বৃষ্টির ছন্দ পর্ব-০১

0
17

#বৃষ্টির_ছন্দ
পর্ব-১

রিধি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে বসে আছে। ওর কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। দূর থেকে মৃদুল খেয়াল করলেও এগিয়ে প্রশ্ন করবে কিনা ভাবে।
বিয়েবাড়ির আয়োজনে লোকসমাগম এমনিতেই বেশি, তা আবার যদি হয় গ্রামের আয়োজন। ঠিক গ্রাম বলা যায় না, উপজেলা শহর। তবে এ এলাকাটি শহর ছেড়ে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে।
বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে তিন বান্ধবীকে সাথে এনেছে তিন্নি। ভার্সিটির ছুটি চলছিল বলে গ্রামের বিয়ে দেখতে বান্ধবীরাও খুশি মনে রাজি হয়ে যায়। এসে দেখে যতটুকু ভেবেছিল তার চেয়েও এলাহি কাণ্ড।
বৈশালী গ্রামের ভূইয়া পরিবার বেশ বিত্তশালী। সিরাজ ভূইয়ার মেজো ছেলে তিন্নির বাবা। বাজারে বিরাট কারবার, প্রাচীর ঘেরা পৈত্রিক সম্পত্তিতে দোতালা বাড়ি। তিন্নির ছোট চাচাও পাকা ব্যবসায়ী, একতালা বাড়ি, দোতালার নির্মাণ কাজ চলছে। ভূইয়া বাড়িতে আজ সাজ সাজ রব। চারিদিকে আলোকসজ্জা, পেন্ডেল টাঙিয়ে রান্নার আয়োজন, জেনারেটরের ব্যবস্থা আরো নানান কিছু। তিন্নি বান্ধবীসমেত এসে পৌঁছেছে গতকাল সন্ধ্যায়। রাতের গীত গাওয়া, খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে উঠে ভোর থেকেই নানান আয়োজন দেখায় ব্যস্ত। আজ কনের গোসল দেয়া হচ্ছে। কনের পাশাপাশি নারীরা নিজেদের মাঝেও জলখেলা করছে। রংমেখে পানিতে ভিজে একাকার সকলে। অনেকক্ষণ ধরেই এক কোণে চুপ করে বসে আছে রিধি। কেউ তাকে ডাকছে না, পানি দিয়েও ভেজাচ্ছে না।
ভূঁইয়া বংশের বড় ছেলে মৃদুল। বড় ভাই হিসাবে যদিও বিয়ের দায়দায়িত্ব তার ঘাড়ে কেউ চাপায় নি তবু নিজ উদ্যাগে সহযোগিতা করার চেষ্টা। যখন তখন হাসপাতাল থেকে ডাক এলে আয়োজন ছেড়ে যেতে হবে। উপজেলা সদর হাসপাতালের ডাক্তার সে।
জলখেলায় পুরুষদের থাকা নিষেধ। মৃদুল স্টেজের কাজ বোঝাতে এদিকটায় এলে রিধিকে খেয়াল করে। গতকালের রিধির সাথে আজকের মিল নেই। কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। এগিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি খারাপ লাগছে?
রিধি চোখ তুলে তাকায়, স্মিত হেসে মাথা নাড়ে। গতরাতে পরিচয় পর্বে মৃদুলের সাথে চোখাচোখি হয়েছিল। তিন্নির চাচাতো ভাই ছাড়া মৃদুল সম্মর্কে তেমন ধারণা নেই রিধির।
মৃদুল হাঁটু ভেঙে রিধির পাশে বসে গলা নামিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, শরীর অসুস্থ লাগছে?
রিধি খানিক কুঁকড়ে যায়, লজ্জা আড়াল করে।
মৃদুল উঠে তিন্নিকে খুঁজে বের করে বলে, তোর ওই বান্ধবী কোণায় চুপচাপ বসে আছে কেন? জিজ্ঞেস করলে কিছু বলছে না।
তিন্নি অল্প কথায় উত্তর দেয়, ওর পেট ব্যাথা।
তাই আন্দাজ করেছিল মৃদুল। রিধির কাছে আবার ফিরে এসে ধীর গলায় বলে, তুমি অসুস্থ ফিল করলে ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো।
রিধি নরম গলায় বলে, ঘরে মেহমান ভর্তি… আমি..
-কোনো সাহায্য লাগবে? আমি ডাক্তার , দ্বিধা ঝেড়ে আমাকে শেয়ার করতে পারো।
– ঘণ্টা খানেকের জন্য আমার একটু প্রাইভেসি দরকার। আসলে বিয়ে বাড়িতে এমন চাওয়া অমূলক। রিধির গলা নেমে আসে।
-আচ্ছা দেখছি কী করা যায়।
কিছুক্ষণ পর তিন্নি এসে বলে, তুই দাদীর ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক। মৃদুল ভাইয়া তোকে নিয়ে যাবে।
মৃদুলের পিছে পিছে উঠান পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে ছোট সেমিপাকা ঘরে ওঠে রিধি। খোলা বারান্দার দরজা খুলতেই সামনে বড় ঘর মাঝ বরাবর বিছানা পাতা। ডানপাশে আরেকটি রুম তবে দরজা ভেজানো।
জলচৌকিতে নামাজ পড়ছিলো দাদী। বিছানার এক কোনে বসে রিধি। ভয় হয় দাদী রাগ করে কিনা। শুনেছে, গ্রামের মুরব্বিরা পিরিয়ড হলে নাক কুঁচকে অচ্ছুত করে রাখে।
মৃদুল ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণে আবার ফিরে আসে। দাদীর নামাজ শেষ হলে বলে, দাদী, ও রিধি, তিন্নির বান্ধবী। শরীরটা খারাপ করেছে, ওখানে অনেক হৈচৈ তাই এখানে নিয়ে এলাম। একটু শুয়ে থাকুক।
দাদী রিধির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, দাদীর পাশে শুইবা?
রিধি মাথা নেড়ে সায় দেয়।
-মৃদুল রে, আমারটা তো ছোট। পাশের রুমে…
মৃদুল বিব্রত হয়ে চোখ ইশারা করলে রিধি ঝটপট বলে, আমি এখানেই পারবো দাদী।
-পারবা,? ঠিক আছে শুয়ে পড়ো। খাওয়া দাওয়া হইছে?
-জ্বি দাদী।
মৃদুল জিজ্ঞেস করে, কোনো ঔষধ লাগবে?
-না, নিয়েছি অলরেডি। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবো।
মৃদুল চলে যায় পেছনের একটি ঘরে। রিধি শুয়ে চোখ বন্ধ করে। কেমন বিব্রত পরিস্থিতি হলো! পিরিয়ড ইরেগুলার বলে প্রায়ই ঝামেলায় পড়তে হয়। ব্যবস্থা সাথে নিয়েই এসেছিল কিন্তু শুরুর দিন প্রচন্ড পেট ব্যথা হয়, সেটা আড়াল করার উপায় নেই। দাদীর পাশে কাঁথামুড়ি দিয়ে কুকড়ে থাকে রিধি। ব্যথায় মাঝে মাঝেই কেঁপে ওঠে।
কিছুক্ষণ পর পেছনের রুম থেকে মৃদুল বেরিয়ে আসে হাতে হটওয়াটার ব্যাগ নিয়ে।
দাদী দেখে বলেন, ভালো করছোস, মেয়েটা ব্যথায় কষ্ট পাইতেছে।
মৃদুল কথা না বলে এগিয়ে দিলে রিধি হাত এগিয়ে নেয়। এবার একটু আরাম হবে। মনে মনে এটা খুঁজলেও বলার সাহস হয় নি।
সন্ধ্যার পর তিন্নি আসে দাদীর ঘরে। রিধিকে জিজ্ঞেস করে, এখন কেমন অবস্থা?
– ভালো, ওদিকের কী খবর?
– আড্ডা হচ্ছে, একটু পর খাওয়া তারপর ঘুম। আসল মজাতেই তুই থাকতে পারলি না।
– হুম, তবে পানিতে ভিজাভিজি আমার ভালোও লাগে না।
– এখন খেতে চল। ঘুমানোর আগে আড্ডা হবে।
দাদী বলেন, এই শরীরে নড়াচড়া করার দরকার নাই।
রিধি চুপ করে থাকে। এমন জিনিস হলো জনে জনে সবাই টের পেয়ে গেছে।
তিন্নি বলে, তুই চাইলে আজ দাদীর কাছে থাকতে পারিস। আমার রুমে চারজন এক বিছানায় থাকতে হবে, অবশ্য ফ্লোরিং করা যাবে। চাইলে দাদীর সাথে নিরিবিলি ঘুমাতে পারবি। আমি মাকে জানিয়ে দেবো।
রিধি হাঁফ ছেড়ে বলে, তাহলে এখানেই থাকি রে…. শরীরটা এখনো নড়বড়ে। কাল থেকে নাহয় আনন্দ করবো। আজ একটু ঘুমাই।
– তাই ভালো, রাতে কী আর এমন আড্ডা হবে! খেতে চল।
দাদী বলেন, আজকে আর যাওয়ার দরকার নাই রিধির। আমার সাথে ওর খাবারও পাঠায়ে দাও।
তিন্নি চলে যাচ্ছিল আবার ফিরে বলে, পাশের রুমে মৃদুল ভাইয়া ঘুমায়।
তিন্নির কথার মর্ম বুঝতে পেরে রিধি চমকে ওঠে। মৃদুল ভাই একা থাকেন?
তিন্নি হেসে বলে, একাই তো থাকবে, বিয়ে হয়েছে নাকি!
রিধির মুখ শুকিয়ে যায়, এভাবে পুরুষ মানুষের ঘরে…
স্বাভাবিক করতে তিন্নি বলে, তুই এতো চিন্তা করিস না, দাদীর সাথে আরামে ঘুমা। বিয়ে বাড়িতে এর ওর বাড়িতেই থাকতে হয়। এসব কেউ এতো খেয়াল রাখে না।
– আমার ব্যাগটা লাগবে। আমি আসছি তোর সাথে।
– ওটা মৃদুলের সাথে দিয়া পাঠাও তিন্নি, দাদী বলেন।
রিধির আর কিছু বলার থাকে না।

মৃদুল ওবাড়িতে খাওয়া শেষে রিধির ব্যাগ হাতে ফিরে। রিধির খুব অস্বস্তি হয়। মৃদুল নিজ ঘরে ঢুকতে গেলে দাদী ডেকে বলেন, আজ কী কী হইলো কইলি না তো!
-আসতেছি দাদী, রিধিকে একটু ফ্রেস হতে দাও, সে তো বাইরের জামা পড়ে কখন থেকে শুয়ে আছে।
রিধি খেয়াল করে এই বাড়িতে বাথরুম একটি তাও দাদীর রুমে। মৃদুলকেও একই বাথরুম ব্যবহার করতে হয়।
কিছুসময় পর কারেন্ট চলে যায়। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলে রিধি বেশ চমকায়। বাইরে জেনারেটরের আওয়াজ ভেসে আসছে অথচ এই বাড়ি পুরো অন্ধকার। বাকি দুই বাড়ির চাকচিক্যের সাথে এবাড়ির পরিবেশ কিছুই মেলেনা। মৃদুল মোম হাতে এগিয়ে এলে রিধি মুখ ফসকে বলে ফেলে, আই পি এস নেই?
হালকা হেসে মৃদুল বলে, না নেই, আমাদের দরকারও পড়ে না।
নিজেকে সামলে রিধি বলে, সরি, আমি আসলে না বুঝে…
দাদী বলেন, তোমার প্রশ্ন করা স্বাভাবিক। ভূইয়া বাড়ির জাঁকজমক আমার এ বাড়িতে নাই, প্রশ্ন ওঠারই কথা। আমাদেরও দিন ঘুরবো, মৃদুল এখন ডাক্তার। হেলার দৃষ্টি সইরা মৃদুলরে এখন সবাই তোয়াজ করে। আমার নাতি ঠিকই একদিন সব অন্যায়ের জবাব দিবো।
দাদীর হাতে হালকা চাপ দিয়ে থামিয়ে দেয় মৃদুল। রিধি অবাক হয়ে একবার দাদীকে একবার মৃদুলকে দেখে।
মৃদুল গম্ভীর সুরে বলে, দাদীর বয়স হয়েছে তাই মনে যা আসে তাই বলে। তোমার কেমন লাগলো বিয়ে বাড়ি?
রিদি বুঝতে পারে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছে মৃদুল। সেও সহমত হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টায়।
এ কথা সে কথায় অনেক জানাশোনা হয়। রিধিরা তিন বোন, বাবা মারা গেছে দুবছর হলো। বড় বোন বিবাহিত, দুলাভাই আপন মানুষ। বাবা সরকারি কর্মচারী ছিলেন সেই পেনশনের টাকায় তারা চলছে।
মৃদুল ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে পাশ করে এই উপজেলা হাসপাতালেই পোস্টিং নিয়েছে। দাদীর কাছে বড় হওয়া তাই দাদীর সাথেই এ ঘরে থাকা। এরচেয়ে বেশিকিছু বলতে নারাজ মৃদুল। দাদীকেও বলতে দিতে চায় না।

ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ। মৃদুল ঘর ছেড়ে বের হয় না। রিধি ঘুমোচ্ছে, অপরিচিত পুরুষ ঘুমন্ত মেয়ের ঘরে হাঁটাচলা করা অভদ্রতা দেখায়।
রিধি ও দাদীর গলার আওয়াজ শুনতে পেলে তারপর বের হয়। রিধি তখন দাদীর সাথে গল্প করছিল।
শরীর এখন কেমন জিজ্ঞেস করতে নিয়েও থেমে যায় মৃদুল। কিছু রোগ নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না। শুধু বলে, তোমাকে সতেজ লাগছে। ভালো ঘুম হয়েছে?
রিধি হাসে, আন্তরিক হাসি। মৃদুল একটু অবাক চোখে তাকায়। ঢোলা কুর্তি-পাজামায় কাঁধ পর্যন্ত ছাটা চুলে রিধিকে বাচ্চা মেয়ে লাগছে। চোখ সরিয়ে বেরিয়ে পড়ে মৃদুল।

চলবে।

ঝিনুক চৌধুরী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে