#বেনিফিট_অফ_লাভ -৪
Tahrim Muntahana
মাথায় বরফের এক টুকরো ফেলে রেখে অস্থির চিত্তে পাইচারি করছেন বেনিফিট খাজা। চোখ তাঁর অসম্ভব বড়। বরফ গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছে, সেদিকে খেয়াল নেই। ড্রয়িং রুমে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন মনসুর হক, চাঁন হক ও তার স্ত্রী পরিবানু। চাঁন হকের দুই মেয়ে কোনো রকম পালিয়ে ঘরের দরজা টেনেছে। এত বড় অপমান, এত বড় হার কিছুতেই মানতে পারছেন না বেনিফিট খাজা। মনে হচ্ছে সিলভিয়ার মাথাটা ফাটিয়ে দিতে পারলে, আবার কখনো মনে হচ্ছে বরফের উপর মেয়েটাকে শুয়িয়ে রাখতে পারলে, নাহয় ফুটন্ত গরম পানি তে চুবিয়ে রাখতে পারলে। সবচেয়ে বেশী রাগ তো তার শামউলের উপর হচ্ছে। পাইচারি করতে করতে তিনি বললেন,
-“কত বিগ হারামি আমার সন। কোনো প্রতিবাদ করলো না, হোয়াই? ফাদার ইন লো হোমে থাকার জন্য ডান্সিং করে উঠলো। মিল্ক ব্যানানা দিয়ে কালস্নেক পুষছি। মাদার থেকে ওয়াইফ বেশী বিগ হয়ে গেল। মি যে টেন মান্থ বেলিতে রাখছি তার কোনো দাম নাই। এরকম সন কারো বেলিতে না আসুক।”
আবার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“ইউ মাদারের মনু, ইউ মাদার ভক্ত, বাট ইউর সন নট মাদার ভক্ত। আমার লাইফ অবহেলা পেতে পেতেই গোয়িং। এই আমার কপালে ছিল? এর আগে আমি নো মোর হলাম না হোয়াই মাই আল্লাহ?”
আবার একা একা মন খারাপ করে বলছেন,
-“মাই সন ইউর কি কষ্ট হচ্ছে? মাদার কে ফরগট করে দিও। ইউ কে রেখেই চলে এলাম। আ’ম এ পঁচা মাদার।”
শেষের কথাটা শুনে মনসুর হক ফিক করে হেসে দিয়েই যেন নিজের কাল ঘটালেন। বেনিফিট খাজা চশমা ভেদ করে এমন ভাবে তাকালেন মনসুর হক এক ছটকায় ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। আজ আর তার রক্ষা নেই। হলোও তাই, বেনিফিট খাজা গর্জে বলে উঠলেন,
-“ইউ মাদার ইন লো’র মনু, তোমাকে আজ করবো তনুতনু।”
বলেই তিনি এগিয়ে যাবেন, এর আগেই ফ্যাচফ্যাচে কন্ঠে ডেকে ডেকে উপস্থিত হলেন চায়না বেগম,
-“আমার মনু আইছো? আমার চান্দে আইছো? কই, কই দেখি আমার মানিকরে।”
বেনিফিট খাজা মুখ বেঁকিয়ে প্রস্থান করলেন। শাশুড়ির এই ঢং তার মোটেও পছন্দ নয়। চায়না বেগম ছেলেদের মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন কিছু একটা হয়েছে। ভ্রু কুঁচকে তিনি বলেন,
-“কই? রানী ফিট খাঁ কই?”
-“আম্মা তুমি আবার এই নামে ডাকো?”
-“তো কি ডাকবো? রানী ফিট খাঁ কি ফিট খায়ছে নাকি? আমার নাতি নাতিবউ কই?”
মনসুর হক সবটাই বলেন। চায়না বেগমের রাগ যেন আকাশ ছুঁবে। মেয়ে বাড়ি লোকের এত গোমর? কেন থাকবে? তিনি গলা উঁচিয়ে বলেন,
-“ফিট খাঁ কই ছিল? মুখে কথা ছিল না? তাড়াতাড়ি আমার নাতিরে আনার ব্যবস্থা করো। নাহলে তোমাদের দুইটারে সহ ওই ফিট খাঁ রে ফিট করিয়ে ছাড়বো, এই বলে রাখলাম।”
ঘর থেকে বেনিফিট খাজা সব শুনতে পান। এমনিই তার মাথায় আগুন, তার উপর শাশুড়ির এমন কথায় রাগে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। বরফ টুকরা ইতিমধ্যেই গলে গেছে। তিনি ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়েই কোমরে হাত রেখে গজ গজ করে বলেন,
-“চায়না কোম্পানীর চোরাই মাল চুরি করা চোরের মতো অতি বুদ্ধিসম্পন্ন মহিয়সি নারী চায়না বেগম, ইউকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি; আমার নেইমের এমন বিকৃতি করলে মি ইউকে চায়নার রেখে আসবো।”
-“কি বললা তুমি? ফিট খাঁ আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন।”
শাশুড়ির কথায় শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে বেনিফিট খাজা এগিয়ে আসেন। দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলেন,
-“চায়না কোম্পানীর জন্যই টুডে মি’র এত অপমান সহ্য করতে হলো। ইনিই মি কে বলেছিল বাইক আর ল্যাপটপ চাইতে। নাউ মি কে রাগ দেখানো হচ্ছে?”
চায়না বেগম এবার একটু থামলেন। সাথে সাথে বেনিফিট খাজাও চুপ করে নিজের রুমে চলে এলেন। ছেলে মেয়ের জন্য তার মন ভীষণ পুড়ছে। কি করছে কে জানে?
…
রান্না করছিলেন সিমা শিকদার। তাকে সাহায্য করছিলেন ভাইয়ের দুই বউ। এই সময় শিতাব গলা উঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে রান্না ঘরে এলো,
-“শাশুড়ি, ও শাশুড়ি, কই তুমি?”
সিমা শিকদার ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না কাকে ডাকছে ছেলেটা। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
-“তুমি কাকে ডাকছো?”
-“ওহ সরি, শাশুড়ি নয়, ভাইয়ের শাশুড়ি হবে।”
বলেই হে হে করে হেসে উঠলো। সিমা শিকদার কিছুক্ষণ ভাবলেন, ছেলেটার মতলব ভালো না। ঠিক তখনই শিতাব ভাবনা টা বাড়াতে না দিয়ে বললো,
-“আসলে কি বলে ডাকবো বুঝতে পারছিলাম না তো, তাই আর কি!”
সিমা শিকদার ও এবার হাসলেন। শিতাবের চিবুকে হাত বুলিয়ে বললেন,
-“আন্টি বলেই ডেকো।”
শিতাব বাধ্য ছেলের মতো মাথা কাত করে বলে,
-“আমার ক্ষিদে পেয়েছে আন্টি।”
ছেলেটাকে ভীষণ ভালো লেগে যায় তার। কেমন আপন ভেবে সব বলছে। টেবিলে নাস্তা দিতেই শিতাব আগেভাগে খেয়ে নেয়। একদম ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না সে। এবার একটু ভাইয়ের খোঁজে যাওয়া দরকার। কালকের ঘটনার পর আদৌ ঠিক আছে কিনা কে জানে। দরজায় টোকা দেয় কয়েকবার। সাড়াশব্দ নেই।জোরে ধাক্কা দেয়, পিটপিট করে চোখ খুলে শামউল। নিজেকে ফ্লোরে দেখে চমকে উঠে সে। মনে পড়ে যায় কালকের রাতের কথা। ভয়ে বারংবার ঢোক গিলে দরজা খুলে দেয়। ছোট ভাইকে দেখে একটু সাহস ও পায়। জাপটে ধরে বলে,
-“তুই, বাড়ি যাবো কখন?”
-“বাড়ি যাবা মানে? একবছর থাকবে!”
-“আবুল তাবুল বকিস না, আজ বাড়ি ফিরবো।”
শিতাব উত্তর কাটতে পারে না। তার পূর্বেই ডেজি ঘুম থেকে উঠে পড়ে। একেতো তার কালকের রাত স্পয়েল্ড হলো, তারউপর ওই বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনেই রাগ বেড়ে যায় তার। ক্ষোভ মিশিয়ে বলে,
-“আমি ওই বাড়িতে যাবো না, আপনার মা আমাকে রেখে যেতে চেয়েছিল দেখেননি? আপনি গেলে যান। আমি বাপের বাড়িই থাকবো।”
শামউল স্ত্রীর দিকে তাকায়। শান্ত স্বরে বলে,
-“তা হয়না ডেজি।”
-“হবে না কেন? কালকের অপমান আমি ভুলিনি, আপনি এবং আপনার ওই ফাউল মা পার পাবেন না।”
মায়ের সম্পর্কে এমন শুনে আগুন চোখে তাকায় শামউল। ডেজি পাত্তা দেয়না। বোকা বোকা কথা বলা ছেলেটার রাগ থাকতে পারে কিনা ডেজির সন্দেহ। শামউল গম্ভীর তেজি গলায় বলে,
-“ভালো করে কথা বলো ডেজি। আমার মা হয় উনি?”
-“হ্যাঁ জানি জানি, আপনার ওই জুকার মা। যার কথা বলার ঠিক নেই, ন্যায়-অন্যায় বুঝে না। অন্য নারীকে সম্মান করতে জানে না।”
-“ডেজি আমি সাবধান করছি, ঠিক করে কথা বলো।”
-“কি করবেন? আপনার মুরোদ আছে? মেরুদণ্ডহীন আপনি, হবু বউয়ের সম্মান রাখতে পারেন না। এখন মায়ের কথা শুনে রাগ হচ্ছে?”
শামউলের সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেল। তেড়ে এসে ধমকে উঠতেই কেঁপে উঠলো ডেজি। রাগ তার তবুও কমলো না। হনহন করে বাইরে চলে গেল। শিতাব শুধু দেখেই গেল, কিছুই বলতে পারলো না। শামউল বললো,
-“সাম্মা কে বল রেডি হতে, একটু পরেই রওনা হবো।”
-“ভাইয়া পাগলামি করো না, মাথা ঠান্ডা করো। ভাবীর এখানে দোষ থাকলেও পুরো দোষ কিন্তু নয়। কালকে সে যেমন দেখেছে এসব বলা অসম্ভব কিছু নয়। না বলায় অস্বাভাবিক লাগতো। মানুষ রাগ থেকে তো যা খুশি বলে, ভাবী কি আমাদের সাথে মিশেছে? মিশলে তো বলতে পারবে মম কেমন, আমরা কেমন।
আর তোমার ব্যাপারে ধারণা করাও ভুল নয়, তোমার মমের সামনে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল, সেখানে তুমি চুপ ছিলে। এখন ভাবীর ধারণা হতেই পারে তুমি তার সম্মান রাখতে পারবে না। আর এখানে মমের ও দোষ নেই। মম তো আগে থেকেই এমন। যৌতুকের বিষয় টা দাদীই মমের মাথায় ঢুকিয়েছে, না হলে কাল এমন করতো না কখনোই। যার যার জায়গা থেকে তোমরা ঠিক, পরিস্থিতি বামে ছিল। এখন তুমিও যদি ভাবীর ভুল ধারণা টা না ভেঙে অভিমান করো তাহলে সম্পর্কে শান্তি আসবে না। কয়দিন পর বাচ্চার বাপ হবা, এখন তোমাকে এসব বুঝাতে হয়।”
শেষের কথাটায় কি এক বিরক্তি। শামউল ভাইয়ের কাঁধ চাপটে মুচকি হাসে। বলে,
-“বাবাহ, আমার ভাইয়ের দেখছি অনেক বুদ্ধি।”
-“হ্যাঁ, সংসার কিভাবে করতে হয় জানা আছে। তাড়াতাড়ি বিয়ে একটা করিয়ে দাও। পরের বছরই তোমাকে চাচ্চু ডাক শোনাবো। আল্লাহ’ই জানে তুমি এত তাড়াতাড়ি পারবা কিনা!”
শামউল চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। শিতাব দাঁত বের করে হাসে। শামউল ঠাস করে চড় বসায় পিঠে। ব্যথায় পিঠ বেঁকিয়ে রাগ দেখায় শিতাব। পরক্ষণেই দুজন ফিক করে হেসে দেয়। কারো কাশির শব্দে দু ভাই দরজায় তাকায়। সিলভিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সিলভিয়া কে দেখেই শিতাবের মনের ভেতর সুরসুর করে প্রশান্তির হাওয়া ঢুকে পড়ে। সিলভিয়া বলে,
-“খেতে আসুন!”
শামউল মাথা নেড়ে হাঁটা ধরে, বউয়ের রাগ ও ভাঙাতে হবে। শিতাব সিলভিয়া কে একা পেয়েই বলে,
-“আসসালামু আলাইকুম বেয়ানসাব!”
দাঁতে দাঁত চেপে সিলভিয়া কিছু বলবে পূর্বেই শিতাব হে হে করে হেসে বলে,
-“আমি জানি, আপনার পকেটে সরকারি রিভলবার, সরকারি গুলি! কিন্তু আমার বুকটা সরকারি নয়, ব্যক্তিগত। তাই আপনার ব্যক্তিগত রিভলবার দিয়ে যদি ঝাঁঝরা করতে পারেন, এই শিতাব যাবী হাসতে হাসতে মৃত্যু কে বরণ করে নিবে।”
সিলভিয়া কথা বাড়ায় না, এই ছেলে কথা বললেই কথা বাড়ানোর সুযোগ পাবে। শিতাব আবার পেছন থেকে বলে,
-“জাস্ট এক সপ্তাহ, এরপর দেখ সিলভিয়া রেড তুমি নিজেই আমাকে বিয়ে করবে।”
সিলভিয়া তাচ্ছিল্য হেসে চলে যায়। পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়। চরম অপমানিত হয় শিতাব। মেয়েটা তাকে গুনতাই ধরছে না। মনে মনে বিশাল প্ল্যান করে হাসতে হাসতে ছাদের দিকে চলে যায় শিতাব। বিড়বিড় করে বলে,
-“এবার বুঝবা সিলসিলা রানী!”
চলবে…?