ব্রহ্মকমল পর্ব-০২

0
4

#ব্রহ্মকমল

_____________

কাস্টডি নিয়ে প্রথম দু বছর দু’জন খুব ছোটাছুটি করার চেষ্টা করলেও আমাদের ভাইবোনের রাগারাগির কারণে তা বন্ধ হলো। পারিবারিক বৈঠকে মৌখিক একটা সমাধান এলো,
আমি যেহেতু সাবালিকা হয়ে গিয়েছি তাই আমি চাইলে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে জীবন গুছিয়ে নিতে পারি। সে পড়াশোনা করে হোক কিংবা বিয়ে! খরচাপাতি যা প্রয়োজন হবে সবটা বাবা-মা’ই দেবে। ওদের তো আর কম নেই। এতদিন সংসারে যা করেছিল তা তো আমাদের দু ভাইবোনের জন্যই। যতই আলাদা হোক আমাদের প্রাপ্য ওরা বুঝিয়ে দেবে। শুনে আমার ভারী হাসি পেল। আমি তো মানুষদুটোকে জীবনে চেয়েছিলাম, আর ওরা পড়েছে টাকা নিয়ে!

তবে আমাকে এত সহজে ছাড়লেও অংককে নিয়ে টানাটানি থামল না ওদের। শেষ বৈঠকেও নানা প্রলোভন আর যুক্তিতর্ক দিয়ে দুজন দুদিক থেকে বোঝাতে চাইল, অংক আসলে একজন গার্ডিয়ানের সাথেই বেশি ভালো থাকবে। ও যেহেতু ছেলে মানুষ, পড়ে সরকারি কলেজে। বাঁধাধরা নিয়মের বালাই তো ওখানে নেই। পাছে পারিবারিক উত্থান-পতনের খারাপ প্রভাব না পড়ে ওর ওপর। তারচেয়ে গার্ডিয়ানের সাথে থাকবে, নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সেই তো ভালো। বাবা-মায়ের নির্মল স্নেহার্দ্র যুক্তি। কিন্তু অংক শুনে ভীষণ ক্ষেপে গেল। দুই পরিবারের অত মুরুব্বিদের সামনে ফুঁসে উঠে চোখ লাল করে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
— খুব ছোটবেলায় যখন আমাকে ভালো স্কুলের দোহাই দিয়ে ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়েছিলে তোমরা, তখন মনে পড়েনি আমি নষ্ট হয়ে যেতে পারি? লিগ্যাল গার্ডিয়ান তখন কি ফুপু ছিল? তোমরা আদৌ ভেবে দেখেছিলে নিজের পরিবার ছাড়া আট-ন বছর বয়সী একটা ছেলে কেমন থাকতে পারে।

এতটুকুন ছেলের মুখে এতবড় কথা অবিশ্বাস্য ছিল। বাবা-মাও ভীষণ অবাক হলো। সাথে অবাক হলো উপস্থিত পরিবারের লোকজন। দাদা-নানা তো ক্ষেপে একবার ধমকও দিলো ওকে। ফুপু পাশে থেকে হাত ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করল। তবে ওর গনগনে রাগ কমল না কিছুতেই। হাত ছাড়িয়ে ও সরাসরি আমার কাছে এসে টেনে ওঠালো আমাকে। এতক্ষণ যে ধমকটা বাবাকে দিচ্ছিল, ঐ একই সুরে চোখ লাল করে আমাকে বলল,

— শুনেছিস? একটু হলেও কি বুঝেছিস কতবড় বোকার স্বর্গে বাস করছিলি এতদিন। এই যে এই স্বার্থপর মানুষদুটো, এরা একবারও তোকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছে? চায়নি। আমাকে নিয়ে যে টানাটানি করছে, এর পেছনেও কোনো স্বার্থ আছে আমি জানি।
— অংক তুই ঠান্ডা হ। বাবা-মাকে নিয়ে কেউ এভাবে বলে?

পাশে থেকে বলল কে যেন। অংক তার দিকে ঘুরে শুধু এতটুকু উত্তর দিল,
— আমি বলি। এখন নিশ্চয়ই আমাকে বেয়াদব বলবেন?

আমি অংকের হাতে চাপ দিয়ে থামালাম। তারপর নরম সুরে বোঝাবার চেষ্টা করলাম,
— তুই ভুল বুঝছিস৷ এখানে তো শুধু..
— ভুল তুই বুঝেছিলি এতদিন৷ বোকার মতো অন্ধ হয়ে ছিলি। আর অন্ধ হয়ে থাকতে থাকতে তোর চোখদুটো এমনভাবে নাই হয়ে গেছে, এখন ঝকঝকে আলোতেও দেখতে পাচ্ছিস না কিছু।

বলার একপর্যায়ে ঝরঝর করে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল ওর। তবু রাগ আর বিষণ্নতার অনুভূতিটাকে সে কথায় ফুটতে দিল না৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বর একটু নরম করে বলল,
— তুই প্রমিস কর এদের একজনের থেকে এক সিকিপয়সাও নিবি না। আজকের পর থেকে আমরা দু’জন অনাথ। পৃথিবীতে বাবামাহীন ছেলেমেয়েরা যেভাবে সার্ভাইব করে আজ থেকে আমরা দু’জনও করব। আর এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

অংক ঠিকই বলত, আমি বোকা মেয়ে। পরগাছার মতো এতগুলো বছর কাটিয়ে দেবার পর এখন এসে স্বাবলম্বী হতে হবে, এমনকি নিজের সাথে ভাইয়ের দায়িত্বও বুঝে নিতে হবে এই ভয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম ভেতরে ভেতরে। মনে হলো শেষমুহুর্তে বাবা অথবা মায়ের মধ্যে একজন পিছু ডেকে ফেললেই হয়তো গলে যেতাম আমি। তখন অংকও হারিয়ে যেত জীবন থেকে। তাই তো সৃষ্টিকর্তার প্ল্যান অন্যরকম ছিল।
শেষ মুহুর্তে অসহায় চাহনিতে তাকালেও বাবা-মা আমার নাম ধরে একটাবারও ডাকল না। বরং ওদের দিকে শেষ আশা নিয়ে যখন তাকালাম, ফিরতি নজরে মা’র চোখভরা বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা আমাকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিল। বিস্ময়টুকু প্রকাশ করতে ঠোঁট নড়ে উঠল একবার, কিন্তু উথলে ওঠা কান্না ছাপিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম না।
বোধহয় তখনই পরগাছা ইপশার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল। বড্ড আশায় বাড়িয়ে রাখা ভাইয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে দৃঢ় গলায় বললাম,
— প্রমিস।

সেদিনের পর থেকে গোটা পরিবারের সামনে স্বঘোষিতভাবে আমরা অনাথ হয়ে গেলাম। জানি সমাজ, ধর্ম কোনোটাই সন্তানের চোখে বাবা-মায়ের প্রতি এত বিদ্বেষ সমর্থন করে না। কিন্তু আমরা ঐ মুহুর্তে ও দুটোর কোনোটাকেই মানার পরিস্থিতিতে ছিলাম না৷ সবাই বলেছিল,
“জেদাজেদি কয়েকদিনের। ইট-পাথরের শহরে একসন্ধ্যা যখন না খেয়ে থাকবে, তখন বেয়াদবি ছুটে যাবে দুটোর;ঠিক চোখ মুছতে মুছতে বাপ-মায়ের পায়ে পড়ে আশ্রয় নেবে। আমরাও দেখব তো জেদ কতদিনের থাকে।”

বেরিয়ে আসার সময় কথাগুলো শুনলাম দু’ভাইবোন চুপচাপ, কোনো উত্তর দিলাম না। মনে মনে জানতাম জেদ আমাদের মধ্যে বসে গিয়েছে। আর যার কাছেই সাহায্য নিই, ওই স্বার্থপর মানুষদুটোর পায়ে পড়ে অন্তত ভিক্ষা কখনো চাইব না।

শুরু শুরুতে রাগ-জেদের তেজ থাকে অপরিসীম, কিন্তু সময় গেলে তা ফুরিয়েও যায় স্বাভাবিক নিয়মে। আমাদের কতটা কি হলো বিষয়টা ধাঁধার মতো।
তবে অস্বীকার করার উপায় নেই শুরুর দিকে টাকা-পয়সাবিহীন, শক্তপোক্ত ছাদবিহীন শুধু বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে যাযাবরের মতো ঘুরেফিরে বেড়াতে ভীষণ কষ্ট হলো। অন্যের আশ্রয়ে থাকার ফোঁড় যে কত তা অল্প কয়েকদিনে বুঝতে সময় লাগল না আমাদের। তবু মাথানত করে হাত পাততে ছেড়ে আসা পথ মাড়ালাম না দুজনের কেউই। অল্পদিনে অনাহারে, অনাদরে আমাদের শরীর ভেঙে এলো। চেহারার দিকে তাকাতেও ভয় হতো। প্রকাশ করতাম না মুখে, প্রায়ই হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হতো, কিন্তু শেষ মুহুর্তে অংকর ঋজু ব্যক্তিত্বের দিকে তাকিয়ে সাহস ফিরে আসত। ভেঙে পড়তে পড়তেও সামলে নিতাম নিজেকে।
তবে এভাবেওবা কতদিন। জীবন তো আর বাংলা সিনেমা নয় যে সব ছেড়েছুড়ে বস্তিতে গিয়ে উঠব আর বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যাবে! উল্টো স্বাভাবিক নিয়মে কাছের বন্ধু কিংবা অনাত্মীয়-আত্মীয় যাঁদের বাড়িতে আমরা টেনিস বলের মতো ঘোরাফেরা করলাম, তারা এতটুকুন সময়ে আমাদের ওপর বেশ নাখোশ হয়ে উঠে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। চেয়েও “আশ্রয়” শব্দের ছায়াতলে থাকতে পারলাম না আর। চেষ্টা করেছিলাম টিউশন কিংবা অন্যকিছু করার। কিন্তু যে অল্প টাকা আসত, তা দিয়ে অতবড় শহরে আমাদের দুজনের হতো না। হেল্প নিতেই হতো জানতাম, তবু মাথা নত করার প্রশ্ন আসলে রক্ত গরম হয়ে যেত।
অংক এসবে বিশ্বাস না করলেও আমি টের পাচ্ছিলাম আমার মন চাইছে একটা মিরাকল। ইতোমধ্যে এত কষ্টে জর্জরিত আমাদের অপরিপক্ব মনদুটো, তারমধ্যে অভাবের তাড়না। এমন দিন কাটানোর প্রত্যাশা তো কখনো দুঃস্বপ্নেও করিনি তাই না?

মিরাকল জিনিসটা অন্যতম এক জটিল ধাঁধার নাম। আসলে সবই সৃষ্টিকর্তার খেলার মতো। তিনি চাইলে কাউকে যেমন ধ্বংস করে দিতে পারেন চোখের পলকে, তেমনই চাইলেই হাত ধরে সাহায্যও করতে পারেন অনেক কঠিন কঠিন সময়ে অনায়াসে। আমরা তো কত অবাধ্যতা করেছিলাম, তবু তিনি আমাদের প্রত্যেকটা খারাপ সময়ে দু-হাত ভরে সাহায্য করেছেন। যেমন সেবার করলেন।

সবে তখন টিউশন পেয়েছি একটা। স্টুডেন্ট যে গার্লস হোস্টেলে উঠেছি তার মালিকের ভাগ্নে। আমার আগে অনেক টিচার রাখা হলেও বাচ্চাটা দুষ্টু বলে কেউ টিকত না। আমি তো চুপচাপ ছিলাম, এছাড়াও আমার টাকা জমেছিল অনেক, তাই ওসব বিষয়ে কান দেয়ার সুযোগই ছিল না। যাহোক আমার সেসময় পড়াশোনা কিছু ছিল না। জীবন এলোমেলো হয়েছে বলে ওসব দিকে গুরুত্ব দেবার কথা মনেও নেই। ডেইট পার হয়েছে ন্যাশনালেরও ফর্ম তোলা হয়নি। দিন রাতের দৈর্ঘ্য এত বড় ছিল, কাটতেই চাইত না। তাই স্টুডেন্ট যত দুষ্টুই হোক ওকে সময় নিয়ে পড়াতে আমার ধৈর্য্যে কখনো টান লাগত না৷ তবে ওরা টাকা অনেক কম দিত। যা দিত তাতে একবেলার খাবারের খরচ উঠে যেত। অন্যকিছু দূরের ব্যাপার। টেনেটুনে এভাবেই চলছিলাম কোনোরকমে, সেসব দিনে একদিন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই কলেজ ড্রেসে অংকের আগমন। বিভ্রান্ত দৃষ্টি, চুল উসকোখুসকো, মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ভয়ের কারণ, ও যে তখন আগের মতো স্থির নেই আর। সবসময় মাথা গরম থাকত আর কেউ কিছু বললে ফুঁসে উঠে মারপিট। ভেবেছিলাম সেদিনও বোধহয় এমন কিছুই করেছে। নইলে ওর চেহারার এই দশা কেন!
কোনোরকমে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ছুটে গিয়ে ভীতু সন্ত্রস্ত গলায় ওর কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলাম,
— তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন বাবু? কোনো সমস্যা হয়েছে আবার?
— বাবা বিয়ে করেছে আপু।

একবাক্যে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে টলমল চোখে চাইল আমার দিকে। যতটা না ওর চোখভরা অসহায়ত্ব দেখলাম, তারচাইতে কয়েকগুণ উপলব্ধি করলাম, এই প্রথম ওর গলায় হেরে যাওয়ার ছাপ স্পষ্ট। এতদিন বাবা আলাদা হয়েছে, সন্তানদের নিয়ে স্বার্থপরতা করেছে সব যে ছেলেটা কষ্টেসৃষ্টে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে; সেই ছেলেটাই বাবা অন্যকারোর হয়ে গিয়েছে এতবড় সংবাদটা আর কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ঠিকঠাক বুঝলাম৷ আমাকে কিছু বলতে হলো না। মাথা নামিয়ে হাত মুঠ করে ভাঙা ভাঙা গলায় ও ই আবারও বলল,
— হাউ ক্যুড হি আপু? হাউ ক্যুড!

আমি বরাবরের মতো নিশ্চুপ ভূমিকায়। উত্তর দিতে পারলাম না।
অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়, আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। যেন এমনটাই হতো জেনে ছোট্ট শ্বাস ফেলে ওর কাঁধে হাত রাখলাম। খানিক পর জিজ্ঞেস করলাম,
— তুই কীভাবে জানলি?
— সিকান্দার এসেছিল। দাদি ওকে পাঠিয়েছিল আমার কলেজে। দাদু নাকি এই নিউজ শুনে অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। মেডিকেলে ভর্তি। তোকে আর আমাকে দেখতে চায়।
— কোন মেডিকেল? চল এ পথেই যাই।
— তুই যাবি?

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল অংক। আমি হেসে ওর গালে হাত রাখলাম।
— চল।

বলেছিলাম না একটা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করছিল আমার ভেতরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ভীতু ইপশা সত্বা? ঐ সত্বার তাড়নায় মেডিকেলে যাওয়া কিন্তু আমাদের জীবনে অন্যতম মোড় ঘোরানোর একটা প্রথম পদক্ষেপ ছিল। ভাগ্যিস শুনেছিলাম মনের কথা। তাই স্বল্প দিনের ভোগান্তির জীবন থেকে মুক্তি মিলেছিল দু ভাইবোনের মেডিকেলে যাওয়ার পর থেকে।

_______________

বাবা দ্বিতীয় বউ একদম আমার বয়সী। ডিভোর্সের কারণের এক অংশও যে ইপশা বিন্দুমাত্র শুনতে আগ্রহী ছিল না সেই ইপশাই বাবার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা আগাগোড়া মন দিয়ে শুনল।
দুঃখ হলো না আমার একফোঁটা। শুধু মায়ের প্রতি যে বিদ্বেষ জন্মেছিল সেদিনের ঘৃণার দৃষ্টি দেখে, সেটা কিছুটা হালকা হলো। ঐযে সাদা পাতায় পেন্সিলের মোটা দাগ দিয়ে আবার ইরেজার দিয়ে মেশালে যেমন হালকা হয়ে যায় না? অমনই কিছুটা। তা অবশ্য বললাম না কাউকে। অতটুকু সময়ে ফেস করা দুর্ঘটনাগুলো যেভাবে ট্রাস্ট ইস্যু তৈরি করে দিয়েছিল আমার মনে, মাকেও বা শতভাগ বিশ্বাস করতাম কীভাবে।
তবে দাদির কথায় বুঝতে পারলাম দ্বিতীয় এই বউটিকে চাচির তরফের কোনো আত্মীয় হিসেবে সে চিনত। সর্বপ্রথম চাচার বিয়েতে মেয়েটাকে দেখেছিল বছর চারেক আগে। তারপরেই হয়তো কোনোভাবে যোগাযোগ হয়ে দুজনের..
কি বিচ্ছিরি কান্ড। যার মেয়ের কিনা আর্লি এইজে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, সে ব্যক্তি উল্টো মেয়ের বয়সী একজনকে বিয়ে করে বীরদর্পে বাপের বাড়িতে উঠছে নতুন সংসারের খবর জানাতে।
ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠল আমার। দাদির গল্পের ফাঁকে হুড়মুড়িয়ে উঠে গিয়ে বমিও করলাম আমি। দাদি অবাক হলো না। সেও শক পেতে পেতে ততক্ষণে পাথর।
তবে বাবার বিয়ের ঘটনা এবারে আমি আগাগোড়া জানলেও লুকনো হলো অংকর থেকে। বাবা যে পরকীয়া করে আমার মাকে তালাক দিয়েছে, সেটা জেনে-বুঝে নিজের বুকের ভেতর মাটিচাপা দিয়ে রাখলাম আমি। সন্দেহ ছিল অংক হয়তোবা জানে, অথবা ধারণা করেছে ততক্ষণে। তবু মুখ ফুটে কিছু বললাম না। বরং ওর যেন এদিকটায় নজর না পড়ে তাই মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেভাবেই হোক মাইন্ডটা ডাইভার্ট হয়ে যাক ছেলেটার। অন্যকিছু ভাবনায় এতটা ব্যস্ত হয়ে যাক, নিজের বাবার জীবনে সদ্য ঘটে যাওয়া নোংরা ঘটনাটাও যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।

প্রার্থনা কাজে দিলো দু-তিনদিনে। যদিও অনেক শোকাবহ ভাবনার মাধ্যমে ওর মন সরল বিষয়টা থেকে তবু আমি স্বস্তি পেলাম।
হাসপাতালে এক সপ্তাহ প্রবল কষ্ট সহ্য করে দাদু আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন। মাইনর অ্যাটাকেই যদিও তাকে ভর্তি করা হয়েছিল, অবজারভেশনে থাকা অবস্থায় শরীরের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। হার্ট অ্যাটাক থেকে এক ধাক্কায় স্ট্রোক, তারপর কোমা আর সবশেষে..

অসুস্থ মানুষের মৃত্যুগুলো অদ্ভুত। টিমটিমে মোমবাতির শিখা নিভে যাওয়ার আগ মুহুর্তে যেমন দপ করে জ্বলে উঠে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, তেমনই রোগভোগে কাটানোর পর চলে যাওয়ার দিন দাদু সকালবেলা হুট করে ঠিক হয়ে গেল। চোখ খুলল, হাত পা নাড়াল, আমাকে আর অংককে পাশে বসিয়ে অস্পষ্ট স্বরে গল্পও করল। শেষে আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে দাদিকে ইশারা করে ঘটা করে উকিল ডেকে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে বাবার যে অংশটুকু ছিল, সে সম্পূর্ণ অংশটা আমাদের দু ভাইবোনের নামে করে দিয়ে সে হারিয়ে গেল আমাদের মধ্য থেকে।
লটারি পাওয়ার মতো দোদুল্যমান অবস্থাটায় আমরা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের চাবিকাঠি পেলাম মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটার থেকে।
প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত, আহত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও জানতাম এই আমাদের জীবন পাল্টে যাওয়ার প্রথম দিন। এরপর সবটা না হলেও কিছুটা তো অবশ্যই ঠিক হবে আমাদের। অবশ্যই।

চলবে,
Sara

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে