#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩১)
“এই মেয়ে, ওভাবে বৃষ্টিতে ভিজছো কেন?”
“আপনিও আসেন না।”
“জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে?”
“একটু আধটু জ্বর হলে কিছু হয় না।”
“উষশী এখনি চলে আসো।”
“না,না আমি আরো থাকব। এই বৃষ্টিটা খুবই দারুণ।”
“তোমার কাছে কোন বৃষ্টিটা দারুণ নয় বলো তো।”
“যে বৃষ্টিতে অভিরাজ থাকবে না।”
বাক্যটি শেষ করে আরেকটু এগিয়ে গেল উষশী। উঠানের সামনের জায়গাটুকু বাঁধাই করা বিধায় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে ঘুরছে সে। অন্যদিকে অভিরাজ শান্ত সুমদ্রের মতো দাঁড়িয়ে। এক চুলও নড়ছে না ছেলেটা। ওর মস্তিষ্কে উষশী’র বলা শেষ কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন রিক্ত হতে শুরু করেছে। হুট করেই প্রচন্ড রাগ হলো ওর। ভরা বৃষ্টিতে নেমে গেল সে। উষশী’র বাহু চেপে ধরে একদম কাছে টেনে নিল।
“বাহ আপনিও ভিজতে শুরু করলেন।”
“একটু আগে কি বললে?”
“কি বললাম?”
“মনে করো।”
“আরে বাবা কোনটা?”
“উষশী, তোমার জীবনে এমন কোনো বৃষ্টি আসবে না যে বৃষ্টিতে অভিরাজ থাকবে না।”
উষশী কেমন করে তাকাল যেন। অভিরাজের ভেতরের ব্যথাটা বোধহয় অনুভব করার চেষ্টা চালাল।
“জেদি মেয়ে, জানো আমার বুকের ভেতরে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আর কখনো এভাবে বলবে না। তুমি কখনো হারিয়ে গেলে অভিরাজের জীবন থমকে যাবে।”
ভরা বৃষ্টিতে ছোট্ট মেয়েটিকে দু হাতে আগলে নিল অভিরাজ। বৃষ্টি’র জলে ভিজে একাকার ওরা। অভিরাজের বুকের ভেতর থেকে আসা লাব ডাব শব্দ যেন শোক নামাল। উষশী ধীরে ছেলেটির পিঠে হাত রাখল। তার দু চোখের নোনা জলের সাথে বৃষ্টির জল মিশে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় দেওয়া কাজল টুকুও লেপ্টে গিয়েছে। তবু কতটা সুন্দর লাগছে তাকে!
বর্তমান
অতীতের সবটুকু ব্যথা ভুলে গিয়ে অভিরাজ আজ বিমানবন্দরে। তার সাথে রয়েছে লাবণ্য আর ঈশান ও। শুরুতে ঈশানের যাওয়ার কথা ছিল না। তবে কোন মতলবে যেন এল ছেলেটা। এতে অবশ্য সবথেকে খুশি হয়েছে অভিরাজ। ছোঁয়া’র সাথে ঈশানের বিষয়টা শুধুমাত্র সে জানে। এত বছরেও পাঁচ কান হয় নি ঘটনাটা। আসলে ঈশান ই চায় নি এই ঘটনাটা আর কেউ জানুক। নিজের ব্যক্তিগত ঝামেলার কারণে ছোট ভাইকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া হয়ে উঠে নি। একটা বোধ থেকে কেমন কষ্ট হচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার পার্থক্যে ডেনমার্ক চলে এসেছে ওরা। সেখান থেকে সোজা উঠল হোটেলে। তিন মাসের লম্বা সফরের জন্য এসেছে! ঈশান নিজ রুমের চাবি নিয়ে আগেই উঠে গেল। লাবণ্য সেদিকে তাকিয়ে চেচাল। “শ য় তা ন একটা। আমাদের জন্য দাঁড়াল না অবধি!”
“ওকে ওর মতো থাকতে দে লাবণ্য।”
“সারাজীবন কি দেবদাস হয়ে থেকে যাবে? ওর কাহিনীটা রহস্যই রয়ে গেল। এমন ভাবে বদলে গেল!”
এ ব্যপারে মন্তব্য করল না অভিরাজ। ওর থেকে সাড়া না পেয়ে থেমে গেল লাবণ্যও। একটা গভীর শ্বাস ফেলল। সত্যি বলতে ওদের প্রত্যেকের জীবনই ভীষণভাবে অগোছালো। অভি তাকে বার বার নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে বললেও সে পারে নি গোছাতে। সর্বদাই মনে হয়েছে শেষ দিন অবধি অভি’র পাশে থাকতে হবে। সেটা হোক স্বার্থপর হয়ে কিংবা স্বার্থহীনভাবে। দিন শেষে একটাই সত্য অভি’র পাশে থাকছে সে। নিজ রুমে এসে লম্বা শাওয়ার নিল অভিরাজ। ঘরের মাঝ বরাবর দেয়াল জোড়া আরশি রাখা। সেখানে নিজের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল ছেলেটা। অন্তঃকরনে কেমন জ্বালা করছে। একটা ধারালো ব্যথা গলায় এসে উৎপাত চালাচ্ছে। এত বছর পর ও নিজের মাঝে কোনো পরিবর্তন খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। যতটা মানসিক অবসাদের মাঝে গিয়েছে এতে করে গঠন ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ এমনটা হয় নি। পাঁচ বছর কি কম সময়? নাকি লাবণ্য’র করা যত্ন গুলোই এই সৌন্দর্যের একমাত্র রহস্য।
অতীত
উষশী’র চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে। কিশোরী’র শ্বেত রঙা গালে কালো বর্ণটা একেবারে ফুটে উঠেছে। ওর অবস্থা দেখে হেসে উঠল অভিরাজ। নিজ হাতের কনিষ্ঠা আঙুলের সাহায্যে সেটা মুছে দিয়ে শুধাল, “আরো বৃষ্টিতে ভিজতে চাও?”
“উহু।”
“চলো তাহলে। ঠান্ডা না লেগে যায়। কি যে করো তুমি। একটা কথাও শোনা না।”
কথা শেষে মেয়েটিকে নিয়ে পথ আগাল অভিরাজ। ইরা আর রত্না ড্রয়িং এ বসে গল্প করছিল। দুজনকে কাকভেজা হয়ে ফিরতে দেখে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।
“এ মা,ভিজলে কেমন করে ভাইয়া?”
“যেভাবে মানুষ ভিজে।”
“ইচ্ছে করে ভিজেছ তোমরা?”
“তেমনি কিছুটা। সব কথা রেখে উষশী’কে দ্রুত ঘরে নিয়ে যা। চেঞ্জ করা হলে হাতের তালুতে তেল মালিশ করে দিবি। ঠান্ডা লাগার চিন্তা আছে।”
ভাইয়ের কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনল ইরা। নিজের জন্যে একটুও চিন্তা নেই। অথচ উষশী’র নখের যত্ন নিতেও ভুল করছে না! এর মধ্যেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে রত্না। সে মৃদু হেসে চা বসাতে গেল। অভিরাজ নিজ ঘরে আসতেই লাবণ্যকে দেখতে পেল। লাবণ্য কাজ করছে। মুখের ভঙ্গিমা বিশেষ ভালো নয়।
“একটা ইম্পর্টেন্ট মেইল এসেছে। চেইক করিস তো।”
“কিসের মেইল?”
“হসপিটাল থেকে। ম্যানেজার পাঠিয়েছেন।”
“ঠিক আছে। আমি দেখে নিয়ে তোকে সেন্ড করছি।”
“তার আগে চেঞ্জ করে আয়।”
“ও হ্যাঁ। তুই তাহলে বোস।”
অভিরাজ চলে যেতেই ফের কাজে ব্যস্ত হলো লাবণ্য। বাড়ির বড়ো মেয়ে হওয়াতে তার দায়িত্ব একটু বেশিই যেন। সে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও কাউকে বলে না। অভিরাজের সাথে এই একটা দিক বড়ো মিল তার। দুজনেই কাজের প্রতি ভীষণভাবে দায়িত্বশীল।
উষশী ড্রেস চেঞ্জ করে অভিরাজের কাছেই এসেছিল। সেখানে লাবণ্যকে দেখে ফিরে গেল। কাজের সময় বিরক্ত করতে চাচ্ছে না। পথে দেখা হলো রত্না’র সাথে। মেয়েটার হাতে চা। সেখান থেকে এক কাপ তুলে নিয়ে কি মনে করে যেন আরেকটা কাপ ও নিল। অভিরাজের রুমের ঠিক বিপরীত পাশের করিডোরের প্রথম ঘরটা ঈশানের। ছেলেটা শুয়ে আছে। ফোনের দিকে তার গভীর দৃষ্টি। বাইরে থেকেই নক করল উষশী। নড়ে উঠল ঈশান। মলিনতা সরিয়ে কণ্ঠে ছন্দ ফিরিয়ে বলল,”আরে উষশী! হোয়াট লাক আই হ্যাভ। বাইরে দাঁড়িয়েছ কেন?”
“এখানটায় ই ঠিক আছি। ঈশান তোমার সাথে আড্ডা দিতে চাচ্ছিলাম। খুব বোরিং ফিল হচ্ছে।”
“জাস্ট আ মিনিট।”
ঘরের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ঝটপট চলে এল ঈশান। অভিরাজের মতোই লম্বা ছেলেটা। কিশোরী’র নিকটে আসতেই একটা মন ভালো করা সুবাস মিলে। উষশী চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। মৃদু হাসল সে। চায়ের কাপ নেওয়ার সময় ঝলমলে বাদামি রঙা চুল গুলোর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল।
“চুল ভেজা কেন?”
“বৃষ্টিতে ভিজেছি।”
“উইথ ব্রো?”
“হুম।”
“ফাইনালি ইউর লাভ হেজ স্টার্টটেড।”
“কাইন্ড অফ। বাট ঈশান, ওয়ান থিংক আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।”
“সেটা কেমন?”
“আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি।”
“চিল ইয়ার। ব্রো তোমাকে কতটা চায় সেটা তো দেখছোই।”
উষশী একদমই চুপ হয়ে রইল। করিডোর দিয়ে চলতে চলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে। সাথে আসছে ভেজা মাটির সৌরভ। কিন্তু কেন যেন উষশী’র মন ভালো হচ্ছে না। একটা চাপা দুঃখ ওকে প্রচন্ড বেগে আ ঘা ত করে চলেছে। যেন একটু একটু করে শোকের প্রহর নেমে আসছে।
ঘুমন্ত মেয়েটিকে এভাবে নিয়ে আসতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছিল না অভিরাজের। আবার ঘুম ভাঙানোর ও ইচ্ছে হলো না। তাই মেয়েটিকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই তুলে নিয়ে এল। হসপিটালে কিছু সমস্যা হয়েছে। সেই জন্যেই রাতারাতি ফিরতে হচ্ছে ওদের। সবাই বলেছিল উষশীকে রেখে যেতে। তবে অভি মানতে নারাজ। মেয়েটিকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে চাচ্ছে না। লাবণ্য’র থেকে থেকে ঝিমুনি আসছে। অর্ধেক রাত অবধি কাজ করেছে। শরীর ক্লান্ত তবু চেয়ে থাকার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। সেটা দেখে অভিরাজ বলল,
“ঘুমিয়ে নিতে পারিস। পৌছে গিয়ে উঠিয়ে দিব।”
“না। ঠিক আছি।”
“হুট করেই হসপিটালে এমন একটা কান্ড হয়ে যাবে ধারণা করতে পারছি না। ওরা কি করে বলতে পারে পেসেন্টের মৃ ত্যু টা অস্বাভাবিক।”
“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না অভি। আমাদের হসপিটালে আগে এমন কখনো কি হয়েছে?”
“এটাই চিন্তার। যদি আমাদের গাফিলতি হয়ে থাকে তাহলে খুব অন্যায় হয়েছে লাবণ্য। আর এর শাস্তি অন্তত এ পৃথিবীতে সম্ভব না।”
“শুধু শুধু নেগেটিভ চিন্তা করছিস। টেনশন করিস না। গিয়ে দেখি কি অবস্থা।”
অভিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফ্রন্টের মিররে উষশীকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা গভীর ঘুমে তলিয়ে। তার ফর্সা মুখশ্রীতে কিছু বিরক্তিকর চুল এসেছে। যা কিশোরী’র ঘুম নষ্ট করছে। হুট করেই গাড়ি থামানোয় চমকে উঠেছে লাবণ্য। যখন চোখ মেলে তাকিয়েছে তখন অভিরাজ ড্রাইভিং সিটে নেই। সে পেছনের সিটে গিয়ে কিশোরী’র অবিন্যস্ত চুল বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত। উষশী ঘুমের ঘোরেই অভিরাজের উষ্ণতা মেখে চলেছে। ছেলেটা’র কাছে যেতে চাইছে। এটা দেখেই নজর ঘুরিয়ে নিল লাবণ্য। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ক্রমশ সবটা কেমন জটিল লাগছে।
উষশী’র ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। মেয়েটি তখনো জানে না কোথায় আছে। খানিক বাদে ঘুম জড়ানো কণ্ঠটা শুনতে পেল। অভিরাজ তার পাশেই আধশোয়া হয়ে বসেছে।
“ঘুম ভেঙেছে?”
“হুম। কিন্তু এটা…।”
“ঢাকায় চলে এসেছি আমরা।”
“কখন!”
“অনেক রাতে।”
“আমি তো বুঝতেও পারলাম না।”
“তখন তুমি গভীর ঘুমে ছিলে। এত মিষ্টি একটা ঘুম নষ্ট করতে চাই নি।”
সরল চোখে তাকাল উষশী। মেয়েটি’র শুভ্র সুন্দর মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে আছে অভি। দুজন দুজনাকে দেখে নিচ্ছে মন প্রাণ ভরে। অত্যন্ত এক জনমে তো এ দেখার শেষ হবে না।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩২)
জানালার পর্দা খুলতেই একরাশ শুভ্রতার দেখা মিলল। এখানকার কোলাহল মুক্ত পরিবেশ আর মিষ্টি রোদ্দুর মুহূর্তেই মন ভালো করে দিচ্ছে। অভিরাজ পূর্বের স্বভাবে ফিরে গিয়েছে। এখন নিয়ম করে সকালে শরীরচর্চা করে। খাবার খাওয়ার দিকটাও বেশ নিয়মের মাঝে চলে। নরম মিষ্টি রোদ মেখে ফ্রেস হয়ে এল। কিছু সময় পর অভি’র জন্য খাবার নিয়ে এল লাবণ্য।
“খাবারটা কোথায় রাখব?”
“টেবিলে রাখ। ঈশান উঠেছে?”
“হুম।”
“ওর সাথে কথা আছে। একটু পাঠিয়ে দে।”
“দিচ্ছি। বিকেলে কিন্তু মিটিং রয়েছে।”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
লাবণ্য চলে যাচ্ছিল। হুট করেই ডেকে উঠল অভিরাজ। লাবণ্য ফিরে এসে একদম বরাবর দাঁড়াল।
“হু?”
“আর কতটা কষ্ট দিবি নিজেকে?”
“এসব কথা বলতে নিষেধ করেছি অভি।”
“অথচ আমি বিষয় গুলো ভুলতে পারি না। তোর কাছে আমি বড়ো ছোট হয়ে যাচ্ছি। একজন অকতৃঘ্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে রাঙিয়ে তুলছি।”
“থাক না এসব কথা। আমার ভালো লাগে না।”
“আমার ও লাগে না।”
“কী?”
“তোকে কষ্ট পেতে দেখলে। আমার জন্য নিজের জীবনের সব থেকে সুন্দর সময় গুলো নষ্ট করে চলেছিস। এর কি ব্যাখা দিব এই পৃথিবী’র কাছে?”
“এর কোনো ব্যাখা নেই অভি। যত দিন না তুই আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে আসছিস অথবা উষশীকে ফিরে পাচ্ছিস ঠিক ততদিন আমি তোর পাশে থাকব। স্বার্থপরতার সাথে কিংবা স্বার্থহীন ভাবে। এটা নিয়ে পৃথিবীতে কে কি ভাববে সত্যিই আমার যায় আসে না অভি।”
লাবণ্য চলে গেল। হয়ত তার চোখ দুটি সিক্ত হতে শুরু করেছিল। অভি ধীর স্থির ভাবে বসল। মেয়েটিকে কিছুতেই বোঝানো গেল না। অথচ ওর ভেতরের চাওয়াটা যে একেবারে অনুচিত সেটাও নয়। প্রতিটা মানুষ চায় তার প্রিয় মানুষের সঙ্গ পেতে। যেমনটা অভিরাজ চায় উষশীকে, কিংবা উষশী চেয়েছিল অভিরাজকে। ঠিক তেমনি লাবণ্য চেয়ে চলেছে। অথচ তিনটি জীবন তিনটি ব্যাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে। অভি তখন খাবার খাচ্ছে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল ঈশান। একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,”ডেকেছিলে ব্রো?”
“হুম। এদিকে এসে,বোস পাশে।”
“বল,কি বলবে।”
“খেয়েছিস?”
“না। একটু পর খাব।”
“ঠিক আছে। যেটার জন্য ডেকেছিলাম। হুট করেই জব ছেড়ে বিজনেসে আসার ইচ্ছে হলো কেন?”
“জবের টাকায় পোষায় না।”
“এতদিন তো দিব্যি চলছিল।”
“হুম। বাট ব্রো সামনে পার্টনার হবে। দোক্কা হলে খরচ তো বাড়বে তাই না?”
“বিয়ে করবি?”
“না করার তো কিছু নেই।”
“গুড ডিসিশন। বাট সেটা ছোঁয়া হয়ে থাকলে ভুলে যা।”
মুখ ফিরিয়ে নিল ঈশান। অভি নিরুপায়। করুণ তার চোখের দৃষ্টি।
“ছোট থেকেই বড়ো আদরে বড়ো করেছি তোকে। এমন কিছু করিস না। যাতে ভালোবাসার জায়গাটা ঘৃণায় পরিনত হয়।”
অভি উঠে গেলেও বসে রইল ঈশান। তার দুটি চোখ জ্বালা করছে। অধর রাঙানো অতৃপ্তির হাসি। সে যখন নিজেকে গোছাতে চায় তখুনি একটা ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দেয়।
অতীত
উষশীদের লোকাল গার্ডিয়ানের নাম আজাহার আহমেদ। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন শহরের বাহিরে ছিলেন। ফিরেই অভিরাজের সাথে দেখা করতে এসেছেন। খবরটা যখন থেকে পেয়েছে তখন থেকেই বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট করতে লাগল। বেশ কিছু সময় বসে রইল ছেলেটা। লাবণ্য এসে দু বার ডেকে গিয়েছে। অথচ এক পা এগোনোর সাহস হচ্ছে না। বেশ সময় নিয়ে নিজের মন মস্তিষ্ককে বুঝিয়ে বেরিয়ে এল। অভি’র লম্বা চওড়া দেহটা দৃশ্যমান হতেই উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। হাত মিলিয়ে বললেন,”আমি আজাহার আহমেদ।”
“জী বসুন।”
“উষশী’র মম সাব্রিয়া আমার বন্ধু। আমার আন্ডারেই এসেছিল ওরা।”
“উষশী’র মা বাবা’র কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ওদের বাসাটা বন্ধ আছে।”
“জানি আমি। আসলে দীর্ঘদিন ধরে শহরের বাইরে ছিলাম। তাই খোঁজখবর হয় নি। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা না।”
“উষশী’র মম। আই মিন সাব্রিয়া পলের বাবার বাড়ির ঠিকানা নিশ্চয়ই জানেন?”
মুখটা বির্বণ হয়ে গেল আজহারের। তিনি একটা হতাশার নিশ্বাস ফেললেন।
“আসলে সাব্রিয়া এতিম ছিল। ওর বাবার ফ্যামিলি বলতে কেউ নেই।”
“আপনি কত সময় ধরে চিনেন ওনাকে?”
“ভার্সিটি থেকে। আমরা একই ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি।”
বেশ সমস্যায় পড়ল অভিরাজ। উষশীকে নানা বাড়ি সম্পর্কে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল। তবে এই বিষয়ে কোনো উত্তর করতে পারে নি কিশোরী।
“উষশী’র বাবার ঠিকানা তো থাকার কথা?”
“সরি। বাট বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে ওদের ডিভোর্স হওয়ার কথা চলছিল। সেই জন্যেই দেশে পালিয়ে এসেছিল সাব্রিয়া। যাতে করে ডিভোর্সটা না হয়। এসব যদিও সিক্রেট ছিল তবু বলতে বাধ্য হলাম।”
এই ধাক্কাটা আসলেই সামলানোর মতো ছিল না। বেশ ধাক্কা খেল অভিরাজ। বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। উষশী’র ভবিষ্যৎ কতটা বিঘ্ন হতে চলেছে সেটা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে।
উষশী’র নরম তুলতুলে হাতটা অভিরাজের বুকে লুটপাট চালাচ্ছে। মেয়েটি তখন থেকে হাতের সাহায্যে কি যেন আঁকুবুঁকি করে চলেছে। এতেই যেন সবটুকু সুখ খুঁজে পায় কিশোরী। ওদের পায়ের কাছে বসে আছে কোকো। পরম আনন্দে খাবার খাচ্ছে প্রাণীটা। অভি’র সমস্ত ধ্যান আজ অন্যদিকে। আজাহারের বলা কথা গুলো নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়। উষশীই বলেছিল সে তার মায়ের সাথে এসেছে। বাবার কথা খুব বেশি স্মরণ ও করে না মেয়েটি। এতেই বোঝা যায় কথা গুলো সত্য। বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হওয়ার কথা জানলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। তাই বিষয়টি চেপে গেল সে। একটা সময় পর উষশী বলল,”সব অসহ্য লাগছে। আপনি এমন আপসেট হয়ে আছেন কেন?”
“আপসেট?”
“হ্যাঁ। তখন থেকে দেখছি কেমন চুপচাপ।”
“চুপচাপ তো প্রায়ই থাকি।”
“মিস্টার রাগি,কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নি উষশী।”
“মিথ্যে বলছেন?”
“উহু।”
কথাটা বিশ্বাস হয় নি কিশোরী’র। তাই সে রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হেসে উঠল অভিরাজ। শব্দ করে হাসার দরুণ পেছন ঘুরে তাকাল কিশোরী। নাক কুঁচকে বলল,”কোকো,এখানে থাকার দরকার নেই। মিস্টার রাগি বদলে গিয়েছে।”
“জেদি মেয়ে শুনে যাও একটু।”
“শুনব না।”
“আরে।”
“কথা বলবেন না আমার সাথে।”
লম্বা কদমে চলছে কিশোরী। অভিরাজ সময় খরচ না করে উঠে এল। উষশী এক নজর তাকিয়ে বলল,”মিথ্যেবাদী।”
“সরি। আর কখনো মিথ্যে বলব না। তাকাও আমার দিকে।”
কথার শেষে নিজেই মেয়েটিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। ছেলেটার ফর্সা সুন্দর মুখশ্রী’র পানে নিরলস ভাবে তাকিয়ে আছে উষশী। দুজনের দৃষ্টি যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। একটা মিষ্টি সুবাস আসছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। প্রেমের বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টিতে শুরু হবে ওদের বৃষ্টিভেজা আলাপন।
অভিরাজ কফি বানাচ্ছে। আর উষশী হা হয়ে দেখছে সেটা। ছেলেটা’র শরীর ঘেমে গিয়েছে দেখে খারাপ লাগল। কিশোরী উঠে গিয়ে টিসু আনল। তারপর নিজ হাতে মুছিয়ে দিল। ওর আচরণে কেমন সুখ অনুভব হচ্ছে। কতটা যত্ন,মায়া,ভালোবাসা নিয়ে তাকাল অভিরাজ সেটা ভাষায় ব্যক্ত সম্ভব না। ওর পলকহীন দৃষ্টি দেখে উষশী বলল, “দুষ্টুলোক নজর সরান।”
“চেষ্টা তো করছি। তবে সরাতে পারছি না। এত ভয়ংকর কেন তুমি?”
“বিদ্রুপ করলেন নাকি ভালোবেসে বললেন?”
“দুটোই।”
“কেমন করে?”
“দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”
অভি এগিয়ে আসতে চাইলে বাঁধা দিল উষশী। একটু আগে লাবণ্যকে ড্রয়িং রুমে দেখে এসেছে। বাড়ির সহযোগী ও কাছেই আছেন। ওর থমকে যাওয়া ভয়ার্ত মুখটা দেখে হেসে উঠল অভিরাজ। হাত ধুঁয়ে নিয়ে একদম নিকটে এসে দাঁড়াল।
“আজকাল খুব লজ্জা পাচ্ছ রেইন।”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
“উহু মোটেও স্বাভাবিক না। অত্যন্ত তোমার কালচারের সাথে বড়ো বেমানান।”
“ঠিক। আমার কালচারে এই আচরণ একদম স্বাভাবিক নয়। তবে আপনার কালচারে খুবই স্বাভাবিক অভিরাজ।”
উষশী’র মুখে নিজের নাম শুনে ভালো লাগল ওর। তাই আরেকটু দূরত্ব কমিয়ে নিল। বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালে ও কিশোরী অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেতরটা উত্তপ্ত। অথচ সামনের জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। সেই সাথে আসছে বেলা ফুলের মিষ্টি সুবাস।
“এই কালচারের সাথে মানিয়ে নিচ্ছি। জানেন আমি খুব করে চাই আপনার সাথে জীবনের শেষ প্রহর অবধি কাটাতে। আর সেই জন্যেই বড়ো ভয় হয়। হারিয়ে না ফেলি।”
বর্তমান
চোখ খুলল অভিরাজ। সামনেই বিশাল একটা নদী। এখানে মানুষ জন নেই। শুনশান সুন্দর একটা পরিবেশ। নদীর সুন্দর জলের দিকে তাকিয়ে নিজের অতীত ঘুরে এল সে। শেষ দিন গুলোতে নিজেকে খুব করে মানিয়ে নিয়েছিল উষশী। পরিবেশের সাথে বেশ মিশে গিয়েছিল। হারিয়ে ফেলার ভয় পেত। অথচ এসব নাকি অভিনয় ছিল। ব্যপারটা কল্পণা করতেও কষ্ট হয়। মেয়েটা ওকে ছেড়ে গেল। সেই সাথে দিয়ে গেল এক বুক যন্ত্রণা! নিজের কষ্টের স্মৃতি পেরিয়ে জায়গাটা থেকে উঠে এল। শীতল হাওয়ায় কেমন ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। এদিকে তখন থেকে ফোন বেজে চলেছে। ধ্যান হতেই তুলল সেটা। লাবণ্য’র বিচলিত কণ্ঠ।
“অভি! এটা কি করলি তুই? কত সময় ধরে অপেক্ষা করছি আমরা। ওনারা বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন।”
অভিরাজ নিশ্চুপ। সে কিছু ভাবছে। অপর পাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করছে লাবণ্য।
“সন্ধ্যার পর ওনাদের জন্য পার্টির আয়োজন কর। আমি আসছি।”
“ঠিক আছে। সাবধানে আয়।”
হোটেলে ফিরে ঈশানের দেখা মিলল না। অভি বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল। ঘরের চারপাশ খুঁজে নিয়ে কল করল। ফোন সুইচ অফ বলছে। এবার বেশ চিন্তা হচ্ছে। লাবণ্যকে কল করে জানাতেই লাবণ্য বলল সে আসছে। চারপাশে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যার ঠিক পূর্বে ছেলেটার দেখা মিলল। পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। দৃষ্টি যেন প্রাণহীন। ধীর স্থিরভাবে পাশে বসল অভিরাজ। তার বুকের ভেতরটা এখনো ধীম ধীম করছে।
“সন্ধ্যায় পার্টি রেখেছি। সেই সাথে মিটিং ও চলবে। যেহেতু বিজনেসে এসেছিস। তাই দায়িত্ব নিতে হবে।”
হু,না কিছুই বলছে না ঈশান। অভি ভরসা দিতে কাঁধে হাত রাখল। এতেও নড়ল না ছেলেটা। খানিক বাদে বলল,”ভাই আমি আর নিতে পারছি না। যন্ত্রণায় পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছি। ছোঁয়া’র কান্না গুলো সহ্য হচ্ছে না। কেন এমন হতে হলো?”
অভি’র হৃদয়টা ভে ঙে যাচ্ছে। ভবঘুরে,চটপটে ঈশানের সাথে এই ঈশানের একদমই মিল নেই। দুজন যেন দুই পৃথিবী’র মানুষ। সময় মানুষকে কতটা পাল্টে দেয়।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি