#বোবা_টানেল (০৭)
“আসসালামু আলাইকুম আংকেল। আমি অসিফাকে বিয়ে করতে চাই।”
উক্ত কথাটি কর্ণকুহরে পৌছাতেই আসিফ খন্দকার থমকে যান। তিনি বুঝেছিলেন, শিখন আজ আসবে এবং অসিফার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে মানানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু তিনি এটা কল্পনাও করেননি যে শিখন এসেই সোজা তার কাছে অসিফাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়ে বসবে।
আসিফ খন্দকারকে অন্যমনস্ক হতে দেখে শিখন পুনরায় বলে ওঠে,
“আংকেল?”
হুশ ফেরে আসিফ খন্দকারের। তড়িৎ গতিতে বলে ওঠে,
“হ্যা! ওয়া আলাইকুমুস সালাম। শেষেরটুকু তুমি যেন কি বললে?”
“আমি অসিফাকে বিয়ে করতে চাই আংকেল।”
এবার আসিফ খন্দকার মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে তুলে বলে ওঠেন,
“হঠাৎ এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ?
” না মানে আংকেল আমার লেখাপড়া তো শেষের পথে। আর দুই মাস পরেই আমার মাস্টার্স কম্পলিট হয়ে যাবে। আর আপনি বুঝতেই তো পারছেন বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে। এখন বিয়ে করে বউ-বাচ্চা নিয়ে আর রাজনীতি নিয়েই শান্তিতে বাকি জীবন পার করে দিতে চাই।”
“তোমার বয়স তো বেশি না। পঁচিশ-ছাব্বিশ তো হবেই। এত সকালে বিয়ে? বিয়ে করে বউকে খাওয়াবে কি?”
মুচকি হাসি দেয় শিখন।
“আংকেল জানেনই তো! জীবন তো মাত্র দুদিনের। এই দুদিনকে ঘিরেই তো মানুষের কত শখ-আহ্লাদ থাকে। সেরকম আমারও আছে। বউ ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। তারপর ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দুইজন দাদা-দাদী আর নানা-নানী হবো। আর তার জন্য তো একটু আগে আগে বিয়ে করতেই হবে আমাদের। আর আপনাদেরও কি একটু নানা-নানী হতে ইচ্ছা করে না বলেন? আর আমার বিয়ের বয়স তো আরও আগেই পার হয়ে গেছে আংকেল।”
শিখনের কথায় আচমকা কেশে ওঠেন আসিফ খন্দকার। সাথে সারা মুখমন্ডলেও লজ্জার লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। এই ছেলে যে এত বড় ঠোঁট কা’টা হতে পারে তা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি।
“আংকেল আপনি ঠিক আছেন তো?”
নিজেকে সামলে নিয়ে আসিফ খন্দকার বলে ওঠেন,
“হ্যা হ্যা। আমি ঠিক আছি।”
একটা দম ফেলে পুনরায় শিখন বলতে আরম্ভ করে,
“আংকেল? আমি এই তিন বছর হলো একটা ছোটখাটো বিজনেস করি। মোটামুটি যা আয় করি তাতে আপনার মেয়েকে ভালোই রাখতে পারব। কখনো আফসোস থাকবেনা কিছু নিয়ে কথা দিচ্ছি।”
“সবই বুঝলাম বাবা। তবে তুমি নিজের প্রেমিকা থাকা সত্ত্বেও আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছ কেন?
নিলুফা বেগমের এহেন প্রশ্নে একদম চমকায় না শিখন। আগের মতোই একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
” আমি এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম আংকেল এবং আন্টি। সত্যিটা তবে আজ সামনে আনবই আমি। সব এক্সপ্লেইন করব আমি এখন।”
“আপনাকে কিছুই এক্সপ্লেইন করতে হবেনা। আপনাকে বিয়ে করব না আমি।” (অসিফা)
সকলে অবাক হয়ে অসিফার রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে অসিফা দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“বিয়ে তো তুমি করবেই। আর সেটা আমাকেই এবং হাসি-খুশিভাবেই বিয়ে করতে বাধ্য হবে। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা সত্য জানতে হবে।” (শিখন)
“আমি কোনো সত্যই জানতে চাইনা। চলে যান আপনি এখান থেকে।”
“অসিফা! ছেলেটা কী বলতে চাইছে একটাবার শোন। (আসিফ খন্দকার)
” কি শুনব আমি বাবা? এই? যে উনার প্রেমিকা উনাকে ধোকা দিয়ে চলে গেছে। উনি উনার ভুল বুঝতে পেরেছেন? আমার কি কোনো ব্যক্তিত্ববোধ নেই বাবা? উনার তখন প্রেমিকা ছিল বিধায় আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এখন প্রেমিকা চলে গেছে বলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন। আমি কেন রাজি হবো বাবা? যতই য’ন্ত্র’ণা ভোগ করিনা কেন, আমি উনাকে বিয়ে করব না।”
ধৈর্যের বাধ ভেংগে যায় শিখনের। ধ’ম’কে অসিফার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“এনাফ ইজ এনাফ অসিফা। আমাকে কি তোমার ক্যা’রে’ক্টা’রলেস মনে হয়? একজন ছেড়ে চলে গেছে বলে আর একজনকে গিয়ে ধরব। আমাকে কি এমন প্রকৃতির ছেলে মনে হচ্ছে তোমার? সব ছেলেদেরকে একভাবে জাজ কেন করো? সবাই একই ধরনের হয় না অসিফা। আমার কোনোদিনই তুমি ব্যতীত অন্য কোনো প্রিয় মানুষ ছিল না। আমার কাছে আমার মায়ের পরেই তোমার স্থান। আমার মায়ের পরে পৃথিবীতে তুমিই দ্বিতীয় নারী যাকে আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমার জীবনটাই এমন বিভীষিকাময় যে আমি সবসময়ই আমার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে ভয় পেতাম। তিন বছর আগে এই শিখন খানের শক্ত পায়ে দাড়ানোর মতো তেমন কোনো ঠাই-ই ছিল না। কিভাবে আমি অন্য কাউকে নিজের সাথে জড়াতাম বলো? ভালোবাসা শব্দটাই আমার কাছে কেমন যেন বিদঘুটে ছিল। তোমার মতো একটা নিষ্পাপ ফুলের আমার চক্করে পড়ে জীবন তেতো হয়ে যাক আমি চাইতাম না। যখন দেখলাম বারবার প্রত্যাখ্যান করার পরেও তুমি তোমার জায়গায় অটল তখন আমাকে বাধ্য হয়ে মিথ্যা অভিনয়ের পথ বেছে নিতে হলো। সেদিন যাকে তুমি আমার প্রেমিকা ভেবেছিলে ও আমার একজন ব্যাচমেট। ওর সাথে আমার কোনো প্রকার প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। ওর বিয়ে হয়ে গেছে দুই বছর আগেই। তুমি চাইলে আমি ওর বিয়ের ছবিও দেখাতে পারি অসিফা। তোমাকে দূরে সরানোর পরে আমি বুঝে ছিলাম যে, আমি চিরতরে ফেসে গেছি তোমার কাছে। যখন তোমাকে আমি সত্যটা বলতে যাব তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততোদিনে তুমি তন্দ্রাহরণী আমার তন্দ্রা কেড়ে নিয়ে কুমিল্লায় গিয়ে লুকিয়েছিলে। বিলিভ মি অসিফা, তুমিই আমার প্রথম এবং তুমিই আমার শেষ।”
ড্রইং রুমে যে আসিফ খন্দকার এবং নিলুফা বেগম উপস্থিত আছে তা এক প্রকার ভুলেই যায় অসিফা। হুহু করে কেদে উঠে ছুটে গিয়ে শিখনের দুই গালে এলোপাতাড়ি থা’প্প’ড় দিতে আরম্ভ করে সে। আসিফ খন্দকার সোফা থেকে উঠতে উঠতে শিখনের উদ্দেশ্য বলতে আরম্ভ করেন,
“আমার বাগানের একমাত্র ফুলটাকে তোমায় দিয়ে দিলাম ইয়াংম্যান। কিন্তু খবরদার! তোমার রাজনীতির চক্করে যেন আমার এই ফুলের চোখ হতে এক ফোটাও পানি না পড়ে।”
প্রতিত্তোরে চোখ টিপ্পনি কেটে শিখন বলে ওঠে,
“যথা আজ্ঞা হবু শশুড় আব্বু।”
আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম নিশ্চিন্ত মনে ড্রইং রুম ত্যাগ করেন। তিনটা বছর পরে তাদের মেয়ে এবার মন-প্রাণ খুলে আসবে। সন্তানের খুশির চেয়ে বাবা-মায়ের কাছে আর কি-ই বা বড় হতে পারে!
হুশ ফিরতেই লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলে অসিফা৷ বাবা-মায়ের সামনে সে কি একটা পা’গ’লা’মিই না করে বসল! অসিফাকে মাথা নুয়ে রাখতে দেখে শিখন বলে উঠল,
“কি হলো? মাথা নামিয়ে রেখেছ কেন? কি জোরেই না থা’প্প’ড় গুলো মারলে! তিন বছরের রা’গ-ক্ষো’ভ কি এই থা’প্প’ড় গুলোর দ্বারাই মেটালে নাকি? তা এখন কি আমাকে বিয়ে করবে?”
মুখ হতে কোনো কথা বের হয় না অসিফার। শুধু মাথা নাড়িয়ে “হ্যা” সূচক জবাব দেয়।
এবার শিখন মুখে ক্ষানিক গম্ভীরতা এনে বলে ওঠে,
“কিন্তু আমিতো এবার আর তোমাকে বিয়ে করব না।”
অসিফা চোখ-মুখ কুচকে শিখনের দিকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে মিহি শব্দে বলে ওঠে,
“আপনি কেন বিয়ে করবেন আমাকে? আমাকে বিয়ে করবে তো আমার নেতা সাহেব।”
হোহো করে এসে ওঠে শিখন।
“অবশেষে আমার তন্দ্রাহরণীর অভিমান ভাংগলো তবে!”
——–
ক্লাস শেষে ভার্সিটির ক্যাম্পাস হতে বেরোতে নিতেই ফোন বেজে ওঠে শিখনের। কল রিসিভ করে সালাম দিতেই ওপর পাশ হতে সালামের জবাবসহ এক অতি পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসে। তবুও না চেনার ভান করে শিখন বলে ওঠে,
“কে বলছেন?”
“আমি তোমার বাবা বলছি। আমার নাম্বারটাও তোমার ফোনে সেভ নেই?”
“দুঃখিত। আমি একজন এতিম। আর অপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসই আমি আমার সংগ্রহে রাখিনা। কি বলতে কল দিয়েছেন তাই বলুন।”
“তুমি নিজের মানসম্মানের পরোয়া করো না ঠিক আছে। তবে আমার মানসম্মান খোয়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছো কেন?”
“কি বলতে চাইছেন ডিরেক্ট বলুন।”
“আজ এমপি সাহেব মানে জাহিদ মির্জা স্বয়ং নিজে আমাকে কল দিয়েছিলেন। তিনি বললেন যে, তুমি নাকি তার হবু পুত্রবধুর পেছনে ঘুরঘুর করছ। আমি জানতাম তুমি অ’ভ’দ্র। কিন্তু তুমি যে এত নিচে নেমে গেছো তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।”
সাকলাইন খানের কথায় মাথায় একরাশ রা’গ চেপে বসে শিখনের। বাজখাঁই কন্ঠে বলে ওঠে,
“না জেনে বুঝে অন্যের কথায় না’চা’র অভ্যাস আপনার আগে থেকেই আছে তা আমি জানতাম। ভালো করে শুনে রাখুন মি. সাকলাইন খান, শি ইজ মাই ফিয়োন্সি। সামনেই আমাদের বিয়ে। অগ্রিম দাওয়াত থাকল। স্ব পরিবারে আসবেন। আর ফের এমপি সাহেব কল দিলে বলবেন, আপনি আমাকে চেনেন না।”
কল কেটে দিয়ে সোজা ভার্সিটির ক্যান্টিনের দিকে চলে যায় শিখন। ক্যান্টিনের ভেতরেই জয় তার লোকজন নিয়ে বসে আড্ডা দেয়। শিখনকে রা’গা’ন্বিত হয়ে ক্যান্টিনের ভেতরে ঢুকতে দেখে উপস্থিত সকলে থমকে যায়। জয় চেয়ার হতে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাট্টার সুরে বলে ওঠে,
“আরে ভিপি সাহেব যে?”
শিখন ছুটে গিয়েই জয়ের কলার চেপে ধরে।
“আমার ব্যক্তিগত জীবনে বা হাত না ঢু’কালেই নয়? আমার ওপর যদি রাগ থেকেই থাকে কিছু নিয়ে তবে তা আমার ওপর দেখাও। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিষয় এবং আমার ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে টানাটানি করাটা তো একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাচ্ছে জয়। অসিফার থেকে দূরে থাকো। ভুলেও ওইদিকে চোখ দিও না। নতুবা তোমাকে সারা জীবন পস্তাতে হবে।”
জয়ের কলার ছেড়ে দিয়ে হনহন করে ক্যান্টিন হতে বেরিয়ে যায় শিখন। সে পারতো রা’গের বশে জয়ের নাক-মুখে দুই-তিন ঘা বসিয়ে দিতে। কিন্তু শিখন বিচক্ষণ মানুষ। সে তা করেনি। ওই যে কথায় আছেনা? “রে’গে গেলেন তো হেরে গেলেন!”
চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা