#বোবা_টানেল (০৮)
ডাইনিং টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে আসিফ খন্দকার, নিলুফা বেগম ও অসিফা। পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম কিছুক্ষণ পর পর অসিফার দিকে তাকাচ্ছেন আর মিটমিট করে হাসছেন। কিন্তু কেউ কিছুই বলছেন না। এমন পরিস্থিতিতে অসিফা বেশ অস্বস্তি বোধ করছে বুঝতে পেরে আসিফ খন্দকার হালকা কেশে অসিফার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। অতঃপর ক্ষানিকটা হেসে বলে ওঠেন,
“আমার আম্মাজানকে যে এত খুশি খুশি লাগছে আজ!”
আসিফ খন্দকারের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায় অসিফা।
“এই নিয়ে সকাল হতে ছয় বার এই একই কথা বলেছ বাবা। কিছু কি বলতে চাইছো তুমি?”
থতমত খেয়ে নিলুফা বেগমের দিকে তাকান আসিফ খন্দকার। রাগান্বিত চোখে নিলুফা বেগম তাকে কিছু একটা বলার জন্য ইশারা করেন।
“আমার ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে আম্মু। আট নয়দিন পরেই কুমিল্লা ফিরে যেতে হবে আমাকে। অফিস হতে আমাকে ঢাকাতে ট্রান্সফার হতেই দিতে চাইছেনা। তুমিতো বোঝোই, আমার বয়স হয়েছে। একা একা এখন আর রোজ রান্না করে খেতে পারব না।”
“একা একা রান্না করে খেতে হবে কেন? আম্মুকে নিয়ে যাও।”
“তোমাকে এই ফ্ল্যাটে একা রেখে যেতে আমরা ভরসা পাইনা আম্মু। বলছি কি? তোমরা বিয়ে কবে করবে ভাবছ? তোমাকে শিখনের হাতে তুলে দিতে পারলেই আমরা ভরসা পাব। আমাদের একটাই মেয়ে তুমি। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক ভয় হয়। কিছুদিন আগেও যে একটা দূর্ঘটনা ঘটল! তাতে করে তোমাকে একা রেখে যেতে আমরা সাহস পাইনা আম্মু।”
বাবার কথা শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে অসিফা। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলে ওঠে,
“হ্যা সবটাই বুঝেছি বাবা। পছন্দটা যেহেতু আমিই করেছি তবে এবার বাকিটুকু সব তোমাদের ইচ্ছাতেই করো। আমার কোনো বাধা-নিষেধ নেই।”
আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠেন।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে অসিফার। ফোনের স্ক্রিনে শিখনের নাম্বার দেখে মুখে আপনা-আপনি হাসি ফুটে ওঠে। গ্লাস থেকে একটু পানি খেয়ে নিয়ে ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ হতে সালামের শব্দ ভেসে আসে। সালামের জবাব দিয়ে অসিফা বলে ওঠে,
“হঠাৎ কল দিলেন যে?”
“কেন আমার কি কল দেওয়ার অধিকার নেই?” (শিখন)
“এমা ছি ছি! কি বলছেন? অবশ্যই আছে।”
“বিকালে একটু বের হতে পারবে? তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যেতাম আরকি।”
“কোথায় নিয়ে যাবেন?”
“সে না হয় গিয়েই দেখো। সাড়ে চারটা নাগাদ রেডি হয়ে থেকো। আমি নিতে যাব তোমাকে।”
“আচ্ছা আমি রেডি হয়ে থাকব।”
কথার মাঝেই পাশ হতে আসিফ খন্দকার আস্তে আস্তে বলে ওঠেন,
“শিখনকে বলো একটু আমাদের বাসায় আসে যেন।”
ফোন কানে রেখেই অসিফা বলে ওঠে,
“হ্যা সে বিকালে আসবে বাবা।”
ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে দিয়ে অসিফা শিখনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“বাবা কি বলেছে শুনেছেন তো? আপনি একটু আগে আগে আসবেন বিকালে।”
ফোনের অপরপাশ হতে শিখন হেসে বলে ওঠে,
“কি! আমার হবু শশুর আব্বু এত জরুরি তলব করলেন যে? আজকেই আমাকে একদম মেয়ের জামাই বানিয়ে ফেলবেন নাকি তিনি?”
শিখনের কথা শুনে হোহো করে হেসে উঠে আসিফ খন্দকার বলে ওঠেন,
“পোলা তো নয়! যেন আগুনের গোলা!”
——
“সবই তো শুনলে বাবা। এখন তুমি কি বলো? বিয়েটা কি শীঘ্রই সেরে ফেলা যায়?” (আসিফ খন্দকার)
“আংকেল আমিতো আগেরদিনই আপনার কাছে অসিফাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো আপত্তি নেই দ্রুত বিয়ে সেরে ফেলতে। আজও যদি বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চান তাও আমি এক পায়ে রাজি। তবে অসিফা কি রাজি?”
“অসিফার থেকে রায় নিয়েই তো তোমাকে জানালাম কথাটি। বিয়ের পর তোমরা এই ফ্লাটেই থেকো। আবারও বলছি, আমার ফুলটাকে যত্নে আগলে রেখো বাবা। বড্ড যত্নে বড় করেছি ফুলটাকে। খুব বিশ্বাস করে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।”
“বিশ্বাস রাখতে পারেন আংকেল। তবে এই শুক্রবারেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা যাক?”
“অবশ্যই। তোমার পরিবারকে একদিন আসতে বলো এ বাসাতে। নিজের আপন বাবা-মা না হোক তারা। তবে তোমাকে লালন-পালন তো তারাই করেছেন। আমরা দুই পরিবার একসাথে মিলেমিশে বিয়ের সকল ব্যবস্থা করব। ” (আসিফ খন্দকার)
আচমকা থমথমে হয়ে যায় শিখনের মুখখানা। ভারী কন্ঠে আসিফ খন্দকারের উদ্দেশ্য বলে ওঠে,
“আংকেল আমাদের বিয়ের দিন ছাড়া আমার পরিবারের কেউই উপস্থিত থাকবে না। আসলে আমিই এটা চাইনা। একটা সত্যি কথা আজ বলে দেই, মি. সাকলাইন খান আমার আপন বাবা হন। তবে তার বর্তমান যে স্ত্রী আছেন, তিনি হলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। আমি মি. সাকলাইন খানের প্রথমপক্ষের সন্তান। কেন প্রথম কথাটুকু বলেছি তা অন্য আর একদিন বলব। এই শিখন খানের বিভীষিকাময় জীবনের এক অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।”
এর মাঝেই নিলুফা বেগম ট্রে ভর্তি করে খাবারদাবার নিয়ে হাজির হন। শিখন চায়ের কাপটা হাতে নিতেই অসিফা তার রুম হতে বেরিয়ে আসে। সাদা রঙের থ্রিপিস পরিহিতা অসিফার দিকে তাকাতেই চোখের পলক ফেলা থেমে যায় শিখনের।
চারটা চল্লিশ নাগাদ বাসা হতে বের হয় অসিফা ও শিখন। কিছুটা সামনে হেটে গেলেই তারা রিকশা পেয়ে যাবে। হাটার মাঝপথেই শিখন থেমে গিয়ে অসিফার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে বলে ওঠে,
“এই মেয়ে পায়ের হিল খোলো। খোলো বলছি।”
ভয়ে কেপে উঠে অসিফা দ্রুত পা হতে হাই হিল জোড়া খুলে ফেলে।
“হিল খুলতে বললেন কেন হঠাৎ?” (অসিফা)
“যা পরে হাটতে অসুবিধা হয় তা পরো কেন?”
ঠোঁট উলটে শিখনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসিফা বলে ওঠে,
“আপনার চেয়ে আমি কত খাটো দেখেছেন? নাগালই পাইনা আপনার। তাই তো হাই হিল পরেছি। নাহলে যে আপনার পাশে আমাকে বড্ড বেমানান লাগে।”
ভ্রু কুচকে শিখন একবার অসিফাকে পা হতে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। অতঃপর ধ’ম’কে উঠে বলে,
“এই মেয়ে তোমার হাইট একদম ঠিকই আছে। কে বলেছে তোমাকে আমার পাশে বেমানান লাগে? একদম পার্ফেক্ট ম্যাচ আমরা। ফের যদি কখনো এমন কথা শুনেছি তোমার মুখে! যাও দৌড়ে গিয়ে ফ্লাট কোনো জুতো পরে আসো। আমি ততক্ষণে রিকশা ঠিক করছি। ফাস্ট যাও।”
আপাতত অসিফার পুরো পৃথিবীটাই থমকে গেছে যেন। ড্যাবড্যাব করে শিখনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
“এই মেয়ে তুমি যাবে? নাকি আমি কোলে করে তোমায় নিয়ে যাব? কোনটা করলে খুশি হও?
শিখনের এহেন কথায় লজ্জায় গাল ও কান গরম হয়ে আসে অসিফার। এক মুহূর্ত আর শিখনের সামনে দাঁড়ায় না সে। হাই হিল জোড়া হাতে তুলে নিয়ে এক ছুটে বিল্ডিং এর ভেতরে চলে যায়। আর একটু সময় দাড়ালে এই ঠোঁট কা’টা ছেলে কখন কি বলে ফেলতো তার ঠিক নেই।
—
রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে শিখন ও অসিফা। তবে মাঝে তাদের চার আংগুল সমান গ্যাপ রয়েছে। শিখন কিছুক্ষণ পরপরই অসিফার দিকে তাকায় আবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়।
” দেখুন নেতা সাহেব! এভাবে বারবার তাকাবেন না আমার দিকে। আমার লজ্জা করবে। রাস্তার জন্য যে পরিমাণ ঝাঁকির সৃষ্টি হচ্ছে তাতে লজ্জা পাওয়ার সুযোগই পাচ্ছিনা। মনে হচ্ছে এই বুঝি টুপ করে পড়ে যাব রিকশা হতে।”
অসিফার কথায় হেসে উঠে শিখন বলে,
“আমার চোখে যে তাক লাগিয়ে দিয়েছ! তাতে করে আমার তো উচিত তোমাকে সামনে বসিয়ে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা। আমার এখন মন চাইছে তোমাকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে চলে যাই।”
চোখ-মুখ কুচকে অসিফা শিখনের মাথার ওপরে হাত দিয়ে উত্তাপ পরীক্ষা করে।
“না আপনার মাথা রোদে গরমও তো হয়নি। তবে এত আবোলতাবোল ব’ক’ছে’ন কেন?”
অসিফার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে শিখন গুন-গুন করে এক লাইন গান গেয়ে ওঠে,
“এক সুন্দরী মাইয়া আমার মন নিলো কাড়িয়া।”
—
রিকশা এসে একটা বৃদ্ধাশ্রমের সামনে থামতেই অসিফা অবাক হয়ে শিখনের দিকে তাকায়।
“আমরা এখানে কেন এসেছি?” (অসিফা)
“আমার কিছু মায়ের সাথে তোমাকে দেখা করাতে নিয়ে এসেছি। এখন রিকশা হতে নেমে ভেতরে চলো।”
বৃদ্ধাশ্রমের ভেতরে প্রবেশ করতেই শিখনকে দেখে কয়েকজন বৃদ্ধা ছুটে আসেন। তারা আরও কয়েকজনকে ডাকতে ডাকতে বলে ওঠেন,
“আমাদের ছেলে আসছে। আমাদের ছেলে আসছে।”
অসিফা তাদের হৈ-হুল্লোড় দেখে বুঝে যায় শিখনের এই বৃদ্ধাশ্রমের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রায়ই এখানে এসে তাদের সাথে সময় কাটায় সে।
“এই যে তোমাদের হবু বউমা। ওই যে যার গল্প করতাম না তোমাদের কাছে?”
শিখনের এহেন কথা শুনে সকলে অবাক হয়ে অসিফাকে ঘিরে ধরে। তাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন বলে ওঠে,
“তুমি বড্ড ভাগ্যবতী মেয়ে। এমন পাগলাটে প্রেমিক আমি আর একটাও দেখিনি। আগলে রেখো।”
অসিফা টলমল চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে থাকা শিখনের দিকে তাকায়। শিখন তার দিকে তাকিয়েই মুচকি মুচকি হাসছে।
——-
দুইদিন পর,
পরপর দুইবার কলিংবেল বাজতেই আসিফ খান দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেন। দরজার অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে তিনি ঠিক চিনে উঠতে সফল হন না। মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে রেখে অপরিচিত ব্যক্তিটি বলে ওঠেন,
“আসসালামু আলাইকুম। আমি জাহিদ মির্জা।”
চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা )