#বোবা_টানেল (০২)
প্রিয় তন্দ্রাহরণী,
হারালে তো হারালেই সাথে করে তোমার প্রেমিকের দুচোখের ঘুমও কে’ড়ে নিয়ে গেলে। তোমার নেতা সাহেব যে প্রেমিক হিসেবে বড্ড কাঁচা। না না বলতে পারো পুরো মানুষটাই কাঁচা। কাকে আগলে রাখতে হয় আর কাকে দূরে যেতে দিতে হয় তা সে জানেইনা। তোমার নেতা সাহেব যে ভালোবাসতেই বড্ড ভ’য় পায়। তাকে কেউ কখনও তো তোমার মতো ভালোবাসেনি তাই তোমার ভালোবাসারও কদর সে করতে পারেনি। এখন কোথায় খুজব তোমায় আমি? এই বিল্ডিং এর প্রতিটা কোণায় কোণায় জমে থাকা তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে দিচ্ছেনা ভালো থাকতে। যখন দোতলায় নেমে দাড়াই, মনে হয় এই বুঝি দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে তুমি আর খিলখিল করে হেসে উঠে ‘নেতা সাহেব’ বলে আমায় ডেকে উঠবে। কিন্তু তুমি তো আর আসোও না আর আমায় ডাকোও না। এখন কে আমায় ‘নেতা সাহেব’ বলে ডাকবে?
কথাগুলো বলতে বলতেই এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে শিখনের চোখ হতে। আচমকা কারো কন্ঠ কানে বাজতেই দরজার দিকে তাকিয়ে পড়ে সে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে চিরচেনা এক ব্যক্তির ঝাপসা অবয়ব চিনতে ক’ষ্ট হয়না শিখনের। সেই অবয়বকে উদ্দেশ্য করে গলা খা’কারি দিয়ে বলে ওঠে,
“হঠাৎ আমার রুমের বারান্দায় মিঃ সাকলাইন খানের আগমন যে? কোনো দরকার?”
“আমাকে বাবা বলে ডাকলে কি তোমার মুখে ফো’স’কা পড়ে যাবে?” বলতে বলতে শিখনের দিকে এগিয়ে আসেন সাকলাইন খান।
“এই ধরেন তাই-ই। আমার বাবা নেই। আমার কেউই নেই আমি একা।”
“তুমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করো। এই অন্ধকারে বারান্দায় বসে আছো কেন? শুনলাম তুমি নাকি অনেক রাত করে করে বাসায় ফেরো। দেখো ভালোয় ভালোয় বলে দিচ্ছি, আমার খেয়ে-পরে তুমি অ’বা’ধ্যের মতো চলতে পারবেনা।”
“এই খবর আপনাকে কে দিয়েছে? আপনার বউ? এত বছরে গতকালই প্রথম অনেক রাত করে ফিরেছি আমি। ইম্পর্টেন্ট মিটিং ছিল একটা। যা বুঝলাম আমার জন্য বোধ হয় আপনার বউয়ের অনেক অসুবিধা হচ্ছে। তাকে রিল্যাক্স হতে বলুন। আমি আগামীকাল ভার্সিটির আবাসিক হলে শিফট হয়ে যাচ্ছি।” বলেই ধপাধপ পা ফেলে বারান্দা ছেড়ে নিজের রুমে চলে যায় শিখন।
সাকলাইন খান চুপচাপ ঠায় বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে থাকেন।
তিনদিন হলো শিখন বাসা ছেড়ে হলে উঠেছে। সে ভেবেছিল বাসা ছেড়ে দূরে গেলে বোধ হয় কষ্ট একটু কম হবে। সিড়ি বেয়ে ওঠা নামার সময় দোতলায় গিয়ে আর থমকে দাড়াবেনা সে। অসিফার হাসি হাসি মুখখানা মনে পড়ে আর হৃদয় পু’ড়ে উঠবে না তার। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? এখন তো সে দ্বিগুণ হারে পু’ড়’ছে। শিখন বিল্ডিং এর নিচতলার ভাড়াটিয়াদের থেকে জেনেছে অসিফার ফ্যামিলি কুমিল্লাতে শিফট হয়েছে। এরপর থেকেই তার মন চাইছে ছুটে কুমিল্লাতে চলে যেতে। কিন্তু সে কুমিল্লাতে গিয়ে কোথায় খুজবে অসিফাকে? পুরো একটার জেলার অত মানুষের ভীড়ে কি আদৌ তার তন্দ্রাহরণীকে খুজে পাওয়া সম্ভব?
–
“অসিফা খেয়েছে?”
বলেই মুখে এক লোকমা ভাত তুলে নেন আসিফ খন্দকার।
আসিফ খন্দকারের প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে নিলুফা বেগম বলে ওঠেন,
“হ্যা খেয়েছে। ওকে খাইয়ে দিয়েই তোমাকে খাবার দিতে এলাম। একটু পরে ঔষুধ খাইয়ে দিয়ে আসব।”
“ঔষুধ ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখবা নিলুফা। আপাতত ঘরের কাজ কম করে আমার মেয়ের দিকে খেয়াল রাখো। আমার ফুলের মতো সতেজ মেয়েটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে হঠাৎ। রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনা আমি মেয়েটার টেনশনে।”
“তুমি টেনশন করো না তো। আমাদের মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে একদম।”
“বুঝলে নিলুফা,তুমি ভালোই স্ট্রং।”
“হ্যা বুঝেছি। এখন তুমি খাওয়া শেষ করে দ্রুত ঘুমাতে যাও। আমি মেয়েকে ঔষুধ খাইয়ে দিয়ে আসি।”
নিলুফা দ্রুত ডাইনিং রুম থেকে প্রস্থান করে অসিফার রুমে প্রবেশ করেন।
“অসিফা উঠে বস ঔষুধ খেতে হবে।”
“এত ঔষুধ খেতে খেতে তো আমি পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছি মা।”
নিলুফা বেগম একগাল হেসে অসিফার কপালের ওপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দেন। নিলুফা বেগমের আদুরে আচরণে অসিফা আচমকা হুহু করে কেঁদে ওঠেন। অসিফার কান্না দেখে নিলুফা বেগমের আর বুঝতে বাকি রইল না যে সে কাঁদছে কেন। তার মেয়েটা ইদানীং হুটহাট কেঁদে ওঠে। বিশেষ করে তাকে একটু কোমল হতে দেখলেই মেয়েটা যেন লাই পেয়ে যায়। সন্তানের কান্না দেখতে কোন মায়েরই বা ভালো লাগে? তাই নিলুফা বেগম ইদানীং মেয়ের সামনে তেমন একটা কোমলভাব প্রকাশ করেন না। নিজ চোখে মেয়ের কান্না দেখে দেখে বুকটা পু’ড়ে ছারখার হয়ে গেছে নিলুফা বেগমের। সে চায় তার মেয়েটা এবার উঠে দাড়াক।
“মা শিখন ভাই আমাকে একটু ভালোবাসল না কেন?” ওই মেয়েটার প্রতি শিখন ভাইয়ের ভালোবাসাটা কেন আমার হলো না? মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাব।”
অসিফা কথা শেষ করতেই নিলুফা বেগম মেয়ের চেপে ধরেন।
“চুপ একদম চুপ। তুই আমাদের একটা মাত্র মেয়ে। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর বাবার আর আমার কি হবে? কুমিল্লায় আসার পরের দিন যখন তুই সে’ন্স’লে’স হয়ে পড়ে গেলি, তখন যদি তোর বাবার অবস্থাটা একবার নিজের চোখে দেখতে পারতি তাহলে বোধ হয় তোর এই দমবন্ধকর পরিস্থিতও অতি ন’গ’ণ্য মনে হতো নিজের কাছে। কিভাবে যে ওই মানুষটা হসপিটালের করিডোরে বসে ছটফট করেছে তা শুধু আমি আর হসপিটালের ডাক্তার এবং নার্সরা দেখেছে। তোর ভালোবাসাটা ভুল না। তবে ভালোবাসা ডেলিভার করার জায়গাটা ভুল। ছেলেটারও তো দো’ষ নেই। তুই যেমন ওর জন্য ফিল করিস ও তো ওই মেয়েটার জন্য ঠিক তেমনটাই ফিল করে। তুই এখনো অনেক ছোট মা। নিজেকে একটু সামলে নে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই বয়সে এরকম বহু আ’ঘা’ত লাগবে। সেগুলো থেকে যারা ওভারকাম করতে পারে তারাই জীবনে এগিয়ে যায়। তোর বাবার কিন্তু তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন মা। ওই মানুষটাকে আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানাইনি নাহলে যে সে প্রচন্ড ক’ষ্ট পেত। তোর বাবা এবং আমার জন্য অন্তত তুই স্ট্রং আর স্বাভাবিক হয়ে যা মা। ঘুমা এখন মা।”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিলুফা বেগম আর এক মুহূর্ত রুমে দাড়ান না। তিনি চান এখন অসিফা ভাবুক তার উঠে দাঁড়ানো নিয়ে,প্রচুর ভাবুক। নিলুফা বেগম অসিফার রুমের লাইট অফ করে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে জান।
নিলুফা বেগমের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তবে অসিফার গালে হয়তো হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ আলবাত পড়ত। এদেশের অধিকাংশ বাবা-মায়েরা অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের মুখে যদি ভালোবাসার কথা শোনে বা তার এ্যাফেয়ার সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে সেই সন্তানের আর নিস্তার নেই। কিন্তু নিলুফা বেগম বিচক্ষণ মানুষ। সন্তানকে যদি তার বাবা-মা ই না বোঝে তবে আর কে বুঝবে? সন্তানকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ভুল পথ হতে সরিয়ে আনা বাবা-মায়েরই দায়িত্ব। সন্তানের খারাপ সময়ে তার পাশে দাড়ানোটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সব বাবা-মায়েরাও বুঝে উঠতে পারেন না। কারণ এই বয়সেই একটা মানুষ ঝরে পড়লে আর সে উঠে দাড়াতে পারেনা। তাই তাদের জন্য কঠিনতর ঢাল হয়ে দাঁড়ানো উচিত প্রত্যেকটা বাবা-মায়েরই। যা নিলুফা বেগম করে দেখিয়েছেন।
মায়ের কথায় অনেকটা হালকা হয় অসিফা। তার মনের ভেতরে বাজতে আরম্ভ করে,”শুধু শুধু সে কেন ক’ষ্ট পাচ্ছে? তার ক’ষ্টের বার্তা কি শিখন অব্দি পৌছায়? তবে কেন সে ওই মানুষটার জন্য কষ্ট পাবে? আজ থেকে শিখনের কথা সে ভাববেও না। শিখনকে লেখা জমিয়ে রাখা চিঠিগুলো সব আ’গু’নে পুড়িয়ে ফেলবে। চোখের নিচে আর ডার্ক সার্কেল পড়তে দেবে না সে।”
সকালে হতেই নিলুফা বেগম ও আসিফ খন্দকারকে চমকে দেয় অসিফা। সবার আগে এসে ডাইনিং হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে অসিফা। মেয়ের পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়েন আসিফ খন্দকার। মনটা যেন তার প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে। আজ ঠিক কতগুলো দিন পরে মেয়ের মুখে হাসি দেখছেন তিনি। নিলুফা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। তার ডোজ তবে কাজে দিয়েছে।
—-
সময় চোখের পলকে অতিবাহিত হয়ে যায়। তেমনি ভাবেই তিনটা বছর পার হয়ে গেছে।
শিখন তার দলের লোকদের সাথে কথা বলতে বলতে রাস্তার কিনারায় এসে দাড়িয়েছে গাড়ির জন্য। বর্ষাকাল হওয়ায় আকাশ বেয়ে ক্ষানিক বাদে বাদেই বৃষ্টি নামছে। যার জন্য রাস্তার কিনারায় কিনারায় পানি জমে রয়েছে। শিখন কিছুক্ষণ বাদে বাদেই ঘড়িতে সময় দেখছে আর বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফে’ল’ছে। ক্যাম্পাসে কি নিয়ে যেন তুমুল ঝা’মে’লা শুরু হয়েছে যার কারণে জরুরিভাবে ডাক পড়েছে শিখনের। ভার্সিটির ভিপি হওয়ায় প্রায় ঝা’মে’লা’ই তার সামলাতে হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছেনা। ফোনের ওপর ফোন এসেই চলেছে আর এদিকে গাড়ি না পেয়ে রা’গে ফেটে চৌ’চি’র হয়ে যাচ্ছে শিখন।
আচমকা শিখনের পাশ ঘেষে একটা স্কুটি যেতেই রাস্তার পাশে জমে থাকা পানি আর কাদা ছি’টে শিখনের সাদা পাঞ্জাবীতে লেগে যায়। একবার নিজের গায়ের দিকে তাকিয়ে শিখন হুং’কার দিয়ে বলে ওঠে,
“এই স্কুটিওয়ালী দেখে স্কুটি চালাতে পারেন? চোখ কি কপালে তুলে রাখেন নাকি?”
কিছু দুর গিয়ে স্কুটিটা থেমে যায়। স্কুটিতে থাকা মেয়েটা সন্তপর্ণে শাড়ির কুচি সামলে নিয়ে শিখনদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মেয়েটার চোখে-মুখে তীব্র অ’প’রা’ধবোধ দৃশ্যমান। কিছু দূর এসেই দাঁড়িয়ে পড়ে সে। শিখন রা’গা’ন্বি’ত দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকাতেই ক্ষানিক বাদে চোখের চাহনিতে শীতলতা নেমে আসে তার। মেয়েটাকে আর এগোতে না দেখে টলমলে চোখে শিখন নিজেই তার দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে। কিন্তু উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে মেয়ে আচমকা নিজের মুখ চেপে ধরে ঘুরে আবার নিজের স্কুটির দিকে দৌড় লাগায়। শিখন সে অব্দি পৌছানোর আগেই মেয়েটা স্কুটি নিয়ে উপস্থিত সকলের দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে যায়।
চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা