#বেনিফিট_অফ_লাভ -৮
Tahrim Muntahana
দরজা খুলছে না ডেজি। শামউল সেই কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে মেয়েটা কানেই তুলছে না। ধৈর্যের সীমা নেই, আছে তো? আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। অফিস থেকে এসেই ঝামেলা। নিচে চলে যায় আবার। সোফায় বসে আপন মনে কিছুক্ষণ ভাবে। এরমধ্যে বেনিফিট খাজা পাশে বসেন, কিছু বলার চেষ্টা করেন তবে শামউল সেদিকে তাকায় না। বেনিফিট খাজা আমতা আমতা করে বলেন,
-“মাই সন, আমি বিগ সরি।”
-“ও আমার স্ত্রী মম। আমার ভরসায়, তোমার ভরসায়, এই বাড়ির ভরসায় নিজের এতদিনের বাসস্থান ছেড়ে এসেছে। আমরাই তো ওর আপন এখন! তাহলে কেন সে আপন জনের থেকে কষ্ট পেয়ে বড় বোন কে নালিশ করবে? কেন কষ্ট পাবে মম? তুমি তো আমার মা, তাহলে আমার অর্ধাঙ্গিনীর মা হতে পারছো না কেন?”
বেনিফিট খাজার চোখ ছলছল করে উঠলো। শামউলের হাত ধরে বললো,
-“আমি বিগ সরি মাই সন। তুমি তো চেনো মম কে। জানো তো। আমি কি খারাপ?”
শামউল কথা বলে না। বেনিফিট খাজা আবার বলেন,
-“হুজুগে কাজ আমি করে ফেলি। তোমার দাদী যৌতুকের বিষয় টা মাথায় না ঢুকালে বিয়েতে ওরকম হতো না। তোমার বাবা যে পরের কথায় মত দিয়েছিল আমি জানতাম না, আমার মনে হয়েছে তারা আমাদের মিথ্যে বলে বিয়ে দিয়েছে। তাই রেগে গিয়েছিলাম। তুমি তো জানো আমার মাথা ঠিক নেই, যাকে বলে পাগল। ঠুমকো ওই রাগে আমি আজকের ব্যবহার করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও শামউল। আমি আর এমন করবো না।”
কি অনায়েসেই পাগল শব্দ টা ব্যবহার করলো। শামউল সব ভুলে মায়ের কোলে লুটিয়ে পড়লো। বেনিফিট খাজার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো তপ্ত নোনা জল। তিনি বললেন,
-“তেতো হলেও সত্যি। মানুষের অস্বাভাবিকতা বিভিন্ন ধরণের। তাই তোমরা যতই বলো আমি যে একজন মানসিক রোগি আমিও সেটা জানি। ছোট বেলায় দাদির এই একটা নামের জন্য আমার শৈশব যেমন নষ্ট হয়েছে, কৈশর ও নষ্ট হয়েছে। স্কুলে গেলে সবাই হাসাহাসি করতো, বাদ দিলাম পড়াশোনা। বাপ তো আর যুবতি মেয়ে ঘরে বসিয়ে পালবে না। বিয়ে দিল। তোমার বাবা আমাকে সম্মানের সহিত মেনে নিলেও মেনে নিল না সমাজ। মোটা সোটা দানবের মতো বউ, তার আবার কিরকম নাম! তোমার বাবা আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারতো না, নাহ তোমার বাবার দোষ নেই। আমার মন খারাপ হতো বলেই নিয়ে যেত না। শাশুড়ির তিক্ত কথা। সব মিলিয়ে আমি অসুস্থ ছিলাম। ঠিক করলাম মর্ডান হবো। ইংরেজির কোর্স নিলাম তবে সেটা গভীর ভাবে আয়ত্ত করতে পারলাম না, পার্লারে যাওয়া ধরলাম, ঘুরতে যাওয়া ধরলাম। নিজের মতো যখন চলতে শুরু করলাম তখন সমাজ আর আমাকে ছুঁতে পারলো না। এই নেশা টা এত ভাবে আমাকে আগ্রহ করে তুললো আমি নিজের সত্তা কে লুকিয়ে এই সত্তা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করলাম। এখনো চেষ্টা করছি, এগুলো দিয়ে আমি আমার শৈশব , কৈশর,যৌবন, বিবাহিত জীবনের কিছু সময় কে ভুলে থাকতে চাই। সবাই সুখে থাকতে চায়, আমিও চাই। আর এই সত্তা টাকে আঁকড়ে ধরতে ধরতে মস্তিষ্ক জং ধরে গিয়েছিল, তাই তো বিয়ের পরদিন মেয়েটার উপর কত অত্যাচার করলাম। তোমার দাদি এতবার বলছিল, বিয়ের পর বউ আপন হয়ে মা পর হবে! সেসব আমার মস্তিষ্ক কে আরো নষ্ট করে দিয়েছিল। যাইহোক আমি ডেজির কাছে ক্ষমা চাইবো।”
শামউল মায়ের হাতে চুমু খেল। পেছন থেকে শিতাব এসে জড়িয়ে ধরলো মা কে। তারা কখনো ভাবেই নি এমন হাসিখুশি মায়ের মনে এতটা দুঃখ থাকতে পারে। অতিত এতটা ভয়াবহ হতে পারে।
নাম! কর্ম আমাদের পরিচয় হলেও তা একটা নামের উপর নির্ভর করে। তা যদি সমাজের নিকট হাস্যরসাত্মক হয়, কতটা দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে তা হয়তো নাম রাখার আগে কেউ ভাবে না। ভাবা উচিত। আমরা যে সমাজে বসবাস করি, সে সমাজ অন্যকে নিয়ে হাসাহাসি করতে বড়ই উস্তাদ। আপন কে ভুলে তারা অন্যতে মত্ত থাকতে চায়। তাই ছোট্ট শিশুর এমন নাম রাখা উচিত যা তাকে কর্মের দিকে ধাবিত করবে, মানুষের মতো মানুষ হতে সাহায্য করবে, সমাজে এক চিহ্ন হয়ে মৃত্যুর পরও বাঁচিয়ে রাখবে। তার নামের মাঝেই তার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে।
ডেজির রাগ দুঃখ এতটা ভয়াবহ ছিল সে ঠিক করেছে বাবার বাড়ি চলে যাবে। সুটকেস গোছানোই ছিল, কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলার পর মাত্রই বেরিয়েছে। বেনিফিট খাজার কথা শুনে আপনাআপনিই তার পা থেমে যায়। কৌতুক এক চরিত্রের পেছনে কত কত রহস্য, কত কত দুঃখ, কত ভয়াবহতা। অথচ তারা মানুষের ভেতর না দেখে বাহির টা দেখেই বিবেচনা করে। নোংরা পোশাক দেখে বিবেচনা করে নেয় লোকটি গরিব, অস্বচ্ছল। এটা ভাবে না, পোশাক কোনো কারণে নোংরা হতে পারে, পোশাকে কি আসে যায়! সবাই শুধু নিজের ইমেজ, স্ট্যাটাস নিয়ে পড়ে থাকে।
মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে ডেজির ঘোর কাটে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মনসুর হক কে। চোখের কার্ণিশে থাকা জলটুকু মুছে হাসার চেষ্টা করে ডেজি। মনসুর হক মলিন মুখে বলেন,
-“তোমার শাশুড়ির ওই বুকে যতটা না কষ্ট আছে, তার চেয়ে বরং দুই ছেলের জন্য অধিক ভালোবাসা আছে। বোনের মেয়ে কে বড় ছেলের বউ করতে চেয়েছিল। কিন্তু শামউল যেদিন তোমার কথা এসে বললো, এত দিনের আগ্রহ ইচ্ছে কে নিজের মাঝেই লুকিয়ে রেখে হ্যাঁ বলে দেয়। কোনো খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করে নি। ছেলের পছন্দ, ভালোবাসায় তার কাছে মুখ্য হয়েছিল। বাঁধ সাধলো আমার মা। বেনির বোনের মেয়েটা গ্রামের ছিল তো, তাই মায়ের বেশী পছন্দ ছিল। তার ভাষ্যমতে গ্রামের মেয়েরা মুখ বুজে সহ্য করবে কিন্তু শহরের মেয়েরা তা করবে না; তারা সংসার নিয়ে ওত ভাবেও না যতটা গ্রামের মেয়েরা ভাবে। বেনিকে সেজন্যই বড় বউ করে নিয়ে এসেছিল। যখন বেনি আম্মার কথা শুনলো না তখন আম্মা ইচ্ছে করেই ওর মাথায় যৌতুকের কথা টা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আম্মা ভেবেছিল তোমার মা রাজি না হয়ে বিয়ে ভেঙে দিবে। তা তো হলো না, বরং তোমার মাও রাজি হয়ে গেল। ওই জন্যই তোমার উপর রাগ দেখিয়েছে। আর মা শামউলের উপর রাগ করো না। ওর দাদী বিয়েতে না মত করার পর বেনিকে অনেক কিছুই বলে, বিয়ের পর মা পর হয়ে যাবে, বউ পেয়ে মা কে ভুলে যাবে। তাই বেনি খানিক বাচ্চামো করেই শামউলের থেকে কথা আদায় করে নিয়েছে, মায়ের উপর সে একটা কথাও বলতে পারবে না, না বউয়ের হয়ে সাফাই গাইতে পারবে। এই বিষয় গুলোই গোলমেলে হয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবে মা , তোমারো ভুল ছিল। নিজের স্বামী, শশুড় কে না বলে বড় বোন কে বলে ভুল করেছো। আমরা তো বাড়িতে ছিলাম না, জানতাম না। আমাদের জানালে ভালো হতো। তোমার বোনের কথাও ভুল না, অতি আদরের ছোট বোন, তার উপর পুলিশের রক্ত সবসময় গরম ই থাকে।”
বৃহৎ এক বক্তব্য দিয়ে থামলেন মনসুর হক। ডেজি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তিনি আবার বললেন,
-“সংসার হলো এক ষড়যন্ত্র! জটিল এক সমীকরণ। তুমি দক্ষ হাতে, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে ওই ষড়যন্ত্রের গোড়া ধরতে পারলে, জটিল সমীকরণের রহস্য উন্মোচন করতে পারলে; দেখবে এই সংসার প্রশান্তির বাগান হয়ে যাবে!”
ডেজি হাসলো। শশুড়ের হাতে মৃদু ভাবে হাত রেখে ভরসা দিল। মনসুর হক ও তাল মেলালেন। ডেজি উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন,
-“আমার সংসারে এমন বেনিফিট খাজার খুব করে দরকার বাবা। নাহলে সংসারের প্রাণই হারিয়ে যাবে। কাল থেকে এই ডেজি লস্কর বেনিফিট খাজার বারোটা বাজাবে, দেখবেন! সাথে আপনার মা আর দুই ছেলের।”
দুই শশুড় বউমা এক যোগে হেসে হাই ফাইভ করে যে যার ঘরে চলে গেল। কাল থেকে ডেজি নতুন সংসারের শুভ সূচনা করবে। দেখা যাক না, বউ-শাশুড়ির কেমন মিলে!
…..
রাত বারোটা বেজে চুয়ান্ন মিনিট। পুরো শহর ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম নেই শিতাবের চোখে। অন্তর আজ ভীষণভাবে পুড়ছে, জ্বলছে, খাঁক হয়ে যাচ্ছে যেন। সিলভিয়ায় ওই মৃদু কম্পন তাকে অনুশোচনার অনলে পুড়াচ্ছে। না পাওয়ার এক ভয় তাকে গ্রাস করছে।
সে জানেনা সিলভিয়া জেগে আছে কিনা। কিন্তু এই জোৎস্না রাতে মেয়েটার কন্ঠ শোনার লোভ হচ্ছে। চঞ্চল শিতাব আর অপেক্ষা করলো না। ফোন দিল “সিলসিলা রানী” নামক নম্বরে। রিং হয়ে কেটে গেল, একবার নয় পর পর চারবার। চঞ্চল প্রেমিক তবুও থেমে নেই, দিতেই থাকলো। কল যখন সংখ্যায় দশ ছাড়িয়ে গেল হতাশা ঘিরে ধরলো শিতাব কে। মেয়েটা ইচ্ছে করেই ফোন তুলছে না। জেগে ছিল, নাহয় ফোনের শব্দে জেগেছে। সিলভিয়া কখনোই ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমায় না, এখন নতুন কেসে ঢুকে তো প্রশ্নই আসে না সাইলেন্ট করার। মন কে কিছুটা শান্ত করে শিতাব ছোট্ট এক বার্তা পাঠালো,
-“মেয়ে তুমি বড্ড নিষ্ঠুর! বুকে থেকে সেই বুকেই ক্ষত সৃষ্টি করো!”
সিলভিয়া সত্যিই ঘুমায় নি। বোনের কন্দনরত মুখশ্রী তাকে ঘুমাতে দেয় নি। এতক্ষণ ফোনের টুং টুং শব্দ শুনছিল। মেসেজের শব্দ কানে পৌঁছাতেই খানিক বিরক্ত নিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। দু বাক্যের বার্তা টি কেমন বুকে এসে বিঁধে।
পরক্ষণেই তাচ্ছিল্য হেসে লিখে,
-“তুই কি ভেবেছিলি? বাইরের লোক বলে আমাকে অপমান করলেই আমি তোকে জোর করে বিয়ে করে ওই বাড়িতে ঢুকবো? অধিকার ফলাবো? এসপি সিলভিয়া রেড কে এখনো চিনিস নি। তোকে সাবধান করছি শিতাব, আমার থেকে দূরে থাক। ফল ভালো হবে না। কাল সকালের জন্য অপেক্ষা কর, চমক দেখতে চেয়েছিলি না, দেখবি! বড় চমক!”
শিতাব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো মেসেজ টির দিকে। পরক্ষণেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এখন তার কি হবে? কে বাঁচাবে? কাল সকালে কি করতে যাচ্ছে তাই নিয়েই ভাবতে বসলো সে। ভাবনা ফুরায় না, রাত পার হয়ে যায়। সকাল নামে, ধড়ফড় করে বুক। কি হতে যাচ্ছে?
চলবে…?