#বেলা_শেষে- ২
[০৭]
সুফায় আয়েশ করে বসে বুকে কুশন জড়িয়ে টিভি দেখছি। পাশেই মামনি বসে বসে তার হাতের কাজ করছে। কিছুক্ষণ আগে আংকেল অফিসে চলে গেছে। খানিকক্ষণ বাদে ভাইয়া তার লাগেজ নিয়ে নিচে আসলো। আমি আড় চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম তখন তার দৃষ্টি ছিলো মামনির দিকে। সে এসে মামনিকে জড়িয়ে ধরলো। মামনিও তার ছেলেকে আদর করলেন। তাদের এমন ভালোবাসাময় মুহূর্তে দেখে বুঝতে পারলাম ভাইয়া কোথাও যাচ্ছে। কিন্ত কোথায় যাচ্ছে সে। আজ তো দাদুরা আসছে। দাদু এসে যদি ভাইয়াকে দেখতে না পায় তবে অনেক চেঁচামেচি শুরু করে দিবে। এটা জানার পরেও আজই ভাইয়াকে আজ চলে যেতে হবে। নাকি কাল রাতে নেশা করার জন্যে আমার উপর রাগ করে ভাইয়া চলে যাচ্ছে। আমার তো কিছুই মনে পরছে না। কাল যে আমি কি বলেছি ভাইয়াকে আল্লাহ ভালো জানে। আমি উৎসুক দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– তুমি কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া।
আমার কথা মনে হয় ভাইয়ার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। মামনির সাথে কথা বলে চলে গেলো। এদিকে আমি এখনো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার চলে যাওয়ার দিকে। এই সাহেবটার আবার হলো কি। আমাকে এভাবে ইগনোর কেন করছে। ভাইয়া চোখের আড়াল হতেই আমি ইনোসেন্ট মুখ করে মামনির দিকে তাকালাম। অতঃপর বললাম,
– তোমার হিটলার ছেলেটার আবার কি হলো বলতো?? মামনি আমার কান টেনে ধরলো। আর বলল, খুব দুষ্ট হয়েছিস।
– আহঃ মামনি ছাড়ো না। কি করছো তুমি আমার কানটা যদি ছিঁড়ে যায় তখন কি হবে। মামনি আমার কান ছেড়ে দিয়ে বলল,
-চট্টগ্রাম যাচ্ছে। নিউ ব্লগের কাজে।
-ওহ। তারপর আমি মনোযোগ দিলাম টিভি দেখায়। আর মামনি তার হাতের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন।
ভাইয়া চলে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হলো। এই এক সপ্তাহে তার সাথে আমার কোন কথা হয়নি। গত কাল আমি আমাদের বাড়ি চলে আসছি। আব্বু আম্মু স্পর্শ সবাই চলে এসেছে। তাই আমিও চলে আসছি ও বাড়ি থেকে। আগে ভাইয়া যখন ব্লগের কাজে কোথাও যেতো তখন তাকে কিছুক্ষণ পরপর কল করতাম। এবার আর সেটা করিনি। ভাইয়ার চট্টগ্রাম যাওয়ার দ্বিতীয় দিন তার বান্ধুবির সাথে একটা ছবি আপলোড করে সোসাইল মিডিয়ায়। যেখানে তার বান্ধুবি এ্যনি তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ছবিটা দেখে আমার কেন জানি খারাপ লাগতে শুরু করে। বুকের ভেতরে চিনচিন এক ব্যথা অনুভব করি আমি। ভাইয়ার পাশে এ্যনিকে মেনে নিতে পারছিলাম না আমি কোন ভাবেই ।ভাইয়ার উপর রাগ করে আমি সেই অপরিচিত লোকটার সাথে কথা বলতে শুরু করে দেই। তার সুন্দর ভয়েজ আর সুন্দর কথায় আমিও তার প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পরি। এখন রোজ রাতে তার সাথে নিয়ম করে কথা হয় আমার। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে মামনির সাথে দেখা করাবো আর মামনিকে তার সম্পর্কে বলবো। আমার ব্যপারে মামনি যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে। কারন আব্বু আম্মু আমার কথা না শুনলেও মামনির কথা ঠিক শুনবে। আমি মামনিকে চোখ বন্ধকরে ভরসা করতে পারি।
কলেজের পাশে বড় রাস্তায় মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর অর্ণা। ওই ছেলেটাকে আমি এখানেই আসতে বলেছি। সে আসলে আমি তাকে নিয়ে সোজা মামনির বাসায় চলে যাব।সকালে মাননিকে সব বলে রেখেছি আমি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমি আর অর্ণা কথা বলছি তখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়লো এক সুদর্শন ছেলে। ঠোঁটের কোনে আলতো হাসির রেখা টেনে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ছেলেটাকে দেখে আমি ভ্রু কুচকিয়ে তাকালাম তার দিকে। কারন এই ছেলেটাকে আমি চিনতে পারছি না। তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে তো আমার মনে পরছে না। আমার কপালে আপনা আপনি চিন্তার ভাজ পড়লো। ভ্রু কুচকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বেটা খবিশ। আমার কথা ছেলেটার কর্ণপাত হলো না। সে আগের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার এমন চাহনি দেখে আমার রাগ হলো। তার সামনে তর্জনী তুললাম কিছু বলার জন্যে তখনি অর্ণা আমার হাত ধরে বলে,
– কি করছিস তুই মিষ্টি। ওনার সাথে এরকম বিহ্যাভ কেন করছিস?
-এই তুই চুপ কর। ছেলেদের হয়ে একদম সাফাই করবি না। দেখছিস না কি ভাবে তাকিয়ে আছে আমি ওনার চোখ তুলে নিবো। আমার এমন চটে যাওয়া দেখে অর্ণা আমাকে টেনে ওই ছেলেটার থেকে একটু দূরে এনে দাঁড় করালো। অতঃপর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
-বইন এসব কি বলছিস তুই। এতক্ষণ কষ্টকরে ওনার জন্যে অপেক্ষা করে এখন ওনার সাথেই কোমড় বেধে ঝগড়া করছিস। তুই এসব কি করে পারিস বলতো। অর্ণা কথা শুনে আমি ইনোসেন্ট মুখ করে ওর দিকে তাকালাম। অর্ণা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দিলে আমি ওই সুদর্শন ছেলের দিকে অসহায় ফেস করে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সরি বলে নেই। এতে ছেলেটা স্মিত হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকায়।
-হায় আমি জিয়ান হায়দার। হ্যান্ডসেক করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল সেই সুদর্শন ছেলেটা। আমি তার সাথে হ্যান্ডসেক করলাম না। এমনি হাসি মুখে বললাম,
– আশফিয়া হাসানাত মিষ্টি। অতঃপর তার সাথে কথা বলে তাকে নিয়ে মামনির বাসার দিকে রওনা দিলাম।
বাসায় ডুকে দেখি মামনি রান্নাঘরে কাজে ব্যাস্ত। আরাভ আংকেলও বাসায় এখন। ড্রয়িংরুম বসে বসে কফি খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। আমি ড্রয়িংরুমে ডুকে জিয়ানকে ইশারা করে আংকেলকে দেখিয়ে দিলাম। জিয়ান আংকেলকে সালাম দিয়ে তার সাথে আলাপ করতে লাগলো। আমি চলে গেলাম রান্নাঘরে। সেখানে গিয়ে আগে মামনিকে জড়িয়ে ধরলাম। মামনির ঘমাক্ত শরীর নিয়ে রান্নাঘরে কাজ করছে দেখে আমাকে বলল,
-কি করছিস মিষ্টি, দেখছিস তো আমার শরীর কেমন ঘেমে একাকার। আর তুই এই অবস্থায় আমাকে জড়িয়ে ধরছিস। এখানে খুব গরম ড্রয়িংরুমে যা। বস গিয়ে।
-উহঃ মামনি তুমিও না। রান্নাঘর তো প্রতিটা মেয়ের কর্মস্থল। মেয়েরা যতই উচ্চশিক্ষত হোক না রান্নাঘরে তাদের আসতেই হয়। যেমন দেখ তুমি। একজন ল-ইয়ার হয়েও এখন হাউজওয়াফ হিসাবে জিবন যাপন করছো। আমার কথা শুনে মামনি কাজ থামিয়ে থমকে দাঁড়ালো। চোখ মুখ শক্তকরে সমনের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি মামনির অবস্থা বুঝতে পেরে বললাম,
-সরি মামনি।আসলে আমি কথার কথা বলে ফেলেছি।
– ঠিক আছে। এখন এখান থেকে চলে যা। কড়া গলায় বলল মামনি। মামনির কথা অবাধ্য হওয়ার সাধ্যি নেই আমার। নিঃশব্দে প্রস্থান করলাম আমি।
ড্রয়িংরুমে এসে আংকেলের পাশে বসলাম আমি। আংকেল এখনো জিয়ানের সাথে কথা বলছে। জিয়ানের কাজের ব্যপারে কথা বলছে এখন। আমি জিয়ানের দিকে তাকাতেই সে একটা হাসি উপহার দিলো সে। সৌজন্যতার খাতিরে আমিও হাসলাম। তারপর বসে বসে ওনাদের কথা শুনতে লাগলাম। ততক্ষণে দাদুভাই দাদি এখানে এসে আংকেলের পাশে বসে জিয়ানের সাথে কথা বলছে। এমনি সময় ল্যান্ডফোনে ফোন আসলো। আমি গিয়ে কল রিসিভ করলাম। ওপাশের গলার আওয়াজ শুনে কিছুসময়ের জন্যে থমকে যাই আমি। তারপর দাদিকে কে ডেকে বলি,
-দাদি তোমার ফোন।
-এই সময় আবার কে কল করলো। বলেই দাদি উঠে আসে। আমি দাদির হাতে ল্যান্ডফোন ধড়িয়ে দিয়ে আংকেলের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
কিছুক্ষণ পর মামনি ড্রয়িংরুমে আসে। তারপর সে হাসি মুখে জিয়ানের দিকে তাকায়। আচার্যজনক ভাবে জিয়ানের মুখশ্রী দেখেই মামনির মুখের হাসি উবে যায়। সে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জিয়ানের দিকে। কিছুসময় বাধে মামির কপাল কুচকে এলো। ভ্রুতেও সামন্য ভাজ পড়লো। মামনির এমন দৃষ্টি দেখে আংকেল মামনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তুমি ওকে এভাবে দেখছো কেন ভূমি।
মামনি আংকেলের কথার কোন জবাব দিলো না। সে গিয়ে আংকেলের পাশে বসে জিয়ানকে তার সম্পর্কে বলতে বললেন। জিয়ান কোথায় থাকে কার সাথে থাকে ওর ফ্যামিলি মেম্বার কতজন? ব্লা ব্লা। জিয়ান মামনির সব প্রশ্নের জবাব দেয়। তখনি মামনি উঠে দাঁড়ায়। আর জিয়ানকে সরাসরি বলে দেয়,
– সরি জিয়ান, এই সম্পর্ক আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তোমার আর মিষ্টির সম্পর্ক এখানেই শেষ করে দাও।
– কিন্ত আন্টি আমার অপরাধ কি? উঠে দাঁড়িয়ে বলল জিয়ান।
– কারন আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আর যাকে বিশ্বাস করতে পারবো তার হাতে আমি আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারবো না। বলেই মামনি হনহন করে রান্নাঘরে চলে গেলো। জিয়ান মামনির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তখন আমি আংকেলের কাছে গিয়ে বললাম,
– তুমি একটু মামনিকে বুঝাও না। মামনি কেন এমন করছে। আমার কথার প্রতিউত্তরে আংকেল কিছু বলবে তার আগেই দাদুভাই বলে উঠে,
– তুমি এখনো অনেক ছোট মিষ্টি তাই বাহিরের পৃথীবি সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই। বৌ-মা সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটার সাথে আমরা সকলে একমত।
– কিন্ত দাদুভাই।
– কোন কিন্ত নয়। তোমার বন্ধুকে এখন আসতে বলো।
দাদুভাইয়ের শেষ কথা শুনা মাত্রই আমি অসহায়ের মতোন করে জিয়ানের দিকে তাকালাম। জিয়ান আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে দাদুভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আজ চলে যাচ্ছি। কিন্ত আমি আবার আসবো। সেদিন কিন্ত আমি আমার অপরাধ না কেনে কোথাও যাব না। তারপর হনহন করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় জিয়ান। জিয়ান চলে যাওয়ার পর আমি আংকেলের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– তোমরা কি জিয়ানকে আগে থেকেই চিনতে??
– এখন বাড়ি যাও মিষ্টি। আর হ্যাঁ এই জিয়ানের সাথে যেন তেমার কোন যোগাযোগ না থাকে রাকিব নয়না তোমার জন্যে টেনশন করছে। কথাটা বলেই আংকেল উপরে চলে যায়। আমিই আর কোন কথা বাড়াই না। এক বুক অভিমান নিয়েই সেই বাড়ি থেকে চলে আসি।
চলবে,,,,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।