#বোবা_টানেল (০৯+১০)
“আসসালামু আলাইকুম। আমি জাহিদ মির্জা।”
সালামের জবাব দিয়ে কিছুক্ষণ জাহিদ মির্জার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে আসিফ খন্দকার বলে ওঠে,
“ভেতরে আসুন।”
এর মাঝেই নিলুফা বেগম দৌড়ে এসে বলে ওঠেন,
“কই গো? দেখো ব্লিডিং এর সামনে কতগুলো গাড়ি এসে দাড়িয়েছে। আর গাড়িগুলোর সামনে কেমন ফরমাল পোশাক পরিহিত কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। কারা এনারা!”
কথা শেষ করতেই ড্রইং রুমে জাহিদ মির্জাকে প্রবেশ করতে দেখে চমকে ওঠেন নিলুফা বেগম। দ্রুত মাথায় ওড়না তুলে জাহিদ মির্জাকে সালাম দেন তিনি।
“গাড়িগুলো আমারই। আর ফরমাল পোশাকে যাদের দেখতে পাচ্ছেন ওরা আমার বডিগার্ড।” (জাহিদ মির্জা)
আসিফ খন্দকারের মনে এবার হরেক রকম প্রশ্নের ঝ’ড় ওঠে। “কে এই ব্যক্তি?” আসিফ খন্দকারের মনে হচ্ছে, এই নাম তিনি কোথায় যেন শুনেছেন! আচমকা তার কিছু একটা স্মরণ হতেই চমকে উঠে তিনি জাহিদ মির্জাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
“আপনি এমপি সাহেব না? আসুন আসুন। প্লিজ এখানে বসুন। নিলুফা চা,নাস্তার ব্যবস্থা করো।”
“মি. খন্দকার আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আগে এখানে বসুন। একসাথে আমরা একটু আড্ডা দেই। পরে না হয় চা খাওয়া যাবে।” (জাহিদ মির্জা)
নিলুফা বেগমকে চোখ দিয়ে ইশারা করে রান্নাঘরের দিকে যেতে বলে আসিফ খন্দকার আমতাআমতা করে বলে ওঠেন,
“একটা কথা জানতে চাচ্ছিলাম এমপি সাহেব। আমাকে কিভাবে চিনলেন? আর হঠাৎ আমার বাসায়ই বা কি মনে করে?”
মুখে স্বভাবসুলভ হাসি ফুটিয়ে জাহিদ মির্জা বলে ওঠেন,
“আসলে হয়েছে কি মি. খন্দকার! আমার একটা মাত্র ছেলে হচ্ছে জয়। ছেলেটা আমার সহজে কিছুই চায় না আমার কাছে। তাই একবার যদি ওর মুখে শুনি কিছু পছন্দ হয়েছে ওর, তবে তা যেভাবে পারি মুহূর্তের মাঝে এনে দেওয়ার চেষ্টা করি। আপনার মেয়েটাকে আমার ছেলেটা খুব পছন্দ করেছে। এমনকি আজ পর্যন্ত কখনো জয় আমার কাছে এভাবে কিছু চায়নি। যেভাবে আপনার মেয়েটাকে চেয়েছে নিজের লাইফপার্টনার হিসেবে। আমি আপনার কাছে জয় এবং অসিফার বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছি। আশা করছি আপনি আমাকে ফেরাবেন না।”
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় আসিফ খন্দকার। তার ঠিক কী বলা উচিত তা আর বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে নিয়ে আসিফ খন্দকার বলে ওঠেন,
“এমপি সাহেব! সন্তানের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি গুরুত্ব দেওয়াটা তো প্রতিটি বাবা-মায়েরই উচিত। আপনিও যেমন ছেলের পছন্দকে গরুত্ব দিয়ে এই যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন! তেমনি আমিও আমার মেয়েটার পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে তার পছন্দের মানুষের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছি। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত এমপি সাহেব।”
“আশ্চর্য! মেয়ে বললেই কি বিয়ে ঠিক করবেন নাকি? ছেলে ভালো কি মন্দ তা পরীক্ষা করে দেখেছেন? আমার ছেলে কিন্তু লাখে একটা! আর আপনার মেয়েটা মির্জা পরিবারে বউ হয়ে এলে রাণীর হালে থাকবে। তাই বলছি কি, নিজে একটু সময় নিয়ে ভাবুন আর মেয়েটাকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করুন।”
বিরক্তিতে ছেয়ে আসে আসিফ খন্দকারের মুখমণ্ডল।
“আমার মেয়ের পছন্দের ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে এমপি সাহেব। তাই এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই। আর সেই ছেলেটাকেও আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালো করেই চিনি। আমি আমার সন্তানকে সব পরিবেশেই মানিয়ে চলতে শিখিয়েছি। তার স্বামী যেই পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন, সে তার স্বামীর সাথে তালে তাল মিলিয়ে সব কিছুর মোকাবেলা করতে পারবে। আমি এই শিক্ষাই আমার মেয়েকে দিয়েছি। তার অতিরিক্ত আভিজাত্যের প্রয়োজন নেই। আশা করি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি।”
রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে আসে জাহিদ মির্জার। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“আসছি তবে।”
“সে কি! এভাবে যাবেন না প্লিজ। এক কাপ চা হলেও খেতে হবে। নিলুফা চা কি হয়েছে?” (আসিফ খন্দকার)
“চা খাওয়ার পরিবেশটা তো রাখলেন না মি. খন্দকার।” বলেই হনহন করে বাসা হতে বেরিয়ে যায় জাহিদ মির্জা।
ছোট একটা দম ফেলে সোফাতেই মাথা এলিয়ে দেন আসিফ খন্দকার। রান্নাঘর হতে নিলুফা বেগম ছুটে এসে জানালা দিয়ে বাইরে দুই-তিনবার উঁকি-ঝুকি দিয়ে আসিফ খন্দকারের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“কি গো? এমপি সাহেব হঠাৎ এভাবে চলে গেলেন কেন?”
“আগে দরজা আটকে দিয়ে আসো তারপর বলছি।”
নিলুফা বেগম দরজা আটকে দিয়ে এসে আসিফ খন্দকারের পাশে বসে পড়েন।
“এবার শোনো তবে, এমপি সাহেব তার ছেলের সাথে অসিফার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। তার ছেলে নাকি অসিফাকে পছন্দ করে। তারপর আমিতো বলে দিয়েছি যে, অসিফা অন্য কাউকে পছন্দ করে এবং তার সাথেই অসিফার বিয়ে ঠিক করেছি। তবে এমপি সাহেব অনেক রেগে গেছেন দেখলাম। সামনে কি হতে চলেছে কে জানে? (আসিফ খন্দকার)
আতংকে নিলুফা বেগমের বুক কেপে ওঠে। তিনি তরতরিয়ে আসিফ খন্দকারের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
” তুমি তাড়াতাড়ি শিখনকে জানাও এটা। আর যত দ্রুত পারো ওদের বিয়ে দিয়ে দাও। নাহলে কখন কি ঘটে যাবে বলা যায়না। আমার কেমন যেন ভয় করছে।”
“ভয় পেলে মানুষ আরও পেয়ে বসে নিলুফা। একদম ভয় পাওয়া যাবেনা।”
–
এদিকে রাগান্বিত হয়ে গাড়িতে উঠে বসতে দেখে জয় জাহিদ মির্জাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“কি হলো বাবা? তুমি রেগে আছো কেন? কিছু হয়েছে।”
সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে জাহিদ মির্জা বলে ওঠেন,
“তোমার অসিফার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তার প্রেমিকের সাথে। একদম সোজা মানা করে দিয়ে দিয়েছে মি. খন্দকার।”
“প্রেমিক! ওহ শি’ট! বাবা এই প্রেমিক আর কেউ না শিখনই। আমাদের আগে ও গুটি চেলে দিয়েছে। কিন্তু যে করেই হোক আমার ওই মেয়েকেই লাগবে বাবা।” বলতে বলতে চোখ দিয়ে ইশারা করে বাইরে তাকাতে বলে জাহিদ মির্জাকে।
জাহিদ মির্জা গ্লাস নামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখেন রাস্তার অপর পাশে রিকশা হতে নামছে অসিফা। মুচকি এসে তিনি জয়ের উদ্দেশ্য বলে ওঠেন,
“বলতেই হবে,তোমার পছন্দ আছে জয়। সোজাসাপ্টাভাবে যখন কাজ হলো না। তাহলে এবার বাকা পথ তো অনুসরণ করতেই হবে। এই মেয়েই হবে মির্জা বাড়ির বউ। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দাও।”
গদগদ হয়ে জাহিদ মির্জাকে জড়িয়ে ধরে জয় বলে ওঠে,
” লাভ ইউ বাবা”
“লাভ ইউ ঠু মাই সান।”
বিল্ডিং এর সামনে হতে সাঁ সাঁ করে কয়েকটা মাইক্রোবাস চলে যেতে দেখে ভ্রু কুচকে আসে অসিফার। দ্রুত বড় বড় পা ফেলে সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায় অসিফা।
বাসায় ঢুকেই সোজা আসিফ খন্দকারকে জিজ্ঞাসা করে,
“বাবা বিল্ডিং এর সামনে এতগুলো মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে ছিল যে? কারা এসেছিল জানো কিছু?
“এমপি সাহেব এসেছিলেন তার ছেলের সাথে তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তোমাকে নাকি এমপি সাহেবের ছেলেটা কোথায় দেখে অনেক পছন্দ করেছে।”
“ওয়েট ওয়েট। ছেলের নাম কি?”
“কি যেন বলেছিল! ও হ্যা জয়।” (আসিফ খন্দকার)
উক্ত নাম শুনে একদম চমকায় না অসিফা। সে যেন এই নামটা শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। কপাল চাপড়ে বলে ওঠে,
“ওই ছেলের মনে তবে এই ছিল! তাইতো ভাবি ছেলের এতো দাপট কেন! এমপির ছেলে হিসেবে সবখানে ক্ষমতা দেখিয়ে বেড়ায় এই ছেলে। তুমি বলোনি যে আমার বিয়ে ঠিক?”
“বলেছি তো। তবে এমপি সাহেব যেভাবে রা’গ-ক্ষো’ভ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে তাতে আমি আর তোমার মা তোমার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি। যদি কিছু মনে না করো তবে এই শুক্রবার পর্যন্তও আমি অপেক্ষা করতে চাইছিনা। কালই তোমাদের বিয়ে সেরে ফেলতে চাইছি। শিখকে কল দিয়ে আমি সব জানিয়ে দিয়েছি। বিকালে আসছে ও। কিছু নিয়ে টেনশন করার দরকার নেই তোমার। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।”
——-
“আংকেল আজ একটা সত্যি কথা বলি?” শিখন?
“হ্যা অবশ্যই। বলো বাবা।” (আসিফ খন্দকার)
“এই জয় অসিফাকে পছন্দ করে এটা সম্পূর্ণ ওর বানোয়াট কথা। ওর বাবাকে দিয়ে আপনার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়ছিল এজন্য যে, ও অসিফাকে ছি’নি’য়ে নিয়ে আমাকে একদম দূর্বল করে দিতে চায়। রাজনীতির ফিল্ডে ও আমার বড়সড় প্রতিদ্বন্দ্বী বলা চলে আর ভার্সিটির স্টুডেন্ট কমিটি ইলেকশনে হেরে যাওয়ায় আমার ওপর ওর ক্ষো’ভ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। সামনের এমপি নির্বাচনে যেহেতু আমি ওর প্রতিদ্বন্দ্বী থাকব, তাই ও এখনই চাইছে আমাকে দমিয়ে দিতে। সে কারণে আমার সবচেয়ে দূর্বল জায়গাটিতেই ও হাত দিয়েছে। ও জেতার জন্য যা কিছু করতে পারে আংকেল। এখন আমারই ভয় হচ্ছে। আমার জন্য আমার কাছের কিছু মানুষের ক্ষ’তি না হয়ে যায়। আপনারা কুমিল্লা যাচ্ছেন এ কথা যেন কাকপক্ষীও না জানতে পারে।”
শিখনের কথা শুনে ড্রইং রুমে উপস্থিত নিলুফা বেগম ও অসিফার চোখ-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসিফ খন্দকার গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠেন,
“অন্যায়ের হাত যতই লম্বা হোক না কেন। সে হাত কোনো না কোনো একদিন কাটা তো পড়বেই। তুমি চিন্তা করো না শিখন। তোমার এই বাবা সবসময় তোমার ছায়া হয়ে থাকবে। কালই তবে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে ফেলি। তুমি মি. সাকলাইন খানকে খবর দাও। আর আমি আমার কিছু ক্লোজ রিলেটিভসদের খবর দিচ্ছি। দশ পনের জন মানুষ নিয়ে আমরা ছোটখাটোভাবে বিয়েটা সেরে ফেলব।”
“যথা আজ্ঞা হবু শশুর আব্বু।” বলেই আড়চোখে শিখন অসিফার দিকে তাকায়।
অসিফা মুচকি হেসে অন্যদিকে মুখখানা ঘুরিয়ে নেয়।
———
পরদিন অল্পকিছু আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আহনাফ ও আসিফ খন্দকারের জোরাজুরিতে আহনাফকে নিয়ে বিয়েতে হাজির হন সাকলাইন খান।
অসিফার রুমে শিখন, আহনাফ ও অসিফাসহ অসিফার দুজন বান্ধবী বসে বসে গল্প করছে। ওদিকে ডাইনিংরুমে সকল অতিথিদেরকে আপ্যায়ন করছেন আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম।
আচমকা অসিফার এক বান্ধবী শিখনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আপনিই তবে সেই নেতা সাহেব? নাহ যতটা খারাপ আপনাকে ভেবেছিলাম ততোটা খারাপ আপনি নন দুলাভাই। তবে থ্যাংকিউ আমাদের এই বোবা বান্ধবীর মুখে আবার হাসি ফোটানোর জন্য। এই মেয়ের সাথে যবে থেকে পরিচয় হয়েছে তবে থেকে কখনো ওর মুখে হাসি দেখিনি। আন্টিকে অনেক জোর করার পর জানতে পারি, ওর মুখের এই হাসি উবে যাওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ ছিলেন আপনি।”
আর মুখ হতে কথা বের হয়না অসিফার বান্ধবী ইমার। অসিফা হাত দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দেয়।
“আরে আরে ওকে থামালে কেন তুমি? বলতে দাও ওকে।” (শিখলন)
রাগান্বিত ভংগিতে অসিফা বলে ওঠে,
“আপনি চুপ করুন। এই বাচাল মেয়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। না জানি আর কী না কী বলে আমার মানসম্মান উদ্ধার করে দেবে।”
রুমে উপস্থিত সকলেই অসিফার কথা শুনে হোহো করে হেসে ওঠে। এর মাঝেই অসিফাদের ডাক পড়ে রাতের খাবার খেতে যাওয়ার জন্য।
–
ঘড়ির কাটা প্রায় রাত দুটো ছুই ছুই। আসেপাশের সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। থেমে থেমে জানালা ভেদ করে কিছু কিছু কু’কু’রের ঘেউঘেউ আওয়াজ ভেসে আসছে রুমের ভেতর। জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকের উকি দিতে দিতে অসিফা আতংকিত ভংগিতে শিখনের দিকে চেপে দাঁড়ায়। শিখন অসিফার দিকে এক পলক তাকিয়ে তার মাথায় আদরের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠে,
“কু’কু’র ডাকছে অসিফা। ভয় নেই।”
“আমি কু’কু’র অনেক ভয় পাই।”
ক্ষানিকটা হেসেই শিখন বলে ওঠে,
“কু’কু’র নিশ্চয়ই এই দোতলার জানালা ভেংগে তোমাকে কা’ম’ড়া’তে আসবে না!”
“হ্যা তাও কথা!”
“তোমাকে লাল শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে অসিফা।” (শিখন)
“ধন্যবাদ ধন্যবাদ। তবে আমি জানতাম আমার নেতা সাহেবকে শুধু কালো রঙয়ের পাঞ্জাবীতেই মানায়। কিন্তু লাল রঙয়ের পাঞ্জাবীতেও যে তাকে এত অপূর্ব লাগতে পারে আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।”
অসিফার কথা শুনে শিখন মুচকি হেসে পুনরায় বাইরের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে।
“এই ইট-পাথরের শহরের ভালোবাসাগুলোতে যে স্বচ্ছতা নেই, আসল ভালোবাসার মতো কোনো আবেগ-অনুভূতি নেই নেতা সাহেব। প্রেমিক-প্রেমিকাগুলো কেমন যেন রোবটের মতো। একই ছাদের নিচে থেকেও যেন কত দূরত্ব তাদের মাঝে। সবসময় ব্যস্ত থাকে মানুষের সামনে নিজেদের আবেগ-অনুভূতিহীন ভালোবাসাকে পার্ফেক্ট প্রমাণ করতে। এই শহরের মানুষ এখন আর পাঁচ টাকার গোলাপের মাঝে ভালোবাসা খুজে নেয়না। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয়টি হলো, এখন সেই পাঁচ টাকার গোলাপই তো রেয়ার। তবে ভালোবাসা কেন রেয়ার হবেনা? “জানেন আমার না অনেক বড় একটা শখ আছে।”
অসিফার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শিখন বলে ওঠে,
“তুমি৷ ঠিকই বলেছ। তবে তোমার সেই শখটা সম্পর্কে কি আমি জানতে পারি?”
“আমার না এই ইট-পাথরের শহরে মন টেকে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। দুদিনের জন্য হলেও আমার কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে হারিয়ে যেতে মন চায় আপনার সাথে। সেখানে আপনার সাথে মাটির ঘরে থাকব। সেখানে কোনো বিদ্যুৎ থাকবেনা, নেটওয়ার্ক থাকবেনা, মোবাইল ফোন বা টিভি কিছু থাকবেনা, পাকা রাস্তা এবং বড়সড় গাড়িও থাকবেনা। গ্রামের মেঠোপথে আপনার সাইকেলের সামনে বসে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াবো। আপনার হাত ধরে পুকুরে নেমে ইচ্ছা মতো পানিতে ঝাপাঝাপি করব। আমি মাটির চুলায় রান্না করব আপনার জন্য। আপনি যখন খেতে বসবেন আমি আপনার পাশে বসে তালপাতার তৈরি পাখা দিয়ে বাতাস করব। রাত হলে ঘরের মাটির বারান্দায় বসে আপনার সাথে চাঁদ দেখব। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি শখ নেতা সাহেব। যা হয়তো আমার কল্পনা পর্যন্তই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে।”
কিছুক্ষণ গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায় শিখন। অতঃপর হেসে উঠে বলে,
“তোমার মতোই তোমার শখটাও অদ্ভুত সুন্দর। চলো তবে বেরিয়ে যাই তোমার শখ পূরণের উদ্দেশ্যে।
অবাক ভংগিতে অসিফা বলে,
” মানে?”
“আমি যেহেতু তোমার স্বামী। তাই তোমার সকল শখ পূরণের দায়িত্ব এখন হতে আমার। তোমার এই শখ আমি পূরণ করবই।”
“কিভাবে? এমন গ্রাম কি আপনি আদৌ খুজে পাবেন?”
“আলবাত পাব। সবকিছু তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর গোছগাছ শুরু করে দাও। শনিবার আব্বু-আম্মু কুমিল্লা রওনা হলেই আমরাও রাতে বেরিয়ে পড়ব।” (শিখন)
অসিফা টলমল চোখে বলে ওঠে,
“আমার জীবনে এতদিন শুধু একটা জিনিসেরই অভাব ছিল। আর সেটা হলো আপনি। আজ আপনাকেও পেয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য।”
অসিফাকে নিজের এক বাহুতে আগলে নিয়ে শিখন বলে ওঠে,
“ধন্যবাদ তো আমার তোমাকে দেওয়া উচিত। ধন্যবাদ আমার জীবনকে পুনরায় আলোকিত করে দেওয়ার জন্য।”
——-
আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম কুমিল্লা ফিরে যাওয়ার পর সেদিন রাতেই শিখন অসিফাকে নিয়ে রওনা হয় তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বন্ধুদের দিয়ে খোজ-খবর লাগিয়ে ওমনই একটা গ্রামের সন্ধান পেয়েছে শিখন। সেখানে আগে নিজে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে এসেছে সে। আসিফ খন্দকার প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হয়ে যান।
অসিফা এই প্রথম টেনে উঠেছে। এর আগে সে কখনোই ট্রেন ভ্রমণ করেনি। ট্রেনে এত মানুষের সামনে অসিফার অস্বস্তিবোধ হতে পারে ভেবেই শিখন একটা ছোট্ট কেবিন নিয়ে নিয়েছে। ট্রেন চালু হওয়ার আগে শিখন অসিফার জন্য কিছু হালকা খাবার ও পানি নিয়ে আসে। ট্রেন চলা শুরু করার পরে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে ঘুম এসে ভর করে অসিফার। শিখন বুঝতে পেরে ব্যাগ হতে একটা কাঁথা বের করে অসিফার গায়ের জড়িয়ে যায়। বিড়ালছানার মতো গুটিশুটি মে’রে ঘুমিয়ে পড়ে অসিফা।
–
ভোরের দিকে ট্রেন এসে থামে এক স্টেশনে। এখান হতে সেই গ্রামে প্রবেশ করতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে। শিখন একটা ভ্যান আগে হতেই ভাড়া করে রেখেছিল। ভ্যানওয়ালা লোকটা সেই গ্রামেরই বাসিন্দা। ভ্যানে ব্যাগ-পত্র চাপিয়ে অসিফাকে নিয়ে উঠে বসে শিখন। গ্রামের ভেতরের রাস্তার অবস্থা এতই করুণ যে মাঝ বয়সি লোকটার ভ্যান টেনে নিতেই যেন জান-প্রাণ বের হয়ে আসার উপক্রম হয়। শিখন ও অসিফা দুজনই ভ্যান হতে নেমে যায়। শিখন এক হাত দিয়ে পেছন থেকে ভ্যান ঠেলতে থাকে আর ওপর হাতে অসিফার হাত ধরে নিয়ে হাটতে থাকে।
প্রায় এক ঘন্টা দশ মিনিট পরে তারা যে বাড়িটায় থাকবে সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। ভ্যান থেকে সব ব্যাগ-পত্র নামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দেয় শিখন। অসিফা বাড়িটার দিকে তাকাতেই অবাকের শীর্ষে পৌছে যায়। সে আগেও মাটির তৈরি বাড়ি দেখেছে কিন্তু এত সুন্দর মাটির বাড়ি সে আগে কখনো দেখেনি। একটা উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। উঠোনে পা রাখতেই মাথার ওপরে হেলে থাকা বড় আমগাছটার ঠান্ডা হাওয়ায় মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায় অসিফার। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয় সে। তার যেন এসব কিছুই কল্পনা মনে হচ্ছে। আগে যখন সে দাদাবাড়িতে যেত তখন তার ঠিক এমনই অনুভূত হতো। কিন্তু এখন সেই গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। আধুনিকতার ছোয়ায় সেখানেও কেমন শহুরে শহুরে ভাব চলে এসেছে। আচমকা শিখনের ডাক পড়তেই ভাবনার জগৎ হতে বেরিয়ে আসে অসিফা।
“অসিফা ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? রুমে এসো।”
অসিফা তাকিয়ে দেখে শিখন ইতোমধ্যে ব্যাগ-পত্র নিয়ে দরজার তালাও খুলে ফেলেছে। অসিফা দ্রুত বড় বড় পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে। এই বাড়িতে দুটো ঘর রয়েছে। বাড়ির সাথে লাগোয়া একটা রান্নাঘর ও একটু পাশেই একটা বাথরুম রয়েছে। রুমগও দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ খুব যত্নের সাথে গুছিয়ে রেখে গেছে। অসিফা গিয়ে ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে।
“অসিফা বাড়ির পাশে একটা সুন্দর পুকুর আছে। তুমি নাকি পুকুরে ঝাপাঝাপি করবে? চলো তাহলে। তার আগে গোসলখানায় জামা-কাপড় রেখে এসো। আমি বাইরে দাড়াচ্ছি।” বলেই ব্যাগ হতে একটা লুংগি নিয়ে বেরিয়ে যায় শিখন।
অসিফা রুম হতে বাইরে বেরিয়ে দেখে শিখন লুংগি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা অসিফাকে হেসে গড়াগড়ি খেতে দেখে শিখন ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,
“হাসছো কেন তুমি? আমাকে কি প’চা দেখাচ্ছে?”
“না না। প’চা কেন দেখাবে? আমার বাবাও তো পরে। সুন্দর দেখায় তাকে। আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। তবে এটা আমার কাছে আনএক্সপেক্টেড ছিল তাই আসলে হাসি কন্ট্রোল করতে পারিনি। তা আপনি গিট্টু ওভাবে মেরেছেন কেন?”
“সেফটি সেফটি।ও তুমি বুঝবে না গো বউ। একবার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়ি গিয়ে লুংগি পড়ে পুকুরে গোসল করতে নেমে যে ইতিহাস করে এসেছিলাম তা আর না বলি!”
অসিফা এবার হাসতে হাসতে বারান্দার খুটি ধরে মেঝেতে বসে পড়ে।
“কিগো জামাই-বউ মিল্লা দেখি ভালোই হাসি-তামাশা করতাছো। তা খাওন-দাওন কি লাগব না তোমাগো?” বলতে বলতে ভাত ভর্তি গামলা ও তরকারির বাটি নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন জমিলা বেগম।
“চাচী এত পরে আসলেন? এইযে আপনাদের বউমা।” (শিখন)
“আর বইল না বাজান রান্নাঘরের কাম শেষ করতে করতে দেরি হইয়া গেল। বউ তো ভারী মিষ্টি মা শা আল্লাহ। তা বাজান গোসল কইরা আইসা খাইয়া লও। আমি একটু পর আইসা তোমাগো সাথে গল্প করবানি।”
“আচ্ছা চাচী। আর আপনাকে যে কি ক’ষ্ট দিচ্ছি।”
“এইসব কইয়ো না তো। তুমি আমার ছেলের মতই।”
–
অনেক বছর পরে পুকুরে গোসল করতে নেমেছে অসিফা। একবার সাতার কেটে এদিক যাচ্ছে তো ওদিক যাচ্ছে। শিখন ঘাটে বসেই অসিফার কান্ড দেখছে। আচমকা অসিফা সাতার থামিয়ে শিখনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“সা’প! সা’প! নেতা সাহেব আপনার লুংগি কা’ম’ড়ে ঝুলে আছে দেখুন।”
শিখন কোনোদিকে না তাকিয়ে লুংগি ঝাড়া দিয়ে “ওমাগো” বলে দৌড়ে ঘাট হতে ওপরে উঠে যায়।
অসিফার বুঝি হাসতে হাসতে এবার দমই বন্ধ হয়ে যাবে।
চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা