বৃষ্টি শেষে রোদ পর্ব-২+৩

0
747

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

‘ভাইয়া তোকে নিয়ে জেলাস’ রুমকির কথাটা যেন আরশির কিশোরী মনে জেগে উঠছে নানান কৌতুহলী প্রশ্ন। তখন রিদের শান্ত দৃষ্টিও কি একই কথার ঈঙ্গিত দিচ্ছিল? নাকি এটা পুরোটাই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

রুমকির রুমে এসে চিন্তিত ভঙ্গিতে বিছানার এক পাশে বসে রইল আরশি। হটাৎ রিদ রুমে আসতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল সে। বিছানা থেকে উঠে দাড়াতেই রিদ তার এক হাত চেপে ধরে বেলকনিতে নিয়ে গেলো চুপচাপ।

আরশির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। মুঠো হাতের এক আঙুল দিয়ে তাকে শাসিয়ে তীব্র অধিকারী কন্ঠে বলে,
“এই ফারুক নামের ছেলেটার থেকে দুরে থাকবি। তোকে যেন তার আশে পাশেও দ্বিতীয় বার না দেখি।”

রিদের এমন ব্যবহারে মনে কিছুটা ভয় জন্ম নিলেও কৌতুহল বসত আরশি বলে উঠে,
“কেন ভাইয়া?”

আরশির পাল্টা প্রশ্ন শুনে রিদ কিছুটা ধমকের স্বরে বলে,
“আমি বলেছি তাই।”

এই মুহুর্তে পাল্টা প্রশ্ন করার সাহস হলো না আরশির। নত মাথা হালকা নাড়িয়ে ছোট করে বলে,
“আচ্ছা।”

আরশির এমন ইনোসেন্ট ভাব দেখে আর কিছু বলতে পারলো না রিদ। চোখ বুঁজে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে রইল সেখানে। আরশিও পাশে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ।

কিছু সময় নিরবতায় পার হলে আরশির মুখের সামনে আসা পাতলা চুল গুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল রিদ। আরশির মায়াবী মুখশ্রীতে দৃষ্টি রেখে এবার পুরোপুরি শান্ত গলায় বলে,
“ভয় পেয়েছিস? স্যরি, এভাবে বলার জন্য। জানিস তো, আমার অসহ্যকর এমন কিছু ঘটলে চারপাশে সব কিছু এলেমেলে মনে হয়। খুব রাগ হয় আমার, খুব।”

বলেই চুপচাপ চলে গেলো সে। আরশি দাড়িয়ে রইল ওভাবেই। রিদের চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি রাখলো সে। বুকের ভেতর ধুকপুক করা অনুভুতি নিয়ে গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকলো।
অসহ্যকর বলতে কি বোঝালেন তিনি? রুহি আপুর দেবরের সাথে কথা বলাটা অসহ্যকর, নাকি সে হাত ধরতে চাওয়াটা অসহ্যকর মনে হলো আপনার কাছে? তাছাড়া যাই হোক, তাতে আপনার এত অসহ্যকর মনে হবে কেন? আজব!

আনমনে কিছুক্ষণ ওভাবে দাড়িয়ে থাকলো আরশি। রুমি পাশে এসে দাড়ালে স্বাভাবিক হয়ে সেদিকে তাকায় সে।
রুমকি ক্ষনিকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
“আরশি দেখ, আমরা রুহি আপুকে কত আবুল ভাবতাম। অথচ সে কতক্ষণ ধরে ফাহিম ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। এতক্ষণ কি কথা বলছে ওটা ভেবেই অবাক হচ্ছি আমি।”

আরশির মনে এমনিতেও অন্য বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্য কিছু নিয়ে খুব একটা ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না আপাতত। তাই স্বাভাবিক গলায় বলে,
“তো আপু তার হবু বরের সাথে কথা বলবে না তো কার সাথে বলবে?”

রুমকি চেহারায় এখনও সেই চিন্তার ছাপ রেখে পূনরায় বলে,
“তাই বলে এই আবুল মেয়েটা এতক্ষণ কিভাবে কথা বলছে? বিষ্ময়কর!”

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময়ের পর মোটমুটি লজ্জা ভাঙলো দুজনেরই। ফাহিম স্বাভাবিক গলায় রুহিকে বলে,
“আচ্ছা তোমাকে সরাসরি কিছু প্রশ্ন করি? একদম নিশ্চিন্তে উত্তর দিবে। ভয় পাওয়া বা নার্ভাস হওয়ার কোনো কারণ নেই।”

রুহি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। ফাহিম পূনরায় বলে,
“বিয়েটা কি তোমার ইচ্ছায় হচ্ছে? আই মিন ফ্যামিলি প্রেশারে তুমি বিয়ে করছো না তো? এমন কিছু হলে আমার নিশ্চিন্তে বলতে পারো।”

রুহি মাথা নিচু অবস্থায় জবাব দেয়,
“কেউ জোর করেনি আমাকে।”
ফাহিম এবার বুকে দু’হাত গুঁজে দুষ্টু হেসে বলে,
“আমাকে পছন্দ হয়েছে?”

ক্ষনিকটা লজ্জা পেলো রুহি। ফাহিম পুনরায় বলে,
“বিয়ের কথাবার্তা চলছে অলরেডি। তোমাকে নিজের মানুষ ভেবেই সরাসরি এসব বলছি। তাই আমার কাছে কোনো রকম লজ্জা পাওয়া বা নার্ভাস হওয়ার কারন নেই।”

লজ্জা জনক ভাবে হ্যাঁ সূচক হালকা মাথা নাড়ালো রুহি। অতঃপর লজ্জায় মুখ নিচু করে নিল সে। ফাহিম কিছুটা হেসে বলে,
“কিছু মনে করো না। আমি এমনই। কখনো মনে কৌতুহল বা কোনো কিছু লুকিয়ে রাখতে পারি না। তাই যেই মানুষটার হাত ধরে আমি সারা জীবন পার করার স্বপ্ন দেখবো, যে মানুষটার সাথে বাকি জীবনটা পাড়ি দিবো, সে মানুষটার সম্মতিটাও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটা সম্পর্কে দুজনের মতামতই সবার উর্ধে। তাই সরাসরিই জেনে নিলাম। যাই হোক, কনগ্রেচুলেশন টু ইউ এন্ড মি।”

অভিনন্দন জানানোয় রুহি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে বলে,
“কেন?”
“তুমি আমাকে পাচ্ছো, আর আমি তোমাকে,,,, তাই।”
বলেই মুচকি হাসলো ফাহিম। বিপরীতে হেসে দিল রুহিও। মানুষটা কেমন হবে এই কৌতুহলে বুকের ভেতর উম্মাদ হওয়া হৃদপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দটা যেন হালকা হতে শুরু করেছে একটু একটু করে।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

আরশি ও রুমকির পাশে এসে বসে হাফ ছেড়ে নিশ্বাস নিলো রুহি। রুমকি হাস্যজ্জল চহুনিতে তীব্র কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
“দুলাভাইয়ের সাথে কি কথা হয়েছে আপু?”

রুহি শ্বাস নিয়ে নিজেকে হালকা করে বলে,
“তোর এত জানার আগ্রহ কেন?”
“বলো, আমরাও শুনি। অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে না?”

এর মাঝেই রোহান উপস্থিত হয় সেখানে। রুমকির দিকে চেয়ে বলে,
“রুহিরে, এই বাতি লেবুটাকে তোর আগে বিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল।”

পাশ থেকে রোহানের কথায় মুখ চেপে হেসে উঠলো রুহি-আরশি দুজনই। শুধু হাসেনি রুমকি। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে রাগী দৃষ্টিতে রোহানের দিকে চেয়ে বলে,
“আপনি বাতি লেবু কাকে বললেন?”

রোহান স্বাভাবিক ভাবে আরশি ও রুহির দিকে চেয়ে বলে,
“আমি কি কারো নাম ধরে বলছি?”
আরশি রুহি দুজনই মাথা নেড়ে বলল,
“না তো।”
রোহান এবার একটু ভাব নিয়ে বলে,
“তাহলে তার গায়ে লাগলো কেন? নিশ্চই চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।”

আবারও হাসলো সবাই। সবার মাঝে হাসির পাত্র হয়ে রুমকি এবার রোহানের দিকে চেয়ে ক্ষুদার্থ বাহিনীর ন্যয় ফোঁসফোঁস করে কয়েকটা শ্বাস নিল। ইচ্ছে হচ্ছে রোহানকে ধরে কাপড় কাঁচার মতো করে কয়েকটা আছাড় দিতে। কিন্তু এত বড়ো দামড়া ছেলেকে তুলে আছাড় দেওয়ার শক্তি ও সাহস কোনোটাই নেই তার। তাই নিজের রাগ কমাতে কয়েকটা কড়া কথার বিকল্প নেই। তবে কি বলা উচিৎ তা এই মুহুর্তে খুঁজে না পেয়ে বলে উঠে,
“অভিশাপ দিলাম, আপনার জীবনেও বিয়ে হবে না।”

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

পাত্র পক্ষ চলে গেছে অনেক আগেই। এখন রাত প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই। ব্যস্ততা শেষে ঘুমাতে গেলো বাড়ির সবাই।
মাঈমুনা চৌধুরী চোখে মুখে এক রাশ চিন্তার ছাপ নিয়ে রোহানকে ডেকে বলে,
“রিদ কোথায়রে রোহান। সেই সন্ধার পর থেকে এখনো কোনো খবর নেই। ফোন দিচ্ছি।, ফোনও বন্ধ। কোথায় গেলো ছেলেটা? তোকে কিছু বলেছিল?”

ফোন হাতে শুয়ে ছিল রোহান। শোয়া থেকে উঠে লাইট অন করে চাচির দিকে চেয়ে বলে,
“কই না তো চাচি। আমি তো ভেবেছি, আপনারাই কোনো জরুরি কাজে কোথাও পাঠিয়েছেন তাকে।”

রুমকির পাশে চুপচাপ শুয়ে ছিল আরশি। অজানা কোনো কারণে বা অকারণে ঘুম আসছিলো না তার। হটাৎ পাশের রুম থেকে এমন কিছু শুনেই বিছানায় উঠে বসে গেলো সে। বুকটা টিপটিপ করতে শুরু করেছে। নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার মনে। এত রাতে বাইরে কি করছে রিদ ভাই? কেন এখনো ঘরে ফিরেনি? নাকি রুমকির কথাই সত্যি। আমার উপর রাগ করে বাইরে পরে আছে না তো? যদি এমনটাই হয়, তাহলে এত রাগ কেন তার? এমন পাগলামির কোনো মানে আছে?

ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সে। রুমের বাইরে সবার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেখানে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না তার। যদি মা জেনে যায়, আরশির উপর রাগ করে রিদ এখনো ঘরে ফিরেনি, তাহলে নিশ্চই মায়ের অনেক বকাঝকা শুনতে হবে তাকে।

হটাৎই কথাবার্তার পরিবর্তন দেখে হেটে দরজার সামনে এসে দাড়ায় আরশি। পর্দা সরিয়ে রিদকে দেখে একটা স্বস্থির নিশ্বাস নিল সে। তার মানে রাগ কমেছে তার? তাছাড়া সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এমন রাগ করার কি আছে? আজব মানুষ!

এত রাত বাইরে থাকার কারণ জানতে চেয়ে রুদ্র চৌধুরী বলে,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
রিদ অনেকটাই ক্লান্ত গলায় বলে,
“হসপিটালে।”
পাশ থেকে মাঈমুনা চৌধুরি বলে,
“হসপিটাল! সব ঠিক আছে তো?”

রিদ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“হুম সব ঠিকঠাক। রাফিকে(রিদের বন্ধু) ছিনতাইকারী ধরেছিল। মাথায় আ’ঘাত করায় হসপিটালে নিয়ে ছয় সেলাই দিতে হয়েছে। তারপর বাসায় পৌছে দিয়ে আসতে হয়েছে তাকে।”

পূনরায় খাটে এসে শুয়ে পড়লো আরশি। এতক্ষণ কতকিছুই না মাথায় এসেছিল, তার উপর রাগ করে রিদ বাইরে পড়েছিল। রিদ ভাই তাকে নিয়ে জেলাস দেখে রাগ করে ছিল। এখন দেখছে এমন কিছুই না। ধুর ছাই!!!

যাই হোক বাসায় ফিরেছে, চিন্তা কমেছে। এটাই অনেক। ভেবেই চোখ বন্ধ করলে পাশ থেকে রুমকি বলে,
“ভাইয়া ফিরে এসেছে ভাবি। এখন আর টেনশন করতে হবে না। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো।”

আরশি মুহুর্তেই তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
“তুই ঘুমাস নি?”
রুমকি ঘুমো ঘুমো চোখে বলে,
“ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই যা শুরু করে দিয়েছিল, তাতে মরা মানুষও লাফ দিয়ে উঠবে। আচ্ছা যাই হোক, আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না, ঘুমা।”

আরশি ক্ষনিকটা ভাব নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“তোর ভাইয়ের জন্য আমি কেন চিন্তা করতে যাবো?”
রুমি একটা হাই দিয়ে উল্টো দিকে কাত হয়ে চোখ বুঁজে নিয়ে বলে,
“বুঝি বুঝি।”
আরশি কি বলবে ভেবে না পেয়ে ক্ষনিকটা ব্যঙ্গ করে বলে,
“বুঝি বুঝি,,, বেশি বুঝিস তুই, ঘুমা।”

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

দু’দিন পর আরশির এক্সাম থাকায় পরদিন সকালে বাসায় ফিরে যায় তারা। এমনিতেও গতকাল ক্লাস মিস হয়েছে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল সে। বেলকনিতে যেতেই ছোট একটা ঢিলের মতো মোড়ানো কাগজ দেখতে পায় সে। হাতে নিয়ে খুলে দেখে ছোট একটা লেখা,,

প্রিয়ন্তি,,,,
‘আমার অনুভবে সৃষ্টি হওয়া সেই সৌন্দর্যের আবছায়াটাই হয়তো তুমি। তাই তো লুকিয়ে তোমার মন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে তোমারই অনুভূতির ডানায় চড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখি। শুনো, সেই রাজ্যে আমার রাজত্ব চিরধার্য। শুধু আমার।’

লেখাটা কয়েকবার পড়লো আরশি। কারো নাম উল্লেখ না থাকায় বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে,
“কে আপনি?”

To be continue………….

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ৩)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

চিঠি হাতে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল আরশি। দুরুদুরু বুকে বেশ কয়েকবার অগন্তুকের চিঠিটা পড়ে নিল সে। সেই অগন্তুক কে জানার তীব্র কৌতুহল হানা দিয়েছে মনে।
আজ নতুন নয়। গত সাত মাসে এই বারান্দায় ২৬ টা চিরেকুট পেয়েছে সে। নিয়ম করে প্রতি সাপ্তাহে একটা চিঠি। বৃহস্পতি, শুক্র, শনি প্রতি সাপ্তাহে এই তিন দিনের মাঝে যে কোনো একদিন চিরেকুট আসে। নির্দিষ্ট কোনো দিন উল্লেখ নেই। তাই কখন এসে রেখে যায় তা বোঝার উপায় নেই। রিদকে একটু একটু সন্দেহ হয়েছিল তার। কিন্তু সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও তাকে তার রুমে দেখে এসেছে। রাতে হসপিটাল থেকে ফেরার পর তিনি আর বাড়ি থেকেই বের হয় নি। তাহলে নিয়ম করে চিরেকুট রেখে যাওয়া ব্যাক্তিটা কে হতে পারে?

দুঃখজনক হলেও সত্য এই ছাব্বিশ টা চিরেকুটের মাঝে একটাতেও তার নাম উল্লেখ নেই। নেই তাকে জানার কোনো সূত্র। অগন্তুক হয়তো চাইছে তাকে ঘিরে তীব্র কৌতুহল সৃষ্টি হোক। বুক টিপটিপ করা অনুভূতি তৈরি হোক।

সাবিহার গলা শুনে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে রুমে ফিরে আসে আরশি। চিরেকুট টা লুকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বই গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। সাবিহা ব্যাগ কাধে আরশির রুমে প্রবেশ করে কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
“রেডি হতে এতক্ষন লাগে? কতক্ষণ ধরে এসে বাইরে অপেক্ষা করছি। জানিস না পরিক্ষার আগের দিনের ক্লাস কত গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাস শুরু হতে আর আধা ঘণ্টাও নেই। নির্ঘাত আজ তোর জন্য আমাকেও স্যার এর বকুনি খেতে হবে।”

আরশি ব্যাগ কাধে নিয়ে বলে,
“হয়ে গেছে আমার। সময় মতোই পৌছে যাবো, চল বের হই।”
,

পুরো রাস্তা বিষণ্ন মনে চুপচাপ ছিল আরশি। মনটা আজ সকাল থেকেই খারাপ। মামার বাড়ি থেকে বাসায় ফেরার পর ঘটে গেছে এক ঘটনা। বর্তমানে সেটা দুর্ঘটনা বললেও ভুল হবে না।

সকালে বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরই বাড়িওয়ালা এসেছিল ভাড়া নিতে। লোকটা অনেকটাই কর্কশ স্বভাবের। তাছাড়া এ মাসে টাকার সমস্যা থাকায় ভাড়া দিতে লেট হয়েছে কিছুদিন। যার কারণ স্বরুপ সকাল সকাল এসে অনেক কথা শুনিয়েছে।
ফলস্বরুপ আরশির বাবা রাগ করে তার কাছে থাকা ছয় হাজার টাকা বাড়িওয়ালার হাতে দিয়ে বলে, বাকিটা রাতে অফিস থেকে ফিরেই বাসায় পাঠিয়ে দিবে।

আরশির স্কুলের বেতন ও পরিক্ষার ফিস আজকে দেওয়ার কথা ছিল। এমন একটা ঘটনার পর সেও বাবার কাছে চাইতে আর সাহস করেনি। কারণ এই মুহুর্তে বাবার হাতে থাকা সব টাকাই বাড়িওয়ালাকে দিয়ে দিয়েছে সে। বিষণ্ন মনে চুপচাপ বেড়িয়ে যায় স্কুলের উদ্দেশ্যে।
,

স্কুলের সামনে পৌছেই ক্ষনিকটা অবাক হলো আরশি। গেটের সামনে কয়েকটা ছেলে দাড়িয়ে ছিল বাইক নিয়ে। তাদের মাঝে একজন ছিল রুহি আপুর হবু দেবর মানে ফারুক। আরশিকে দেখেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আরে বেয়াঈন কেমন আছেন?”

সৌজন্য মূলক ভাবে আরশিও বলে,
“জ্বি ভালো। আপনি?”
“এতক্ষন শুধু ভালো ছিলাম। এখন খুব ভালো।”
“কেন?”
“এই যে আপনার সাথে আবার দেখা হয়ে গেলো, তাই। এটাকে কি সৌভাগ্য বলবো নাকি কাকতালীয় বলবো? বলুন তো।”

প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না আরশি। একবার হাত ঘরির দিকে চেয়ে বলে,
“আচ্ছা আমি এখন আসি। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে এখনই।”

বলেই ফারুককে কিছু বলার সুজগ না দিয়ে ভেতরে চলে গেলো আরশি। পুরো স্কুল অনেকটাই নিরব হয়ে গেছে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, এই লোকের সাথে আজাইরা কথা বলার কোনো মানে হয়?

হাটতে হাটতে সাবিহা কৌতুহল নিয়ে বলে,
“ছেলেটা কে?”
“তোকে বললাম না গতকাল রুহি আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
“হুম।”
“আপুর হবু দেবর।”

সাবিহা কিছুটা ভেবে বলে,
“তাহলে তো সে এখানকার না। অন্য এলাকার ছেলে। এখানে কি করছে? নাকি তোকে ফলো করছে?”
আরশি কিছু না ভেবে বলে,
“জানি না।”

সাবিহা কিছুটা মুচকি হেসে বলে,
“মনে আছে, কয়েক মাস আগে নাহিদ্দা তোকে ডিস্টার্ব করতো দেখে রিদ ভাইয়া আর রোহান ভাইয়া এসে তাকে সবার সামনে কি থা’প্পর গুলোই না মারলো। রিদ ভাইয়ার চ’র গুলো খেয়ে বেচারার গাল দুটো ফুলে এমন হয়ে গিয়েছিল যে, এখনো ক্লাসের সবাই তাকে টমেটো বলে ক্ষেপায়। এখন এই ছেলেও যদি তোর পিছু নেয়, তাহলে নির্ঘাত তার কপালেও দুঃখ আছে।”

বলেই হেসে দিল সাবিহা। আরশি কিছু বললো না। ভয় হচ্ছে সত্যিই যদি এমন কিছু হয়, তাহলে অনেক বড়ো ঝামেলা হয়ে যাবে। কারণ কিছুদিন পর ফারুক তাদের আত্মিয় হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ক্লাসের সামনে এসেই স্যারের অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়লো দুজন।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

রুদ্র চৌধুরী বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাঈমুনা পাশ থেকে ডেকে বলে,
“আফা ফোন দিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে বাসায় গিয়ে পৌছেছে সে।”
“আচ্ছা।”
“তোমাকে নাকি ফোন দিয়েছিল। ফোন ধরো নি তুমি।”
“তখন ওয়াশরুমে ছিলাম। তাই ধরতে পারিনি।”

স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলে বেড়িয়ে গেলো রুদ্র চৌধুরী। হয়তো এই ব্যপারে আর কথা বলতে ইচ্ছুক না সে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিল মাঈমুনা। এদের ভাই বোনে সম্পর্ক টা কি সব সময় এমন গম্ভিরতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

অবশ্য এটারও একটা কারণ আছে। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। আরশির বাবা ও মায়ের বিয়েটা হয়েছিল ফ্যামিলির অবাধ্য হয়ে। আরশির বাবার আর্থিক অবস্থা দুর্বল দেখে বাবা ও দুই ভাই কেউই আরশির মাকে এমন ছেলের হাতে দিতে রাজি হয়নি। অতঃপর অন্যত্রে বিয়ে ঠিক করলে ফ্যামিলির অমতে লুকিয়ে বিয়ে করে নেয় তারা।

মেয়ের এমন কান্ড মেনে নিতে না পেরে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আরশির নানার। তখন সুস্থ হলেও তার দুমাস পর মারা যান তিনি। যার জন্য রিদের বাবা ও রোহানের বাবা দুই ভাই আজও মনে করে আরশির মায়ের জন্যই তাদের বাবা মারা গেছে।

বছর দুয়েক পরে মায়েক কথা রাখতে বোনকে মেনে নিল তারা। তবে সম্পর্কটা এখন আর আগের মতো নেই। ভাই বোনের ভালোবাসার সম্পর্কটা রুপ নিয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্যের সম্পর্কে। মা বলে গিয়েছিল যা হওয়ার হয়েছে, ভাই বোনের মাঝে যেন দ্বিতীয় বার সম্পর্ক ছিন্ন না হয়। সেই কারণেই হয়তো আজও ভালো থাকার অভিনয় করে তারা। তবে সম্পর্ক খুব একটা ভালো, এমনটাও না।
এই কারণে আরশি ও আরিশা দুজন ভাগ্নী হয়েও মামাদের আদর খুব একটা পায়নি তারা। সম্পর্ক টা শুধু মাত্র দায়িত্বের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

এদিকে তৃতীয় ক্লাসের সময় রবিউল স্যার হাতে একটা খাতা নিয়ে ক্লাস রুমে প্রবেশ করে। যদিও তিনি ক্লাস নেয় না। স্টুডেন্ট ভর্তি, বেতন, উপবৃত্তি এসবেরই হিসেব রাখেন। তবুও সবাই তাকে রবিউল স্যার বলেই চেনে।

টেস্ট পরিক্ষার আগে এটাই লাষ্ট ক্লাস। আর এখনো আট জনের বকেয়া পরিশোধ করা বাকি। তাই খাতায় খুঁজে খুঁজে একে একে সবার নাম বলছেন তিনি। নাম শুনোই একজন একজন করে দাড়াচ্ছে। ভয়ে চোখ বুঁজে রইল আরশি। কখন যেন তার নাম বলে তাকেও দাড় করায়? ক্লাসে শতাধিক স্টুডেন্টের মাঝে মাত্র আট জনের বকেয়া বাকি। তাই তাদেরকে দাড় করানো হচ্ছে। বাকি সবাই তাদের দিকে তাকাচ্ছে। আর তাদের মাঝে আরশিও একজন হবে। কি লজ্জার বিষয়।

এ প্রথম বার এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতির শীকার হতে হচ্ছে তাকে। সবই ঐ বাড়িওয়ালা বুড়োটার জন্য। এই মুহুর্তে তাকে ধরে তার মাথায় যে কয়টা চুল অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। যারা যারা দাড়াচ্ছে তাদের দিকে বাকি সবাই কিভাবে তাকিয়ে আছে। সে যখন দাড়াবে তার দিকেও হয়তো সবাই এমন করে তাকাবে৷ ভাবতেই কাঁন্না পাচ্ছে আরশির।

কিন্তু রবিউল স্যার আরশির নাম বলল না। আট জনের নাম বলে খাতা বন্ধ করে নিল। তার মানে আট জনের মাঝে আরশি নেই। তাদের মাঝে দু’জন অনুপস্থিত ছিল। বাকি ছয়জনকে অফির রুমে যোগাযোগ করার জন্য বলেছে।

রবিউল স্যার চলে যাওয়ার জন্য অনেকটাই অবাক হলো আরশি। সেও তো বকেয়া পরিশোধ করতে পারেনি। তাহলে তাকে দাড় করায়নি কেন? এতক্ষন লজ্জা জনক পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়ে ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ডটা যেন স্থির হতে শুরু করেছে।

ছুটির পর কৌতুহল নিয়ে রবিউল স্যারের সাথে দেখা করে সে। বকেয়ার বেপারে জানতে চাইলে তিনি বলে,
“ক্লাস শুরু হওয়ার পর রিদ এসে তোমার সব বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছে।”

আরেক দফা অবাক হয় আরশি। সব সময়ই ছোট বড়ো সব বিপদের মাঝেই কোথা থেকে যেন এই মানুষটা তার পাশে এসে হাজির হয়ে যায়। আবার সব সমস্যা সমাধান করে কোনো কিছু না বলেই নিরবে চলে যায়। সব কিছু কিভাবে বুঝে যায় তিনি? খবর পায় কোথায়? আজব মানুষ!

To be continue……………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে