বেনিফিট অফ লাভ পর্ব-০৬

0
625

#বেনিফিট_অফ_লাভ -৬
Tahrim Muntahana

সময় টা এখন অপরাহ্ন। সিলভিয়া নিজ কেবিনে বসে নতুন এক কেস নিয়ে ভাবছিল। শহরে এক নতুন ছিনতাই দলের আবির্ভাব হয়েছে‌।‌ ছিনতাই বলবে না ডাকাত বলবে সিলভিয়া বুঝতে পারলো না। এই দলের কাজ‌ই হচ্ছে বড় বড় কোম্পানির কাছে চিঠি দিয়ে হুমকি দেওয়া। হুমকি পর্যন্ত‌ই স্থির নয়, কোম্পানি যখন এমন হুমকি কে গুনতাই না ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যায় এক রাতে হুট করেই হাজির হয় এই দল। সব কিছু লুট নয়, তারা এ পর্যন্ত চারটে কোম্পানি থেকে মোট চল্লিশ লাখ টাকা ডাকাতি করেছে। প্রত্যেক কোম্পানি থেকে দশ লাখ টাকায় নেয়, বেশীও নয় কম ও নয়। এমন কি নিজেদের আড়ালে রাখতে এবং বাঁচানো ছাড়া এরা কোনো ক্ষতিও করছে না। এটা নিয়েই বেশ চিন্তিত সে। এমন ডাকাত অথচ ভালো লোকের আবির্ভাবে দেশের অবস্থা ভালোই কোনঠাসা। প্রত্যেক থানায় এটি নিয়ে তদন্ত চালানোর নির্দেশ দিয়েছে উপরতলা। রিপোর্ট গুলো দেখছিল আর নিজের মতো পয়েন্ট গুলো সাজাচ্ছিল। এমন সময় এডিশনাল এসপি শেখ লবিন এসে উপস্থিত হয়। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। এসেই খানিক গদগদ হয়ে বলে,

-“ম্যাম, লাঞ্চের টাইমেও আপনি কাজ করছেন? আসুন খেয়ে আসি।”

ছেলেটার কথার শেষে খানিক টান আছে। টেনে টেনে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য। সিলভিয়া কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তাকালো‌। তাকে দেখেই লবিনের এই গদগদ ভাবটা মোটেও পছন্দ নয় তার‌। ছেলেটা যে লাইন ও মারতে চায় সে বুঝে, এরজন্য‌ই কাজের বাইরে পাত্তা দেয় না। সিলভিয়ার জবাব না পেয়ে লবিন আবার বললো,

-“চলুন না ম্যাম। আমিও খাই নি, আপনার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিলাম। পাশের ক্যাফেতে গিয়েছে সবাই‌। চলুন না ম্যাম।”

খিদে যে পায় নি এমন না। ছেলেটার এত বার খাই নি বলায় সিলভিয়ার খিদে টা যেন বেড়ে যাচ্ছে। ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভেবে উঠে দাঁড়াতেই লবিনের মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে এলো। ভেবেছিল প্রতিবারের মতো এবারও ধমক খেয়ে ওয়াশরুমে ছুটতে হবে তার। খুশিতে গদগদ হয়ে কেমন নেচে উঠলো ছেলেটি। সিলভিয়া সেদিকে না তাকিয়েই বাইরে বেরিয়ে এলো‌। কয়েকজন হাবিলদার নিজেদের জায়গায় বসেই খাচ্ছে। সিলভিয়া টুপি টা কেবিনে রেখে এসেছে। ক্যাফ টা পাশেই, সময় লাগবে না। চেয়ার দখল করে বসতেই লবিন এসে আরেকটা চেয়ার দখল করে নিলো। কিছু বলতে গিয়েও সিলভিয়া চুপ র‌ইলো। অনেক মানুষ, অপমানিত হতে পারে। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“একটা কথাও বলবেন না, চুপচাপ খাবেন।‌”

লবিনের গদগদ ভাব একদম ফুস হয়ে গেল। ভেবেছিল আজ সুযোগ মতো নিজের প্রশংসা খানিক নিজেই করবে, যদি পটে যায়। তা তো হলোই না, আহ্লাদের খাবার টাও এখন গলা দিয়ে নামবে না। মিনমিনে সুরে বললো,

-“আপনি আমার সাথে অযহত এমন করেন ম্যাম, আমি কি অযহত কথা বলি? খুব কষ্ট পেলাম।”

-“তা কত কেজি কষ্ট পেয়েছেন?”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লবিন। এই মেয়ের তাও মন গললো না, উল্টো প্রশ্ন করছে কত কেজি কষ্ট পেয়েছে? লবিনের মনটা ভেঙে কয়েকভাগ হয়ে গেল। আর কিছু বলার সুযোগ সে পেল না। তার পূর্বেই পাশের টেবিল থেকে ভেসে এলো বেসুরে গলার গান,
“ও মাউয়মা তোমার সিলু কথা শুনে না!
যার তার লগে কথা বলে আমায় চিনে না!
ও সিলু স্টেশনে যাইবো, দরজায় দাঁড়াইবো! সিলুরে দেইখা আমার পরাণ জুড়াইবো!”

রাগে চোখ বুজে নেয় সিলভিয়া। কন্ঠটা তার অতি পরিচিত। তাকেই যে উদ্দেশ্যে করে বলছে , জানে। কিন্তু এই মুহুর্তে সে কিছুই বলতে পারছে না। সিলভিয়ার রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে লবিন আর কিছু না বললেও ফিক করে হেসে দিল শিতাব। এই শান্তির কাছে সব শান্তি ফেইল। জলন্ত চোখে একবার তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো সিলভিয়া, গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিতাব। শিতাবের টেবিলের সামনে এসেই খানিক ঝুঁকলো সে। শিতাব বাঁকা হেসে বললো,

-“এসপি সিলভিয়া রেড, কিছু বল…?”

বলতে পারে না শিতাব, ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় সিলভিয়া। আপনাআপনি গালে হাত চলে যায় শিতাবের। সিলভিয়া চোখ রাঙিয়ে হাঁটা ধরে। এতগুলো মানুষের সামনে চড় খেয়ে কোনো অপমান বোধ‌ই হয়না ছেলেটার। চড়ের বদলা নিতে গলা উঁচিয়ে বলে উঠে,

-“একশত একচল্লিশ খানা চড় কে সুদে আসলে দুইশত বিরাশি খানা চুমু তে পরিণত করবো এসপি সিলভিয়া রেড়।”

সিলভিয়া ফিরেও তাকায় না। শিতাব কিটকিটিয়ে হেসে উঠে। তেড়ে আসে লবিন‌। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,

-“এই ছোকড়া তোমার তো সাহস কম না, কি বললে তুমি? আবার বলো।”

এই লবিন ছেলেটা কে তার তিনমাস ধরে অপছন্দ। চার মাস আগে চাকরিতে জয়েন করে, তিনমাস ধরে তার সিলসিলা রানীর সামনে ভালো সাজতে চায়। একবার তো হাত পা ভেঙে দিতেও চেয়েছিল, নেহাত বন্ধুরা আটকিয়ে ছিল। নাহলে দেখিয়ে দিত এই ছেলেকে। একে তো তার সিলসিলা রানীর সাথে বসে লাঞ্চ করছে, তার‌উপর তাকে সাহস দেখাতে আসছে। শিতাব দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত চোখে তাকায়। পরক্ষণেই হেসে বলে,

-“ইউ লবণ, তুমি তেতো। তোমার এরকম মিষ্টি মিষ্টি কিসি কিসি কথা পছন্দ হবে না। তাই তেতো তেতোর মতো থাকো, মিষ্টি হতে চেও না। শিতাব যাবীর মধ্যে মিষ্টান্নের অভাব নেই। শুধু প্রয়োগ করা বাকী। তা খুব শীঘ্রই প্রয়োগ করবো।”

লবিন কে বিস্ময়ের সাগরে ভাসিয়ে শিতাব গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে আসে‌। আর লবিন সে তো আহম্মক হয়ে বুঝার চেষ্টা করে ছেলেটা তাকে অপমান করলো নাকি নিজের প্রশংসা করলো!

…..

তিন শাশুড়ি ব‌উমার ঝগড়ায় হক বাড়ি রমরমা। চায়না বেগম সকালে নিরব ভূমিকা পালন করলেও তাকে ‘মিল্করাইস’ বলার খেসারত ঠিক‌ই বেনিফিট খাজা কে দিতে হচ্ছে। একটু পর পর এটা ওটা রান্নার হুকুম দিচ্ছেন, বেনিফিট খাজা আবার এরকম হুকুমে না করতে পারেন না। সব বানিয়ে দিচ্ছেন, তা গোগ্রাসে গিলছেন চায়না বেগম। প্রথম দিকে ব্যাপার টা হালকা করে নিলেও, এখন বেনিফিট খাজা চেতে গেছেন। কখনো কালাই ভাজাচ্ছেন, কখনো পপকর্ন, কখনো রুটি, কখনো সুপ , কখনো ভাত, বিভিন্ন তরকারি আবার পানের বাহার তো আছেই। নিজেও যে ছেলের ব‌উ কে শান্তি তে রেখেছেন এমন না। নতুন ব‌উ কে দিয়ে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করার থেকে ভালো কাজ আর পাননি বেনিফিট খাজা। এমন ভাবে গদগদ হয়ে বেনিফিট খাজা কাজের কথা বললেন ডেজি না করতে পারে নি। সহজ সরল মন তার, একটু গদগদতেই গলে গিয়ে রাজী হয়ে গেছে। কিন্তু এত বড় বাড়ি, এত গুলো ঘর হাঁপিয়ে গেছে মেয়েটি। তার উপর বেনিফিট খাজা বসে নেই, একটু পর পর নিচ থেকে ‘ডেজি মা’ বলে ডেকে উঠছেন রাগী ব্যবহার‌ও সে করতে পারছে না। হাসতে হাসতে অত্যাচার করছেন বেনিফিট খাজা, আর তাকেও হাসতে হাসতে মানতে হচ্ছে। এতকিছুর মাঝে পরিবানু আর তার দুই মেয়ে বসে আছেন খালি হাতে‌। বরং তারা এই রমারমায় গাঁ ভাসিয়ে হাসছেন। কাজ নেই আর কি লাগে।

শিতাব যখন বাড়ি এলো তখন ডেজি বেনিফিট খাজার ঘর পরিষ্কার করছিল। শিতাব, শাম‌উলের বাড়ি এসে প্রথম কাজ‌ই হলো মায়ের ঘরে উঁকি দেওয়া, প্রথমেই মায়ের সাথে দেখা করা। আজ‌ও তাই হয়েছে, তবে এসেই যে এতবড় চমক দেখবে ভাবেনি। ডেজিকে কাজ করতে দেখে শিতাব রসিকতা করে বললো,

-“বাহ, ভাবী। আমি বলেছিলাম দুটো দিন দেখ। তুমি তো দেখছি কয়েক ঘন্টায় সবাই কে চিনে ফেলেছো। কি সুন্দর কাজ করছো।”

ডেজি রক্ত লাল চোখ তাকাতেই শিতাবের হাসি হাসি মুখটায় আঁধার নেমে এলো। শুকনো ঢোক গিলে মানে মানে কেটে পড়তে চাইলেও পেরে উঠলো না। কলার চেপে ফ্লোরে বসিয়ে দিল ডেজি। ভেজা কাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-“তাড়াতাড়ি করো, নাহলে আমিও দেখবো তুমি কিভাবে ওই মেয়েকে বিয়ে করো। বেনিফিট গাঁজার মাথায় এমন কথা ঢুকিয়ে দিবো, আজন্মের মতো বিয়ে করার শখ মিটে যাবে।”

শিতাব করুণ, অসহায় চোখে তাকালো। মেয়েটা কে সে অত্যন্ত ভদ্র সহজ সরল ভেবেছিল। কিন্তু তার বুঝা উচিত ছিল সিলভিয়া রেড়ের বোন শান্তশিষ্ট হবে ভাবা বোকামি‌। ভালোবেসে নিজের পরিণতি দেখে শিতাবের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এর থেকে অবশ্য‌ই আত্ম’হত্যা ভালো ছিল। একটা মেয়ের জন্য পুরুষ জাতির সকল গুমোর সে এক নিমিষেই ভেঙে দিল। অসহায় কন্ঠে বললো,

-“ওটা খাজা হবে, গাঁজা নয় ভাবী।”

ধমকে উঠলো ডেজি,

-“তুমি চুপ করো, পাঁচ মিনিটে পরিষ্কার করবা‌। নাহলে কিন্তু..”

শিতাব ধমক খেয়ে আর কিছু বলার সাহস পেল না। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে হাতে থাকা নোংরা কাপড়টার দিকে তাকিয়ে বললো,

-‘হাইরে ভালোবাসা, শেষমেষ আমারে তুই এই পর্যন্ত নামিয়ে আনলি।”

উবু হয়ে ঘরের মেঝে পরিষ্কার করার পর শিতাব উঠে দাঁড়ালো। বিছানায় শুয়ে পড়ে ডেজির দিকে তাকিয়ে বললো,

-“ওসব কিছু না ভাবী, আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি বলে, তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারি না বলেই আমি তোমাকে সাহায্য করলাম।”

ফিক করে হেসে ফেললো ডেজি। শিতাবের বাহুতে চাপড় দিয়ে হেসে বললো,

-“এত বদমাইশ কি করে হলে? তোমার ভাই তো এমন না!”

-“আমার ভাই কিন্তু খুব রোমান্টিক!”

-“রোমান্টিক না কচু, ভিতুর ডিম কোথাকার। বাসর ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে, রাসকেল।”

কথাটা শোনা মাত্র‌ই হো হো করে হেসে দিল শিতাব। তার হাসি যেন থামছেই না। ডেজি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে র‌ইলো, কিছু বললো না। শিতাব এক সময় উঠে বসে বললো,

-“তোমাকে এত কাজ করাচ্ছে বাড়িতে বলছো না কেন? বলে দাও তোমার বোনকে।”

-“তোমার কি মতলব বলোতো।”

শিতাব হতাশার শ্বাস ফেললো। উঠে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকালো। উদাস কন্ঠে বললো,

-“মতলব কিছুই না, ওই মেয়ে আজ আরেকটা চড় মেরে একশত একচল্লিশ মিল করেছে। তার‌ উপর আজ ওই মেয়ের জন্য আমার ষাট টাকা গাড়ি ভাড়া, তিনশো ষোল টাকার খাবার খরচ গিয়েছে‌। এত সহ্য হয় ভাবী? তুমিই বলো।”

চলবে…?

শব্দ সংখ্যাঃ ১৩৩৩

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে