#বেনিফিট_অফ_লাভ -৭
Tahrim Muntahana
কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে শামউল। সম্মুখে পায়ের উপর পা তুলে মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে সোফায় বসে আছে ডেজি। হাতে ফোন, কারো সাথে চ্যাট করছে। মাঝে মাঝে হাসছেও। কার সাথে এভাবে কথা বলছে দেখতে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে উঁকি ঝুঁকি করছে শামউল। খুব একটা সুবিধা সে করতে পারছে না। হতাশায় বুক তার ধড়ফড় করছে। রাগও হচ্ছে, আবার ভয় ও করছে। আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে কানে ধরে তো দাঁড়িয়ে আছে, বউ কি নিয়ে রাগ করেছে সে এখনো বুঝতে পারেনি। এখন যদি এটা ডেজি বুঝে যায়, তাহলে হয়তো তাকে সারা রাত ছাদের রেলিংয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে। এ রিস্ক সে কিছুতেই নিতে চায় না। দুম করেই সে কান থেকে হাত নামিয়ে ডেজির ফোনটা কেড়ে নিল। রেগে তেড়ে আসতেও পারলো না ডেজি। পূর্বেই তাকে কোলে উঠিয়ে নিল শামউল। হতবাক হয়ে ডেজি কথা বলতে ভুলে গেল। আকস্মিক বরের এমন সাহসীকতায় যার পর নাই অবাক সে। শামউল আরো একটি কাজ করে বসলো। টুক করে ডেজির গালে চুমু দিয়ে মুচকি হাসলো। ডেজি আর নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলো না। স্বামীর সোহাগ পেয়ে সারাদিনের পরিশ্রম, অপমানের কথা ভুলে গেল। ডেজির রাগ ভাঙাতে কাজটা করলেও শামউলের এবার ঘোর লেগে গেছে। এত সুন্দর একটা বউ তার, বিয়ের রাত চলে গেল এখনো বাসর করতে পারলো এই আফসোসে সে ছটফট করেছে। এভাবে চলতে থাকলে সে নির্ঘাত জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হবে। না হলেও চোখ মুখ হলুদ দেখে যে কেউ ই ভেবে বসবে। এমন রিস্ক সে নিতেই চায় না। আহ্লাদ করে বললো,
-“আমার খাওয়ার রুচি কমে গেছে, তারাফুল!”
প্রথমে খানিক অবাক, তারপর মুগ্ধ। ‘তারাফুল’! লোকটা তাকে এই নামে সম্বোধন করলো? এত মুগ্ধতা ছড়ালো কেন? এত মিষ্টি শুনালো কেন? ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“হঠাৎ কমে গেছে?”
-“কাল বিকেল থেকে অজানা এক অসুখ ভেতর টা আমার ছারখার করে দিচ্ছে, খাওয়ার রুচিও কমে গেছে! চোখেও কম দেখছি!”
-“অবস্থা বেশী গুরত্বর, চলুন আজই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।”
-“ডক্টর তো ঘরেই আছে!”
ভ্রু কুঁচকালো ডেজি। বললো,
-“ঘরে? কে?”
শামউল মুচকি হেসে জবাব দিল,
-“আমার মনে হচ্ছে এই ছারখার করা অসুখটা একমাত্র বাসর করলেই সেরে যাবে। তোমার ওই সুশ্রী মায়াময়ী মুখশ্রী দেখে চোখের জ্যোতি ফিরে পাবো, তোমার ওই নেশা মেশানো অধরে প্রথম চুম্বনে খাওয়ার রুচি ফিরে আসবে। তোমার ওই নরম শরীর টা বুকে জড়িয়ে রাখলে বুকের ধড়ফড় ভাবটা পালিয়ে যাবে। আমার ছারখার অসুখের একমাত্র ডাক্তার তুমি তারাফুল। বাঁচা দায় হয়ে যাচ্ছে, ডাক্তার রা খুব মহান হয় জানো?”
এতক্ষণ কিছুটা চিহ্নিত থাকলেও শামউলের কথায় ডেজি আরক্ত হয়ে উঠলো। লজ্জায় চোখ তার নত হয়ে এলো, মুখ লুকালো স্বামীর বুকে। মৃদু চড় বসালো পিঠে। শামউল হাসতে হাসতে বললো,
-“ইশশ বউ দেখ, বুকের ধড়ফড়ানি উধাও। এবার রুচি ফিরিয়ে দাও না!”
ডেজির মনে হচ্ছে দেয়াল ফাঁক করে বাইরে যেতে পারলে। নিজেই তো দরজা বন্ধ করে বৃহৎ ভুল করেছে। শামউল জোর করে মুখ উঠালো ডেজির। থুতনি তে হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মুখ একটু একটু করে এগিয়ে যেইনা অধরে অধর স্পর্শ করবে, বিকট শব্দে দরজায় কেউ থাবা বসিয়েছে। আকস্মিক এমন শব্দে ভয় পেয়ে হাত আলগা হয়ে আসতেই চরম বিস্ময় ও ভয়ানক এক কাজ হয়ে গেল। ঠাস করে পড়ে গেল ডেজি। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রক্তিম চোখে তাকালো শামউলের দিকে। শামউল সে চাহনিতে কেঁপে উঠলো। দরজা ধাক্কানোর শব্দ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শামউল কোনো রকম ডেজিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। খুলতেই দেখা পেল বেনিফিট খাজা দাঁড়িয়ে আছেন। শামউল নিজেকে ঠিকঠাক করে বললো,
-“মম তুমি এখানে? কিছু..”
শেষ করার সুযোগ বেনিফিট খাজা দিলেন না। গর্জে বললেন,
-“নাউ মি কে সনের রুমে আসতে বিকজ দেখাতে হবে?”
চরম ভুল করে ফেলেছে শামউল। দাঁত জিভ কেটে মায়ের হাত ধরলো। বললো,
-“মম তেমন কিছুই না। তুমি যখন তখন আসবে।”
বেনিফিট খাজা মাথা উঁচিয়ে একপলক ডেজি কে দেখলেন। পরক্ষণেই শামউলের হাত ধরে নিচে নেমে গেলেন। এতে রাগ যেন বাড়লো ডেজির। রাগ দুঃখ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো। বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক এমন হবে কেন? সে তো সুন্দর একটি সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল। জেদের বশে ফোন দিল বড় বোন কে। সিলভিয়া তখন থানাতেই ছিল। বোনের ফোন পেয়ে কিঞ্চিৎ হেসে ফোন রিসিভ করলো,
-“কেমন আছিস ফুল?”
-“সেটা জেনে তুমি কি করবে?”
অভিমান! বোনের এমন বাচ্চাসুলভ অভিমানে হাসলো সিলভিয়া। বললো,
-“সেটা আমার কাজ, তোর কাজ উত্তর দেওয়া সেটা তুই কর!”
-“ভালো নেই!”
সিলভিয়ার বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। বড় বোনেরা মায়ের মতো হয়, এটা হয়তো ঠিক। ভালো নেই কথাটা যেন বুকের উপর হাজার মণ পাথর চাপিয়ে দিল। বললো,
-“কি হয়েছে?”
-“ওই গাঁজার জ্বালাই আমি সংসার করতে পারবো না। আজ এই বাড়িতে প্রথম দিন অথচ আমাকে দিয়ে সারা বাড়ি পরিষ্কার করিয়েছে, রান্না করিয়েছে।”
-“তোর সংসার করতে তো হবেই।”
-“আমি জানি আপু। তাই বলে এত সার্ভেন্ট থাকতে আমি একা হাতে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করবো, তাও প্রথম দিন? একটু আগে ছেলে কে নিয়ে চলে গেল, কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করবো তাও না! এখানে আমি থাকতে পারবো না।”
-“আচ্ছা আমি আসছি!”
সিলভিয়া কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো। রাগে কান গরম হয়ে এসেছে তার। বোন কে বিয়ে দিয়ে বউ করে পাঠিয়েছে, কাজের লোক তো নয়। আজ বেনিফিট খাজার একটা হেস্তনেস্ত না করে সে বাড়ি ফিরবে না!
….
সিলভিয়া যখন হক বাড়িতে পৌঁছালো তখন ডিনারের সময়। গোল টেবিলে বসে ডিনার করছিল সবাই। বেনিফিট খাজা দুই পাশে দুই ছেলেকে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। প্রতিদিন ই খাইয়ে দেন না, ছেলে যেন বউয়ের দিক বেশী না ভিড়তে পারে তার জন্যই আজকে হুট করে খাইয়ে দিচ্ছেন। কলিংবেলের শব্দে ডেজির মুখে হাসি ফুটে। সে টেবিলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল, বেনিফিট খাজা হুকুম দিয়েছেন পরিবেশন করতে। স্বামীর চুপ থাকায় অভিমানেই সে টু শব্দ করে নি, পরিবেশন করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কলিং বেলের শব্দ কানে আসা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। ডেজির এমন উৎসাহে সকলের খাওয়ার ভাটা পড়ে। পুলিশ ইউনিফর্ম পরিহিতা সিলভিয়া কে দেখে বেনিফিট খাজার শান্তিতে থাকা আর হলো না, অশান্তি যেন ধপ করে মাথায় এসে পড়লো। সিলভিয়া সরাসরি এসে বেনিফিট খাজার সামনে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে,
-“আমার বোন আপনার বাড়ি কাজের লোক হয়ে এসেছে?”
থতমত খেয়ে যান বেনিফিট খাজা। বড় ছেলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলেন,
-“মানে? ইউ হোয়াট বলছো?”
-“এই সিলভিয়া রেডের সামনে নাটক করবেন না মিসেস গাঁজা আই মিন খাজা। পুলিশের ডান্ডার বারি শরীরে পড়লে না এত রস সব বেরিয়ে যাবে!”
চমকায় শামউল শিতাব। দৃষ্টিকটু লাগে। কোনো সন্তানই হয়তো সহ্য করতে পারবে না। শামউল বলে,
-“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন আপু? ঠিক ভাবে কথা বলুন!”
-“পরের মেয়ে আর বউয়ের সামনে নিজের পুরুষত্ব না দেখিয়ে মায়ের ক্ষেত্রেও দেখাবেন, এতে আসল পুরুষত্ব বজায় থাকবে। আমি আপনাদের বাড়ি বোন কে বউ করে পাঠিয়েছি, কাজের লোক করে নয় যে প্রথম দিনই এসে সার্ভেন্ট থাকা সত্ত্বেও আমার বোন কে সারা বাড়ি একা হাতে পরিষ্কার করতে হবে। আপনাদের আরো সার্ভেন্ট রাখার ক্ষমতা না থাকলে জানাবেন বাইক ল্যাপটপের বদল নাহয় আমাদের সার্ভেন্ট কে যৌতুক হিসেবে পাঠাবো।”
শামউল মায়ের দিকে শান্ত চোখে তাকালো। বেনিফিট খাজা এতে নিভে গেলেন। ছেলের চোখে চোখ রাখার সাহস হলো না। সে তো এভাবে ভেবে দেখেনি। রাগের বশে করে ফেলে এখন খানিক অনুতপ্তও সে। শিতাব বুকে হাত চেপে ধরলো। এই মেয়েকে পাওয়ার চান্স আরো দশ পার্সেন্ট কমে গেল। কি এক খারাপ ধারণা পোষণ হলো। জীবনেও মেনে নিবে না তাকে। বড় সড় ঢোক গিলে বড় সড় এক ছক কষলো সে। আজই যা করার করতে হবে। এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“ভাবীর সংসার, ভাবী কাজ করবে না কে করবে? সে নাহয় বুঝলাম প্রথম দিন ই মমের এমন করা ভুল হয়েছে। তাই বলে আপনি বাইরের একজন মানুষ হয়ে পরিবারের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করতে এসেছেন? ভাবীর অভিযোগ ভাবী করবে, আপনি কে? আপনি কেন করবেন?”
সিলভিয়া হতভম্ব হয়ে গেল। তিক্ত কথাগুলো বুকটা কে কেমন ঝাঁঝরা করে দিল। বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখলো মাথা নত করে চোখের জল ফেলছে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা টা সারা শরীরে কম্পন ধরিয়ে দিল। বেনিফিট খাজার মুখে হাসি। সিলভিয়া নিজের ভেতর কার ঝড় টাকে প্রকাশ করলো না। ঠোঁটের ভাঁজে বাঁকা হাসি ধরে রেখে বললো,
-“জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”
তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল। ডেজি চোখের জল নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দৌড়ে উপরে চলে গেল। শামউলের কি হলো সে জানে না, বিতৃষ্ণা অনুভূতি নিয়ে মায়ের দিক না তাকিয়েই বউয়ের পিছু নিল। আর বেনিফিট খাজা তো সিলভিয়া কে অপমান করতে পেরে উৎসব করছে। তবে ভালো নেই শিতাব। প্রিয়তমার মৃদু কম্পন তার অন্তর কেউ নাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু বিড়বিড় করে বললো,
-“এটা করার খুব দরকার ছিল সিলভিয়া রেড!”
চলবে…?