বৃষ্টির ছন্দ পর্ব-০২

0
11

#বৃষ্টির_ছন্দ

পর্ব ২

সকালের নাস্তায় তিন্নিকে জিজ্ঞেস করে রিধি, মৃদুল ভাই ও দাদী ওরা নাস্তা করতে আসবে না?

-মৃদুল ভাই এখন হসপিটালে থাকার কথা।

-না খেয়ে গেছেন?

-কী জানি, দাদীর সাথে খেয়েছে হয়তো।

-দাদীরা আলাদা ঘরে থাকে কেন? তাদের রান্না কে করে?

-ঘরের পেছনের ঘরটা রান্নাঘর, দেখিসনি? রান্নাঘরে বিছানো চকিতে স্বপ্না খালা থাকে। ওইবাড়ির সকল কাজ তিনিই সামলান। বিয়ে উপলক্ষে মা উনাকে এখানে এনেছে। দাদীকে অনেক অনুরোধ শেষে রাজি করানো গেছে। তাই দাদীর খাবার এখান থেকেই যাচ্ছে।

-কিন্তু বুড়ো বয়সে দাদী এমন আলাদা থাকেন কেন?
– লম্বা কাহিনী। পরে বলবো।

এমন সময় মৃদুল ঘরে ঢোকে। ঢুকতেই রিধির সাথে চোখাচোখি হয়। মৃদুল চোখ সরিয়ে ডাইনিংয়ে বসে।
এখানে খেতে না এলেও হতো। দুইএকদিন খাবারের ব্যবস্থা হাসপাতালে করাই যায়। তবু আধঘন্টার ব্রেক নিয়ে এখানে এলো। দরকার ছিল না, তবুও।
নিরবে খাওয়া শেষে উঠে গেলে রিধি আবার তাকায় মৃদুলের দিকে তবে মৃদুল তাকায় না। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। রিধি শুরু থেকেই দেখছে মৃদুল বেশ গম্ভীর ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলে। গতরাতে দাদী ও রিধির সামনে অনেক গল্প করেছে তাও নয় তবে আন্তরিক ছিল।

বাথরুমে লম্বা লাইন লেগেছে গোসলের জন্যে। হলুদের অনুষ্ঠানে তৈরি হবার তাড়া সবার। পার্লার থেকে দুটো মেয়ে এসেছে সাজাতে। রিধি ও ওর বন্ধুরা নিজেরাই সাজবে বলেছে, মেয়ে দুটো কেবল চুল বেঁধে দেবে। সবাই হালকা বেগুনী শাড়ি পরে লম্বা বেনীতে ফুল জড়াবে। রিধির চুল ছোট বলে টার্সেল লাগাতে হবে। দাদীর ঘর থেকেই গোসল সেরে চুল বাধার জন্য লাইনে পড়ে রিধি।
তিন্নিকে অবসর পেয়ে আবারো প্রশ্ন করে, দাদী ও মৃদুল ভাইয়ের কাহিনী কী বল না?

রিধিকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আম তলায় দাঁড়ায় তিন্নি, জায়গাটা নিরব। গলা নামিয়ে বলে, কারো সাথে শেয়ার করবি না খবরদার।

– ঠিক আছে, বল?

– আমার বড় চাচা মানে মৃদুল ভাইয়ের আব্বা খেয়ালি মনের মানুষ ছিলেন। কাজকাম করতেন না, গান বাজনা, আড্ডবাজি করতেন। দাদা সুন্দরী দেখে বউ আনলেন, তবু চাচার মন ঘরে থাকতো না। মৃদুল ভাইয়ের চার বছর বয়সে বড় চাচা সাপে কাটায় মারা যান। সুন্দরী যুবতী চাচীকে তার পরিবার সাথে করে নিয়ে যায়। একবছর যেতেই বিয়ের ব্যবস্থাও করে। শর্ত ছিল ছেলেকে সাথে নেয়া যাবে না। ততোদিনে দাদা মারা গেছেন। মৃদুলভাই নানাবাড়ীতে একা বড় হচ্ছে শুনে দাদী নিজের কাছে নিয়ে আসেন। শুরু হয় বিপত্তি। সবই আম্মার কাছ থেকে শোনা, জানিসই তো আম্মা কতোটা সোজাসরল। আব্বা ও ছোট চাচা দাদার সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলো। মৃদুল ভাই ফিরে আসায় বড় চাচার ভাগটুকু দিতে তারা আপত্তি জানায়। দাদীর সাথে এ নিয়ে অনেক গন্ডগোল হয়, সালিশ বসে। আব্বা চাচার প্রতাপে সালিশ তাদের পক্ষেই যায়। দাদী তখন স্ত্রী হিসাবে দাদার সম্পত্তির হক চায়। সালিশে সেটা মানা হয়। দাদীর অংশটুকু আলাদা করে দিতে বাধ্য হয় আব্বা ও চাচা। সেই থেকে দাদী রাগ করে ছেলেদের হতে আলাদা থাকেন। মৃদুল ভাইকে আকড়ে ধরে একা হাতে বড় করেছেন। আমরা অনেক ছোট ছিলাম বলে এসব দেরীতে জেনেছি। মৃদুল ভাই পড়ায় ভালো ছিল, আমাদের সাথে খুব একটা মিশতো না, সারাক্ষণ পড়ার টেবিলেই থাকতো। মেধাবী বলে স্কুল কলেজে শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছে, গ্রামের মানুষও বুঝতে পারে উনার সাথে অবিচার হয়েছে।
মৃদুল ভাই নরম মনের মানুষ, আজ পর্যন্ত কাউকে কটু কথা বলেনি। অবহেলা সাথে নিয়েই বড় হয়েছে। শহরে ভালো চাকরী পেয়েও দাদীকে ভালোবেসে এখানে পড়ে আছে। এতো বড়ো ভূইয়া বাড়ি, এতো আত্মীয় স্বজন তবু কেউ তার আপন হয়নি। এ গ্রামে পড়ে থাকার কোনো কারণ নেই উনার।

রিধির চোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়তে থাকে।

তিন্নি বিরক্ত হয়ে বলে, এই এক জ্বালা, কিছু শুনলেই কান্না শুরু। তোকে কিছু বলবোই না। সুখের খবর শুনেও কাঁদিস, দুঃখের গল্প শুনেও কাঁদিস। শোন, দাদী বা মৃদুল ভাইয়ের কাছে এসব তুলিস না খবরদার। আব্বার অন্যায়ের দরুন আমাদের ভাইবোনদের সাথে মৃদুল ভাইয়ের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা ঘুচবার নয়। আমরা উনাকে সম্মান করি কিন্তু উনার গাম্ভীর্যের কারণে ধারে ঘেষার সাহস পাই না। আম্মার স্নেহ মৃদুল ভাই অনুভব করেন। তাই উনার কথা কখনো ফেলেন না। এই যে বিয়েতে ভাইয়ার উপস্থিতি সেটা আম্মার অনুরোধে। নইলে উনার দেখাই পাওয়া যেত না। এবার চোখ মুছে ঘরে চল।

*****
নকল চুলে ফুল পেঁচিয়ে দাদীর ঘরে ফিরে আসে রিধি। সবাই মিলে এক আয়না নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করার কোনো ইচ্ছে নেই। তারচেয়ে দাদীর বাথরুমের আয়না দেখে আরাম করে সাজা ভালো।
দাদী গলা উঁচিয়ে বলে, মৃদুলের ঘরে আয়না আছে, ওখানে যাও।
রিধি আন্তরিকভাবে মানা করে দেয়। শাড়ি ও হালকা সাজে দাদীর সামনে এসে দাঁড়ালে ফোকলা হাসে দাদী।

দরজায় টোকা দেয় মৃদুল। ভরদুপুরে দাদী দরজা বন্ধ কেন বোঝে না।
রিধি দরজা খুলে দিলে মৃদুল রীতিমতো ধাক্কা খায়। একে তো রিধিকে একেবারেই আশা করেনি তার উপর শাড়ি, সাজে পরিপূর্ণ।
হতবিহ্বল চোখে চেয়ে থাকলে রিধি লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়ায়। মৃদুল স্বাভাবিক হয়ে বলে, দেখতে ভালো লাগছে।
ছোট একটি বাক্য, রিধির মন খুশি হয়ে যায়।
দাদীর পাশে বসে জিজ্ঞেস করে মৃদুল, খেয়েছো দাদী?

-হ, তুই?

-হুম।

রিধির সাজা শেষ, দাদী নাতির মাঝে বসে থাকার কোনো কারন নেই তবু বসে বসে টুকটাক গল্প করে রিধি। দাদীরও ভালো লাগে।
গল্পে গল্পে মৃদুলকে জিজ্ঞেস করে, আপনি যাবেন না হলুদে?

ভ্রু তুলে তাকায় মৃদুল। হুম দেখি, হসপিটাল থেকে ডাক না এলে থাকতে পারি।

– দাদী, আপনি যাবেন না?

-যামু একবার, পান্নারে হলুদ মাখায়ে দোয়া দিয়া আমু।

নকল চুলে আরাম পাচ্ছে না রিধি, বার বার ঘাড়ে আঙুল দিয়ে চুলকাচ্ছে। মৃদুল খেয়াল করলেও দাদীর ঘোলা চোখ তা দেখতে পায় না। রিধির কাঁধ-গলা লাল হয়ে উঠেছে।

-নকল চুল লাগানোর দরকার কী ছিল, ন্যাচারাল সাজই তো সুন্দর। বলেই মৃদুলের মনে হয় বলা ঠিক হয়নি, ব্যাপারটা ব্যক্তিগত!
রিধি চুপ করে থাকলে দাদী বলেন, চুল এমন ছোট করে কাটছো কেন? মেয়েদের অলংকার হইলো লম্বা চুল।

রিধির মুখ লাল হয়ে ওঠে।

দাদী নিজেই বিড়বিড় করেন, অবশ্য লম্বা চুলে কী হইবো? যে আটকায় সে লম্বা চুলেও আটকায়, ন্যারা মাথায়ও আটকায়। মৃদুলের মায়ের রূপ আছিল, কোমর সমান লম্বা চুল আছিল তাও জামাইরে আটকাইতে পারেনাই। সবই কপাল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদী।
মৃদুল উঠে নিজের রুমে গিয়ে ফিরে আসে এলার্জির মলম হাতে। রিধির পাশে চুপ করে রেখে আবার নিজের রুমে ফিরে দরজা ভিজিয়ে দেয়।

হলুদ অনুষ্ঠান বিকাল থেকেই শুরু হয়েছে। ছেলেপক্ষের কিছু মুরব্বির সাথে একদল ছেলে মেয়ে ডালা, মিষ্টি হাতে এসেছে।
মৃদুল আসে সন্ধ্যার পর। চাচাতো ভাই গুলো বন্ধুদের নিয়ে তিন্নির বান্ধবীদের সাথে রংঢং করছে। বান্ধবীগুলোও তাল মিলিয়ে সায় দিচ্ছে। গ্রামে বড় হওয়া ছেলেরা ঢাকার কলেজ, ভার্সিটিতে পড়লেও সেখানকার বেড়ে ওঠা মেয়েদের সাথে তাল মেলাতে পারে না। মেয়েগুলোর চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি। তাদের হাসাহাসি, মেলামেশায় ছেলেগুলোর কেবল ঘুম হারামই হবে, মেয়েগুলো ঠিক তেমন ভাবেই ফিরে যাবে যেভাবে এসেছিল। রিধি হয়তো তেমন নয়, খানিক চুপচাপ ধরনের। চঞ্চলতা নেই, কথা কম তবে বোঝার চেষ্টা বেশি। ছেলেরা রিধির সাথে আলাপ চালিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
আনমনেই চোখ ঘুরিয়ে রিধিকে খোঁজে মৃদুল। একপাশের চেয়ারে চুপ করে বসে সবকিছু দেখছে রিধি। মৃদুলের উপস্থিতি চোখে পড়ে নি।

রিধির সাজ বদলেছে। নকল বেনীটি নেই। কাঁধ পর্যন্ত খোলা চুলে সোজা সিঁথি কাটা, তাতে ছোট একটা হলদে গাঁদা ফুল, একই ফুল দুই কানেও। অল্প সাজে মিষ্টি লাগছে। ঠোঁটে হাসি ফোটে মৃদুলের তখনই রিধি তাকায় মৃদুলের দিকে। মৃদল চমকে চোখ সরায়, বিব্রত হয় এমন চেয়ে থাকার জন্য।
মৃদুলকে ঘিরে ধরে ছেলেপক্ষের উঠতি বয়সী কয়েকটি মেয়ে। দুষ্টমী করে কেউ হলুদ ছোঁয়াতে চায়, কেউ মিষ্টি খাওয়াতে চায়। গ্রাম অঞ্চলে এসব স্বাভাবিক।
আমি এখনই আসছি বলে স্থান ফেলে পালায় মৃদুল। রিধির রাগ হয় এমন গায়েপড়া মেয়েদের দেখে।
আচমকা কানের কাছে মৃদুলের কণ্ঠ শোনা যায়। রিধি, দাদীকে সাথে করে আনতে পারবে?
রিধি পাশ ফিরে তাকায়। একেবারে পাশের চেয়ারে কখন এসে বসেছে মৃদুল টের পায়নি রিধি। কথাটি বলেই উঠে যায় মৃদুল।

দাদীকে সাথে করে নিয়ে আসে রিধি। স্বপ্নাখালা আগেই তৈরি করে রেখেছিল, নিজ থেকেই হয়তো আসতো। রিধিকে দেখে ফোকলা হেসে ওর হাত ধরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হোন।
পান্নাকে হলুদ দিয়ে ওর পাশেই বসে থাকে দাদী। ক্যামেরাম্যান পটাপট ছবি তুলতে থাকে।

তিন্নি ও বাকি বান্ধবীরা হৈচৈ করে আনন্দে মেতে আছে। রিধি তাদের পাশে বসলেও চুপ করে মৃদুলকে দেখে। হলুদে সব ছেলেরা টিয়ে রংয়ের পাঞ্জাবী পরেছে। মৃদুল কেবল ভিন্ন তবে সাদা পাঞ্জাবিতে বেশ লাগছে দেখতে। দাদীর গল্প অনুযায়ী বড় চাচী রূপবতী ছিলেন, মৃদুল মায়ের রং পায়নি তবে লাবন্য পেয়েছে। দাঁড়িয়ে একজনের সাথে গল্পে করছে, মানুষটার ভেতরে কত কষ্ট চাপা ভাবতেই মন খারাপ হয় রিধির।
মেয়েগুলো আবার ঘিরে ধরে মৃদুলকে। পান্নার বড় ভাই বলে ছেলেপক্ষকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারে না মৃদুল। বিনা করণে হি হি করে কেলানো বন্ধ হবার নাম নেই। হঠাৎ রিধি তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করে বসে। দাদীর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, তখন থেকে মৃদুল ভাইকে জ্বালাচ্ছে এই মেয়েগুলো।
দাদী কোনো উত্তর দেয় না, কেবল চোখ পাকিয়ে মেয়েগুলোকে দেখে।
মৃদুল হলুদ মাখাতে এলে পান্নার আশেপাশে মেয়েগুলো আবার জড়ো হয়। চামচে মিষ্টি তুলে মৃদুলের দিকে এগিয়ে দিলে বিব্রত হয় মৃদুল। বাকিগুলো অযথাই হাসিতে গড়িয়ে পড়ে।
দাদী হঠাৎ ধমকে উঠে বলেন, এতো রং লাগছে কেন? বিয়ার লাগি নাগর খুঁইজা পাও না, এতো মানুষ থইয়া আমার নাতির পিছে লাগছো কেন?
পরিবেশ হঠাৎ থমথমে হয়ে যায়।
পরিস্থিতি সামলাতে তিন্নির মা ছুটে এসে বলেন, আত্মীয়রা এমন রং তামাশা করেই আম্মা।

-করলে করে, আমার নাতি এসব পছন্দ করে না দেখার পরও বেহায়ার মতো হি হি হি হি করে দাঁত কেলায় কেন? এই মৃদুল আমারে ঘরে নিয়া চল, এসব আহ্লাদ আমার ভালো লাগে না।
মৃদুল ঝটপট দাদীকে নিয়ে সরে গেলে শুরু হয় মেয়ে পক্ষের ক্ষমা চাওয়া।

তিন্নি এসে নিচু গলায় রিধিকে বলে, এরজন্যেই দাদী থেকে সবাই দূরে দূরে থাকে। আনন্দের মুহূর্ত নষ্ট করতে ওস্তাদ।

তিন্নির সাথে রিধিও মন খারাপের ভান ধরে তবে মনে মনে খুশি হয়।

ঝিনুক চৌধুরী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে