#বেনিফিট_অফ_লাভ -১১
Tahrim Muntahana
আজকের সকাল টা অন্যরকম। একটু নয় বেশীই। বেনিফিট খাজা মাথায় বরফের টুকরো দিয়ে বসে আছেন। মূলত তিনি আকস্মিক শক পেয়েছেন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ছোট ছেলেকে ব্যাগ নিয়ে ডাইনিংয়ে বসে থাকতে দেখে তিনি কিছুটা অবাক হলেও যখন শুনলেন এখন থেকে রোজ ভার্সিটি যাবে শিতাব; তখন যেন তার মাথা ঘুরে উঠলো। দীর্ঘ দুই বছর পর শিতাব ভার্সিটির নাম করলো, এমনিই তো পরীক্ষার সময় একটু যায়! শিতাব খেয়ে বেরিয়ে পড়েছে কিন্তু বেনিফিট খাজা নিজের শক থেকে বের হতে পারেন নি। বিস্মিত ডেজিও। তার কথাটা যে কাজে লাগবে সে এতটাও আশা করেনি। শিতাব যে ঘাড়ত্যাড়া, একরোখা স্বভাবের ছেলে, তাকে থানার সামনে ছাড়া ভার্সিটি পাঠানো এতটা সহজ হবে না; ডেজি তাই ভেবেছিল। কিন্তু সে ভুল! ছেলেটার ভালোবাসা তাকে বিস্মিত করে চলছে ক্ষণে ক্ষণে! নিজের বিস্মিত ভাব কাটিয়ে ডেজি বেনিফিট খাজার নিকট এগিয়ে গেল। মাথা থেকে বরফের টুকরো সরিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-“আপনি তো ভারী নাটকবাজ মহিলা, এইরকম ঢং করছেন কেন মিসেস গাঁজা! বলেছিলাম না আপনার দুই ছেলে কে মানুষ করবো? মিসেস ডেজি লস্কর নিজের কথা রেখেছে! এখন আপনাকে একটা কথা রাখতে হবে, প্রমিজ করতে হবে!”
মিসেস বেনিফিট খাজা সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েই ডেজি কে জড়িয়ে ধরলেন। মোটা সোটা শরীরের মাঝে ডেজি হাঁসফাঁস করে উঠলো, হাসিও পেল খানিক। পরক্ষণেই বেনিফিট খাজা ডেজির কপালে চুমু দিয়ে ছেড়ে দিলেন। গদগদ হয়ে বললেন,
-“ইউ ডেজি বেজি ইউ জিনিয়াস! মাই বিলিভ হচ্ছে নো? মাই সন এত গুড হয়ে গেল? হোয়াট করে?”
-“আপনার ছেলে দুটো আগে থেকেই ভালো, শুধু সঠিক শিক্ষার অভাব ছিল। আমি এসে গেছি না? সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে!”
-“ওকে ওকে, কি প্রমিজ বলো বলো!”
-“এখন বলবো না, যখন বলবো তখন রাখতে হবে!”
বেনিফিট খাজা কিছুক্ষণ ডেজির দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ডেজি অনেক ক্ষণ ভাবলো! কথা তো দিয়ে ফেলেছে, যদি কেউ রাজী না হয়? সবচেয়ে বড় সমস্যা তো সিলভিয়া নিজে!
…..
ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট আজ! কেটে গেছে অনেক গুলো মাস, সপ্তাহ! শিতাবের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্টের ডেট চলে এসেছে। হক বাড়ির চিত্র সেই একই, দুই শাশুড়ি বউমা বাড়িটিকে মাতিয়ে রেখেছে খুনসুটি দিয়ে। এত মাস পড়াশোনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেও সিলভিয়ার কাছে আগে যেমন ছিল আজও শিতাব তেমন ই আছে। চড়ের সংখ্যাও আজ একশত বিয়াল্লিশ থেকে একশত ঊননব্বইয়ে ঠেকেছে। শিতাবের হিসেব করে রাখা চুমুর সংখ্যাও তিন শত আটাত্তরে গিয়ে থেমে আছে। আশি করতেই যাচ্ছে সে, রেজাল্ট নিয়ে কোনো চিন্তা তার নেই। তার একমাত্র চিন্তায় হলো সিলভিয়া কে কি করে জ্বালানো যায়। তবে আজ সে খালি হাতে যাবে না! জানে না আজ তার ভাগ্যে কি আছে, আদৌও সে ভালো রেজাল্ট করতে পারবে কিনা। শুধু জানে আজ সিলভিয়ার কাছে পজিটিভ বা নেগেটিভ কোনো একটা কাটকাট উত্তর সে আদায় করেই নিবে!
কম্পিউটার দোকানেই বসে ছিল সে। রেজাল্ট পাবলিসড হওয়া মাত্রই বের করতে সফল হয়েছে। এবং কি তার ঠোঁটে চিন্তার বদল হাসি ফুটেছে। কয়েক মাসের পরিশ্রম তার বিফলে যায় নি। রেজাল্ট কপি নিয়ে শিতাব আর দেরী করে না, কিছুটা দূরেই থানা তাই দৌড়াতে থাকে। খুশিরা যেন উপচে পড়ছে। সে যখন থানায় পৌঁছালো তখন লাঞ্চের সময়। সিলভিয়া বেরিয়েছে ক্যাফে তে যাওয়ার জন্য। শিতাব কে দৌড়ে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। দাঁড়িয়ে পড়ে, শিতাব এসে সিলভিয়ার পাশে থাকা লবিন কে তোয়াক্কা করে না। হাঁটু গেড়ে বসে রেজাল্ট শীট বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-“দীর্ঘ কয়েকমাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল, আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি সিলভিয়া রেড! শুধু মাত্র তোমার জন্য! আমার এত পরিশ্রম একমাত্র তোমাকে পাওয়ার জন্য! আমার এত রাত জাগা, এত দৌড়ঝাঁপ শুধু মাত্র তোমার জন্য। বখাটে থেকে শান্ত শিতাবে রূপান্তর তোমার জন্য। আমার জন্য কিছু করো না সিলভিয়া রেড! শুধু মাত্র রেজাল্ট শীট টা হাতে তুলে নিয়ে বুঝিয়ে দাও তোমার জীবনে এই শিতাব যাবী কিছুটা হলেও প্রভাব রাখে!”
কি এক আকুল আবেদন, নিবেদন! সিলভিয়া খানিক কেঁপে উঠলো। আশেপাশের সবাই বিস্মিত পানে দেখছে। লবিন কটমট চোখে তাকিয়ে আছে শিতাবের দিকে। সিলভিয়া কে চুপ থাকতে দেখে শিতাব আবার বললো,
-“একশত ঊননব্বইয় খান চড় কে দ্বিগুণ করে তিনশত আটাত্তর খান চুমু থেকে এক চুমু বাদ দিলে তিনশত সাতাত্তর খান চুমুতে তে পরিণত করার সুযোগ দিবে সিলসিলা রানী?”
কথাটা বলতে দেরী ঠাস করে চড় পড়তে দেরী হয়নি! গালে হাত দিয়ে শিতাব ঠোঁট উল্টে তাকায়। মন খারাপ করে বলে,
-“একশত নব্বই খান চড় খেয়েও তোমার পিছু পড়ে আছি! আমার ভালোবাসা কে হেলা করো না! তোমার চাকরি তে সমস্যা হবে দেইখো!”
ছেলেমানুষী অভিশাপ! সিলভিয়া কটমট করে তাকিয়ে ফের আরেকটা চড় বসালো। মেয়েটা হঠাৎ রেগে গেল কেন শিতাব বুঝলো না! প্রথম তো ঠিকই ছিল! শিতাব বুঝলো এই মেয়ে কে বলে আর লাভ নেই। যা করার তাকেই করতে হবে। উঠে দাঁড়িয়ে একপলক সিলভিয়ার দিকে তাকিয়ে থুতনি তে হাত রেখে কিছুক্ষণ ভাবলো! পরক্ষণেই উবু হয়ে পায়ের জুতা খুলে হাতে নিল। মিটিমিটি হেসে চটজলদি এগিয়ে এসে ঠুস করে সিলভিয়ার কপালে চুমু বসিয়েই দৌড় শুরু করলো। যেইসেই দৌড় নয়, এ দৌড় হয়তো চ্যাম্পিয়ন কেও হার মানিয়ে দিবে। কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো শিতাব। হাঁটুতে ভর করে হাঁপাতে লাগলো। সিলভিয়া এখনো তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। শিতাব চিৎকার করে বললো,
-“তিনশন বিরাশি খান চুমুর মধ্যে দুটো বাদ দিলে তিনশত আশি খান চুমু পাওনা রইলাম সিলভিয়া রেড! বাসর রাতে অবশ্যই তা আদায় করে নিবো! খেয়ে দেয়ে শরীরে এনার্জি এনো!”
আবার দৌড় শুরু করলো। সে দৌড় থামালো রিকশা পেয়ে। চট জলদি উঠে
বসলো শিতাব। খুব তাড়া তার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ির সামনে আসতেই নেমে পড়লো সে। রিকশাওয়ালা কে পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দিতেই তিনি বললো,
-“ভাংতি নাই তো!”
-“পঞ্চাশ টাকা ভাংতি হবে না?”
-“পুচ্চল্লিশ টেহা ভারা, পাঁচ টেহা না নিলে কি হইবো? আসলেই ভাংতি নাই!”
চোখ ছোট ছোট করে তাকালো শিতাব। ধুরন্ধর লোক, মিথ্যে বলছে কি করে! পঞ্চাশ টাকা টা নিয়ে নিল শিতাব। মানিব্যাগ সহ দুই পকেট হাতড়ে হাতড়ে পঁয়তাল্লিশ টাকা বের করলো, এখন আর তার তাড়া নেই। রিকশাওয়ালা কেমন করে দেখছে শিতাব কে। পঁয়তাল্লিশ টাকা দিয়ে শিতাব বিজয়ীর হাসি দিল। বললো,
-“যার তার সাথে চালাকি করে পারা যায় না! যেখানে আমি প্রতি পদের টাকা হিসেব করে রাখি সেখানে পাঁচ টাকা মেরে খাবা এই শিতাব যাবীর কাছে? এত সহজ? শালা, বাটপার!”
রিকশাওয়ালা কে বকতে বকতে ভেতরে ঢুকলো শিতাব। তখনি তার মনে পড়লো সে খুব তাড়াহুড়ো করে আসছিল। আবার পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে উপরে চলে গেল। ডেজি ফোনে কথা বলছিল। শিতাব এসে সরাসরি বললো,
-“ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি ভাবী, এবার তুমি তোমার কথা রাখো! তোমার বোন কে আমি খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই! পুলিশ হয়েছে বলে ভাব দেখায়, বাসর ঘরে ওর ভাব আমি বের করবো! গুনে গুনে তিনশন আশি টা চুমু না দেওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই!”
হকচকিয়ে গেল ডেজি। ফোনের উপরে ভেসে থাকা মা নামটার দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলো। আরেকবার শিতাবের দিকে তাকালো। ওদিকে সিমা শিকদার সবই শুনেছে। ক্ষেপেও গেছে সে। এক মেয়ে কে দিয়ে ভুল করেছেন, আরেকজন দিয়ে সে ভুল বাড়াতে চান না। ডেজি দেরী না করে কল কেটে দিয়ে শিতাবের পিঠে ধুমাধুম কিল বসালো। আহম্মক হয়ে গেল শিতাব,
-“মারছো কেন ভাবী?”
-“মারবো না? বেশরম পাবলিক! আম্মুর সাথে কথা বলছিলাম শিতাব, শুনে ফেললো সে!”
সেদিকে শিতাব কানই দিল না। উদাস হয়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকালো। বললো,
-“আমাকে কথা দিয়েছো ভাবী! রেজাল্ট করে দেখিয়েছি। এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো।”
-“চাকরী পাওনি শিতাব। আমি কর্মের কথা বলেছি, শুধু রেজাল্ট নয়।”
ডেজির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শিতাব। পাইচারি করতে লাগলো অস্থির হয়ে। মেজাজ তার গরম হয়ে যাচ্ছে। ল্যাপটপ বের করে চাকরীর সার্কুলার দেখে নিল। কয়েকটা ভালো মানের চাকরীর আবেদনের প্রাথমিক কাজ শেষ করলো ঘরে বসেই।বাকি টা পরে করবে! ইন্টারভিউ শেষ হয়ে চাকরীতে জয়েন করতে আরে দু-তিন মাস লেগে যাবে, আবার চাকরী নাও মিলতে পারে। কিছু ভাবতে পারছে না শিতাব! ফোন দিল বন্ধু কে,
-“হেলো চাকরি চাই কোনো একটা। সেলস ম্যান, কম্পিউটার অপারেটর বা রিসিপশনিস্ট যেকোনো একটার ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?”
নেগেটিভ রেসপন্স। শিতাব আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। সার্চ করলো, ফলাফল শূণ্য। মাসের শুরুতে সব বুকিং হয়ে গেছে। হতাশ হয়ে শুয়ে পড়লো শিতাব। আর ভালো লাগছে না! তখনি হুট করে মনে পড়লো ডেজির কথা, “রিকশা চালানোও কর্ম! আর ডেজি কর্মের কথায় বলেছে!” ধপ করে উঠে বসলো শিতাব। এক নিমিষেই ঠিক করে নিল, সে দুই-তিন মাস রিকশায় চালাবে। তবুও সে জলদি বিয়ে করবে। লবিন কে তার ঠিক লাগে না! কাউকে কিছু না বলেই শিতাব নিজের মতো বেরিয়ে পড়লো। খুঁজে খুঁজে পাড়ার রিকশার গ্যারেজে পৌঁছে গেল। হক পরিবারের বেশ সুনাম থাকায় কেউ তেমন না করলো না। নাম ঠিকানা লিখিয়ে রিকশা নিয়ে বের হলো শিতাব। আগে নিজ বাড়িতেই যাবে। ডেজি কে দেখাবে, আজকেই সে প্রস্তাব পাঠাবে। রিকশা চালাতে বেশ লাগছে তার, এমন ভাবে চালাচ্ছে আর গুনগুন করে গান করছে; মনে হচ্ছে সে রিকশা চালাচ্ছে না, চালাচ্ছে উড়োজাহাজ!
চলবে…?