#বেলা_শেষে- ২
[১২]
চারবছর ধরে চাচি তার নাতিকে নিয়ে এখানে আছে। বছর চারেক আগে নদী ভাঙনে তার ভিটামাটি, স্বামি সন্তান কে হাড়ায়। চাচির ছেলের মৃত্যর পর তার ছেলের বউ দুই বছরের বাচ্চা রেখে দ্বিতীয় বিবাহ করে। সব হাড়িয়ে দুই বছরের এই বাচ্চা নিয়ে শহরের বুকে পাড়ি জমায় সে। কোথাও কোন কাজ না পেয়ে ফুটপাত একটা মাদুর বিছিয়ে নাতিকে নিয়ে শুয়ে ছিলো তারা। সেদিন রাতে আহাদের বাড়িতে একটা ব্যাচেলার পার্টি ছিলো আমাদের। আমি আর অয়ন এতটাও ড্রিকং করছিলাম না যে আমাদের বোধ বুদ্ধি হাড়িয়ে যাবে। ড্রিংক করে সবাই ফুটপাতের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম এমনি সময় দেখি কনকনে শীতের মধ্যে একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে নাতীকে নিয়ে শুয়ে আছে চাচি। সেদিন আমরা বন্ধুরা মিলে চাচি ও তার নাতিকে আমাদের এই বাগান বাড়িতে নিয়ে আসি। তারপর থেকে ওনারা এখানেই থাকেন।
ভাইয়ার কথা শুনে কিংচিৎ মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকালাম। একটা মা ঠিক কতটা স্বার্থপর হলে এইটুকু একটা বাচ্চা রেখে তার জিবন নতুন করে শুরু করে। হ্যাঁ মানছি তার জিবনকে একটা নতুন সুযোগ দেওয়া উচিৎ তাই বলে সে বাচ্চাটার কথা একবারও ভাববে না। এই বাচ্চাটা তার জিবন থেকে কি পেলো। না পেয়েছে বাবার স্নেহ আর না পেলো মায়ের ভালোবাসা। আমি বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলাম। ভাইয়া এখনো বাচ্চাটাকে তার বাহুডোরে আবদ্ধ করে রেখেছে। আর বাচ্চাটাও ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে কখনো ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খাচ্ছে আবার কখনো গালে, কখনো কপালে চুমু খাচ্ছে। নয়তা ভাইয়ার গালের সাথে তার গাল ঘসে খিলখিল করে হাসছে। ভাইয়াও তার সাথে হাসছে। কি প্রাণউচ্ছল হাসি দুজনের।
কিছুক্ষণ পর চাচি ড্রাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমাদের ডাকালেন। আমরা চাচির ডাক অনুসারণ করে ড্রাইনিং এ গিয়ে বসলাম। তারপর ভাইয়া বাচ্চাটাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেলো। আমি খাওয়ার ফাঁকেফাঁকে ভাইয়াকে দেখছিলাম শুধু। আগে কখনো ভাইয়াকে এমন প্রাণউচ্ছল ভাবে হাসতে দেখিনি। কোন বাচ্চার সাথে এমন ভাবে মিশতে দেখি নি। এমনি কি ভাইয়ার ভয়ে আমার ভাই স্পর্শও খন্দকার বাড়িতে আসতে চয়না। আর সেই ভাইয়া কি একটা বাচ্চাকে কোলে নি আদর করছে তাকে খাইয়েও দিচ্ছি। সত্যি বলতে আমি ভাইয়ার থেকে এটা কখনো আশা করিনি।
সন্ধার পর বাসায় ফিরে আসি আমরা। ফিরে এসে মামনিকে সব খুলে বললাম আমি। সব শুনে মামনি বললা, এটা তো গত চার বছর ধরেই হচ্ছে। তোর সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে না খেয়ে বের হয় এটা ঠিক। কিন্ত পরে ও বাড়িতে গিয়ে ওই বৃদ্ধাকে দিয়ে ভূনা খিচুড়ি রান্না করিয়ে তারপর পেট পুরে খেয়ে বাড়ি ফিরে। মামনির কথা শুনে আমি আর কিছু বললাম না। মৃদু হাসলাম। তারপর মামনিকে বিদায় জানিয়ে চলে আসবো এমনি সময় ভাইয়া বলে উঠে,
– আজ তুই কোথাও যাচ্ছিস না মিষ্টি। কাল সকালে আমি তোকে বাড়ি পৌঁছে দিবো। আম্মু তুমি আন্টিকে কল করে জানিয়ে দাও মিষ্টি আজ ফিরবে না।
ভাইয়ার কথা শুনে মামনির বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
– এটা কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা।
– উহঃ আম্মু তোমাকে যা বলছি তাই করো। এই রকম একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে আর যাই হোক যুদ্ধ করা যায় না। শরীরে এক কিলো মাংস নেই সে নাকি যুদ্ধ করবে। বিরক্তি সহিত বলল ভাইয়া। ভাইয়ার কথা শুনে আমি ভ্রু কুচকিয়ে তাকালাম তার দিকে। ইন ডিরেক্টরি আমাকে অপমান করছে। কাঁদোকাঁদো মুখ করে মামনির দিকে তাকালাম। কি বলবো তার আগেই দাদি বলে উঠে,
– যুদ্ধ করা যায় না সেটা বুঝলাম। তাহলে এই বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে কি করা যাবে।
দাদির কথা শুনে ভাইয়া তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার মুখশ্রীর দিকে। ওষ্ঠদ্বয় চেপে হসে বিরবির করে বলল,
– এই বাচ্চা মেয়েটাকে শুধু ভালোবাসা যায় দাদি।
– কি বললি। [মামনি]
– নাহ। মিষ্টি আমার জন্যে এক কাপ কফি করে নিয়ে আয় আমার রুমে। বলেই ভাইয়া হনহন করে উপরে চলে গেলো। আমিও চলে যাওয়ার জন্যে জোর করলাম না। থেকেই যাই না। যদি মামনির কাছ থেকে কিছু জানতে পারি। কি হয়েছিলো আরাভ আংকেলের সাথে। দুইবছর কোথায় ছিলো তারা দুজনে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সব জানতে পারছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই। মামনির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম। আমার এমন ভাবে তাকিয়ে থাকা থেকে মামনি আমার সামনে তুরি বাজিয়ে বলল,
-কি দেখছিলাস এভাবে? অভিকে কফিটা দিয়ে আয়। না হলে আবার চেঁচামেচি শুরু করে দিবে।
– ও হ্যাঁ, হ্যাঁ যাচ্ছি।
কফি নিয়ে ভাইয়ার রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে দরজা লক করে দিলো।
– এতক্ষণ লাগে এক কাপ কফি করতে। আমি কখন থেকে ওয়েট করছি তোর কোন আইডিয়া আছে।
– কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছো তুমি। রুমে এসেছো তো দশ মিনিট হবে।
– এই দশ মিনিট আমার কাছে দশ ঘন্টার মতো লাগছে। জানিস তো অপেক্ষার সময়গুলো কতটা দীর্ঘ হয়।
– হু। এই নাও তোমার কফি। কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললাম আমি। ভাইয়া আমার হাত থেকে কফির মগ নিয়ে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়াল তাতে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– কফিতে মিষ্টি দেসনি!
– দিয়েছি তো।
– দেসনি। তুই টেষ্ট করে দেখ। আমার সামনে কফির মগ ধরে বলল।
– ঠিক-ই তো আছে। আমি কফির স্বাদ নিয়ে বললাম। অতঃপর ভাইয়া আমার। হাত থেকে কফির মগ নিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– এবার ঠিক আছে। আমার মিষ্টি পেয়ে গেছি। তারপর আমার দেওয়া অধরের স্পর্শ সেখনে সেই সেই খানটায় নিজের ওষ্ঠ ঠেকিয়ে কফির খেল ভাইয়া। এদিকে ভাইয়ার এমন কান্ডে বেশ লজ্জা লাগছে আমার। মাথা নিচু করে মুখের উপর পরে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দেওয়ার চেষ্টা করছি আমি। আর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ঠোট চেপে হাসছে আর কফি খাচ্ছে।
– আ- আমি আসছি। বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালাম চলে আসার জন্যে। আর তখনি ভাইয়া আমার হাত ধরে ফেলে। কফির মগ রেখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– ছাদে ওয়েট করবো।
মাথা তুলে ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি। ক বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন আমার কি বলা উচিৎ। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ভাইয়ার দিকে। তখন ভাইয়া আমার বলে উঠলো,
– আসবি তো?
– যদি না আসি!!
– তাহলে ছাড়ছি না।
– কখন আসতে হবে। অতঃপর ভাইয়া আমাকে একটা নিদিষ্ট সময় বলে দেয়। আর আমি সেখান থেকে চলে আসি।
মামনির রুমের সামনে দাড়িয়ে হাত কচলাচ্ছি আমি। ভিতরে যাব কি যাব না সেটাই ভাবছি আমি। আচ্ছা এখন মামনির কাছে যাওয়াটা ঠিক হবে। ফিরে যাব আমি। কিছুক্ষণ পর তো ছাদে যেতে হবে ভাইয়া অপেক্ষা করবে। আংকেও এখন রুমে আছে এই সুযোগ টা মিছ করা যাবে না কিছুতেই। সমস্ত ভাবনা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দরজায় টোকা দিলাম আমি। আর অপেক্ষা করতে লাগালাম কখন দরজা খুলবে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পরেও যখন কেও দরজা খুলছে না তখন আমি আবারও দরজায় টোকা দিলাম। আর তখনি আরাভ আংকেল এসে দরজা খুলে দেয়। এই সময়ে আমাকে তার দরজার সামনে দেখে বেশ অবাক হয় আরাভ আংকেল। সে অবাকের সুরে বলে,
– মিষ্টি তুমি এখানে!!
আমি আংকেল প্রশ্নের প্রতিউত্তরে কোন জবাব দিলাম না। সোজা রুমের ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমার কোন জবাব না পেয়ে আংকেন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাে আমার দিকে তারপর দরজা লক করে চলে আসে। আমি রুমে এসে দেখি মামনি বিছানায় বসে আছে। আমি গিয়ে মামনির পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ তারপর মামনির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরি। ততক্ষণ আংকেলও চলে আসে। মামনি আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকে তখন আংকেল বলে উঠে,
– কি হয়েছে মিষ্টির। নিশ্চয় অভি আবার কিছু করেছে। মিষ্টি মামনি বল আমাকে কি করেছ ওই হতছ্ছেরা।
– ভাইয়া কিছুই করে নি আংকেল। তুমি শুধু শুধু ভাইয়াকে বকছো। উঠে বসে বললাম আমি।
– তাহলে আমার আম্মুটার মন খারাপ কেন? মামনির আমার চিবুক ধরে বলল। আমি নিরব চোখে কিছুক্ষণ মামনির দিকে তাকিয়ে রইলাম।তারপর অস্ফুটভাবে বললাম,
– মাহিন তোমাদের সাথে কি করেছিল মামনি। ভাইয়া বলছিলো মাহিন নাকি একজন ধর্ষক, তবে কি সে,,
– না। মাহিন ভূমির কোন ক্ষতি করতে পারে নি। আমার পুরো কথাটা শেষ করার আগেই বলে উঠলো আংকেল।
– তাহলে সে কি করেছিলো তোমাদের সাথে! দুই বছর কোথায় ছিলে তোমরা??
আমার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালো মামনি আর আংকেল। তারা হয়তো ভাবতে পারে নি আমি এই প্রশ্ন করে বসবো। আরাভ আংকেল আর মামনি একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর মামনি বলতে লাগলো,
– আমার কোন ক্ষতিই করতে পারে নি মাহিন। তবে সে চেষ্টা করেছে। প্রথম যে দিন দিগন্তের বাসায় আমাকে দেখেছিল তখন থেকেই মাহিনের ললাসুদৃষ্টি ছিলো আমার উপর। পর পর কয়েকবার আমার উপর আক্রমণ করেছে। কিন্ত সফল হয়নি। সেদিন ছিলো আমাদের কলেজের বসন্ত উৎসব। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমি অভিকে বাসায় রেখেই কলেজে যাই। আরাভ আমাকে কলেজে পৌছে দিয়ে অফিসে চলে যায়। অফিসের সব কাজ রাকিব ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে কলেজে আসতে চেয়েছিলো সে। কিন্ত ভাগ্য সেদিন আমাদের সহায় ছিলো না। প্যান্ডেলের ভিতরে বসে বসন্ত উৎসবের নাচ গান দেখছি এমনি সময় একটা মেয়ে এসে আমাকে বলে, আরাভ নাকি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আর সে আমাকে সেখানে যেতে বলছে। আরাভ যেহেতু বলেছিল সে রাকিবকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসবে তাই আমি মেয়েটার কথা বিশ্বাস করে রাস্তায় চলে আসি। আর তখনি পিছন থেকে কেও আমার মুখে রুমাল চেপে ধরে। আমার ছুটার জন্যে ছটফট করতে থাকি এমনি কেও অন্য একজন এসে আমার মুখে স্প্রে করে আর আমার সেন্সলেন্স হয়ে পরি। পরে যখন আমার ঞ্জান ফিরে তখন একটা অন্ধকার রুমে নিজেকে আবিষ্কার করি।
#চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।