ব্রহ্মকমল পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
5

(সতর্কতা: পর্বটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত)
#ব্রহ্মকমল
শেষাংশ
_______________

স্টেজের ওখানটায় গিয়েও একমুহূর্তের জন্য অংক আমার হাত ছাড়ল না। পাছে আমি নার্ভাসনেসে ধুপ করে পড়ে যাই! সেই আশংকায় নজরে নজরে রাখল আমাকে। এদিকে ও কথা শুরু করতেই কখন আরসালান আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আমি তো তখন অংকের স্মৃতিচারণে বুঁদ। মন দিয়ে শুনছি ওর একেকটা কথা,
— ভাইয়াকে আমি প্রথম আবিষ্কার করি আমাদের গোপন পারিবারিক এক বৈঠকে যেখানে বাচ্চারা স্ট্রিক্টলি নট অ্যালাওড৷

একটু থেমে মজার ছলে অংক একগাল হাসল,
— নিশ্চয়ই তোমরা সবাই ফেইস করেছ এমন একটা সময় যেখানে হুট করে বলা নেই কওয়া নেই বাড়িতে আত্মীয়স্বজনে ভরে যায়, তারপর পড়াশোনা লাটে তুলে সব বাচ্চাদের এক সাইডে পাঠানো হয় খেলাধুলো করার জন্য। অন্যদিকে বড়রা ড্রয়িংয়ে বসে খুব নীচু স্বরে কিসব পরামর্শ করে!

আমাদের বাসায়ও তেমন দিন প্রথম দেখলাম আমার হাইস্কুল ডেইজের একদিন। আমি তখন আপুর মতই ভীষণ চুপচাপ আর পড়ুয়া ধরনের। তারওপর আবার বোর্ড এক্স্যামস চলছিল। তাই স্বাভাবিক নিয়মে আমায় কাজিনদের সাথে পাঠিয়ে দিলেও কিছুটা খেলাধুলো করে জলদি বাড়ি ফিরে এলাম। শোনো, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে সেদিন ফ্যামিলি মিটিংয়ের কথা লুকিয়ে শুনিনি। আসলে মিটিংয়ের নামে এত বাকবিতণ্ডার শুরু হয়েছিল ড্রয়িং রুমে! আর পুরো বাকবিতণ্ডার অংশজুড়ে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল ব্রোর নাম! না চাইতেও আগ্রহ দমাতে পারিনি। আগ্রহ এতটুকুই ছিল,নতুন নামের এই মানুষটা কে? তাকে নিয়ে কেন ঝামেলা হচ্ছে বাসায়? মা একদিকে কাঁদছে, অন্যদিকে দাদি অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। জটিল অবস্থা।
— ভাইয়ার নামই তো তোমাদের ফ্যামিলিতে ব্লাস্টের মতো।

কে যেন মজার ছলে বলল। শুনে অংক আর আরসালান একসাথে হেসে উঠল। সমস্বরে উত্তর দিল,
— ট্রু।
— যাহোক, মিটিংয়ের আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও আরসালান নামটা আমার মাথায় গেঁথে রইল। তোমরা হয়তো জানো না, আমি ও-লেভেল থেকেই ফুপুর বাসায় থেকে পড়াশোনা করি। সেদিন মিটিংটাও কিন্তু ফুপুর বাসায় হলো। যদিও কথা ছিল মা আমার এক্সামের সময়টা থাকবে ওখানে, কিন্তু সেদিনের ঝামেলার পর ফিরে গেল বাসায়। এদিকে একটা প্রশ্ন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে ততক্ষণে। যে করেই হোক উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, কখন সবাই চলে যায় আর ফুপুকে সে ব্যাপারে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলি। জানতাম, আর কেউ হোক না হোক ফুপু আমার থেকে বিষয়টা লোকাতে পারবে না। আফটারঅল শী লাভস মি মোর দ্যান আদার্স রাইট!
যাহোক, এরপর আরসালান ভাই সম্পর্কে প্রথম জানালো আমাকে ফুপুই। অ্যান্ড শী ওয়াজ অলসো স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড ইন দিস ম্যাটার। সে ডিরেক্ট জানাল, দিস ম্যান ইজ মাই কাজিন অ্যান্ড উডবি ব্রাদার ইন’ল। সাথে এও জানতে চাইল, আমার কি তাকে পছন্দ হয়েছে আপুর জন্য?
ভালোবাসা, প্রেম এসব বিষয় বিশেষ অজানা থাকলেও আমার আপুর লাইফে একটা বিশাল চেঞ্জেস সে আনতে চাইছে এতটুকু বুঝতে পারছিলাম। সরাসরি তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া হলো না। ডোন্ট নো হোয়াই আ লিটল হ্যাজিটেন্সি কামস, অ্যান্ড আই টুক এ্য পজ।

ফুপু কিন্তু এক্সাইটেড ছিল। ওরা সবাই-ই ভাইকে বেশ পছন্দ করত শুধু মা ছাড়া।
ছোট্ট শ্বাস ফেলে আমার পেছনে তাকাল অংক। তখুনি টের পেলাম কাঁধের কাছে অন্য আরেকজন মানুষের উষ্ণ শ্বাস। অজান্তেই কেঁপে উঠলাম আমি৷ দুরুদুরু বুকে মুখ ফিরিয়ে তাকালে নিজের থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরে একজোড়া সম্মোহিত চোখ অনুভব করে খুব অদ্ভুত অনুভূতি হলো।
এবং আমি সেই মুহুর্তটা থেকেই ঐ পরিস্থিতির হাত ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম। আমার আর ভালো লাগছিল না সময়টাকে, সন্ধ্যেটাকে, না জানা গল্পগুলোকে। কি দরকার আবারও পরিবার বলে শব্দটাকে টেনে এনে কাটাছেঁড়া করা! অযথা আমার ফেলে আসা সময়ের মিথ্যে স্মৃতিগুলো কড়া নেড়ে অশান্তি বাড়ানোর। কি আছে আমার মধ্যে? কেন কেউ এভাবে ছোট্ট একটা কারণে আমাকে এভাবে ভালোবাসবে! ভালোবাসা তো আমি চাই না৷

মনের ভেতরের দোলাচল বাড়লে চোখ ফিরিয়ে নিলাম তৎক্ষনাৎ। অংকের হাত টেনে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার আর ভালো লাগছে না এখানে, এসব বাদ দিয়ে প্লিজ ফিরে চল। আমি আর জানতে চাই না কিছু, নতুনত্বও চাই না জীবনে। প্লিজ অংক!

মনের ভেতর কথার পাহাড়, অথচ মুখ ফুটে বলার সুযোগ নেই। অংক নিজের মতো গল্প বলেই যাচ্ছে,
— সেদিনের পর ফুপুর মাধ্যমেই ভাইয়ার সাথে পরিচয়। তারপর আস্তে আস্তে কথাবার্তা নিয়মিত হওয়া। গোটা দেশের তফাৎ থাকলেও ভাইয়া আর আমার ফ্রেন্ডশিপ কিন্তু ইজিলি হয়ে গেল। ব্রাদার ইন ল, কাজিন এসব সম্পর্কের নাম আলাদাভাবে মনে করতেই দিল না সে। অ্যান্ড আ’ম প্রাউডলি সেয়িং টুডে, দ্য চার্ম অব মাই ব্রাদার ইজ রিইলি ডিফ্রেন্ট।
একজন ভাই হিসেবে বোনের জন্য এত দুর্দান্ত পার্টনার দেখা আমার জন্য ভীষণ ভীষণ ভাগ্যের। আমি তো ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমার প্রিটিয়েস্ট বোনটার দায়িত্ব ঐ চার্মবয়ের হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে পারব।

একরাশ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অংক এবারে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু আমার মন ততক্ষণে ঘুরে গেছে অন্যদিকে। ওর দৃষ্টি, কথা কিছুর সাথেই কানেক্ট করতে পারছি না। স্বাভাবিক তখনও পারলাম না৷ উল্টো হাত ছেড়ে দিয়ে দিশেহারার মত বিড়বিড় করে বললাম,
— আমি ফ্ল্যাটে যেতে চাই অংক। তুই কি আমায় নিয়ে যাবি?

ভাগ্যিস মাইকটা অন্যদিকে ঘোরানো ছিল। আমার কথা তাই কানে বাজল শুধু আমাকে ঘিরে থাকা কয়েকজন মানুষের কানে;অংক, আরসালান আর তার বন্ধুদের।

ইপশা তো বরাবর খোলা বইয়ের মতন। ভেতরের কথা চোখেমুখে ফুটে উঠে মানুষকে জানিয়ে দেয় সহজেই। তখনের পরিস্থিতিটাও হয়তোবা দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল করে দিয়েছিল অনায়াসে। মনি আপু এগিয়ে এসে পিঠে হাত রাখল আমার। নরম সুরে জানতে চাইল,
— খারাপ লাগছে?
জবাবে আমি ঘোরগ্রস্তের মতো ফিরে তাকালাম। তখন তো আমার সেন্স কাজ করছে না। মাথা নাড়ালাম কি না! হুট করে মনে হলো চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছি। তারপরের ঘটনা ধোঁয়াশা। সেই পুরনো রোগের দৌরাত্ম, ব্ল্যাকআউট৷
_____________

সম্পূর্ণরূপে চেতনা ফিরে পেলাম যখন, তখন আমি আমাদের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর নীচে লেদারের সোফায় কারুর ঘাড়ে মাথা এলিয়ে। মানুষটাকে ঠিকঠাক চেনা লাগল না। কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাসজুড়ে এক মাতাল ঘ্রাণের দৌরাত্ম। যেন অচেনা অজানা বুনোফুল কতগুলো পিষে আমার সামনে রেখে দেয়া হয়েছে। মানুষের গায়ের ঘ্রাণ কখনো এত মনোমুগ্ধকর হতে পারে? একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ধরেছিল আমাকে। তবে তা বেশিক্ষণের জন্য নয়। অচিরে পাশের মানুষটা আমার চেনা নয় বুঝতে পেরে হুড়মুড়িয়ে সোজা হয়ে বসলাম। তাকালাম না ঠিক। কারণ ঘোরভাঙা আমার চোখজোড়া খুঁজছিল শুধুই ভাইকে। অংক বোধহয় পাশেই ছিল। আমায় চোখ খুলতে দেখে এগিয়ে এলো। কিন্তু আমায় কিছু না বলে সরাসরি পাশে বসে থাকা অচেনা মানুষটার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
— ভাইয়া কাজি ডাকব?
— উঁহু। তাড়াহুড়ো করো না অংক। ওকে একটু ধাতস্থ হতে দাও।

ভীষণ শান্ত স্বরে জবাব দিল মানুষটা। আমি চমকে সরে গিয়ে চোখ গোল গোল করে দেখলাম আরসালান। ক্লান্ত গম্ভীর মুখে বসে আছে সোফায় আমারই পাশে। সে অবশ্য আমার দিকে আর তাকাচ্ছে না। রাগ নাকি অভিমান কে জানে!
— কিন্তু ভাইয়া..
— এভ্রিথিং উইল বি অলরাইট।

পুনরায় অংককে থামিয়ে দিয়ে বলল আরসালান। আমি দুজনের কথার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। প্রতিক্রিয়া দেয়া দূরের ব্যাপার। বিভ্রান্ত চোখে দু’জনকে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না আসলে।
অবশ্য বিভ্রান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নিভু নিভু মোম দ্বিগুণ গতিতে জ্বলে ওঠার মতো করে অংক আমার পাশে এসে অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করল,
— আপু, তুই আরসালান ভাইকে বিয়ে করবি?
— আহ্ অংক!
মৃদু ধমকই দিল আরসালান। কিন্তু অংক তা গায়ে মাখল না। হাঁটু মুড়ে বসে আমার দুহাত নিজের মুঠোয় নিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
— বল না বিয়ে করবি?

ততক্ষণে আমি অনেকটা ধাতস্থ হয়েছি। কি, কেন এসব প্রশ্ন মাখছি না গায়ে। শুধু মনে পড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর দগদগে ক্ষত হয়ে আছে বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ঘটনাটা। মাথায় হাতুড়িপেটার মতো অনুরণিত হচ্ছে কয়েকটা কথা,
“সম্পর্ক ভালো নয়, ভালোবাসা ভালো নয়। যে ভালোবাসে সে আসলে ঠকে যায়”
— বল না রে আপু?
পরেরবার অংকের প্রশ্নে ভাবনাচিন্তায় আর সময় ব্যয় করলাম না আমি। দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝালাম,
“নাহ্ বিয়ে করব না।”

অংক যেন স্তব্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। আহত দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে, তারপর আরসালানের দিকে।
আমি জানি না কেন আরসালানের দিকে ফিরে তাকাতে এত কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল! মাথা নীচু করে কুন্ঠা লুকতে গিয়ে টের পাচ্ছিলাম উষ্ণ নোনাপানি টপটপ করে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে আমার হাতের ওপর। ভাবছিলাম প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপমানে আরসালান কি এবার আমাকে কড়া কথা শোনাবে? নাকি অংক ছুঁড়ে দেবে তীর্যক বাক্যবাণ!
আমার ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সম্ভাবনার একটাও কিন্তু হলো না। উল্টো অংককে ইশারায় সরিয়ে ওর জায়গায় আরসালান বসে পড়ল হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে। অনবরত ঝরে পড়া আমার চোখের পানিগুলোকে আলতো করে মুছে দিতে দিতে স্নেহার্দ্র স্বরে বলল,
— ইটস ওকে সুইটডল। ডোন্ট ক্রাই। আই ক্যান ওয়েট। আই হ্যাভ ক্রসড ওশন’স অফ টাইম টু ফাইন্ড ইউ রাইট? অপেক্ষাও করে নেব নাহয়। আই ওয়ান্ট ইওর লাভ, আই ওয়ান্ট হোল অফ ইউ সুইটি। কিন্তু তা জোর করে নয়। তোমার ইচ্ছেতেই।
— হাউ লং ক্যান ইউ ওয়েট?
কাঁপা কাঁপা স্বরে হুট করে জিজ্ঞেস করে বসি আমি। বিনিময়ে মৃদু হেসে সে দু’হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলে,
— ফর দ্য রেস্ট অব মাই লাইফ।

আমাদের প্রথম এবং শেষ প্রেমময় বাক্য বিনিময় বিয়ের আগে এটাই। তারপর তো সব আমার কাছে ফর্মালিটিজ। যাহোক, এরপর সেদিন আমাকে আর অংককে শান্ত করে বেরিয়ে যায় আরসালান ফ্ল্যাট থেকে। রাতে অংকর সাথেও কথা হয় না আমার। পরে অবশ্য জানতে পারি আমার শরীর খারাপ দেখে ওরা কাউকে বুঝতে না দিয়ে সংগোপনে আমায় নিয়ে সরে পড়েছিল। আর নিজের মতো করে গল্প শুনিয়ে আরসালানও সামলে নিয়েছিল পরিস্থিতি।
আমাকে যদিও তখন সরাসরি ফ্ল্যাটে আনা হয়নি, তবে বসিয়ে রাখা হয়েছিল এক কর্নারে। মনি আপু পুরোটা সময় পাশে বসেছিল আমায় আগলে। তারপর গল্পের পাঠ চুকে গেলে আরসালান গাড়ি করে আমাকে আর অংককে ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে৷ এরপরের সময়টুকু স্মৃতিতে জীবন্ত।
_________________

অংক আসলে ভীষণ ভালোবাসত আরসালানকে। পরদিন সুস্থ হতেই ও নিয়ম করে আমায় মানুষটার গল্প শোনাতে লাগল। কি করে সে প্রথমবার মাকে রাজি করাতে দেশে পা রাখল, কি করে নিয়মিত ফোনে, নেটে যোগাযোগ করে সে বোঝাতো অংককে যেন আমায় দেখে রাখে, যত্ন করে। এমনকি ও নাকি মাকে রাজি করাতে মায়ের পায়েও পড়েছিল সেবার। কিন্তু জেদ টলাতে পারেনি। অদ্ভুতভাবে খেয়াল করতাম, পুরনো এসব কথা তুলতে গেলেই রেগে যেত অংক। চোখমুখ লাল করে আমাকে বলত,
— তুই জানিস! মা এত কুটিল মহিলা, তোর সাথে ভাইয়ার দেখা করতে দেবে না বলে মেজো খালাকে ডেকে তার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছিল তোকে খুলনা। বিন্দুমাত্র আঁচ পেতে দেয়নি তোকে নিয়ে কি হচ্ছে আড়ালে।
আর মায়ের এতসব কুটচালের পেছনের কারণ জানিস?
— আমি জানতে চাই না অংক। কি, কেন, কোন কারণে এসব একটুও জানতে ইচ্ছে করে না আমার বিশ্বাস কর। যদি কিছু জানতে ইচ্ছে করে তা হলো, একটা মানুষের ভেতরে এত ভালোবাসা জমিয়ে রাখলে, পৃথিবীতে ঘৃণার গল্পগুলো কেন তৈরি হয়?
— আপু তুই না আমাদের পাস্ট থেকে বেরতে পারছিস না বোধহয়। দেখ, যে খারাপ পাস্টটাকে ধরে তুই সবসময় এত ভয় পাচ্ছিস, এত ইনসিকিউরড হচ্ছিস, সেটা কিন্তু চলে গেছে। আর যা চলে গেছে..

বোঝানোর চেষ্টা করে অংক। খারাপ লাগে ওর এসব অস্থিরতা। অজান্তে ব্যথার হাসি হেসে বলি,
— রেষটা তো রেখে গেছে রে।

শুনে অংক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
— ট্রাই টু মুভ অন আপু। এভাবে পাস্টে আটকে থেকে বৃথা এক পৃথিবী সুখ দূরে ঠেলে রাখছিস তুই বিশ্বাস কর। বৃথাই ঠেলে রাখছিস।

অংকের কথাগুলো আমায় ভাবাত প্রতি মুহুর্ত। আরসালানকে নিয়ে ওর গল্পগুলো, আমায় ভালোবেসে করা পাগলামিগুলো স্মৃতিতে জমা হয়ে সারাক্ষণ খোঁচাত। বোধহয় আবেগের তাড়নায় একবার করে বয়ে যেতে ইচ্ছেও হতো আমার। পরমুহূর্তে পুরনো ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে দু ধাপ পিছিয়ে যেতাম।
দোলাচল চলছিল এভাবে অনেকটা সময়৷ তার মধ্যে আরসালানের যাতায়াত নিয়মিত হলো, ওর সাথে অংকসমেত আউটিংয়েও গেলাম আমি। ফারাকটা তবু চোখে পড়ছিল না। আসলে সব আটকে ছিল আমার পাস্ট নামক লুপে। যার তলের হিসেব আমি পাইনি। যখন পেলাম, বিষে বিষক্ষয়ের মতো এক ভয় আরেকটাকে কেটে সম্পূর্ণ দোলাচল বিলীন করে দিল। যন্ত্রণাদায়ক ছিল, কিন্তু আজ মনে হয়, ভাগ্যিস ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল। নইলে ইনসিকিউরিটির খাঁচা ভেঙে সত্যিকার সুখের পথে কখনো হাঁটতে পারতাম না নিশ্চয়ই।
______________

যন্ত্রণাদায়ক যে ঘটনার কথাটা এখন বলব, তা ঘটেছিল সময়ের থেকে আরও মাস ছয়েক পর৷ অফ ডেতে ল্যাব নিয়ে একটা মিটিং ছিল প্রফেসরের সাথে। সেটা শেষ করে ফাঁকা ক্যাম্পাস হেলেদুলে ঘুরে দেখছি, সেই সময় হঠাৎ আমার ফোনে বাংলাদেশ থেকে একটা কল এলো। যদিও খানিক অবাক হলাম প্রথম ও দেশের কল পেয়ে, তবে রিসিভ করতে দেরি হলো না। মিথ্যে বলব না, ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল এক মুহুর্তের জন্য আমার আত্মা উড়ে গেছে বোধহয়। আশংকা তো অনেক হচ্ছিল, কিন্তু সেসব বেড়ে ওঠার সময় পেল না। আমার হ্যালো বলবারও পূর্বে ফোনের ওপাশ থেকে বুলেট ছোঁড়ার মতো তীব্র গতিতে ভেসে এলো সুপরিচিত কণ্ঠের ঘৃণামিশ্রিত ধিক্কার,
— তুমিও তোমার বাবার দেখানো পথে হাঁটলে তাইনা? জানতাম, জানতাম আমি। ঠকবাজদের রক্ত শেষ পর্যন্ত ঠকিয়েই যাবে আমাকে। পেটে ধরলেও আসলে রক্ত তো তুমি তাদেরই!

হুট করে এত তীর্যক কথার কারণ আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সত্যি সত্যি ফোনটা আমার কাছে এসেছে কিনা! দ্বিতীয়বার চেক করে পুনরায় কানে ঠেকিয়ে অস্ফুটে বললাম,
— মা..
— খবরদার, খবরদার মা বলে ডাকবে না আমাকে। মা নই আমি তোমার। কেউ নই। কেউ না।
— কিন্তু মা আমি কি করেছি?

বজ্রগম্ভীর ধমকের পর দিশেহারার মতো আওড়ালাম আমি। জবাবে রাগে হিসহিসিয়ে মা জবাব দিল,
— কিচ্ছু করনি তুমি। যা ভুল করার আমিই করেছি। একটা নোংরা লোকের রক্তকে পেটে ধরেছি। তোমার জন্ম কীভাবে হয়েছিল জানো?

রাগে চিৎকার করে কথাটা বলে হুট করে থেমে গেল মা। ফোনের এপাশ থেকেও দিব্যি বুঝতে পারলাম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করছে। ভয়ে মুখে কোনো কথা জোগালো না। কান থেকে যে ফোনটা সরাবো তারও সাধ্য নেই। ওভাবেই ফোন কানে নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কান্নায় ভেসে যেতে লাগলাম আমি।

ওদিকে কিছুটা সময় নিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণের পর গম্ভীর গলায় মা পুনরায় বলতে লাগল,
— শোনো ইপশা, এই পৃথিবীর কাউকে যদি আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে ঘেন্না করি তাহলে সেটা তুমি। কেন জানো? কারণ তুমি তোমার বাবার মেয়ে। ঐ নোংরা লোকটার রক্ত। ভাবছ, আজ এই বয়সে এসে ও আমায় ধোঁকা দিয়েছে বলে এই কথা বলছি? হাহ। সত্যি তো হলো, তোমার বাবা এই বয়সে এসে ধোঁকা দিয়ে বরং অনেক বড় উপকারই করেছে আমার। এই উপকার তেইশ চব্বিশ বছর আগে করলে আমাকে নিশ্চয়ই জলন্ত আগুনের চুলোয় বসে জীবন কয়লা করতে হতো না।
— আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না মা।

কোনোরকমে শক্তি সঞ্চয় করে ভেজা গলায় বললাম আমি। মা বোধহয় হাসল একটু। তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
— বোঝার কথাও নয়। তোমার ঐ ইবলিশ শয়তান বাবা যেভাবে ফেরেশতার রূপ ধরে থাকে সবসময় তোমার সামনে! জানবে কি করে আসলে তো ও একটা দুমুখো জানোয়ার। যার সত্যি শুধু আমিই জানি। আমার জীবন ধ্বংস করেছে না! আমাকে তো জানতেই হতো।
যাহোক, সময় পাল্টেছে। অনেক আড়াল করেছি এসব নোংরা ইতিহাস। তোমাদের চোখ ধাঁধানো আলোর সামনে রেখে ভেতরে একা একা জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গেছি। আমার জীবনে তো আর কিচ্ছু বেঁচে নেই। কিচ্ছু শেষ হবার নেই। কিন্তু তোমাদের এত সুখে দেখতেও ঘৃণা হচ্ছে।
ভাবছ এ কেমন মা? নিজের মেয়ের সাথেই প্রতিশোধের খেলায় মেতে উঠেছে! শুনে রাখো ইপশা, আমি তোমার মা হতে চাইনি। জন্ম দিতে চাইনি আমি তোমাকে। আমার জীবনে আসাটা তোমার যেমন অপ্রত্যাশিত ছিল, তেমনই তোমায় বাঁচিয়ে রাখাটাও আমার কাছে ভীষণ দুর্ভাগ্যের আর মনের বিরুদ্ধের ছিল।

এতটুকু বলে আবারও থামল মা। আমি ততক্ষণে জড়বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছি। একটা টুশব্দ বের করার সাহস আমার নেই। আমি জানি মা সবটাই বুঝতে পারছিল ওখানে বসে। কে জানে কোন আগুন জ্বলছিল তার বুকের ভেতর! সহজে সবটা বুঝতে পেরেও প্রতিশোধ চরিতার্থ করার মনোবাসনা অপূর্ণ রাখল না। বরং দ্রুতই তা চরিতার্থ করবে বলে আমার ভঙ্গুরতার তোয়াক্কা না করে একে একে পর্দা ওঠাতে লাগল নিজের পরিকল্পনামতো ফেলে আসা সে অতীতের বাক্স থেকে, যা আমার সামনে আসার আগেই মৃত্যুকে কামনা করতে আমি স্বস্তিবোধ করতাম৷

— শোনো ইপশা, এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গেছ তোমার বাবা আর আরসালানের বাবা জমজ ভাই? তবে এটা তোমাকে জানানো হয়নি, সদ্য একুশে পা দেয়া তরুণি আমার জীবনসঙ্গী হওয়ার কথা ছিল তোমার বাবার নয় বরং ওর ঐ জমজ ভাই ইরশাদের। কারণ ইরশাদকে আমি পছন্দ করতাম, ভালোবাসা বোঝার পর থেকেই ভালোবাসতাম পাগলের মতো। সবাই জানত আমার একতরফা ভালোবাসার কথা। প্রতিবেশী ছিলাম, যতটা ভালোবেসেছি ততটাই প্রকাশ করেছি সবার সামনে। একবিন্দু ছাড় দেইনি। আমার বিশ্বাস ছিল ইরশাদ আমাকে পায়ে ঠেলতে পারবে না। আমি তেমন মেয়েই ছিলাম না৷
আচ্ছা, আচ্ছা লোকের কথা নাইবা বললাম, কিন্তু তুমি তো আমায় দেখেছ, শুনেছ আমি কেমন ছিলাম তরুণি বয়সে। বলো তো ইপশা আমার মধ্যে কিসের কমতি ছিল? ইরশাদের মতো ভালো দেখতে, ভদ্র-নম্র ছেলেকে কি আমি ডিজার্ভ করতাম না? অফকোর্স করতাম। আমার কনফিডেন্স বিন্দুমাত্র মিথ্যে ছিল না জানি। তবু ইরশাদ আমাকে পছন্দ করত না৷ ভালোবাসত না সে আমাকে। কেন ভালোবাসত না কে কানে! এত চেষ্টা করেছি মানানোর, বোঝানোর। চিঠি লিখেছি, নানা বাহানায় তাদের বাড়িতে গিয়ে বসে থেকেছি শুধু তাকে একনজর দেখব বলেই। অথচ সে! বরাবর পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে আমার থেকে।

বলতে বলতে মনে হলো অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠল মা। রাগ আর ঘেন্নার মিশ্রণে অদ্ভুত স্বরে আস্ফালন করল কতক্ষণ। তারপর আবার সামলে উঠে ভেজা গলায় বলল,
— সেসময় কোনো মেয়ের সাধ্য ছিল না নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য এত পাগলামি করবে যা আমি করেছিলাম। সমাজ, পরিবার কিচ্ছুর তোয়াক্কা করিনি আমি, কিচ্ছুর না। ঐযে বিয়ের প্রস্তাবটা, সেটাও তো আমিই পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলাম বাবার দ্বারা। বিপরীতে কত যে মার খেতে হয়েছিল আমাকে, পায়ে পড়তে হয়েছিল বাবা-মার। কান্নাকাটি, অনুনয়-বিনয় এসবের পরেই কিন্তু মেনেছিল দু পরিবার। মেনেছিল ইরশাদও। অন্তত আমি তো তাই ভেবেছিলাম বিয়ে ঠিক হওয়ার মুহুর্তটায়। ভেবেছিলাম এত এত অপমান, অসম্মান, ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প শুনে বরফ গলেছে বোধহয়। ভালোবাসার বিনিময়ে তাহলে ভালোবাসা পেতে যাচ্ছি অবশেষে, বোধহয় শুধরে যাচ্ছে আমার জীবন;যেভাবে চাইছিলাম সেই পথেই এগচ্ছে।

কিন্তু নাহ্ সব এত সহজ ভাবলেও জীবন আমাকে সহজ কিছু দিতে যে কার্পণ্যই করত বরাবর। তাই তো তোমার বাবাকে পাঠালো আমার সুখে বাঁধা হিসেবে। কে জানে কোন অভিশাপে সহ্য হলো না তার আমার সুখ। ভাইয়ের বিয়েতে মত নেই, জোর করে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করছে এমন ধারণা করে সে কুমন্ত্রণা দিতে লাগল আমার আড়ালে আমারই হবু বরের কানে। কে জানে কখন কতটা ব্রেইন ওয়াশ করে ছাড়ল ইজাজ, ইরশাদের! হলুদের রাতে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে ইরশাদ একটা চিঠি লিখে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল আমায় একা ফেলে।

অনেক প্রতিক্ষার পর জীবন নিয়ে সাজানো গোছানো একটা পরিকল্পনা করতে বসেছিলাম আমি ইপশা, ভাবতে পারো, ভাবতে পারো চোখের নিমেষে অধরা স্বপ্নকে পুরোপুরি ভেঙে যেতে দেখে আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?

উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না মা। নিজেই পরক্ষনে বলল,
— পারো না। ভাবতে পারো না তুমি। এই পৃথিবীর কেউ ভাবতে পারবে না, বুঝতে পারবে না ঐ সময়টায় কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল আমার ভেতর দিয়ে। কি অপমানে, অসম্মানে ভেসে যাচ্ছিল আমার নারী সত্তা চোখের পানির সাথে। অপ্রত্যাশিত এই ধাক্কা কীভাবে সামলাবো যখন পাগলের মতো ভেবে যাচ্ছিলাম, সেসময় বলা নেই কওয়া নেই হলুদের আসরে কাজি ডেকে দু পরিবার জোর করে আমার বিয়ে পড়িয়ে দিল তোমার বাবা ইজাজের সাথে৷

কথাটা বলতে বলতে শব্দ করে কেঁদে ফেলল মা। মায়ের কান্নার আওয়াজেই কিনা! হুট করে আমার বিমূঢ় ভাব উড়ে গেল হাওয়ার সাথে। বাবার অন্যায়ের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমি অনুতপ্ত সুরে বললাম,
— স্যরি মা। স্যরি।

মা অবশ্য আমার কথায় গা করল না। নিজের মতই সে বলে গেল,
— ইজাজকে তো পছন্দও করতাম না আমি সেসময়। বেয়াদব, বখাটে;নোংরা একটা ছেলে। অল্প বয়স থেকেই যার মেয়েবাজির স্বভাব গোটা পাড়ার লোক জানত। জানত আমার বাবা-মাও। অথচ বর পালাতেই অপমানের হাত থেকে বাঁচতে সামনে পেছনে কিছু না ভেবে তারা ঐ মেয়েবাজ বখাটেটার সাথেই আমার শূলে চড়িয়ে দিল;আমার মতামতেরও অপেক্ষা করল না।
ইতোমধ্যে নিজের প্রিয় মানুষকে হারানোর যন্ত্রণায় স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম আমি, সেখানে আমার অমতে এতবড় সিদ্ধান্ত! তোমার বাবাকে নিজের পাশে কল্পনা করেও মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার।
এবং আমি মরতে গিয়েছিলামও। কেন যে মরতে পারলাম না সেদিন! অসহ্যকর জীবনের শেষ তখনই হয়ে যেত। কিন্তু তোমার বাবার সাথে তো আমার কোন জন্মের শত্রুতা! জোর করে বাঁচিয়ে আগুনের জীবন উপহার দিলো সে আমাকে। এবং যার প্রথম নিশানা হিসেবে কয়েকদিন বাদে ধরা দিলে তুমি।
তোমাকে আমি এত ঘৃণা করি কেন জানো ইপশা? কারণ তোমার জন্মটাই ঘৃণার ছিল।

মা যে আসলে কি বলতে চাইছে বুঝতে সমস্যা হলো না আমার। লজ্জায় অপমানে কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। শক্ত করে ফোন চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠলাম আমি,
— চুপ করো মা, চুপ করো। আল্লাহর দোহাই লাগে প্লিজ চুপ করো।
— কেন চুপ করব? তুই আর তোর বাপ মিলে আমার সর্বস্ব খেয়েছিস৷ রাক্ষসী। কেন জন্মের সময় মরে যাসনি তুই? তুই যে আমার কতবড় কলঙ্কের নাম তা টের পাস! জানোয়ার। আমার ছেলেটাকেও তো দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছিস আমাকে।

ফোনের ওপাশে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলার তীব্র শব্দ শুনতে পেলাম আমি। হাফাতে হাফাতে গর্জন করে মা বলল,
— দীর্ঘদিন কলঙ্ক বয়ে বেড়ানোর পর ওই একটা সুখ এসেছিল আমার জীবনে৷ কিন্তু নাহ তোর তাও সহ্য হলো না। শুধু তোর কেন, ওই বাটপারের ছেলে আরসালান, ওরও তো সহ্য হতো না শুরু থেকে। বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে আমার ছেলেটাকে ফুঁসলাতো ও।
কে জানে কোন জাদুমন্ত্রণা জানে গোটা পরিবার। যাদের বলির পাঠা ঘুরেফিরে আমিই হয়ে যাই।
যাক, আরও একবার সফল হয়েছিস তো তোরা, তাইনা। এখন ওখানে গিয়ে নিশ্চয়ই মিলে গেছিস ওর সাথে? জারজ, মনে রাখিস বাপের পথে হেঁটে আরও একবার আমাকে নিঃস্ব করে দিলি তো! কোনোদিন সুখী হতে পারবি না তুই। তোর বাপটা, তারও এমন দশা হবে, পৃথিবীতে দোজখ দেখবে শয়তানটা। আর তুই আর তোর নাগর..
শেষটা শোনার সাধ্য হলো না আমার। তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম মাটিতে। এ কোন ভাষায় কথা বলছে আমার মা। কুমন্ত্রণা, নাগর.. আর সবচাইতে ভয়াবহ যেটা, আমি জারজ? আমি, আমি…

ভীষণ একটা ঘৃণায় গোটা গা গুলিয়ে উঠতে শুরু করল। আমার জন্মের ইতিহাস, আমাদের বাবা-মায়ের ফেলে আসা সময়ের ইতিহাস যে এত নোংরা কে জানত! কেনই বা এতবছর পর তা আমার সামনে আসতে হলো এভাবে? কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি? কোন পাপের।
মনে হলো একটু একটু করে গুছিয়ে নিতে চাওয়া জীবনের টুকরোগুলো দ্বিতীয়বার ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল নিমেষে।
অনেকটাক্ষণ বসে ভাবতে লাগলাম, ঘৃণ্য এই জীবনের ইতি আজই হওয়া উচিৎ কি-না। আমি তো ভীতু, প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকে বের করতে পারলাম না। শেষে আহত, জীর্ণ যাযাবর পাখি শেষ চেষ্টায় দাদির দেখানো গোপনতম নীড়ে ঠকঠক করল।
ঐ নীড়ে ছিল আমার ঘরের মানুষ, সত্যিকার মানুষ যাকে পেয়েও পেতে চাইছিলাম না আমি। আপন করেও করতে পারছিলাম না অযাচিত ভয়ে। অথচ শেষ মুহুর্তে নিয়তির ঠিক করে দেয়া গল্পের মতই, অসহায় আমার আশ্রয় হয়ে উঠল কিন্তু সে।
অসহ্যকর বিকেলের কালো ছায়া থেকে টেনে নিয়ে বাহুবন্ধনীতে আগলে নিলো কি ভীষণ দৃঢ়তায়। ঐ যে ভীতু ভীতু প্রশ্নটা, জীবনের ইতি টেনে দেব কিনা!
এর উত্তরে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— ছিহ পুতুল। এভাবে ভেঙে পড়তে হয়? আমি আছি তো তোমার পাশে, সবসময়। সব ঠিক করে দেব একদিন। ভেঙেচুরে ছড়িয়ে পড়া সব।

তার জটিল কথাগুলো বোঝার সাধ্য যদিও আমার তখন ছিল না। কিন্তু ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতো একটা অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরতে বড্ড ইচ্ছে করছিল। সেবার প্রথম ভয়কে জিততে না দিয়ে আমি আমার মনের কথা শুনলাম। সে যতখানি দৃঢ়তায় বুকে চেপে ধরেছিল আমাকে, তার চাইতে কয়েকগুণ আমি আঁকড়ে ধরলাম তাকে।
ভাগ্যিস আঁকড়ে ধরেছিলাম! নইলে অসহ্য, কাঁটায় পরিপূর্ণ জীবনটা ফুলের মতো মসৃণ আর সুরভীত হতো কি করে?

— “পুতুল? এই অসময়ে ব্যালকনিতে কি করছ? ঠান্ডা লেগে যাবে তো পাগল।”

চিরচেনা স্নেহার্দ্র স্বরের মিষ্টিমধুর ধমকে চমকে ফিরে তাকালাম আমি। সাথেই কেটে গেল আমার বিদীর্ণ অতীতের দীর্ঘ ভাবনার প্রহর। ডায়েরির ফাঁকে কলম গুঁজে সুবোধের মতো তা পেছনে লুকিয়ে কাচুমাচু করে বললাম,
— নিউজে পড়লাম এ সপ্তাহে নাকি অরোরা দেখা যাবে। আর তুমি তো জানই…
— নিউজে বলেছে এ সপ্তাহে। একবারও বলেছে আজ? মিথ্যে গল্প বানাচ্ছ। একা একা বসে বসে ডায়েরি লিখছ তুমি তাই না?

ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল আরসালান। সাথে সাথে তীব্র বুনোফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠল আমার পুরো সত্তা। ইশশ এই মানুষটা পুরোটা একটা জাদুর মন্ত্র। এতবছড় গড়িয়ে গেল বিয়ের, ওর গায়ের পাগলাটে ঘ্রাণটা একটুও পাল্টালো না। বহ্মকমল কি, আমি জানি না, কিন্তু বহ্মকমল যদি কোনো অজানা সুগন্ধি ফুল হয় তাহলে সেই তকমা তো ওই ডিজার্ভ করে, আমি নই।

— কি ভাবছ সুইটডল। লুকতে চাইলেই আমি ধরতে পারব না?।
এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে আমায় পুরোপুরি বারান্দার রেলিংয়ের সাথে মিশিয়ে নাকে নাক ছুঁয়ে দিল আরসালান। ওর গায়ের ঘ্রাণ ছাপিয়ে সেই মুহুর্তে নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেল আফটার শেভিংয়ের কড়া স্মেল। ঘোরগ্রস্ত আমি চোখ বুঁজে নিভু নিভু স্বরে বললাম,
— প্লিজ আরসালান।
— কি লিখছ দেখি আমিও।
বলেই একহাতে আমার দু-হাত পিছমোড়া করে খপ করে ডায়েরি টেনে নিলো অন্যহাতে। নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বলল,
— আবারও অতীতকথন শুরু করেছ?

আমার জবাব দেয়ার ক্ষমতা নেই। এভাবে বলা নেই কওয়া নেই হুটহাট কাছে এসে কিছু জানতে চাইলেই উত্তর দিতে পারব নাকি! অদ্ভুত।
— আমাদের প্রেমের গল্পগুলো লিখেছ পুতুল?

আবারও প্রশ্ন করল সে। শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
— লিখব কীভাবে? আগেই তো থামিয়ে দিলে তুমি।

ফিসফিসিয়ে কোনোরকমে বলার চেষ্টা করলাম আমি। কে জানে তার কানে পৌঁছল কিনা! ঝুঁকে আমার থুতনি কামড়ে ধরল আলতো করে। পাগলের পাগলামি ছাড়ানোর বাহানায় এত ছটফট করলাম, কিন্তু গায়ে লাগল না তার। রীতিমতো হ্যান্ডকাফের মতো আমার দুটো কবজিকে এমনভাবে বন্দী করে রেখেছে সে তালুর মধ্যে! নড়বার সাধ্যি নেই। শেষে ওভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তার অত্যাচার সহ্য করার খানিক বাদে একা থেকেই ছেড়ে দিয়ে আমায় ধাতস্থ হওয়ার সময় দিল। তবে হাত ছাড়ল না। আমিও ছোটাছুটি করলাম না। রয়েসয়ে তার অতি প্রেমের ভার সামলে নিয়ে চোখ খুলতেই দেখলাম আমার বেহাল দশার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে সে। এত পাঁজি হয়েছে মানুষটা! ভালোবাসার প্রশ্রয়ে পাগলামো বাড়ছে বেশি করে। আমাকেও ওর প্রেমে এমনভাবে পাগল করে রেখেছে না কিছু বলতে পারি, আর না সইতে পারি। সত্যিই, জীবনের মোড় এভাবে ঘুরে যাবে কখনো ভাবিইনি কোনোদিন।
— ভাবনার দেবী, আবার কোন ভাবনায় হারিয়ে গেলে বলো তো?
— হারাইনি। ভাবছি।
— কি ভাবছ?
এক ভ্রু নাচিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল আরসালান।
— আচ্ছা তুমি আমাকে বহ্মকমল নাম দিয়েছ কেন?
— বলব না, সিক্রেট।
— আহা বলোই না। প্লিজ প্লিজ। কতদিন জিজ্ঞেস করেছি আমি। বলো না প্লিজ। এই?
— উহহু অযথা জিদ করে না পুতুল। চলো এখন শোবে চলো। পেটের ভেতরেরগুলো বোধহয় ঠান্ডায় এতক্ষণে বরফ হয়ে গেল। তারপর কাল সকালবেলা একটু কম নড়াচড়া করলেই তুমি কান্নাকাটি করে আমায় পাগল বানিয়ে দেবে। সেটা হবে না।
— তুমি কিন্তু ইগনোর করছ আমার কথা।

মুখ ফুলিয়ে ওর হাত টেনে ধরলাম আমি। শুনে মৃদু হেসে ও ফিরে তাকাল। অল্প ঝুঁকে মুখে একটা ফু দিয়ে বলল,
— তুমি তো জানই কেন। পড়েছ তো আমার তোমায় নিয়ে লেখা ডায়েরি থেকে।
— পড়েছি। কিন্তু তোমার মুখে তো শুনিনি আরসালান।
— পাগলি মেয়ে। চলো ঘরে চলো। বলছি।
— উহু এখানেই বলো। প্রকৃতির এত স্তব্ধতা, এত স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ। এখানেই স্পেশাল ফীল করাও আমাকে।
— জিদ্দি মেয়ে। আমারও জিদ কম নাকি!

ভ্রু কুঁচকে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে আরসালান আমায় পাঁজা কোলা করে তুলে নিলো সবল বাহুতে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে চট করে ওর ব্লেজার খামচে ধরে চিৎকার করতে করতেও সামলে নিলাম আমি নিজেকে। অল্প হেসে ঘরের ভেতর পা রাখতে রাখতে ও বলল,
— ভারী হয়েছ বেশ।
— তো হব না। তোমার জুনিয়র ভার্সন দু’জনকে সামলে রেখেছি নিজের ভেতর। সারাটাদিন তো ক্ষিদে ক্ষিদে বলে চেঁচায় দুটো। ওদের চক্করে পড়েই..
যাকগে আর কথা কেটো না তো। বলো কেন আমায় ব্রহ্মকমল নাম দিয়েছিলে তুমি?
— না শুনে মানবে না। তাইতো? বেশ বলছি।

বিছানার এককোণে বসে আমায় কোলে টেনে নিয়ে মাথার তালুতে চুমু খেলো আরসালান। এরপর ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল,
— তোমার প্রতি আমার অবসেশান তো অনেক আগেই টের পেয়েছিলাম। কিন্তু ভালোবাসাটা টের পেলাম একবার এক হাইকিংয়ে যাওয়ার পর।
— হাইকিং?
— হু..হুম। আমার ফার্স্ট এভার হাইকিং। শহরের সবচাইতে উঁচু এক পাহাড়ে। যদিও ট্রিপটা ছিল আমার ইন্সটিটিউট থেকে, তবু গাইডের তোয়াক্কা না করে আমরা কয়েকজন ফ্রেন্ড এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতাম সুযোগ পেলে। ফুলটার যেদিন খোঁজ পেলাম,সেদিনও দুষ্টুমিতে সাড়া দিয়ে একা একা বেরিয়ে গিয়েছিলাম পাহাড়ের সবচাইতে রহস্যময় জঙ্গলে, নতুন কিছু আবিষ্কারের তাড়নায়।
বুঝতে পারিনি এতবড় দুঃসাহসিকতা দেখাতে গিয়ে শেষদিন কোনো বিপদে পড়ে যাব।
— বিপদে?
— হুমম। বাট বিস্তারিত জানতে চাইবে না। এতটুকু জেনে রাখো, ঐ বিপদের হাত থেকে বাঁচতে আমি যখন গহীন জঙ্গলে পাগলের মতো ছুটছি, সে সময় একঝাড় বহ্মকমলের ছায়া আমায় নিজের ভেতর আগলে নিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল জীবনমৃত্যুর ব্যবধান থেকে। ঠিক তুমি যেভাবে বাঁচিয়েছিলে একসময় তীব্র জ্বরের হাত থেকে।
— ব্যাস! তাতেই আমায় ঐ ফুলের সাথে তুলনা করে ফেললে!
— তুলনা নয়৷ তোমাকে ফুলটাই ভেবে ফেললাম। আমার ব্রহ্মকমল। ও যেমন আমার দৃষ্টিসীমার অনেক অনেক দূরে এক রহস্যময় আড়ালে নিজেকে ঢেকে রেখেছিল, প্রয়োজনে বেরিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে, তেমনই তুমিও তো আমার থেকে কতটা দূরে ছিলে এতকাল। তোমায় দেখেছি প্রতিমুহূর্তে, কণ্ঠ শুনেছি। কিন্তু ছুঁতে চেয়ে আর পারিনি। ধরা দাওনি তুমি আমার আঙুলের স্পর্শে।

বলতে গিয়ে কেমন একটা ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেল আরসালানের দৃষ্টি। এই দৃষ্টি আমার চেনা। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গেলে যখন আমাদের দূরত্বের হিসেবগুলো মনে পড়ে যায় তখনই অদ্ভুত অভিমান আর রাগে চোখ ঘোলাটে হয়ে যায় ওর। এই আরসালানকে সামলাতে পারি না আমি। ওর ব্যক্তিত্বের এই অংশটুকু চিরকালের মতো অধরা মনে হয় আমার কাছে।
— তুমি একটা পাগল ছেলে আরসালান।
— পাগল, ভীষণ পাগল। শুধু তোমার জন্য পুতুল। শুধু আমার রহস্যময়ী বহ্মকমলের জন্য।

ঘোলাটে চোখের ভাষা গহন হয়ে পরমুহূর্তে ছায়ার মতো নেমে আসে আমার ওপর। ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,
— পুতুল, ক্যান ইউ সে দ্যাট ইউ লাভ মি?
— আই জাস্ট ডোন্ট লাভ ইউ মাই ম্যান, আই ব্রিদ ইউ, আই লিভ ইন ইউ।

ঘোরের ভেলায় ভেসে উত্তর দেই আমি। শুনে সে উজ্জ্বল হাসে। তার নিঃশ্বাস নাকের ডগায় অনুভব করে শেষ মুহুর্তে চোখ বুজতে বুজতে আমি টের পাই থুতনির কাছটায় ব্যথার তীব্রতা এবার বেশি।
এই ছেলের ভালোবাসা আর অভিমান যেমন তীব্র, তেমনই তীব্র সেসবের বহিঃপ্রকাশ। ও বোধহয় জানে না, ওর স্বাভাবিক সত্তার চাইতে এই ক্ষ্যাপাটে সত্তা ঠিক কতটা ভিন্ন। যদি জানত তাহলে কি আর পাগলামি করত না? কে জানে। আমার অবশ্য দুটো আরসালানকেই ভীষণ পছন্দ। দুটোই যে আমার সারাবেলা বোঝায় পৃথিবীতে ভালোবাসার রূপে ভিন্নতা আছে। ভিন্নতা আছে ভালোবাসা প্রকাশের ধরণে। এক ভালোবাসা কারোর কাছে অভিশাপ হলে, অন্যের কাছে তা আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিতে পারে। তাই অন্যের গল্পের সাথে নিজের গল্পকে মেলাতে হয় না। এতে শুধু ভয় বাড়ে, নিয়তি পাল্টায় না।
আমরা ততটুকুই পাই যতটুকুর আশীর্বাদ নিয়ে স্রষ্টা আমাদের পৃথিবীতে পাঠান। এর বাইরে বাকি সব দুর্ভাবনা ছাড়া কিচ্ছু নয়;কিচ্ছু না। আর দুর্ভাবনায় সাড়া দিতে নেই। সাড়া শুধু দিতে হয় ভালোবাসায়। কারণ, ফেইট মেইকস নো মিস্টেকস।

পুনশ্চঃ
কিছুটা গল্প বাকি রয়ে গেল তাই না? আমি আর আরসালান বাদে বাকি চরিত্রদের গল্পটুকু বিস্তারিত বলা হলো না। অবশ্য বিস্তারিত তাদের নিয়ে বলবার কতটুকুই আছে?
মা যে অভিশাপের নাম দিয়ে পৃথিবীতে দোযখ দেখার কথা বলেছিল আমার আর বাবার উদ্দেশ্যে, তা আমার ক্ষেত্রে না ফললেও বাবার জীবনে প্রতিফলিত হলো ঠিক। বছর দেড়েকের মাথায় খুব ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বিছানায় পড়ে গেল বাবা। আমরা ফোনে খবর পেলাম দ্বিতীয় স্ত্রী তার এই দশা দেখে কিছুদিন সহ্য করে আর কূলতে পারেনি। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে চলে গিয়েছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের আশায়।
অপরদিকে মা? তার সাথে অন্যায় তো হয়েছিল অনেক। শেষ বয়সে সে অন্যায়েরই গেটিস হিসেবে সৃষ্টিকর্তা একজন যোগ্য জীবনসঙ্গীর খোঁজ পাইয়ে দিলেন তাকে। মা যদিও বিয়ে করতে দ্বিধান্বিত বোধ করছিল, ভাই এখানে বসে তাকে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় রাজি করিয়ে তবেই থেমেছে।
মা এখন ভালো আছে। তার ঐ সংসারে আগেরপক্ষের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীদের নিয়ে সুখে আছে। আমার সাথে যদিও সেদিনের পর আর কথা হয়নি। আমিই কথা বলিনি নিজে থেকে। আমি তো তার কলঙ্কের অংশ। তাই আমাকে সামনে দেখে কিংবা কথা বলেও অতীতের ক্ষত তাজা না হয়ে যাক সেই ভয়ে পারিনি যোগাযোগ ধরে রাখতে। মাকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যদি পারতাম, তাহলে সত্যিই নিজের এগজিস্টেন্সি পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতাম শুধু মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু আমি হারিয়ে গেলে যে হারিয়ে যাবে আরও দুটো মানুষ। চেয়েও এতগুলো জীবনের ওপর জুলুম করতে কি পারত ইপশা?
যাহোক এ তো গেল মায়ের খবর। এবার তবে আমার জীবনের অন্যতম সুপার হিরো অংকর কথা বলি?
মানুষকে জায়গার হাওয়া না বদলে দেয় অনেকটা। নইলে আমার চিরকালের চিরকুমার ব্রত নেয়া নার্ড ভাইটা ভিনদেশে এসে হঠাৎ সুন্দরী রমনির পাল্লায় পড়ে যাবে কেন এভাবে! জড়িয়ে যাবে ভালোবাসার জটিল জালে। যদিও সে মুখ ফুটে কিছু প্রকাশ করেনি আমার সামনে, তবে গোপনসূত্রে জানতে পেরেছি মেয়েটা অন্যকেউ নয়, মনি আপুর ছোটবোন মিলি, অংকরই ব্যাচমেট। ছবিতে দেখে মনে হয়েছে ভীষণ ভদ্র আর মিষ্টি দেখতে। অংকর পাশে কি দুর্দান্তভাবে যে মানিয়ে যায়! ভেবেছি রিলেশনশিপ নিয়ে দুটোই সিরিয়াস হলে বিয়ে দিয়ে দেব এখানে। আমার ভাইয়ের মতো পারফেক্ট একটা ছেলের থেকে বেশিদিন আলাদা থাকতে দেব না মিলিকে। আরও একটা মেয়ে জানুক ভালোবাসার রূপ কতটা বর্নিল হতে পারে। কতটা রঙিনভাবে আমাদের জীবন রাঙাতে পারে মাত্র চারটে অক্ষর;যে রঙকে আঁকড়ে ধরে আমরা বেঁচে থাকার প্রার্থনা করতে পারি অনেক অনেকটাকাল…

” শেষ “

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে