#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৬)
ছোঁয়া’র বিষয়টা কিছুতেই ভুলতে পারে না ঈশান। বার বার মেয়েটি ওর হৃদয়ে এসে উৎপাত শুরু করে। সে ভীষণ মনোযোগে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে।
“ছবিটা অফ করে রাখ।”
“ব্রো তুমি?”
“হুম। ভাবলাম দুজনের আড্ডা হয়ে যাক।”
সফট ড্রিঙ্কস নিয়ে এসেছে অভিরাজ। দুই ভাই এখন ছাদে বসে আছে। দুজনের হৃদয়েই বইছে তপ্ততা। বেদনার নীল রঙ ছাপিয়ে ভালো থাকার প্রয়াস। অথচ মস্তিষ্ক মেনে নিলেও মন মানছে না।
“ভাই,ছোঁয়া কেন এমন করল বলতে পারো?”
“তোদের দুজনেরই সীমাবদ্ধতা ছিল। দোষটা কারোই না।”
“অথচ দিন শেষে আমরা কেউ কি ভালো আছি?”
“সেটা আগে বুঝে একে অপরকে মেনে নিলে, অনুভূতি ব্যক্ত করলে গল্পটা অন্যরকম হত।”
“বিশ্বাস কর ভাই,আমি যদি জানতাম ছোঁয়া আমায় পছন্দ করে তাহলে সব ছেড়ে দিতাম।”
“এখন সবটা মেনে নিতে হবে ঈশান। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। ছোঁয়া’র হাসবেন্ড কিন্তু কষ্টে আছে।”
“কষ্টে কিভাবে থাকে, জোর করে একটা সম্পর্ক তৈরি করেছে। মেয়েটার জীবন তছনছ করে দিল।”
“ছোঁয়া তখন কিন্তু এসব বলে নি। যদি বলত তবে সব ঠিক হয়ে যেত।”
গোপনে নিশ্বাস ফেলল অভিরাজ। ঈশান শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
“অলক কল করেছিল?”
“হুম। তোদের দুজনের সাধারণ যোগাযোগ টা ও কমিয়ে আনতে হবে। না হলে যে মায়া আছে সেটা দুজনকেই শেষ করে দিবে।”
“বুঝেছি ভাই। কিন্তু ছোঁয়া যে অলকের কাছে খুশি নেই।”
“কিন্তু অলক ছোঁয়াকে ভালোবাসে। ওদের পাঁচ বছরের সংসার। ওদের সংসারে তিক্ততা হয়ে যাস না ঈশান। আমার ভাই বলে এতটা সহজ করে বোঝালাম। তোদের দুজনের একে অপরের প্রতি মায়া বাড়ানোটা অনুচিত।”
অভিরাজ উঠে গেল। তার ডিঙ্কস আর ঈশান কে বলতে চাওয়া কথা, দুটোই ফুরিয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে। এর মধ্যে সব থেকে বড়ো আপন মানুষ গুলোই সব থেকে বেশি পর হয়।
উষশী’র সাথে দেখা হয়েছিল সাত দিনের ও বেশি। আশ্চর্যজনক ভাবে মেয়েটিকে আর খোঁজার চেষ্টা করে নি অভিরাজ। পাঁচ বছরের ভালোবাসা পাঁচ মিনিটেই শেষ! উহু বিষয়টা তেমন না। নিজ ভালোবাসার প্রতি অভিমান জন্মেছে ওর। যে মেয়েটিকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছে সেই মেয়েটি কি না এত বড়ো ছলনা করল! এই বিষয়টা আসলেই বুঝে আসে না ওর। সেই জন্যেই পাঁচ বছর ধরে মেয়েটির অপেক্ষা করেছে। স্লোভেনিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। অথচ মেয়েটি কি না ডেনমার্কে লুকিয়ে বসেছে। অভি’র ভেতরটা কেমন করে উঠল। সে ড্রাইভিং সিটে ছিল। অন্যমনস্ক মস্তিষ্ক। চট জলদি গাড়ির গতি নিজ আওতায় নিয়ে নিল। একটা দীর্ঘশ্বাস লুকানোর প্রয়াস করল ঠিকই তবে পারল না। লাবণ্য ঠিক ই বুঝতে পারল।
“কিছু দিন ধরেই বেশ মনমড়া আছিস। কি হয়েছে অভি?”
“সিরিয়াস কিছু না।”
“মিথ্যে বলে লাভ নেই। আমি বুঝতে পারি।”
“সেসব বাদ,এখন বল ঈশান কতদূরে আছে?”
“দশ কিলোমিটার।”
“আচ্ছা।”
অভি সামনের দিকে দৃষ্টি রাখলেও লাবণ্য’র দৃষ্টি পড়ে রইল অভিরাজের দিকে। ছেলেটা ওর ভেতরের সবটুকু অনুভূতি শুষে নিয়েছে। কিছু দূর যেতেই লাবণ্য’র ফোনটা বেজে উঠল। ঈশানের ম্যাসেজ। সে নাকি কোথাও একটা ঘুরতে যাবে। কথাটা শুনে ভারী মন খারাপ হলো লাবণ্য’র।
“ব্যপার না। পরে এক সাথে ঘোরাঘুরি হবে। তোকে নিয়ে যাই এখন।”
“উহু যাব না আর।”
“কেন?”
“গেলেও ভালো লাগবে না।”
“তাহলে অন্য কোথাও যাই।”
“পেছনে ফেলে আসা পার্কে চল। অনেক গুলো বাচ্চা দেখেছি। ওখানেই যাই।”
লাবণ্য’র ইচ্ছে মতোই গাড়ি ঘোরাল অভিরাজ। একটা সুন্দর গান চলছে। যে গানের লাইন গুলো উষশী’র বাহ্যিক রূপের সাথে বড়ো মিল।
পার্কে অনেক গুলো বাচ্চা। তাদের বয়স দশ থেকে পনের এর মাঝে। সকলেই পোষা প্রাণী নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান চলছে। লাবণ্য বেশ আগ্রহ নিয়ে এগোলো। ওর পেছন পেছন আসছে অভিও। চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে। পরিবেশটা বেশ সুন্দর। এর মাঝে হুট করেই একটা প্রাণী এসে পায়ের কাছে ধাক্কা খেল। অভি নজর ঘুরিয়ে দেখল একটি বিড়াল। একদমই সাদা তার রঙ। দেহের আকৃতি তে বোঝা যাচ্ছে বয়স পাঁচের কম নয়। অভি’র বড়ো ভালো লাগল। সে প্রাণীটাকে কোলে তুলে নিল। প্রাণীটা মিউ মিউ করে ডেকে উঠল। শরীরে হাত বুলাতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি এসে জড়িয়ে ধরল। গলার কাছে একটা লকেট বাঁধা। যেখানে ছোট্ট করে লেখা কোকো। অভি’র পুরো শরীর মৃদু আন্দোলিত হলো। প্রাণীটার নাম উচ্চারণ করতেই কোকো মিউ মিউ করে ডেকে উঠল। অভি’র যে কি ভালো লাগল।
“কোকো, কেমন আছিস তুই? কত বড়ো হয়ে গেছিস। চেনাই যাচ্ছে না।”
কোকো যদি বিড়াল না হতো অথবা তার কাছে বিশেষ কোনো শক্তি থাকত তবে সে খুব জোরে চেচিয়ে বলত ‘আমি তোমায় মিস করেছি অভিরাজ।’ বিড়ালটির শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে উষশী’র কথা স্মরণ হলো। মেয়েটি কি এখানে আছে?
লাবণ্য মাত্রই শুনল এখানে পোষা প্রাণীদের একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনেক প্রাণীরা এখানে খেলা দেখাবে। এর আগে এমন অনুষ্ঠানে আসা হয় নি বিধায় লাবণ্য’র উত্তেজনা অনেক বেশি। খানিক বাদে একটা আওয়াজ শোনা গেল। একটা মিষ্টি মেয়ের কণ্ঠ।
“এভরিওয়ান কাম হেয়ার। দ্য গেইম ইজ এবাউট টু স্টার্ট।”
সকলে একসাথে জড়ো হয়ে দাঁড়াল। লাবণ্য এত গুলো বাচ্চার মাঝে জায়গা পাচ্ছে না। কিছু সময় পর মেয়েলি মিষ্টি সুরটা ফের বেজে উঠল। একের পর এক প্রাণী খেলা দেখাতে শুরু করল। চারপাশ থেকে উল্লাসের সুর ভেসে আসছে। এত গুলো বাচ্চার মাঝে লাবণ্য বড়ো অদ্ভুত অনুভূতি পাচ্ছে। খেলা তখন প্রায় শেষ। লাবণ্য’র কেন যেন মিষ্টি কণ্ঠের মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। সে এগিয়ে গেল। এত গুলো বাচ্চার ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেল সে। বাদামি রঙের চুলের মেয়েটি অন্য দিক ঘুরে আছে। তার পরনে ব্লু রঙের শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। কাঁধসম চুল গুলো উঁচু করে বাঁধা। যত টুকু বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি ভীষণ সুন্দরী। লাবণ্য উত্তেজনা দমাতে না পেরে আরেকটু এগিয়ে গেল। মেয়েটির পেছনে অবস্থান করছে সে। হুট করেই পেছন ঘুরল মেয়েটি। লাবণ্য’র মুখের হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। চোখ দুটো কি বিভ্রম দেখছে? নাকি সামনে থাকা মানুষটিই ভুল।
“সান আওয়ার পোগ্রাম ইজ ওভার।”
“আই এম কামিং মার্গো।”
বাদামি চুলের মেয়েটি চলে যেতে নিলেই ডেকে উঠে লাবণ্য।
“উষশী!”
মেয়েটি দাঁড়ায় না। সে তার মতোই চলছে দেখে লাবণ্য ছুটে আসে। পথ আটকে ধরায় মেয়েটির মুখে বিরক্তিভাব।
“উষশী, কেমন আছ তুমি? স্লোভেনিয়ায় না গিয়ে ডেনমার্কে কেন এসেছ? সেদিন কেন পালিয়ে গিয়েছিলে? কি হলো। বল, এখন প্লিজ বলবে না তুমি উষশী নও।”
উষশী নাকোচ করল না। এগিয়ে এসে লাবণ্য’র বরাবর দাঁড়াল।
“পুরোটাই আমার পার্সোনাল ইস্যু। আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
“তুমি বাধ্য উষশী।”
“কোন কারণে?”
“আমাদের কাছে তিন মাস থেকেছিলে তুমি। সেসব নিশ্চয়ই ভুলো নি?”
“না ভুলি নি।”
“তবে?”
“সাথে এটাও ভুলি নি আমার সাথে তুমি কি অন্যায় করেছিলে।”
এ কথাটা একদমই চমকে দিল লাবণ্যকে। সে এগিয়ে এসে বলল,”কি অন্যায় করেছি আমি?”
“আমার সেনসেটিভ স্কিন জেনেও বাইরের মেকাপ দিয়েছিলে।”
“সেটার জন্য আমি অনুতপ্ত উষশী। যদিও সেটা স্বাভাবিক ছিল। কোনো কিছু খুব বেশি প্রত্যাশিত হলে সবাই প্রতিযোগিতায় নামে। আর তুমি খুব ভালো করেই জানতে অভি আমার কাছে কতটা প্রত্যাশার।”
“এখন কি বলতে চাও?”
“তুমি কেন পালিয়ে গিয়েছিলে?”
“পালাই নি আমি। যদি পালিয়েও থাকি তবু তোমাকে বলতে বাধ্য নই। তাছাড়া আমার কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, মেকাপের বিষয়টা আজও অভিরাজকে বলি নি।”
“শোনো, অহংকার করবে না মেয়েটা। মেকাপের বিষয়টা বাদ দিয়ে, ভুলে যেও না তিন মাস আমার কাছে ছিলে। ছোট বোনের মতো যত্ন করেছি। ওসব নিশ্চয়ই মিথ্যে ছিল না। এতটা অকৃতঘ্ন হইয়ো না।”
উষশী তাচ্ছিল্য হাসল। লাবণ্য এতে অপমান হলো। তবু কিছু বলল না। সে এগিয়ে এসে ওর বরাবর দাঁড়িয়েছে। উষশী’র কিশোরী রূপ যতটা মুগ্ধতার ছিল তার থেকেও বেশি মুগ্ধ করছে ওর যুবতী রূপ। লাবণ্য আর ওর উচ্চতা প্রায় সমান। দুজনের চোখ ই একে অপরের চোখের দিকে।
“সব কিছু বাদ দিলাম উষশী। শুধু বল কেন এমনটা করেছ? আমাকে না হয় বাদ ই দিলে কিন্তু অভি তো তোমার ভালো করেছে। সব থেকে বড়ো কথা তোমরা সম্পর্কে ছিলে।”
কথা বলতে বলতে উষশী’র বাহুতে হাত রেখেছে লাবণ্য। হুট করেই লাবণ্যকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল উষশী। পুরো ঘটনাই নীরব দর্শক হয়ে দেখছিল অভিরাজ। লাবণ্যকে ধাক্কা দেওয়া ছুটে এল সে। উষশী তখনো দাঁড়িয়ে। লাবণ্যকে উঠাল অভি। তার দু চোখ বিশ্বাস হারিয়েছে। এই সেই উষশী? যাকে ভালোবেসে নিজের সবটা শেষ করল অভিরাজ!
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৭)
লাবণ্য যেন সবটা গুলিয়ে ফেলেছে। ওর ভেতরটা এখনো শান্ত হতে পারছে না। পাঁচ বছর আগের উষশী আর এই উষশী যেন আলাদা গ্রহের প্রাণী। অন্যদিকে শান্ত ধীর স্থির অভিরাজ। বত্রিশ বছরেও নিজ সৌন্দর্যের এক চুল কমতে দেয় নি ছেলেটা। তার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল লাবণ্য। ভীষণ মায়া হলো ওর। উষশী যাওয়ার পর অভি’র ভে ঙে পড়া মুহূর্তের কথা স্মরণ হলো। তারপর থেকে প্রতি সেকেন্ড সে চেয়েছে উষশী ফিরে আসুক। অভি ভালো থাকুক। ছেলেটার ভালো থাকার মাঝেই যেন নিজের সব খুঁজেছে। অথচ তেমন কিছু ঘটে নি। সময় যেতে থাকল। অভি’র সুস্থতার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। কয়েক বছরেও যখন কিছুই ঠিক হচ্ছিল না তখন ও ভেবেছিল অভি’র পাশে সর্বদা থেকে যাবে। একটা সময় পর ঠিকই ভালোবাসা হবে। একত্রিশ বছর বয়সে এসেও অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবে নি মেয়েটি। আজ যখন হঠাৎ উষশীকে নজরে এল তখন সবটা যেন বদলে গেল। তবু তার মনে কষ্ট ছিল না। শুধু ছিল একটা ধাক্কা। অভি’র ভালো থাকাটা সব চেয়ে গুরুত্ব ওর নিকট। কিন্তু সব যেন বদলে যাচ্ছে।
“উষশী’র সাথে আগে দেখা হয়েছিল তোর?”
“হুম।”
“কবে?”
“প্রথমবার বারে, দ্বিতীয় বার একটা পার্কে আর তৃতীয় বার ও বারে।”
“কেন জানাস নি?”
“কি জানাতাম?”
এ প্রশ্নে মৌনতা ভেসে উঠল লাবণ্য’র মুখে। অভি একটু পাশ ঘুরে বলল,”ব্যথা পেয়েছিস?”
“একটু।”
“সরি লাবণ্য।”
“তুই কেন সরি বলছিস?”
“উষশী তোকে ওভাবে…”
“সরি তো ওর হওয়া উচিত। তুই কেন বলছিস?”
লাবণ্য’র প্রশ্নটা আসলেই যুক্তিসম্মত। মেয়েটির প্রশ্নের বিপরীতে জবাব নেই অভিরাজের নিকট। একটা সময় পর লাবণ্য বলল,”খুব ভালোবাসিস ওকে?”
“বিনা কারণে উষশী আমায় খু ন করলেও ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা কমবে না লাবণ্য।”
ঈশান শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ছেলেটার ভেতর কখনোই শান্তি পায় না। ওর জীবনের রূপ যেন বহু পূর্বেই বদলে গিয়েছে। ফোনের অপর পাশে থাকা ছোঁয়া ভীষণ ক্লান্ত।
“অভি ভাইয়াই ঠিক। আমাদের দুজনের মায়া বাড়ানোটা অনুচিত ঈশান ভাইয়া।”
“তুই কেন আগে বললি না,আমায় পছন্দ করিস? অলকের সাথে তোর সম্পর্কটার কোনো মানে নেই। জোর করে সম্পর্ক করেছে শ য় তা ন টা।”
“সেসব কথা রাখো। এখন থেকে আমরা আর কথা বলব না। কখনোই না। বুঝেছ?”
“হুম।”
দুজনেই নীরব হয়ে রইল। এক মাস আগে ছোঁয়া নিজের ভেতরের সত্য ব্যক্ত করেছিল। তবে মেয়েটির সীমাবদ্ধতার রেখাটা যেন এখনো একটা রহস্য। তবু সব রেখে ঈশান নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করে। যেখানে অলক আর ছোঁয়ার সম্পর্কের কোনো মানে নেই সেখানে নিজের জন্য একটা ভালোবাসার নীড় তৈরি করতে থাকে। অথচ একদমই অনুচিত ছিল সেটা।
“ছোঁয়া।”
“হুম?”
“আমরা আর কখনো কথা বলব না তাই না?”
“হুম।”
“দেখা হলেও না?”
“না।”
“আচ্ছা।”
“হুম।”
“শোন।”
“বলো শুনছি।”
“অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে। সুখী হ, আর কখনো আমাদের যোগাযোগ হবে না। কখনো দেখা হবে না। কখনো কথা হবে না।”
ছোঁয়া কিছু বলার পূর্বেই ঈশান কল কেটে দিল। অথচ যদি কলটা না কাটত তবে শুনতে পেত ছোঁয়া’র আর্তনাদ। চিৎকার করে বলা ‘আমি তোমায় কখনো ভুলতে পারব না ঈশান ভাইয়া। আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা তুমি।’
অভিরাজ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস ফেলল। তারপর কল করল অলকের নাম্বারে। একটা রিং বাজতেই রিসিভ হলো। ছেলেটা যেন ওর কলেরই অপেক্ষায় ছিল।
“ঈশান আর ছোঁয়া আর কখনো যোগাযোগ করবে না।”
“থ্যাংক ইউ ভাইয়া।”
“যদি বিয়ের আগে এসব জানতে পারতাম তবে ছোঁয়া’র সাথে কখনোই তোমার বিয়েটা হত না। আমার বোন ভীষণ বোকা। নতুবা নিজের কথাটা আগে চিন্তা করত। যাক গে সেসব কথা। ছোঁয়াকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে ঈশানের দুঃখ ভুলিয়ে দিও। গত পাঁচ বছরে যা পারো নি তা পাঁচ মাসে করতে পারবে সেই আশা আমি রাখি না। তবে হ্যাঁ মনে রেখো তোমার জন্য আমার বোনের চোখ থেকে এক বিন্দু জল গড়ালে তোমার বাড়িতে সেদিন ই ওর শেষ দিন হবে।”
“মনে থাকবে ভাইয়া। আমি মানছি সম্পর্কটা জোর করে করা তবে ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। ছোঁয়া’র হৃদয়ে আমি না থাকলেও আমার হৃদয়ে ছোঁয়া আজীবন থেকে যাবে।”
হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল অভিরাজ। তার এত অপরাধবোধ হচ্ছে। সে কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছে না। চারপাশ থেকে সমস্ত চাপ যেন ক্রমশ আ ঘা ত করে চলেছে। পারিবারিক ঝামেলা গুলো আসলেই সইবার মতো নয়।
লাবণ্য দেখল অভি একের পর এক কফি শেষ করছে। ছেলেটা নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন প্রায় শেষ রাত। লাবণ্য নিজেও পুরোটা রাত ঘুমায় নি। ছেলেটার শারীরিক স্বাস্থ্য এভাবে অবনতি’র দিকে যাবে। ওপাশে থাকা ডাক্তার নাফিস বলে উঠল।
“মিস্টার অভিরাজ এখনো জেগে?”
“জি। ওর বিষয়টা তো আগেই বলেছিলাম।”
“হুম। উষশী মেয়েটার প্রতি এক অন্যরকম ভালোবাসা ওনার।”
“সেটাই। হুট করেই সেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেল।”
“তাহলে তো ভালো।”
“ভালো নয়।”
“কেন?”
“কারণ মেয়েটা বদলে গেছে। অভি না ওকে ভুলতে পারছে আর না ছাড়তে পারছে।”
“হুম বুঝলাম। তাই ওনি নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রেখেছেন, রাইট?”
“একদম।”
লাবণ্য উষ্ণ শ্বাস ফেলল। ডাক্তার নাফিস দীর্ঘদিন ধরে অভিরাজের চিকিৎসা করছে। সেই সাথে লাবণ্য’র কলিগ। অভি’র বিষয়ে নাফিসকে সবটা জানিয়ে কল রাখল লাবণ্য।
“আসব?”
“কবে থেকে অনুমতি নিচ্ছিস?”
“না ভাবলাম যদি কিছু মনে করিস।”
“লাবণ্য। ব্যাপারটা অদ্ভুত হয়ে গেল না?”
“কেন?”
“তুই আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। যখন তখন ঘরে আসতে পারিস।”
“হুম।”
অভি কাজ রেখে লাবণ্য’র নিকট এসে দাঁড়াল। মেয়েটা বড়ো ভালো। অভি’র হৃদয়ে ওর জন্য সর্বদা ভালোবাসা কাজ করে। এক বন্ধুর ভালোবাসা।
“উষশী’র কথা গুলো মাথায় রাখিস না।”
“রাখি নি।”
“তাহলে ঘুমাস নি যে?”
“তুই ও তো ঘুমাস নি।”
“আমার তো কাজ ছিল।”
“আমার ও ছিল।”
“সেটা কি? আমার সমস্ত খোঁজ খবর ডাক্তার নাফিস কে দেওয়া?”
কথাটাতে অন্যরকম ইঙ্গিত ছিল। লাবণ্য একটু অবাক হলো বটে। তারপরই সামলে নিয়ে বলল,”তোর সব খবর ওনাকে দিতে হয়। কারণ তোর বিষয় ওনিই দেখেন।”
“জানি তো।”
অভিরাজ আরাম করে বসল। কাহিল হয়ে গিয়েছে তার শরীর। বত্রিশ বছর তো কম সময় নয়। তার উপর একের পর এক ঝামেলা। নিজের যত্ন নেওয়া হয় না। ক্লান্ত অভিকে দেখে লাবণ্য আর সময় নষ্ট করল না। লাইট অফ করে দিয়ে চলে গেল। মেয়েটি চলে যেতেই একটা গরম দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভিরাজ। লাবণ্য ওর জীবনে এমন এক সত্য যে সত্যের কোনো নাম হয় না। এ সত্য কেবল অনুভব করা যায়।
এত ভোরে প্রাণীটার সাথে দেখা হয়ে যাবে তা কখনোই ভাবে নি অভিরাজ। কোকো তার ভারী শরীরটা নিয়ে হেঁটে চলেছে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে ছোট্ট সেই বিড়াল ছানা। সময় কত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়।
“কোকো।”
প্রাণীটাকে কোলে নিয়ে আদর করল অভিরাজ। তারপর এদিকে সেদিক তাকিয়ে বলল,”তোর বন্ধু কোথায়?”
মিউ মিউ করল কোকো। সে কি বোঝাতে চাইছে জানা নেই। তবে কিছু যে বলতে চায় সেটা বোঝা যাচ্ছে। অভিরাজ কোকো কে কোলে নিয়েই চারপাশ ঘুরল। কিন্তু কোনো মানুষ নজর এল না। একটু দূরে আসতেই কোকো লাফাতে শুরু করল। কোল থেকে নেমে একটা সুন্দর বাড়ির কাছে এসে অভিরাজের উদ্দেশ্যে মিউ মিউ ডাকল। অভি কি মনে করে যেন ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়িটা ভীষণ সুন্দর আর পরিপাটি। কোকো তার প্যান্ট ধরে টানাটানি শুরু করেছে। প্রাণীটিকে কোলে নিতে গেলেই ছুটে পালাল। তার পিছু নিয়ে আসতেই দেখা মিলল লাস্যময়ী যুবতী উষশী’র। মেয়েটির শ্বেত রঙা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তার বাদামি চুল গুলো কাঁধের কাছে এসে লুটপাট করছে। তবে কি বিশ বছর বয়সী যুবতী উষশী আরো একবার অভিরাজের মন কেড়ে নিল?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি