#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৪)
সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ লেগে যাওয়ার মতো কম্পিত হলো অভিরাজের শরীর। ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়েছে। সামনে বেশ ভীড়। চোখ দুটো ভীষণ বিচলিত। চারপাশ থেকে ভেসে আসা পানীয়র ঘ্রাণ আর উচ্চ শব্দে গান। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ থেকে কথা হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা নিদারুণ ব্যথা এসে গলা চে পে ধরেছে। অভিরাজ বাক্য প্রয়োগে ব্যর্থ হয়ে পাগলের মতো করতে লাগল। তাকে দেখে সামনে থাকা মেয়ে গুলো মজা নিচ্ছে। অ শ্লী ল আচরণ করছে। অন্য সময় হলে ধমকে দিত না হয়। তবে এখন যে মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছে না। কণ্ঠটা যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে যতক্ষণে ভীড় পেরিয়ে বের হলো ততক্ষণে বাদামি রঙেল চুলযুক্ত মেয়েটি চলে গিয়েছে। বদ্ধ পাগলের মতো কাতরাচ্ছে ছেলেটা। ওর আচরণ বেপরোয়া হয়ে গেল। ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলেছে দামী কিছু গ্লাস সেট। গন্ডগোল দেখে ছুটে এসেছে লাবণ্য। সেখানে অভিরাজ কে দেখে ওর চিত্ত কেঁপে উঠল। ঈশান দৌড়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরল। অনেকটা সোরগোল লেগে গিয়েছে। মানুষ জন হাসাহাসি করছে।
“ভাই, ভাই এমন করছো কেন? কি হয়েছে। শান্ত হয়ে বসো। বসো ভাই।”
লাবণ্য এসে জাপটে ধরল অভিকে। অভি এক পলক তাকাল। ওর দৃষ্টি দিক হারিয়েছে। মনে হচ্ছে ভীষণ যন্ত্রণায় ভেতরের সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।
“অভি, কি হলো তোর। শান্ত হয়ে বোস। এমন করছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
এত গুলো প্রশ্ন করেও শান্ত হলো না লাবণ্য। ওর চোখে জল চলে এসেছে। ঈশান শক্ত করে ধরল অভিরাজকে।
“আপু কথা বাড়াস না। ভাইকে এখানে রাখা ঠিক হবে না।”
অভি’র বিশাল, শক্তপোক্ত ভারী দেহটাকে এক প্রকার টেনে নিয়েই বের হলো ঈশান। পিছু পিছু আসছে লাবণ্য। ওর শরীরের সব টুকু শক্তি হারিয়ে গেছে। অভিরাজের এমন অবস্থা সত্যিই চোখে দেখার মতো না। হুট করেই কি এমন হয়ে গেল!
অতীত
হসপিটালের ঝামেলাটা যেন শেষ হবার নয়। লোক গুলো চরম বে য়া দব। রোগী’র বয়স হয়েছিল। হার্টের পেসেন্ট ছিল। অপারেশন তো সাকসেস ফুল ই হয়েছে। তারাই টাকা বাঁচাতে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। আর তারপর আবার হুট করেই এসে এডমিট করাল। ডাক্তার যখন পেসেন্টকে দেখল তখন প্রায় মৃ ত। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না। আর এখন সব দোষ হসপিটালের! তিক্ত হয়ে উঠল অভি’র মুখটা। লাবণ্য নিজেও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। এমনটা আগে কখনো হয় নি। কথায় আছে যা রটে তার কিছু তো বটে। লোকে এমনটাই বিশ্বাস করবে। কিন্তু আসল ঘটনা ভিন্ন। এর জন্যেই মেয়েটি সারাটা রাত হসপিটালে কাটাবে বলে ঠিক করেছে। অভি ফিরল শেষ রাতের দিকে। উষশী’র জন্য ফিরতে হলো ওকে। অবশ্য লাবণ্যকে বলেছিল। তবে মেয়েটি ওকেই পাঠাল। এত ব্যস্ততা, ক্লান্তি, রাজ্যের চিন্তা কিশোরী’র মুখের পানে তাকাতেই যেন মুছে গেল। ঠোঁট প্রসারিত করল সে। শার্টের দুটো বোতাম খুলে নিয়ে মেয়েটির নিকটবর্তী হলো। শক্ত পোক্ত হাত দ্বারা মেয়েটির বাদামি চুল গুলো মুঠোবন্দী করল। ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব হতেই একরাশ ভালো লাগা ফুটে উঠল কিশোরী’র মুখে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে দেখল উষশী’র ঘুম ভেঙেছে। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে চারটা বাজে।
“ঘুমিয়ে পড়ো।”
“কখন এলেন?”
“মাত্রই।”
“ডাকলেন না কেন?”
“ঘুমিয়ে ছিলে তো। ঘুম নষ্ট করা কি ঠিক?”
“জানেন কতটা অপেক্ষা করছিলাম।”
“তাই?”
“হুম।”
মেয়েটি’র শ্বেত রঙা নরম গালে হাত রাখল অভিরাজ। উষশী মাথাটা কাত করে বলল,”কত ঘন্টা হলো আপনাকে দেখি না। মনে হচ্ছিল ম রে ই যাব।”
“খুব কষ্ট হচ্ছিল?”
“হুম। খুব খারাপ লাগছিল।”
“এসো আমার কাছে। আদর করে দিচ্ছি।”
মেয়েটি বিড়াল ছানার মতো এগিয়ে গেল। ছোট্ট তুলতুলে নরম প্রাণী’র ন্যায় বুকে মাথা এলিয়ে দিল। ওর পিনাট বাটারের মতো চুল গুলো গুছিয়ে দিচ্ছে অভিরাজ।
“খাবার খাও নি নিশ্চয়ই?”
“ক্ষিধে পাচ্ছিল না।”
“আসো এখন খেয়ে নিবে।”
“আপনি খেয়েছেন?”
“উহু।”
উষশী খুশি হলো। সে ঝটপট ফ্রেস হয়ে এল। অভি তখন হাতের ঘড়ি খুলছে। আয়নাতে তার মলিন মুখটা দেখতে পেয়ে আতকে উঠল কিশোরী।
“এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কিছু হয় নি উষশী। তুমি আসো আমার সাথে। এত টেনশন কোরো না। সব ঠিক আছে।”
মেয়েটি একরাশ মন খারাপ নিয়ে উঠে এল। একসাথে খাবার খেল ওরা। অল্পস্বল্প গল্প ও হলো। কথায় আছে মানুষ কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার পূর্বে খুব যতন করে। অভি’র ভেতরটা কেমন যেন লাগছে। একটা যন্ত্রণা ওকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছে।
কিছু দিন পরের ঘটনা। অভিরাজ তখন কাজ করছে। সুন্দর,শুভ্র,কিশোরী ছেলেটার পাশে এসে বসেছে। মেয়েটির শরীর থেকে বেলি ফুলের মতো সুবাস আসে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল ছেলেটা।
“কিছু বলবে?”
“হুম।”
“স্লোভেনিয়া থেকে কল এসেছিল।”
“কবে?”
“তিন দিন পূর্বে।”
“সেটা এখন বলছো কেন?”
“বুঝতে পারছিলাম না কি করব।”
“আচ্ছা। কে কল করেছিল? নাম্বার পেয়েছে কোথায়?”
“পাপা কল করেছিল।”
অভিরাজ ল্যাপটপ রেখে সোজা হয়ে বসল। কাজের চাপে উষশী’র মলিন মুখটা দেখা হয় নি। মেয়েটি’র মনের অবস্থা অনুভব হতেই অভি বলল,”জেদি মেয়ে,এভাবে মন খারাপ করছো কেন?”
“আমাকে যেতে হবে অভিরাজ।”
একটা বাক্য অভি’র ভেতরের সবটা ভে ঙে দিল। সে কিছু সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল,”কবে ফিরবে?”
“এক মাস পর।”
অভিরাজ একটু হাসল। মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলল,”সাবধানে যাবে। আর খুব দ্রুত ফিরে আসবে।”
উষশী’র ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। তারপর বলল,”আমি যেদিন হারিয়ে যাই সেদিনই মমের এ ক্সি ডেন্ট হয়। লোকাল হসপিটাল থেকে ফোনে থাকা নাম্বার গুলোতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। তবে ফল ছিল শূন্য। তারপর একদিন পাপার সাথে যোগাযোগ হয়। পাপা মমকে স্লোভেনিয়ায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মম কোমায় চলে গিয়েছিল। তাই আমার বিষয়ে খোঁজ নিতে পারে নি। কিছু দিন পূর্বে আজাহার আঙ্কেলের সাথে যোগাযোগ হয় তার থেকেই নাম্বার নিয়ে পাপা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে।”
অভি সব গুলো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল,”সেদিন কেন জানাও নি উষশী?”
“আপনাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। পাপা সব কিছুর ব্যবস্থা করেছে। গত তিনটা দিন আমি যেই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি সেই যন্ত্রণা আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম না।”
কতটা খারাপ লাগছে অভি’র সেটা ওর চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। মেয়েটি চাতক পাখির মতো চেয়ে। অভি’র কষ্টটা বোঝার জন্য বুকে হাত রাখল।
“খারাপ লাগছে?”
“তেমন না। তুমি তো ফিরেই আসবে উষশী। মাত্র এক মাসের বিষয়।”
“হুম। আপনাকে মিস করব মিস্টার রাগি।”
“আমিও ভীষণ মিস করব রেইন।”
এত সময়ের কান্নাটা যেন চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল। উষশী, এক সাহসী কিশোরী, যে কি না কোনো মতেই নিজেকে অসহায় বোধ করে না সে আজ ভীষণ অসহায় বোধ করল। আর সাতাশ বছর বয়সী শক্ত পোক্ত দেহের লম্বাটে অভিরাজ নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার এক বৃথা চেষ্টা চালাল।
উষশীকে একাই যেতে হবে। একা একাধিক বার ফ্লাইট করার অভিজ্ঞতা রয়েছে মেয়েটির। তবু অভিরাজ শান্তি পাচ্ছে না। বিমানবন্দরে এসে মেয়েটিকে নানান বোঝ পরামর্শ দিচ্ছে। বার বার পাসপোর্ট আর টিকেট চেইক করে দেখছে। এদিকে ছোট্ট বরফ সাদা রঙের মেয়েটি একবারেই চুপচাপ। তিন মাস পূর্বে যে মেয়েটিকে দেখলেই বাচ্চা মনে হতো সেই মেয়েটি আজ বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। মাত্র তিনমাসে কতটা পরিবর্তন এসেছে। উষশীকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভিরাজ শুধাল,”কি হলো? এভাবে তাকাচ্ছ যে।”
“দেখছি।”
“কি?”
“আপনার দুটি চোখ।”
“কি দেখলে?”
“আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।”
উষশী আর অভিরাজ একে অপরের দিকে কিছু সময় চেয়ে রইল। তারপর হুট করেই নজর ঘুরিয়ে ফেলল কিশোরী।
“সাবধানে যাবে। গিয়েই কল করবে। আর কিছু দিন সময় থাকলে আমি তোমাকে একা ছাড়তাম না রেইন।”
“চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক ঠাক পৌছাব।”
“হুম। আর পৌছেই কল করবে। ভুলে যেও না আবার।”
“আপনাকে ভোলার সাধ্য নেই অভিরাজ।”
অভি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কোকো মিউ মিউ করছে। প্রাণীটার শরীরে হাত বুলিয়ে দিল অভিরাজ। এতেই যেন চুপ হয়ে গেল সে। কাঁধসম বাদামি রঙের চুলযুক্ত শ্বেত রঙা মেয়েটির শরীরে হাঁটুসম ফ্রক। তাকে সব পোশাকেই বড়ো সুন্দর লাগে। অন্তত অভিরাজের চোখে তেমনি মনে হয়। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে উষশী। তাদের এই দূরত্ব যেন আকাশও মেনে নিতে পারল না। তাই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামাল। বৃষ্টি এলেই উষশী’র মন ভালো হয়ে যায়। ভিজতে ইচ্ছে করে। তবে আজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। শুধু একটা যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে। নিজ প্রেয়সী’র মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় দিচ্ছে অভিরাজ। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলা হতে শুরু করল। উষশী পেছন ফিরে তাকাল একবার। এই তাকানোতেই অভিরাজের ম র ণ হলো। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল মেয়েটিকে। উষশী’র হাত ছেলেটার পিঠে এসে ঠেকেছে। নরম তুলতুলে ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিচ্ছে। অথচ শক্ত পোক্ত আলিঙ্গনে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু কিশোরী চুপ। অভি’র মাদক মেশানো ভালোবাসার কাছে সামান্য ব্যথা নিছকই এক ফুলের টোকা।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৫)
জেগে উঠেছে অভিরাজ। এসি চলা সত্ত্বেও ঘেমে গিয়েছে সে। একটা বাজে অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে চারপাশ থেকে সব কিছু ভীষণ ভাবে চেপে ধরছে। এতটাই অসহ্য লাগছে যে শার্টের বোতাম খুলে ফেলতে হলো। লাবণ্য ব্যলকনিতে ছিল। অভিকে জেগে উঠতে দেখে চট জলদি ভেতরে এসেছে। তার কণ্ঠে ব্যগ্রতা।
“কেমন লাগছে?”
“ঠিক ঠাক।”
“হঠাৎ করে ওমন করছিলি কেন?”
“এমনি।”
লাবণ্য বুঝল কথাটা। অভি কোনো বিষয় লুকাতে চাইছে। তাই সে ঘাটাল না। বরং খাবার অর্ডারের কথা বলে বেরিয়ে পড়ল। লাবণ্য যেতেই অভিরাজ উঠে পড়ল। তার দু চোখে তীব্র তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণা বাদামি রঙের চুলের মেয়ের জন্য। রাতের শেষ ভাগে ঈশান এল। ছেলেটা বড়ো ক্লান্ত। পুরো সন্ধ্যা বেশ পরিশ্রম গিয়েছে। অভিরাজ ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। দরজায় নক পড়ল।
“ডিস্টার্ব করতে চাইছিলাম না ব্রো।”
“সমস্যা নেই। বোস এখানে।”
ঈশান গরম পানির মধ্যে কফি মিশিয়ে নিল। এটার প্রয়োজন ছিল খুব। অভিরাজ এখন স্বাভাবিক। খুব অল্পতেই যেন সেড়ে গিয়েছে।
“ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে। ওরা আমাদের সাথে কাজ করবে।”
“গুড। কন্ট্রার্কের ব্যাপারে কি বলেছে?”
“ছয় মাসের জন্য কন্ট্রাক করবে বলেছে।”
“অফার তো দুই বছরের জন্য করেছিলাম।”
“ব্রো,আমরা বিশাল একটা লস করেছি। ওরা যে এতটা ভরসা করেছে এটাই অনেক বেশি।”
“হুম। তবে আমি কন্ট্রাক করছি না।”
অভি’র কথাতে প্রচন্ড অবাক হলো ঈশান। যেই কন্ট্রাকের জন্য এত কিছু সেই কন্ট্রাক পেয়েও নাকি নাকোচ করে দিবে!
“ভাই এটা কি বললে?”
“ছয় মাসের কন্ট্রাকে আমার লসের সম্ভবনা রয়েছে। আমরা যেই অফার করেছি যে কোনো কোম্পানি আমাদের সাথে ডিল করে নিবে। ওরা শুধু আমাদের চাপে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। যাতে করে আরো বেশি লাভবান হওয়া যায়। কিন্তু আমরাও এর কম প্রফিটে কাজ করব না। বিজনেস বিষয়টা অত সহজ না। সবটাই মাথা খেলিয়ে করতে হয়।”
“তাহলে কি করবে?”
“সোজা হিসাব। ডিল ক্যানসেল। চট করে মেইল পাঠিয়ে দে।”
“ভাই, শোনো কথা।”
“এ ব্যপারে দ্বিতীয় কথা হবে না ঈশান। দ্রুত মেইল পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”
বেরিয়ে গেল অভিরাজ। ঈশান হতাশ হয়ে পড়ল। কতটা চেষ্টার পর এই কন্ট্রাক পেয়েছে আর অভি কি না পায়ে ঠেলছে!
ভোরের মিষ্টি আলো অভি’র পুরো শরীর কে ভালো লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে। এখানকার রাস্তা ঘাট খুবই পরিষ্কার। লম্বা লম্বা গাছ গুলো কেমন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। বিদেশীরাও শরীর চর্চা করছে। অভি পায়ের গতি বাড়াল। এদিকে ফোন বেজে চলেছে। লাবণ্য’র কল। মেয়েটা নিশ্চয়ই ঈশানের থেকে ঘটনা শুনেছে।
“হ্যাঁ লাবণ্য বল।”
“অভি,তুই এটা কি বলেছিস?”
“শুনেছিস যেটা সেটাই।”
“দেখ, আমরা কতটা পরিশ্রম করে ওদের মানিয়েছি। আর তুই কি না ক্যানসেল করে দিবি।”
“কারণ ওদেরকে এত প্রফিট দিয়ে ছয় মাসের জন্য কন্ট্রাক করাটা যুক্তিসম্মত না।”
“তাহলে কি করবি?”
“অন্য কোম্পানি’র সাথে কথা বলব।”
“যেটা ভালো বুঝিস কর।”
“হুম।”
“তুই কোথায় এখন?”
লাবণ্য’র শেষ কথাটা শুনতে পায় নি অভিরাজ। তার দুটি চোখ থেমে আছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিনাট বাটারের মতো চুলের মেয়েটির দিকে। তার শ্বেত রঙা গাল, সুন্দর দুটি চোখ আর পাতলা শরীর। সব অভিরাজের নিকট ভীষণ চেনা লাগছে। ছেলেটা ঘোর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল সেদিকে। সুন্দর শুভ্র মেয়েটি তখন একটি ছেলের সাথে কথা বলছে। তাদের কথা বলার ধরণ দেখে অনেক কিছুই মাথায় আসে। অভি খুব বেশি আগাতে পারে নি তার পূর্বেই মেয়েটি গাড়িতে উঠে গেল।
সবটাই কি দৃষ্টিভ্রম? নাকি মেয়েটা জীবন্ত সত্য। পাঁচ বছর পূর্বের সেই কিশোরী কি সত্যিই ডেনমার্কে অবস্থান করছে? যদি তেমনি হয় তবে এর পেছনের কারণ কি? এসব প্রশ্ন অভিকে একটু একটু করে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ভীষণ চাপে মস্তিষ্ক কাজ করছে না। এত এত ঝামেলার মাঝে সত্যিই ঠিক থাকা যাচ্ছে না। তবু ঠিক রয়েছে অভিরাজ। তার পরের দিন গুলো প্রচন্ড ঝামেলায় পার হলো। টানা একটা সপ্তাহ গোরু খাটুনি গিয়েছে সবার উপর। প্রথম দিকে ক্লাইন্ট খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিল হলেও এখন সেই অসুবিধাটা নেই। একে একে ছয়টা কোম্পানি ২ বছরের চুক্তি করেছে। এরই মধ্যে পুরনো কোম্পানি গুলোও যোগাযোগ করেছে। অভিরাজ তাদের ফিরিয়ে দেয় নি। বরং স্বাদরে গ্রহণ করেছে। সব ঝামেলা শেষে আজ হাতে বেশ ভালো সময় পেল অভিরাজ। হাঁটতে হাঁটতে লেকের কাছে এসে দাঁড়াল। মুক্ত বাতাস পেয়ে প্রাণ ভরে উঠছে। তারপর হঠাৎ ই সেদিনের বারের কথা স্মরণ হলো। যেখানে বাদামি রঙের চুলের সেই মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিল। হুট করেই সেখানটায় চলে এল সে। কেন এল,কোন আশা নিয়ে এল তার কোনো ব্যাখা নেই। সবটাই খুব দ্রুত চলছে। মৃদু সুরে গান বাজছে। চারপাশে লাস্যময়ী নারী’রা নেচে চলেছে। অভিরাজের পরনে ক্যাজুয়াল জামা কাপড়। সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা ডিভানে এসে বসেছে। বার বয় এসে নেশাক্ত পানীয় দিয়ে গেল। অভি সেসব ছুঁয়েও দেখছে না। রকমারি মেয়ের আনা গোনা এখানে। পোশাকের অবস্থা চোখে দেখার মতো না। সবার মাঝেও একটি মেয়েকে খুঁজে চলেছে উতলা নয়ন। অথচ পাচ্ছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উঠে যাচ্ছিল ঠিক সেসময় একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। যেই হাসিতে অভিরাজের ভেতরকার সবটা তপ্ত হয়ে উঠল। দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল মস্তিষ্ক। যতক্ষণে মস্তিষ্ক স্বাভাবিক হলো ততক্ষণে চারপাশ থেকে লাউড মিউজিক শুরু হয়ে গেছে। এক দল ছেলে মেয়ে ডান্স করছে। আর তাদের মধ্যে সব থেকে আর্কষণীয় মেয়েটা হচ্ছে উষশী! যার পিনাট বাটারের মতো চুল,শ্বেত রঙা গাল আর সুন্দর দুটি চোখের মায়ায় ডুবে নিজের সবটুকু শেষ করেছিল সাতাশ বছর বয়সী অভিরাজ।
বয়ফ সাদা মেয়েটির সাথে কিশোরী উষশী’র বড়ো অমিল। অবশ্য এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। পাঁচ বছর কম সময় নয়। অভি’র জীবন থেমে থাকলেও বাকি সবই ছিল চলমান। ভীড় ঠেলে অভিরাজ ভেতরে গেল। উষশী তখন গানের তালে তালে অর্ধমাতাল। রোজকার অভ্যাস তার। মেয়েটির উন্মুক্ত বাহু বড়ো চোখে লাগে। এত সৌন্দর্য’র মাঝেও ছড়িয়ে পড়ল তিক্ততা। অভি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই টেনে নিল যুবতীকে। বারে থাকা সব গুলো মানুষ চকিত হলো। উষশী একটা রাগ ক্ষোভ নিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়েছে। তার সাথে থাকা মেয়ে গুলো চেচামেচি করছে। অভিকে রুম ডেটের অফার করছে। এসব শুনে প্রতি দিনকার মতো হাসল না মেয়েটি। বরং অত্যন্ত রাগ নিয়ে বলল,”নট অ্যানাদার ওয়ার্ড। এভরি ওয়ান মুভ। আই সেইড মুভ।”
মেয়ে গুলো সরে গেল ঠিকই তবে যাওয়ার পূর্বে অন্যরকম দৃষ্টি ফেলে গেল। ৩২ বছর বয়সী অভিরাজের সুদর্শন রূপ যে কারো হৃদয় কম্পন করার মতো।
কি আশ্চর্য যে মেয়েটাকে দেখার জন্য হৃদয় আনচান করত। একটু ছোঁয়া’র জন্য আকুলতার শেষ ছিল না সেই মেয়েটার প্রতি অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। তবে এটাকে ঠিক ঘৃণা বলা যায় না। আবার ভালোবাসাও না। কেমন যেন মাঝামাঝি একটা পরিস্থিতি। উষশী’র দৃষ্টির সাথে অভিরাজের দৃষ্টি একাকার হয়ে গিয়েছে। একটা সময় পর মৌনতা ডিঙিয়ে অভি বলল,”ইউর লাইফ ইজ গোয়িং ভেরি ওয়েল উষশী। দেখে ভালো লাগছে।”
নিরুত্তর উষশী। সে কোনো জবাব দিচ্ছে না। এমনকি নড়চড় ও নেই। অভিরাজ একটা তাচ্ছিল্য ভাব রাখল অধরে।
“স্লোভেনিয়া’র উষশী এখন ডেনমার্কে! পাঁচ বছর পূর্বে স্লোভেনিয়া’র টিকেট রেখে পালিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি আজ আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে! পৃথিবীটা বড়ো আজব। কেউ পালিয়ে গেলেও কোনো এক কালে দেখা হয়েই যায়। তবে এতটাও আশা করি নি। গ্রেট জেদি মেয়ে। তুমি জিতে গিয়েছ। তোমার জেদ, তোমার কালচার এমনকি তোমার করা সব ছলনা সবটা জিতে গিয়েছে। অন্যদিকে নিজের থেকে এক যুগ ছোট এক মেয়েকে ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে গেছে অভিরাজ। যত আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম সবটা আজ ধ্বংস হয়ে গেল। যার ব্যক্তিত্ব, যার কাজ, যার কঠোরতায় পুরো দুনিয়ায় কম্পন ধরে যেত সেই ছেলেটা এক ভুল মেয়ের ছলনায় পড়ে নিজের জীবন থেকে পাঁচটা বছর সরিয়ে নিল। ওয়াও, ইউ এন্ড ইউর চিট আর বোথ উইনার্স। অভিনন্দন জেদি মেয়ে।”
নিজের সমস্ত ভালোবাসাকে শেষ করে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অভিরাজ। আর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিশ বছর বয়সী বরফ সাদা রঙের পাঁচ বছর পূর্বের সেই কিশোরী উষশী। যাকে সব টুকু দিয়ে ভালোবেসে সাতাশ বছর বয়সী এক যুবকের পুরো জীবনই বদলে গিয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে পাঁচটা বছর।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি