#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৪৪)
উষশী’র সিক্ত দুটি চোখ। মাত্রই তার বাবা এলেন পলের কল এসেছে। ব্যক্তিটা এক জীবনে উষশী’র খুব প্রিয় ছিল। তবে এখন বড়ো তিক্ততা অনুভব হচ্ছে। ভদ্রলোক কার থেকে নাম্বার পেয়েছে আসলেই জানা নেই উষশী’র। প্রথমে কল পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিল এখন ঠিক ততটাই মন খারাপ হলো। একটা সময় পর এলেন বললেন,”নিজ মম কে নিশ্চয়ই ভালোবাসো সান?”
উষশী উত্তর করছে না। সে শুনতে চাচ্ছে এলেনের পরের কথা গুলো।
“তোমার মমের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এখনি ফিরে আসবে তুমি। মনে রেখো,তুমি না ফিরলে তোমার মমের জীবন শেষ করতে দু মিনিট সময় লাগবে না আমার।”
নিজ বাবার মুখে এমন ধারার কথা শুনে উষশী আতকে উঠল। তার দুটি চোখে ভীষণ অবিশ্বাস।
“পাপা! তুমি এসব বলছো?”
“বেশি কথা বলতে চাই না। আমি সব কিছু পাঠিয়ে দিব তুমি চলে আসবে। আর যে বাসাতে আছ, তাদের কে কিছু জানানোর চেষ্টা করলে তোমার মমের জীবন শেষ হয়ে যাবে। নাউ ডিসিশন ইজ ইউর।”
এই টুকুই কথা হলো সেদিন। উষশী যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। কি করবে বুঝতে পারল না। খানিক বাদে একটা ছবি এল। যেই ছবিতে সাব্রিয়ার নিথর দেহটা দেখা যাচ্ছে। এক্সিডেন্টের পর আর কথা বলতে পারেন নি তিনি। কোমায় চলে গিয়েছেন। উষশী’র ঘোলাটে চোখে অন্ধকার নেমে এসেছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। বার বার অভি’র কথা স্মরণ হচ্ছে। এদিকে মায়ের জীবন অন্যদিকে বাবার বদলে যাওয়া। সব যেন ওকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিচ্ছে। সেদিন রাতে অভি ফিরতে লেট করেছিল। সারাটা রাত চিন্তা করেছে উষশী। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিরে যাবে। মায়ের জীবন বাঁচাতে হলে তাকে যে যেতেই হবে।
অভিরাজ উষশী’র দিকে তাকিয়ে। সে এত সময় ঘটনা গুলো জানতে না চাইলেও এখন বেশ আগ্রহ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সবটা জানা জরুরি। একটু নয় অনেকটা জরুরি। উষশী বৃষ্টির ঝরে যাওয়া দেখছে। গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এখন প্রায় শেষ রাত্রি। পূর্ব আকাশে কিছুটা আলোর দেখা মিলছে। অভি তার বরাবর এসে দাঁড়াল। হাত দুটো শক্ত করে চেপে বলল,”তারপর কি হয়েছিল উষশী? তোমার তো স্লোভেনিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল।”
“স্লোভেনিয়ায় গেলে আমায় ঠিকই খুঁজে নিতেন আপনি। তাই পাপা কে বলেছিলাম ডেনমার্ক আর স্লোভেনিয়া দুটো টিকেট ই পাঠাতে। আর এয়ারপোর্ট থেকে ক্যামেরা বন্দি হয়ে ইচ্ছে করেই পালিয়ে যাই যাতে করে আপনি আমায় ঘৃণা করতে পারো। আর কখনো আমায় না খুঁজেন। সব সময়ের জন্য ভুলে যান আমাকে।”
এত গুলো কথা বলার সময় উষশী’র শরীরে অদ্ভুত রকমের কম্পন দেখা গেল। তার ছোট্ট শরীরটা নড়ছে কেমন। অভি ভরসা দিতে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল।
“আর কিছু জানতে চাই না উষশী।”
“এখনো তো আসল ঘটনাই জানাই নি আমি। ঘটনার আরো অনেক বাকি অভিরাজ। গত পাঁচ বছরের যন্ত্রণা গুলো শুনবেন না?”
“শুনতে চাই না মেয়ে। তুমি আমার কাছে আছ এটাই সব থেকে বড়ো সত্য।”
মৃদু হাসল উষশী। তবে থামল না। নিজ জীবনের ঘটনা গুলো বলার প্রয়াসের বলল,”অর্ধেক ঘটনা ভয়ঙ্কর হয় মিস্টার রাগি।”
“অতীত স্মরণ করে তুমি যে কষ্ট পাচ্ছ রেইন।”
“তবু স্মরণ করতে হবে। আমৃ ত্যু অবধি এ যন্ত্রণা বহন করতে হবে আমায়।”
অসহায় চোখে তাকাল অভিরাজ। পূর্ব আকাশে সূর্য উঠে গিয়েছে। চারপাশে ভেজা মাটির সৌরভ ভাসছে। মেয়েটা অসুস্থ। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। অভি সেটা লক্ষ্য করে চেয়ার এনে দিল। উষশী কিছু সময় পর বসল। চোখ বন্ধ করে সকালের মিষ্টি সমীরণ অনুভব করছে।
“শুরুর ঘটনা যতটা সহজ মনে হচ্ছে শেষটা আসলেই অতটা সহজ নয়। একটা করুণ স্মৃতি আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে। আপনি কি এক গ্লাস পানি এনে দিবেন আমায়?”
তৎক্ষণাৎ পানি এনে দিল অভিরাজ। মেয়েটার শরীর খারাপ করছে। অভি নিচু হয়ে বসল। হাত দুটো তার শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে শুধাল,”শরীর খারাপ লাগছে?”
এ প্রশ্নের জবাব মিলল না। উষশী পানি পান শেষ করল। তৃষ্ণাটা মিটেছে এবার। অভি’র মসৃণ গালে হাতের স্পর্শ করে ফের গুটিয়ে নিল হাতটা।
“ডেনমার্কে এসে নিজের জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছি আমি। পাপার লোকেরা এসে ডেনমার্কের এয়ারপোর্ট থেকে আমায় নিয়ে যায়। আমি পাগলের মতো কাঁদতে থাকি। একদিকে ভালোবাসা হারানোর শোক অন্যদিকে হসপিটালের বেডে পড়ে থাকা আমার অর্ধ মৃ ত মম।”
অভিরাজ বুঝল উষশীকে থামতে বলেও লাভ নেই। মেয়েটির অন্তরে বড়ো দুঃখ জমেছে। সেগুলো বের না করা অবধি শান্তি মিলবে না। সে চুপ করে থাকলেও উষশী চুপ নেই। সে বলছে,”মমের বেঁচে থাকার আশাটা ছিল খুবই ক্ষীণ। তবে মেয়ে হিসেবে আমি আশা হারাতে পারি নি। আমি ধর্মীয় শিক্ষা পাই নি। তবে সৃষ্টিকর্তা মানতাম। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে সব সময় প্রার্থনা করেছি। অথচ ভাগ্যের বেশি কিছু হয় না। তিনি আমার ভাগ্যে এতিম হওয়াটাই লিখে রেখেছিলাম। কি অদ্ভুত জীবন।”
ওর কথা গুলো শুনতে কষ্ট হচ্ছে অভি’র। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটা একটু একটু করে ক্ষত হচ্ছে। সে তার শক্তপোক্ত বিশাল হাতে আবদ্ধ করে নিল মেয়েটিকে। ছেলেটার উষ্ণতা পেয়ে গুটিশুটি মে রে রইল যুবতী।
“গত পাঁচ বছরে আপনি বড়ো কষ্ট পেয়েছেন তাই না অভিরাজ?”
“তোমাকে পাওয়ার জন্য আমৃ ত্যু অবধি কষ্ট পেতেও দ্বিধা নেই উষশী।”
“অথচ আপনার এত ভালোবাসা ছেড়ে এসেছি আমি।”
“এর পেছনের কারণ গুলো তো বললেই। উল্টো আমার অপরাধবোধে হচ্ছে। তোমার কঠিন সময় গুলোতে সঙ্গ দিতে পারি নি।”
“আপনার তো কোনো দোষ নেই। দোষ আমার আর আমার ভাগ্যের।”
“এ কথা বলবে না মেয়ে। তোমার ভাগ্য খারাপ নয়। শুধু খারাপ সময় যাচ্ছে।”
উষশী খানিক বাদে অভি’র বুক থেকে মাথা তুলল। ক্ষণে ক্ষণে তার উষ্ণ শ্বাস পড়ছে।
“ডেনমার্কে আসার পর পাপার সাথে আমার দেখা হয় নি। সে সব সময় ভিডিও কলেই কথা বলেছে। মমের চিকিৎসা চলছিল। আদৌ চলছিল কি না সন্দেহ ছিল। মম কে আসলে একটু একটু করে মে রে ফেলা হচ্ছিল। কাউকে জানানোর কোনো অপশন ছিল না আমার কাছে। তখন মনে হচ্ছিল কেন আমার কোনো সুপার পাওয়ার নেই। যেই সুপার পাওয়ারের সাহায্যে মম কে উদ্ধার করা যাবে। ধ্বংস করা যাবে নিকৃষ্ট মানুষ গুলোকে।”
কথা গুলো নীরব ভাবে বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ল উষশী। অভি দু হাতে জাপটে ধরল। পিঠে হাত বুলাল ক্রমাগত।
“শান্ত হও। এসব পরেও শোনা যাবে। এখন ভেতরে আসো।”
বারান্দা থেকে ভেতরে এল ওরা। উষশীকে বেডে শুইয়ে দিতে চাইলেও মেয়েটা বসে রইল। খানিক বাদে তার শ্বাসের গতি ঠিক হলো। দু চোখ টলমল করছে।
“কেন এমন হলো অভিরাজ?”
“নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো উষশী। ব্রেইভ গার্লরা কখনো নিয়ন্ত্রণ হারায় না।”
“আমি ব্রেইভ নই। আমি হচ্ছি সেই মেয়েটি যে পৃথিবী’র সবথেকে বোকা আর ভীতু। যে নিজ ভালোবাসার সাথে ছলনা করেছে। বাঁচাতে পারে নি মম কে। এমনকি বন্ধু কোকো’র প্রাণ ও সংশয়ে ফেলে দিয়েছি।”
এত কষ্ট হচ্ছে অভি’র। সে কিছুতেই মেয়েটাকে বুঝ দিতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে বুঝ দেওয়ার মতো পরিস্থিতিই নেই।
“একটু কাছে আসবেন?”
অভি কাছে আসতেই দু হাতে জড়িয়ে ফেলল উষশী। ওর মুখটা ছেলেটার পেটের মধ্যে ডুবানো। গরম নিশ্বাস গুলো উৎপাত চালাচ্ছে। মেয়েটির মসৃণ চুলে হাত গলিয়ে দিল অভিরাজ। একটা ভালো লাগা এসে ছুঁয়ে গেল উষশীকে। সে উত্তাল সমুদ্রের শান্ত ঢেউ হয়ে নুইয়ে রইল। সময় তখন খুব বেশি নয়। সকালের কিছু প্রহর গত হয়েছে। অভি নাস্তা আনতে গিয়েছিল। এসে দেখল ঘরের চারপাশ লন্ডভন্ড হয়ে আছে। উষশী উন্মাদের মতো আচরণ করছে। তার শরীরে পোশাক এলোমেলো। চুলের ঠিক নেই। চোখ মুখের ভয়ংকর অবস্থা। অভি এসে জাপটে ধরল মেয়েটিকে। যেই ছেলেটার জড়িয়ে ধরায় সব থেকে বেশি সুখ মিলত সেই জড়িয়ে ধরাটাই যেন আজ কাল হলো। মেয়েটি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ওকে। চারপাশে কি যেন খুঁজে চলেছে। আর সেটা না পেয়ে উন্মাদের মতো কান্নাকাটি করছে। অভি’র দুটি নয়ন বিচলিত হয়ে পড়েছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটিকে ধরতে গেলেই কেমন করছে যেন। একটু পর পরই চুল টেনে চলেছে। এমন একটা আচরণ করছে যেন সর্বাঙ্গ জ্ব লে যাচ্ছে। ওর আর্তনাদ আর নেওয়া যাচ্ছে না। অভি ছুটে এসে ফের জাপটে ধরল মেয়েটিকে। মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল,”শান্ত হও। কিছু হয় নি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সব ঠিক হলো না। উষশী’র বেদনা বাড়তে লাগল। অভি’র মনে পড়ল লাবণ্য’র কথা গুলো। মেয়েটি নিয়মিত ড্রাগ সেবন করত। মেডিকেল রিপোর্টও তাই বলছে। হুট করেই উষশী শান্ত হয়ে গেছে। অভি’র বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সে চট জলদি মেয়েটিকে নিজের দিকে ঘোরাল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। উষশী তার হাতের শিরা
কে টে ফেলেছে। দু চোখে যন্ত্রণা। অভি যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। উষশী’র যন্ত্রণা ভরা মুখশ্রীতে অজস্র চুম্বন করল অভিরাজ। প্রিয়তমাকে মৃ ত্যু কোলে ঢলে পড়তে দেখে অভি যেন হারিয়ে ফেলল সবটা। ওর আচরণ চার বছরের সেই শিশুটির মতো হয়ে গেল। ভীষণ আর্তনাদ করার ইচ্ছে হচ্ছে। অথচ বুকের ভেতরটা গুমোট হয়ে রইল। আসছে না কান্না। শেষ বেলায় এসে উষশী বলল,”আমি থাকি বা না থাকি সর্বদা তুমি থেকে যেও অভিরাজ। কল্পণায় এসে জড়িয়ে ধরো। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিও। বৃষ্টি হলে ভিজে নিও। মনে রেখো বৃষ্টিভেজা আলাপন।”
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি