#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৮)
ছোঁয়াকে ভুলে যাওয়া ঈশানের পক্ষে সম্ভব নয়। ছেলেটা যতই চেষ্টা করুক না কেন এই চেষ্টার কোনো মানে নেই। অন্যমনস্ক হয়ে চলতে চলতে কিছু একটার সাথে সংঘর্ষ হলো ওর। ছিটকে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামনে নিল। সাদা রঙের প্রাণীটা মিউ মিউ করছে। অদ্ভুত লাগছে ঈশানের নিকট। কিন্তু চোখের সামনে যখন উষশীকে দেখতে পেল তখন সব যেন থমকে গেল। উষশী জগিং এ বের হয়েছিল। সেখান থেকেই এদিকে ছুটে আসে কোকো। তার পিছু নিতে নিতে এখানে চলে এসেছে। মেয়েটি সরি শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেল। ঈশানের চোখে মুখে অদ্ভুত দ্যুতি’র দেখা মিলল।
“উষশী!”
“ঈশান!”
“তুমি এখানে! হোয়াট আ সারপ্রাইজ।”
“আমি তো ডেনমার্কেই থাকি।”
“তুমি তো অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছ। কিন্তু স্লোভেনিয়ায় কেন যাও নি?”
“এই প্রশ্নটা কোরো না ঈশান।”
“ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে?”
কালো মেঘের ছায়া নেমে এল উষশী’র মুখে। মেয়েটি চট জলদি ঈশানের হাতটা ধরে ফেলল। চোখে মুখে অনুনয়ের ছাপ।
“ফ্রেন্ড। প্রমিস কর, আমার সাথে তোমার স্বাভাবিক সম্পর্কটা অন্য কাউকে বলবে না।”
“কিন্তু উষশী।”
“প্লিজ ফ্রেন্ড।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“থ্যাংক ইউ। আমি আজ আসি। কোনো এক সময় কথা হবে।”
মেয়েটি ঝড়ের গতিতে মিলিয়ে গেল। এতটা আশ্চর্য এর আগে হয়েছে কি না ঈশানের জানা নেই। উষশী’র ভেতরকার সত্য জানার জন্য মন আকুপাকু করছে। এদিকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ও উপায় নেই।
পরের দুটো দিন এত বাজে গেল অভিরাজের। ছেলেটার ভেতরে যেন উষশী’র চিন্তাটা রয়েই গেল। উষশী সেদিন বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। মিথ্যে বলেছিল। কিন্তু কেন এমনটা করেছিল? এই রহস্যটার কোনো সমাধান ই পাওয়া যাচ্ছে না। অভি সেই বাড়িটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে উষশীকে দেখেছিল। বাগানের চারপাশে ঘুরেও যুবতী’র দেখা মিলল না। একরাশ মন খারাপ নিয়ে ফিরে এল অভিরাজ। হোটেলে ফিরেই শুনল ছোঁয়ার অসুস্থতার কথা। মেয়েটা হুট করেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার শারীরিক অবস্থা’র খবরটা শুনেই ঈশান এর মস্তিষ্ক বন্ধ হয়ে গেছে। অভিরাজ ওর শান্ত, গুমোট মুখটা দেখেই যেন সবটা বুঝতে পারল। পিঠে হাত রেখে বলল,”কোনো বাঁধা নেই। যেতে পারিস তুই। তবে একজন প্রেমিক হয়ে নয় একজন ভাইয়ের দায়িত্ব পালনে।”
ঈশানের দু চোখে নোনাজল নেমে এসেছে। লাবণ্য এই বিষয়ে কিছুই জানত না। সে যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। মৃদু হাওয়া এসে ধ্যান ফিরাল লাবণ্য’র। ততক্ষণে ঈশান বেরিয়ে গিয়েছে।
“ঈশান, কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“ওকে ডাকিস না লাবণ্য।”
“এটা কি হলো? ঈশান, ছোঁয়াকে…।”
“অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে।”
“অলকের সাথে রিলেশন হওয়ার আগে থেকে?”
“হুম। ছোঁয়া ও পছন্দ করে।”
“মানে টা কি?”
“এর পেছনের কারণটা আমি বলতে পারব না লাবণ্য। তবে একটা কথা,যা হয়েছে তা ভীষণ অনুচিত।”
অভিরাজ চলে গেলেও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লাবণ্য। ওর শরীর মৃদু আন্দোলিত হলো। এর পেছনের কারণটা বুঝি খুবই ভয়ঙ্কর?
ছিমছাম গড়েনের উষশী ধীর গতিতে পথ চলছে। তার পাশে আজ কোকো নেই। প্রায় সময় কোকো কে ছাড়াই অবস্থান করে সে। অথচ একটা সময় প্রাণীটাকে চোখে হারিয়েছে। হারিয়েছে কি, এখনো হারায়। প্রাণীটা ওর ভীষণ আপন। মেয়েটির মৃদু পায়ের গতিতে অনুসরণ করছে অভিরাজ। সে খুব ধীর স্থির ভাবে আগাচ্ছে। মনের ভেতর এত প্রশ্ন থাকলেও সেগুলোকে বাড়তে দিচ্ছে না। উষশী’র দু চোখের ভাষা পড়তে চাইছে। নিজের থেকে কিছু দূরে অভি’কে দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে মেয়েটির। বিশ বছর বয়সী সে যেন সেই কিশোরীতে ফিরে যেতে চাইছে। ছুটে গিয়ে ছেলেটার বুকে মাথা নুইয়ে দেওয়া’র ইচ্ছে হয়। অথচ এমনটা সম্ভব নয়।
“কিছু সময় হবে?”
হু না কিছুই বলল না মেয়েটি। অভি সম্মতি বুঝে নিয়ে বলল,”ঐদিকটা চলো। এখানে অনেক ক্রাউড।”
ভদ্র মেয়েটির মতো এগিয়ে গেল উষশী। অভিরাজ এর ঠিক পাশে বসতে নিয়েও বসল না। মেয়েটি দূরে অবস্থান করায় অভিই এগিয়ে গেল। দূরত্ব মিটিয়ে নিল। একটা সুবাসে ভরে উঠল তার মন।
“পেছনের কিছু জানতে চাইব না। শুধু একটাই প্রশ্ন।”
পথিমধ্যে থেমে রইল অভিরাজ। উষশী তার দিকে পূর্ণ নজর দিল এবার। দুজনের চোখাচোখি হলো। পাঁচ বছর পূর্বের মতো লাজুকহীন ভাবে চেয়ে আছে তারা।
“এখনো ভালোবাসো আমায়?”
এ প্রশ্নের বিপরীতে রকমারি উত্তর দেওয়ার অপশন থাকলেও অভি জানে এর উত্তর একটাই। তবু সে উষশী’র মুখ থেকে শুনতে চায়।
“আনসার মি উষশী।”
“এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।”
“হ্যাঁ ধরে নিব তবে?”
“পাঁচ বছর পূর্বে সব ছেড়ে এসেছি আমি।”
“তবে কি মিথ্যে ছিল আমাদের ভালোবাসা?”
দুজনেই মৌন হয়ে গেল। খানিক বাদে উষশী বলল,”আমার কাছে সময় নেই। আমি আসছি।”
“এভাবে চলে যাওয়ার মানে নেই উষশী।”
“আমাকে সান বলে ডাকলে খুশি হব।”
“কিন্তু তুমি তো আমার উষশী। আমার রেইন।”
“পুরনো দিন স্মরণ করবেন না অভিরাজ। এতে কষ্ট ছাড়া কিছুই মিলবে না।”
হাওয়াই মিঠাই এর মতো মিলিয়ে গেল উষশী। তার বাদামি রঙের চুলের শুভ্রতা আজও অভিরাজের শরীর জুড়ে মেখে আছে। অথচ পা ষা ণ মেয়েটি কি না অতীত স্মরণে নিষেধ করে গেল!
ছোঁয়া’র শারীরিক স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো নয়। মালতি মেয়ের পাশে বসে আছেন। একটা মাত্র সন্তান ওনার। বড়ো আদরে মানুষ করেছেন। স্বামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় বিদেশেই গত করেছেন। ওনার জীবনের সবটুকু আলোর নাম ছোঁয়া। মেয়ের পাশে বসে সারারাত কেঁদেছেন তিনি। ইমার্জেন্সি টিকেটে দেশে এসেছে ঈশান। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে। অলক এসে ওকে দেখে অসন্তোষ হলো। কঠিন স্বর নেমে এল।
“এখানে কি করছ ঈশান?”
নিজের মলিন মুখটা স্বাভাবিক করল ঈশান। অলকের চোখে মুখে অপ্রত্যাশিত বিরক্তির ছাপ। তবু গায়ে মাখল না ছেলেটা।
“ছোঁয়া কে দেখতে এসেছি।”
“ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে?”
“হ্যাঁ।”
“আর কেউ কেন এল না? শুধু তুমিই কেন এলে?”
“কেমন প্রশ্ন করলে অলক?”
“প্রশ্নটা যুক্তিসম্মত। ছোঁয়া’র হাসবেন্ড আমি। ওর বিষয়ে কেউ এক পা আগালে তা জানার অধিকার আছে আমার।”
একটা রাগ এসে স্পর্শ করে গেল ঈশানের চোখে মুখে। তার চোয়ালের পেশি উঠানামা করছে। অলক এগিয়ে এসে ঠিক বরাবর দাঁড়াল।
“আমার স্ত্রী’র প্রতি কারো নজর আমি সহ্য করব না ঈশান সিনহা।”
“ছোঁয়া তোমার স্ত্রী হওয়ার পূর্বে আমার কাজিন। সেটা ভুলে যেও না অলক।”
“শুধু কাজিন হলে আসলেই সমস্যা ছিল না আমার।”
ওর বিদ্রুপ মাখা কথাটা সহ্য হলো না ঈশানের। রাগের বসে কলার চেপে ধরল।
“তুই কি ভেবেছিস,এত সহজে আমার হাত থেকে মুক্তি পাবি? মোটেও না। জোর করে সম্পর্ক করেছিস ওর সাথে। কখনো তোকে ভালোবেসেছে? কখনো ভালোবাসে নি। একটা আগা গোড়ায় ব্যন্ডেজ করা সম্পর্কের কোনো মানে হয় না। এর শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকিস।”
হুট করেই অলক হেসে উঠল। কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”এই রাগ গুলো নিজের বাবা মায়ের উপর দেখালে কাজে দিবে ঈশান। অন্তত কিছু পাপ তো নামবে।”
“আমার মা বাবা নিয়ে একটা কথা বললে তোর জ্বিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব অলক।”
ওদের চেচানোর শব্দে চারপাশের মানুষজন কেমন করে তাকিয়ে আছে। একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি’র সৃজন হয়েছে। ঈশান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”পরে দেখে নিচ্ছি।”
সবটা শোনার পর অভিরাজ বলল,”তোমাকে নিষেধ করেছিলাম অলক। কেন এমনটা করলে?”
“আমি বাধ্য হয়েছি ভাইয়া। আমার স্ত্রী’র দিকে অন্য পুরুষ ভালোবাসার চোখে তাকাবে আমি সেটা মেনে নিব না।”
“শোনো অলক,ঈশানকে এই বিষয়ে আর একটা কথাও বলবে না। আর এত গুলো কথা বলার কোনো অধিকার নেই তোমার। মেয়েটি এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল তোমার বেখেয়ালের জন্য।”
তারপরই রাগ মিশ্রিত কণ্ঠটা নিভে গেল। অভি কল কেটে দিয়েছে। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে অলক। ভেতরে ছোঁয়া। নিস্তেজ হয়ে আছে। ওর শরীরের তপ্ততা যেন এত দূর থেকেও অনুভব হচ্ছে। সেই সাথে বুকের মধ্য ভাগে বাড়ছে ক্ষ ত। ভালোবাসা কি তবে,শুধু দহন ই দেয়?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৯)
এক সপ্তাহ হলো উষশী’র সাথে দেখা হয় নি। মেয়েটি ঘর থেকে বের হচ্ছে না। অন্য কোনো ভাবে যোগাযোগের ও সুযোগ নেই। সেই জন্যেই রোজ বাড়ির সামনে এসে ঘুরঘুর করে অভিরাজ। ওর ভেতরটা কেমন করে উঠল। মেয়েটির কি শরীর খারাপ? হুট করেই চিন্তাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। অসহ্য হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল অভিরাজ। চোরের মতো লুকিয়ে। বিষয়টা অনুভব হতেই বত্রিশ বছর বয়সী অভিরাজ ভীষণ লজ্জিত বোধ করছে। পরমুহূর্তেই ভাবল ভালোবাসার জন্য চাঁদকে জয় করাও কঠিন না। আর সে তো শুধুমাত্র চোরের মতো বাড়িতে প্রবেশ করেছে। সুন্দর শুভ্র সাদা রঙের বাড়িটার এক পাশ জুড়ে রয়েছে বাহারি ঝর্ণা। সেই ফোয়ারার ঠিক পাশেই টেবিল চেয়ার রাখা। আর অপর পাশে কিছু পেন্টিং। অভি আগ্রহ নিয়ে এগোল। পেন্টিং গুলো উলোটপালোট করে দেখতে লাগল। অনেক গুলো পেন্টিং এর মাঝে একটা বিশেষ পেন্টিং নজরে এল। এতে একটুও অবাক হলো না সে। বরং মৃদু হেসে যত্ন নিয়ে পেন্টিং টায় হাত বুলাল। উষশী’র সাথে তার প্রথম চু ম্ব নের দৃশ্য এটি। মেয়েটা তখন একদমই ধ্যানহীন হয়ে পড়েছিল। গাড়িতে এসে প্রশ্ন করেছিল তারা সম্পর্কে আছে কি না। কি অদ্ভুত সুন্দর ছিল দিন গুলো। কথা গুলো মনে হতেই ভালো লাগা এসে স্পর্শ করে গেল অভিরাজের সমস্ত শরীরে। চার পাশ থেকে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে।
“হো ইজ হেয়ার?”
চমকে উঠল অভিরাজ। ধীর হাতে পেন্টিং টা রেখে দিল। ততক্ষণে ব্যক্তিটা ওর সামনে চলে এসেছে।
“হো আর ইউ?”
“মাই সেল্ফ অভিরাজ সিনহা।”
“হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?”
“আই হেভ কাম টু মিট উষশী।”
“সরি। দেয়ার ইজ নো ওয়ান উইথ দিস নেইম। ইউ হেভ কাম টু দ্য রং এড্রেস।”
ব্যক্তিটা মিথ্যে বলায় অভিরাজের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তারপর হুট করেই মনে পড়ল উষশী নিজেকে সান নামে ডাকতে বলেছিল। বারের মেয়ে গুলোও সান নামে সম্বোধন করছিল। ব্যক্তিটা অনেক দূর চলে গিয়েছে। অভিরাজ দূর থেকেই চেচাল।
“আই কাম টু মিট সান। প্লিজ কল হার।”
সান নামটি শুনে মেঘের মতো কালো হয়ে এল ব্যক্তিটার মুখশ্রী। অভিরাজ সামনে এগিয়ে এল।
“কল হার।”
“সরি। ম্যাম ইজ স্লিপিং। ইউ কাম লেটার।”
অভিরাজ কে চলে যেতে হলো। যাওয়ার পূর্বে কয়েকবার পেছনে তাকাল। মেয়েটির দেখা নেই। অভিরাজ চোখের আড়াল হতেই উষশী’র হৃদয় ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে এল উষ্ণ শ্বাস। মেয়েটির চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছে। কেন এত মায়া হয় এ হৃদয়ে?
উষশী ইদানীং বারে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরের মধ্যেই থাকছে সে। এমনকি ভার্সিটিও যাচ্ছে না। মেয়েটির এই স্তব্ধতা অভিরাজের উপর ভীষণ প্রভাব ফেলল। তার কাছে এক একটা সেকেন্ড দীঘল মনে হচ্ছে। কাজে মন বসছে না। লাবণ্যই সব দেখা শোনা করছে। ঈশানের কোনো খোঁজ নেই। ছেলেটা এখনো ফিরে নি। কবে ফিরবে জানা নেই। সব কেমন আবার উলোট পালোট হতে শুরু করেছে। এর মাঝে কয়েকবার বাবার সাথে কথা হলো। ভদ্রলোক ব্যবসাটা নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। সত্যি বলতে এবার আর ব্যবসাটা নষ্ট করতে চায় না সে। ওর মন বার বার সব গুছিয়ে নিয়েও কেমন করে যেন খেই হারিয়ে ফেলছে। উষশী’র সাথে পরবর্তী দুই সপ্তাহ দেখা হলো না। কতটা কষ্ট হলো ওর তা ভাষায় ব্যক্ত সম্ভব না। এক মেঘলা বিকেলে মেয়েটির সাথে দেখা হয়েই গেল। মেয়েটি ত্রস্ত পায়ে হেটে চলেছে। শরীর শক্তি হারিয়েছে। তবু তার পালানোর চেষ্টা। ওর এই অবস্থা দেখে অভি’র ভেতরটা কেমন করে উঠল। ছুটে এসে জাপটে ধরল। কত দিন কত মাস কত বছর পর প্রিয় মানুষের শরীরের শুভ্রতা মিলল। এত সময় ধরে পালাতে চাওয়া উষশী এবার জাপটে ধরেছে। ওর এই আচরণে অভি’র ঠোঁটের কোণে হাসির উদয় ঘটল।
“এখনো অস্বীকার করবে আমায় ভালোবাসো না? উষশী,পাঁচ বছর আগে কি হয়েছে কেন হয়েছে আমি কিচ্ছু জানতে চাইব না। দূরে যেও না প্লিজ। তোমাকে ভোলা এ জনমে সম্ভব না। আই লাভ ইউ মোর দ্যান মাইসেলফ।”
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। চারপাশে আঁধার নেমে এসেছে। সেই সাথে বেড়েছে বাতাসের গতি। ঠান্ডা শীতল হয়ে উঠেছে শরীর। উষশী’র শরীরে পাতলা ফিনফিনে পোশাক। তাও হাঁটুসম। মেয়েটির ভীষণ শীত অনুভব হচ্ছে। অভি একটু ব্যস্ততা অনুভব করল। ওমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টিতে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা যুগল ভেসে যাচ্ছে। তাদের দুজনের তপ্ততা মিলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। অন্যরকম ভালোলাগায় সিক্ত হচ্ছে প্রহর। আর সেই সুন্দর সময়টুকু শুষে নিতে ভুল করল না অভিরাজ।
অভিরাজের কাঁধে মাথা এলিয়ে আছে উষশী। মেয়েটির চোখ সামনের রাস্তাতে। সেখানে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। তারা দুজনেই ভিজে একাকার। অভিরাজ কত দিন পর এমন শান্তি অনুভব করছে। উষশী তার পাশে বসে। শুধু পাশেই বসে নয় বরং খুব নিকটে অবস্থান করেছে। তাদের দুজনের ঠোঁটেই সেই স্বাদ লেগে আছে। প্রিয়তমার বাদামি রঙা চুলে হাত গলিয়ে দিল অভিরাজ। ছেলেটার হাতের মাদকে উষশী’র দু চোখে ঘুম নেমে এল। সে দু হাতে চেপে ধরল অভিরাজের বাহু। সেই সাথে উচ্চারণ করল।
“এভাবেও ভালোবাসা যায় অভিরাজ?”
“যায় তো।”
“পাঁচ বছর পর এসেও তুমি একই ভাবে আমায় ভালোবেসে যাচ্ছ। অথচ আমি তার যোগ্য নই।”
“এভাবে বলে না উষশী।”
“আমি খুব খারাপ অভিরাজ। আমার ছলনায় ডুবে নিজের জীবনটা শেষ করবেন না।”
“জীবন তো তোমার নামেই উৎসর্গ করেছি উষশী।”
“এভাবে ভালোবাসতে হয় না অভিরাজ।”
“কেন হয় না?”
“কারণ দুঃখ পেতে হয়।”
“তোমার দেওয়া সব দুঃখও আমার নিকট সুখ হয়ে ধরা দেয় উষশী।”
উষশী দু চোখের জল মুছে নিয়ে বলল,”যেতে হবে আমায়।”
“আবার কবে দেখা হবে?”
“যেদিন বৃষ্টি নামবে।”
“যদি বৃষ্টি না হয়?”
“তবে মরু উদ্যানে এক চিলতে রোদ হয়ে প্রহর রাঙাবে উষশী। আর শুরু হবে আমাদের প্রহর রাঙা বৃষ্টিহীনা আলাপন।”
লাবণ্য বিরস দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে। অনেক সময় ধরে অভি’র জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলেটা বলেছিল ডিনার এক সাথে করবে। অথচ ডিনারের সময় পেরিয়ে এখন মধ্যরাত। অর্ধভেজা হয়ে ফিরেছে অভিরাজ। লাবণ্য এগিয়ে এল।
“বৃষ্টিতে ভিজলি যে?”
“অনেকদিন ভেজা হয় না তাই।”
“উষশী’র কি খবর?”
“দেখা হয়েছিল আজ।”
“তারপর?”
“কথা হলো।”
“কি বলল?”
“বিশেষ কিছু নয়। বড়ো জেদি মেয়ে।”
“খাবার বাড়ছি আমি। ফ্রেস হয়ে আয়।”
“না। আজ আর খাব না।”
অভিরাজ ভেতরে চলে গেল। লাবণ্য’র মনে বিশেষ কোনো প্রভাব পড়ল না। এসবে সে অভ্যস্ত। অভি’র ভালো থাকাটাই ওর নিকট এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সমুদ্রের তীরে এসে বসেছে ঈশান। সাগরের গর্জনে চারপাশ মুখরিত হয়ে আছে। মৃদু হাওয়ায় উড়ছে তার চুল। দৃষ্টিতে রিক্ততা। বুকে তৃষ্ণা। অথচ এর কোনো সমাধান নেই। মাত্র কিছু প্রহর আগে নিজ মা বাবার প্রতি ভীষণ ঘৃণা বোধ শুরু হলো। সেই ঘৃণা থেকেই নিজেকে হারিয়ে ফেলার ইচ্ছে হচ্ছে। অথচ কোনো এক অজানা টানে সেটা হয়ে উঠল না। পাশে থাকা মুঠো ফোন বেজে চলেছে। অভিরাজের নাম্বার। ইচ্ছা না থাকলেও রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্নতা ভেসে এল।
“ঈশান,কোথায় তুই? বাসায় ফিরছিস না কেন? কি হয়েছে? কথা বল। এই ঈশান।”
“আমি সবটা জেনে গিয়েছি ভাইয়া।”
“ঈশান আমার কথা শোন।”
“কিছু শোনার নেই ভাইয়া। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। সেই সাথে নিজের মা বাবার উপর।”
“পুরনো কথা টেনে আনার কোনো মানে নেই। তুই বাড়ি ফিরে যা ভাই।”
“কোথায় ফিরব? অমন নিচু মনের মানুষ গুলোর সাথে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমি ভাবতাম শুধু আমিই কষ্টে আছি। অথচ ছোঁয়া কতটা সহ্য করেছে। উপায় না পেয়ে সম্পর্কটা করেছে। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে ভাই। তবু ম র তেও পারছি না।”
ঈশান কল কেটে দিয়েছে। অভিরাজ ভীষণ অসহায় বোধ করছে। ঘটনাটা কিছু বছর পূর্বে জেনেছিল সে। ঈশানকে বড়ো আদরে মানুষ করা। ছেলেটার চলন বদল সবটুকুই বুঝে আসত ওর। তবে ছোঁয়া’র অনুভূতিতা জানা ছিল না। মেয়েটা এত চাপা স্বভাবের। অন্যদিকে মায়ের মন ভিন্ন। লতিফা ঠিকই বুঝেছিলেন। ঈশানের অনুভূতি গুলো বুঝতে গিয়ে ছোঁয়া’র অনুভূতি গুলোও ধরে ফেলেছিলেন। এক সন্ধ্যায় বাড়িতে কেউ নেই। শুধু ছোঁয়া আর লতিফা। সেদিন খুব ঝড় ছিল। প্রকৃতির সেই ঝড়টা ছোঁয়া’র জীবনেও উঠেছিল। ছোঁয়া’র শারীরিক কিছু সমস্যা রয়েছে। বাচ্চা জন্ম দেওয়াটা রিস্কের। তাই তিনি চান নি নিজের ছেলের জন্য এমন এক মেয়েকে ঘরে আনতে। ছোঁয়া’র সমস্ত অনুভূতিকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন তিনি। ছোট্ট ছোঁয়া কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছিল ‘আমি কখনো ঈশান ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক জড়াব না মেঝো আম্মু।’
মেয়েটা নিজ প্রতিজ্ঞা রেখেছে। জ বা ই করেছে নিজ অনুভূতিকে। আর এসব কোনো ভাবে জেনে গিয়েছিল অলক। ছোঁয়া’র প্রতি ওর ভালো লাগা ছিল। সেই সুযোগে মেয়েটির সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। ঈশান কথা গুলো জেনে গেলে ঝামেলা হত। ওর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হত। আর সেই জন্যেই পরিবার পরিজনের কথা ভেবে নিজ জীবনের এত বড়ো ক্ষতি করে ফেলল ছোঁয়া।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি