল গোছের লোক। ত্রিশূলের মতোন চাহনি। গাল থেকে গলাভর্তি সাদা-পাকা দাড়ি-গোঁফ। স্বভাবে বড়ো একরোখা আর ঘাড়ত্যাড়া প্রকৃতির। সামনে মেম্বার ইলেকশনে জনপ্রতিনিধি হওয়ার অভিলাষ নিয়ে ঘুরঘুর করছেন। বর্তমান সরকারের একপাক্ষিক সমর্থক তিনি। বিরোধী দলের কেউ কিছু বললে তেলে পানি পড়ার মতোন ছ্যাঁৎ করে উঠেন। কারণেই, এলাকার কম বয়সী ছেলেপিলেরা তাকে সময়ে-অসময়ে, কাজে-অকাজে উত্যক্ত করে। অবশ্য ফলপ্রসূ হয় তারা। মনসুরের ঠিক গা ঘেঁষে বসে ছিলেন ঢাকা ফেরত সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইশতিয়াক হোসেন। তিনি মনসুরের এই দুর্বলতার সম্পর্কে অবগত নন। ফলেই তিনি স্বভাবসুলভ ঢংয়ে জ্ঞানগর্ভ গলায় এবার কথা বললেন,
-‘মনসুর! মানুষকে এভাবে ধমকানো ঠিক না বুঝলে? ও নিরক্ষর মানুষ। কতকিছু বুঝে আর না বুঝে! আর তাছাড়া সরকারের সমালোচনা করার অধিকারও সবার রয়েছে। তবে ভাষাটা একটু শালীন হওয়া উচিত ছিল অবশ্য!
মনসুর অসন্তুষ্ট হয়ে ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
— নাহ সে এভাবে কইতে পারে না। সে বেগার আমারে চেতায় হক্কল সময়।
একটু থেমে শুদ্ধভাবে বলার চেষ্টা করলেন,
যাউক, তই আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
-‘কী কথা?’ বলল ইশতিয়াক হোসেন।
-‘আপনি তো ঢাকা থেকে আসছেন অনেক বছর পর। আপনি ঠিকই আছেন। তই,আপনার মাইয়াটা একটু বেহায়া আছে। ফটাং ফটাং কথার জবাব দেয়। ছোট-বড় মান্য করে না। আরো কত কি!’ বাবার সামনে মেয়ে সম্পর্কে বিরূপ কথাগুলো অকপটে পেট থেকে উগরে দিল মনসুর। ইশতিয়াক হোসেন খানিকটা তটস্থ হলেন। নিজ মেয়ে নিয়ে এধরণের কথা শুনেননি আগে। রাগ দমন করলেন ঠিক কিন্তু উদ্বিগ্নতা দমাতে পারল না, শুধাল,
-‘ কেন? তোমাকে কী করেছে আমার মেয়ে।কোনো বেয়াদবি করেছে নাকি?’
– ‘যা করছে একপ্রকার বেয়াদবিই বলা চলে। মেয়ে তো পয়দা করছেন একখান। ছেলে-টেলে নাই। বংশের বাত্তি জ্বলবে ক্যামনে?’
আলী হোসেন ঠোঁট সংকুচিত করে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
-‘ বংশ যেহেতু আমার। বাত্তি নিয়ে চিন্তাও আমি করব। তুমি আগে বলো আমার মেয়ে কী করেছে তোমাকে।’
-‘ বাত্তি নিয়ে নিয়ে চিন্তা করলে আগেই করতেন। আপনার বাত্তি তো এখন নিভে গিয়ে আকাশে উড়াল দিছে। তয়…
এতটুকু বলে মনসুর আপাদমস্তক একবার তেরছা চোখে নিরীক্ষণ করল ইশতিয়াক সাহেবের। ঠোঁট টেনে বলল, “বিয়ের বয়স এহনো আছে। নতুন বাত্তি জ্বালান যাইবো।”
-‘নতুন বাত্তি আমার লাগবে না ভাই।’
কয়েকজন ক্রেতা মুচকি মুচকি হাসছিল তাঁদের বাক্যালাপে। এবার হো হো শব্দ করে হেসে ফেলল কয়েকজন। মনসুর সেদিকে কান দিল না। অদ্ভুত সুরে টেনে টেনে বলল,
-‘ঠিক আছে, কী আর করা! আপনার মেয়ে করছে কি…’
মূল্যবান কথাটা শেষ হল না। কথার মাঝপথেই আউলা এক যুবক এসে ভরাট কণ্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে জিজ্ঞেস করল,
-‘এক্সকিউজ মি!এখানে থাকার কোনো জায়গা আছে? হোটেল বা বডিং?’
সাধারণভাবেই চকিতে দোকানে বসে থাকা সকল লোকের চোখযুগল যুবকের ওপর নিপতিত হল। যুবকের বাবরিকাটা দীঘল চুল। মুখভর্তি বেশ কয়েকদিনের না কাটা দাড়িগোঁফ। নাকের ডগা চেপে বসেছে নীল রোদ চশমা। কাঁধের ট্যুর ব্যগটা নিতম্ব অবধি প্রলম্বিত। ইশতিয়াক সাহেব কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মনসুর ফট করে বলল,
-‘কার কাছে আসছেন?’
যুবক ইতস্তত করল। গলা খাঁকারি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
– ইয়ে মানে,আমি কারো কাছে আসিনি। মুসাফির! কাজে এসেছি একটা।
-‘পোশাক-আশাকে তো মুসাফির বইলা মনে হয় না।’ কোত্থেকে আসছ?
-‘ আসলে মুসাফির হওয়ার জন্য আলাদা কোনো বেশভূষার প্রচলন আছে বলে আমার জানা নেই।’
ধূর্ত মনসুর পলকেই শ্লেষটা গায়ে মেখে নিল। নিতে হল। ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে শঠ দুঃখী গলায় বলল,” আজকালকার পোলাপাইন…চটাং চটাং কথার উত্তর দেয়। কোন্ যুগে আইলাম!” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মনসুর। ইশতিয়াক আচমকা মৃদু হেসে ওঠে যুবককে উদ্দেশ্য করে বলল,
– ‘তুমি চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’
যুবক বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলল,
-‘ প্লিজ…
-‘ তবে হোটেল কিংবা বডিং নয়। আমার বাসার নিচতলায়।দেখতেই পারছ। এলাকাতে সবে শহুরে ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। এখনো ওসব হয়নি।
-‘হ্যাঁ খুব উপকার হবে,আমি আপনাকে ভাড়া মিটিয়ে দিব আংকেল।’
– ‘সে পরে দেখা যাবে, মুসাফির লোককে থাকতে দিলে সওয়াব আছে বুঝলে।’
বলে স্ফূর্ত হাসে ইশতিয়াক সাহেব। প্রতুত্ত্যরে নম্রতার সঙ্গে হাসিটা ফিরিয়ে দেয় যুবক।
ইশতিয়াক সাহেব চায়ের বিল মিটিয়ে দু’তিন কদম হেঁটে বেরিয়ে এল টং দোকান থেকে। যুবকও ধীর পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল ষাটোর্ধ সবল ইশতিয়াক সাহেবের পিছুপিছু।
-‘নাম কী তোমার?’ সমান্তরাল পথে চোখ দু’টো মেলে দিয়ে যুবকের উদ্দেশ্যে শুধালেন ইশতিয়াক সাহেব।
-‘সৌহার্দ আবিদ।’
-‘ আবিদ? এই নামটায় একটু দুষ্টু-দুষ্টু ভাব আছে। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয় কেউ তোমার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে এলে তাকেই কষে চড় মার। যুবক এলোমেলো দাড়িগোঁফের আড়ালে মিহি হাসল,মুখে কিছু বলল না।
-‘ যাক,বাড়ি কোথায়,মানে বর্তমান আবাসস্থল?’
-‘মেহেরপুর’
-‘ কী কর?’
-‘ টপ সিক্রেট, তবে খারাপ কাজ না, সেটা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকুন।’
– ‘কিন্তু!আমি তোমাকে কেন বিশ্বাস করব?’
এই পর্যায়ে যুবকের নাম যেহেতু আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি, কারণেই সম্মোধন পাল্টানো আবশ্যক। নাম জানার সত্ত্বেও বারংবার একজন মানুষকে যুবক যুবক বলে গলা ফাটানোর কোনো মানে হয় না।
ইশতিয়াক সাহেবের কথায় আবিদ ভাবালু হয়ে খসখস করে দাড়ি চুলকোতে লাগল৷ খানিক পর ছোট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
– ‘বিশ্বাস!… বিশ্বাস জিনিসটা আসলে অতো সোজা নয় যে চাইলেই করা যায়। বিশ্বাস অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল,আপেক্ষিক। কাজেই, আমাকে বিশ্বাস করতে বলব না আপনাকে।’ ভরসা করতে বলব।
ইশতিয়াক সাহেব সন্তুষ্ট হাসলেন। হঠাত্ কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বললেন,
-‘ও হ্যাঁ,তোমাকে আমি আবিদ বলেই ডাকব৷’ কি সব জটিল নাম রাখো, সৌ…হা…র্দ…!
শেষের সৌহার্দ নামটা চোখমুখে কাঠিন্য নিয়ে আওড়ালেন তিনি। আবিদ হেসে বলল,
-‘ আপনার মর্জি।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
মিনিট দশেক হাঁটতে হাঁটতে একটা তেতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মুসাফির এবং ইশতিয়াক সাহেব। ঠিক তেতলা বলা ঠিক হবে কি-না কে জানে! তেতলার ছাদ ঢালাইয়ের পর আর কাজে হাত দেওয়া হয়নি তা বাইরে থেকেই স্পষ্টতর বোধগম্য হয়। শুধু চারপাশে প্যারাপেটের মতো করে দুই-আড়াই ফিটের দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে দূর্ঘটনা রোধনের জন্য।
ইশতিয়াক সাহেবের পিছুপিছু বাড়ির ফটকের লোহার গেইট পার হয়ে ভিতরে ঢুকল আবিদ। সুদীর্ঘ পরিভ্রমণে তার শরীরটা একটুখানি বিশ্রামের জন্য বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে এমন শান্তিপূর্ণ ছায়ানিবিড় বাড়ি দেখে। পারে যদি এখুনি তল্পিতল্পা ফেলে শুয়ে পড়বে এমন অবস্থা! বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে করতে চারপাশটা গভীর চোখে অবলোকন করে নিল সে। সিমেন্ট কংক্রিট ঢালায় করা প্রশস্ত হাঁটার পথ মূল ফটক হতে বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে থেমেছে সমান্তরালভাবে। মূল বাড়ির সুমুখে যে জায়গাটুকুন উঠোনের নিমিত্তে রাখা হয়েছে তা বাদেও হাঁটার পথের দুইপাশের জায়গাজুড়ে যথাক্রমে সুসজ্জিত বিস্তৃত আম্রকানন এবং কাঁঠালবাগানের সমাহার। আমগাছগুলোতে ঝুলছে কাঁড়িকাঁড়ি হরেক রকমের কাঁচাপাকা আম। শেষ বিকেলের স্বর্ণাভ দীধিতি আম্রকাননের মাথা ফুঁড়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে অবাধে। সেই আলোতে অসংখ্য পক্ষীসমাজ অনবরত কিচকিচ শোরগোল করে আপনমনে কুটকুট করে পাকা আম উদরস্থ করছে। কিন্তু একটু পরপরই গাছের মগডালে পক্ষী-তাড়ানো একটা ঘন্টা টংটং করে বেজে উঠায় বিক্ষিপ্ত হয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখিরা। অনাড়ম্বরের সন্ধ্যা নামলেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে তারা। আম্রকাননের ঠিক বিপরীতমুখী কাঁঠালবাগান হতে ধেয়ে এসে নাকে মননে ঝাপটা দিচ্ছে পাকা কাঁঠালের তীব্র ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে যেন ঘুমন্ত খিদেটা হঠাৎ ধড়ফড় করে জেগে ওঠে আবিদের। বাড়ির চারপাশের সীমানা ঘেঁষে মানুষ সমান উঁচু শ্যাওলা পড়া পুরু দেয়াল। দেয়ালের উপরিপৃষ্টে শক্ত সিমেন্টে পা ডুবিয়ে গাঁথা অগনিত পেরেক চেয়ে আছে আকাশের দিকে। ম ম করা পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণে যেমন আবিদের ভেতরে সুপ্ত খিদেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তেমনি এতোবড় আয়তনের বাড়ির আশেপাশে কোনো ফুলগাছের দেখা না মেলায় মনটা একটু বিমর্ষও হল! এ বাড়িতে কোনো সর্বস্তরের খাদক আছে কিনা কেজানে! ইশতিয়াক সাহেব অন্দরমহলের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন,
-‘ও রেণু! বাগানে কাঁঠাল পেকেছে নাকি দেখ তো। কই থাকিস সব!
ভেতর থেকে কোনোপ্রকার সাড়াশব্দ এলো না। দু’জন আরেকটু হেঁটে ভবনের মূল গেইট পার হয়ে ছোট পদের সিঁড়ি ভেঙে নিচের বামপাশের ফ্লাটের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে নিচতলায়। ইশতিয়াক সাহেব পাঞ্জাবির পকেটে হাত পুরে ঝুনঝুন শব্দে একটি চাবির থোকা বার করলেন। এটুকু পথ মাড়াতেই ঘেমে নেয়ে একাকার তিনি। সাদা পাঞ্জাবির মিহি সুতোর বুনন ভেদ করে দৃশ্যমান জবজবে ঘর্মাক্ত পিট। বাস্তবিকই ভয়ংকর গরম পড়েছে আজ। কোনো সুস্থ মানুষ অন্তত এই গরমে না ঘেমে থাকতে পারে না। স্বভাবতই নবে চাবি পুরার আগে একবার ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। ওমনিই ক্যাঁচক্যাঁচ করে দরজা খুলে গেল এবং তাঁর মুখ হয়ে গেল হাঁ। পরক্ষণেই তিনি আত্মসংবরণ করে বললেন,
-‘রেণু বোধহয় কোনো কাজে এসেছিল এই ঘরে। তাই ঘর খোলা। তুমি যাও ভেতরে। আমি তোমার জন্য নাশতার ব্যবস্থা করছি।’
আবিদ মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে সম্মতি জানাল,
-‘ আচ্ছা’
ইশতিয়াক সাহেব পাশের ফ্ল্যাট-মুখী হয়ে দুই কদম পা বাড়াতেই পুনরায় কি যেন বলা হয়নি এমন পায়ে দ্রুত আগের অবস্থানে এলেন,
-‘আচ্ছা তুমি নিশ্চয় ক্ষুদার্ত? এখন নাশতা খেয়ে রাতে ভাত খাবে নাকি এখুনি ভাত পাঠিয়ে দিব?’
আবিদ কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভেবে ইতস্তত করল।বলল,
-‘আপনাদের যা সুবিধে হয় আংকেল,কিছু একটা হলেই হলো!’
-‘ওকে, তুমি ভেতরে যাও। চিন্তা নেই। সবকিছু সাজানো-গোছানোই আছে। তোমার কোনো সমস্যা হবে না।
বলে তিনি আর অপেক্ষা করলেন না, খুব তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে চলে গেলেন। আবিদ মনে মনে হেসে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। বোঝাই যাচ্ছে আগন্তুক মুসাফিরের খেদমতের জন্য তিনি আটঘাট বেঁধে নেমেছেন। কিছু বৃদ্ধ মানুষেরা অবসরে কোনো কাজ পেলে বেজায় খুশি হন। সেই কাজ যদি উভয় জাহানের কামিয়াবির মতো কিছু হয়, তবে তো কথাই নেই! কারোর কারোর আবার আঠারো মাসে বছরেও হয়। তবে সে স্বতন্ত্র কথা।
ঘরে ঢুকেই শেষ বিকেলের ঢিমে আলোতে দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করে সুইচবোর্ড চাপলো আবিদ। গুচ্ছ-গুচ্ছ আলোকরশ্মি চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলোকিত করে তুলল ঘর। ডানে বাঁয়ে চোখ বোলাল সে। সুন্দর, দ্যোতিত ছিমছাম, নিগড়িত ঢাউস বাসা। প্রত্যেকটি জিনিস মুগ্ধতা নিয়ে মিনিট পাঁচেক মনোহর পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখে অবশেষে ডাইনিং-লাগোয়া একটা ঘরে প্রবেশ করল সে।ক্লান্তি,অবসাদ আর খিদেয় পা ঢলছে তার। মাথা করছে ভনভন। পিঠটা বিছানা বিছানা করে গলা ফাটাচ্ছে অনেক্ষণ। দক্ষিণের দেয়ালজুড়ে বড় একটা জানালা থাকায় এই ঘরটা তার বেশ ভালো লাগল। সে মনে মনে আওড়াল, এই রুমেই থাকা যায়! ক্লান্তভরে একটা প্রলম্বিত নিশ্বাস নিয়ে কাঁধের ব্যাগটা আলনার পাশের আংটায় ঝোলালো সে। ইচ্ছে করেই লাইট জ্বালাল না সে। এরপর নিঃশ্বাসটা গিলে খেয়ে ধপাস করে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানাটা যেন একটু নড়ে উঠল আবিদের এই সদম্ভ এলিয়ে পড়াতে। একটু তটস্থ হল সে। চারিদিকে তখন ভরসন্ধ্যা নেমেছে। এই ঘরটাতে সূর্যের শেষ মেদুর আলোটুকু আধিপত্য করছে এখনো। ফলবাগানের পক্ষীসমাজের কিচকিচ উতরোল ক্ষীণ হয়ে এসেছে ইতোমধ্যে। তার পিঠের নিচে কোলবালিশটা এবার যেন আড়মোড়া ভেঙে উঠলো। আবিদ কপাল কুঁচকে চোখ দুটো চেপে বন্ধ করল। কোলবালিশ পরপর দুবার নড়তে যাবে কেন? মনের ভুল হতে পারে! হতে পারে তার মাথা ঘুরাচ্ছে সারাদিনের শ্রান্তিতে। চোখ বন্ধ করলেই ঠিক হয়ে যাবে ভেবে চোখদুটো বন্ধ করেই রাখল সে। কিন্তু কোলবালিশটা ধড়াস করে ওঠে বসে গেল এবং আবিদের লম্বা বাবরিকাটা চুল মুঠো করে ধরে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
— চোর চোর চোর…
আবিদ বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে কল্পিত কোলবালিশের মুখ চেপে ধরল প্রাণপণে। কোলবালিশ হাত পা ছুঁড়ে গোঁগোঁ শব্দ করতে শুরু করল। আশ্চর্য! কোলবালিশেরও কি নাক,মুখ,ঠোঁট আছে নাকি? যথেষ্ট ভড়কে গেল সে। একটা গা ছমছমে ভাব ছড়িয়ে পড়ল আবিদের শরীরের এমুড়োওমুড়ো। ইহজীবন সে ভূতপ্রেতাদির বিশ্বাস করেনি। এই ভর সন্ধ্যার আবছা আলোয় সেই অবিশ্বাসের সাম্রাজ্য যেন চূর্ণ হয়ে ধূলিসাৎ হতে চলল। ভয় সে পায় না সচারাচর। ভয়কে সে আনুষ্ঠানিকভাবে জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেয় করে সেই কবে! মনুষ্য-ভীতি তাকে কাবু করতে পারে না। কিন্তু একে তো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না! মানুশ নয় কোলবালিশ! পরমুহূর্তেই সে উপলব্ধি করল কোলবালিশ আগের জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। তবে তার দোর্দণ্ড হাতের তালুর নিচে কোন্ মানুষ কিংবা প্রেতাত্মার মুখ চাপা পড়ে আছে,যে গরুর মতো ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ত্যাগ করছে? এদিকে অবয়বটি তার লম্বা চুলগুলো যেন এক্ষুনি মাথা থেকে আলাদা করে ফেলার জন্য বদ্ধপরিকর। এ কোন মুসিবত! এই দূর দেশে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো ভূতের হাতে চুল টানা খেতে হবে তা কুলক্ষণেও ভাবতে পারেনি সে। এবার আচমকা তার ষষ্ঠইন্দ্রীয় কাজ করতে শুরু করল। ভূতই যদি হয় তবে চোর চোর করে গলা ফাটাবে কেন? তবে সে নিশ্চয় মানুষ। মানুষের কাছে অনুনয় করাই যায়, ভেবে সে চাপা ক্ষীণ স্বরে বলল,
– ‘চুল ছাড়ুন,আমি চোর-টোর নই।’
অবয়বটি চুল ছাড়ল না৷ বরং গোঁঙানির শব্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে আর পাখির মতোন হাত ঝাপটে বোঝাতে চাইল আগে তার মুখ থেকে হাত সরাতে হবে। আবিদ পলকে তার মুখ থেকে হাত সরালো। ওমনি মানুষটি শেষবারের মতো মুঠো করে ধরে থাকা চুলে জোর টান দিয়ে কয়েক গাছি চুল উপড়ে ফেলে বিছানায় ধরাশায়ী করল আবিদকে। এহেন ঘটনার আকস্মিকতায় আবির যারপরনাই বিমূঢ়। এরপর অবয়বটি বানরের মতো একলাফে বিছানা থেকে নেমে কটাস করে দ্বার রুদ্ধ করল এবং সুইচ টিপে আলো জ্বালাল৷ আলোর জ্যোতিতে লেজ তুলে পালাল সন্ধ্যার মৃদুল স্বর্ণপ্রভা। আবিদের চোখে বিকশিত হলো ক্ষীণাঙ্গী এক নারী অবয়বী। তার চোখ লোহিত লাল। আলুলায়িত চুল সামনে,কাঁধে,পিঠে ছড়ানো। পরনে ঘুমানোর পোশাক। দু’হাত ত্রিভুজ এঙ্গেলে কোমরের ওপর। নির্নিমেষ চোখদুটো ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আবিদের দিকে। মিনিট দুই সে এই ভাব ধরে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচাল,
– ‘বাবা… তাড়াতাড়ি আসো লাঠিসোঁটা নিয়ে। চোর ধরা পড়ছে।’
আবিদ বিছানা থেকে একলাফে বসে বিচলিত হয়ে বলল,
-‘এই কে আপনি? বললাম তো আমি চোর নই।’
মেয়েটি ঝগড়াটে গলায় বলল
-‘ উহঃ,চোর বুঝি নিজে স্বীকার করে যে সে চোর? চোরের মার বড় গলা। আমার ঘরে এসে বলে আমি কে!
আবিদ চট করে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি মুখ বাঁকিয়ে দুইপা পিঁচিয়ে গিয়ে বলল,
-‘চোরের সাহস তো কম না! গায়ের কাছে আসে। যা দূরে যা। এক্ষুনি এলাকার মানুষজন এসে ঠ্যাঙাবে তোকে। বাবা…
বলে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে চেঁচাল সে। আবিদ হতবিহ্বল হয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েও হা করে গেল। একটু ধাতস্থ হয়ে ধীরে ধীরে বলল,
-‘আপনার বাবাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। যদি ভুল না করি বৃদ্ধ লোকটা আপনার বাবা-ই হবে। আমি থাকার জন্য জায়গা খুঁজছিলাম, আপনার বাবা বললেন,আমার ঘর খালি আছে,তুমি চলো। আমি অবশ্য ভাড়া দিব বলেছি।’
মেয়েটি নিজের দিকে অঙ্গুলিসংকেত করে সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
-‘ আমার বাবা নিয়ে এসেছে?’
-‘হ্যাঁ, এই বাড়িতে বৃদ্ধ লোক আর আছে?’
মেয়েটি চোখ নামিয়ে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিল। এবার বুঝি একটু আশ্বস্ত হল সে। বলল,
-‘নাহ নেই।,
পরমুহূর্তেই আবার চটে গেল সে,
– এই,আমার বাবাকে বুড়া বলার সাহস আপনি কেমনে পান হ্যাঁ?’
-‘ওনি তো বৃদ্ধই!’
-‘না ওনি বৃদ্ধ না। ‘
– আচ্ছা, ওনি জোয়ান ছেলে, খুশি?’
মেয়েটি একথার জবাবে কিছু বলল না। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি মাখিয়ে তাকিয়ে নিষ্ক্রিয় গলায় বলল,
-‘যান,অনেক হয়েছে,আমি অসুস্থ। আপনি বের হোন।’
আবিদ কী করব ভেব পেল না। পাছে আবার চটে যায় সে ভয়ে সচেতন গলায় বলল,
-‘ কোথায় যাব?’
মেয়েটি পুনরায় ত্যাড়া গলায় বলল,
-‘ সে আমি কী করে বলব? এটা যে আমার ঘর সেটা আপনি বুঝতে পারছেন না?’
-‘ না… তা না। আংকেল বলেছিল এই ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না। সেজন্যই…
আবিদের কথায় বাঁধা দিয়ে মেয়েটা টেনে টেনে বলল,
-সেজন্য আপনি অন্ধের মতো আমার গায়ের উপর এসে শুয়ে পড়লেন৷ কানা কোথাকার! এমনিতেই জ্বরে শরীরটা দুর্বল, তার ওপর আপনার হাতিমার্কা শরীরটা আমার উপর চড়িয়ে দিয়েছেন।
বলতে বলতে মেয়েটা বাচ্চাদের মতো দাঁত খিঁচিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিল৷
চলবে…
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share