#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৩)
“এই শুনছেন?”
“হু শুনছি।”
“চলেন না।”
“কোথায়?”
“আমার শহরে।”
“কেন?”
“বৃষ্টিতে ভিজতে।”
“এখনি?”
“হু এখনি।”
“যদি বৃষ্টি থেমে যায়।”
“আমি বৃষ্টি হব তখন।”
“কেমন করে?”
“এমন করে।”
“ইসস..”
“কি হলো?”
“কিছু না।”
“আসেন না।”
“আসছি তো।”
“কোথায়?”
“এই তো।”
“দেখছি না তো!”
“হাত বাড়াও।”
“বাড়িয়েছি।”
“চোখ বন্ধ কর।”
“করেছি।”
“অনুভব করছ?”
“হুম।”
“কী?”
“আপনাকে।”
ঘুম ভেঙে গেল অভিরাজের। ছেলেটার পুরো শরীর হাল্কা সমীরণে কেমন আন্দোলিত হয়ে উঠল। সে কিছুটা ঘেমেছেও বটে। জানালা গুলো পুরোপুরি খুলে ফেলল। এখান থেকে বাগানটা খুব সুন্দর দেখা যায়। নানান রঙের ফুল বাহারি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। বারান্দায় কিছু পাখি এসে বসেছে। অভিরাজ যেতেই উড়ে গেল। আকাশের চাঁদ যেন নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। মেঘে ঢাকা আকাশ বলছে খানিক বাদেই বৃষ্টি হবে। এই বৃষ্টিতে কত মানুষের আলাপন তৈরি হবে। ভালোবাসায় সিক্ত হবে কত প্রহর। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। অভি’র দু চোখ কেমন জ্বলছে। খানিক আগে দেখা স্বপ্নটা যেন একদমই সত্য। উষশী তাকে নিজের কাছে ডাকছে। অভিও তাতে সাড়া দিয়েছে। শুরু হয়েছে তাদের বৃষ্টিভেজা আলাপন। মধুময় সুন্দর মুহূর্ত গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। পাঁচ বছর হয়ে গেছে। উষশী এখন নিশ্চয়ই সেই কিশোরীটি নেই। মেয়েটি তো এখন অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে। তার এখন পুরো পৃথিবীতে ডানা মেলার কথা। সে আর ভাবতে পারছে না। কিশোরী মেয়েটির যুবতী রূপ কল্পনাও করতে চাচ্ছে না। কিন্তু একটা অদৃশ্য শক্তি বার বার ভাসিয়ে নিচ্ছে।
ভোরের আলো তখনো পৃথিবীতে পৌছায় নি। অভিরাজের চোখে ঘুম নেই। সে বেরিয়ে এসে চারপাশ একবার দেখতে লাগল। গতদিন এ বাড়িতেই থেকেছে সে। ঝকঝকে তকতকে করা হয়েছে পুরো বাড়িটা। সেই প্রথম দিনের মতো লাগছে। তবে উষশী নেই এখানে। মেয়েটির অভাব বেশ ভালোই মলিন করেছে বাতাবরণ। মনে হচ্ছে আলোটাই হারিয়ে গেছে। ভোর হতেই বাড়ির কেয়ারটেকার আব্দুল্লাহ বেরিয়ে এলেন। ফুল গাছ গুলোতে আগে থেকেই পানি দেওয়া ছিল। অভি দাঁড়িয়ে পূর্ব আকাশে চোখ মেলে দিয়েছে। ভোরের সূর্য বিলাশ করছে সম্ভবত।
“বাবা,কাইল রাতে এখানেই আছিলেন?”
“জী আঙ্কেল।”
“বড়ো ভালো করছেন। কি খাইবেন কন।”
“কিছু খাব না আঙ্কেল। আজই ফিরে যাব।”
“এটা কোনো কথা। আইজ থাইকা যান।”
“দেখি।”
উষ্ণ শ্বাস ফেলল অভিরাজ। সে এখনো পূর্ব দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্য পুরোপুরি না উঠা অবধি একই ভাবে তাকিয়ে রইল সে।
পুরনো ফটো এলবাম দেখার সময় উষশী’র বেশ কিছু ছবি পেল লাবণ্য। মেয়েটা একটু বেশিই সুন্দরী। তাকে দেখলে একদমই বিদেশীর মতো লাগে না। মনে হয় বাঙালির অন্যরূপ। সব গুলো ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবি পেল যেখানে অভিরাজ উষশী’র কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। উষশী’র অধর জুড়ে লাজুক হাসি। অভি’র চোখে মুখে অন্য রকম সুখ। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল লাবণ্য’র বুক চিরে। একটা সময়ে মস্তিষ্কের বিরোধীতা করে উষশী’র সাথে ভয়ংকর অন্যায় করেছিল সে।
অতীত
গ্রামের বাড়িতে আসতেই একটা হৈ হুল্লোড় পড়ে গেল। এখানে অভিরাজের আরো কাজিন রয়েছে। তাদের সাথে সম্পর্ক নেহাত মন্দ হয়। রিয়াজুল সিনহার পাঁচ সন্তান। তিন মেয়ে আর দুই ছেলে। এখনো তারা যৌথ পরিবার। দুই সন্তানের মধ্যে বড়ো আবু সিনহা আর ছোট জাবেদ সিনহা। আবু সিনহার দুই সন্তানের মধ্যে জুনায়েদ বড়ো। সে এখন চাকরি সূত্রে বিদেশ রয়েছে। আর মেয়ে ইরার বয়সী। জাবেদ সিনহা’র তিন সন্তান। বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর দুই ছেলে স্কুলে পড়ছে। বয়সের ফারাক থাকলেও দুজনে একই ক্লাসে পড়ছে। জাবেদের ছোট দুই ছেলেই বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। অভিকে পেয়েই এটা সেটা বায়না শুরু করে দিয়েছে। তাদের বায়নার শুরুতেই রয়েছে নদীর শীতল জলে সাঁতার প্রতিযোগিতা। গল্পের মাঝেই ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত দেওয়া হলো। এটা মূলত ঘোল। উষশী আগে কখনো খায় নি। তার বিশেষ পছন্দ হলো না এটা। সে একটু খেয়েই রেখে দিল। চারপাশের হৈ হুল্লোড়ে অভি আসতেই পারছে না। এদিকে সবাই গল্পে মেতে গেছে। উষশী হয়ে গেছে ভীষণ একা। তার বয়সী কেউ নেই। অনেক সময় পর উষশী’র কাছে আসতে পারল অভিরাজ। উঠানের এক কোণে বসে ছিল সে। মাথার উপর শিউলি গাছ। সেখান থেকে ফুল কুড়িয়ে কিশোরীর মুঠো ভরে দিল।
“বিরক্ত লাগছে?”
“কিছুটা।”
“ওরা সবাই মিশুক। ইরার সাথে যে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছ ওর নাম রত্না। পরিচয় হওয়ার পর দেখবে একদমই একা লাগে না।”
“হুম।”
মেয়েটির পাশে বসে রইল অভিরাজ। কিছু সময় পর লাবণ্য এল। উষশীকে সাথে নিয়ে গেল সে। অভিদের এই বাড়িটা বেশ পুরনো আমলের হলেও ভেতরে সব রকমের সুবিধাই রয়েছে। অন্দরে বাড়ির সব বউদের আড্ডা চলছে। পুরুষ মানুষ গুলো গ্রাম দর্শনে বের হয়েছে। সকলেই ব্যস্ত হয়ে আছে। লাবণ্য উষশী’র জামা কাপড় গুছিয়ে রাখল। তারপর গোসল করতে বলল। সাদা রঙের জামা পরল উষশী। সব রঙেই তাকে সুন্দর লাগে। ভেজা চুল গুলো মেলে দিয়ে বের হতেই অভিরাজের সাথে দেখা। মেয়েটির এই সৌন্দর্য অভিকে পাগল করে দিচ্ছে। সে চোখের ইশারায় কিছু বোঝাল। উষশী লজ্জায় চোখ তুলতে পারল না। তার ফর্সা ফুলকো গাল কমলা বর্ণ ধারণ করেছে। মেয়েটির সাথে ঘনিষ্ঠ হবে ওমন সময় আমিনা এলেন।
“খাবার খেতে আয় তোরা। লাবণ্য কোথায়?”
“গোসল করছে।”
উষশী অন্যদের সাথে খুব কম কথা বলে। এতদিনে আমিনার সাথে এই তার প্রথম বাক্য বিনিময়। তিনি মেয়েটিকে পূর্ণ নজরে দেখে বললেন,”এই জামাটায় তো ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়। অভি ভালো করেছিস বাবা। এই বয়সী মেয়ে হাঁটু অবধি জামা পরে ঘুরে বেড়ালে দৃষ্টিতে লাগে।”
কথা শেষে লাবণ্য’র রুমে গেলেন আমিনা। উষশী’র একটু খারাপ লেগেছে। জামার জন্য ফের কথা শুনতে হলো তাকে। অভি তার কষ্টটা বুঝতে পারল। নরম হাতে গালে স্পর্শ করে বলল,”পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হয় উষশী। প্রথমদিকে তুমি বলেছিলে কেন নিজেকে পরিবর্তন করবে। সেই তুমিই কিন্তু পরিবর্তন হয়েছ। তোমার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না। অথচ আমরা সম্পর্কে আছি। বুঝতে পারছ আমার কথা?”
কিশোরী মেয়েটি যেন সবটাই বুঝতে পারল। অভি তাকে অন্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছে। মেয়েটির শুভ্র রঙা মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”চলো খাবার খেতে হবে। বিকেলে ঘুরিয়ে আনব। দেখবে ভালো লাগবে।”
এ বাড়িতে সবাই মেঝেতে বসে খাবার খায়। বাচ্চারা আলাদা বসেছে। তাদের আড্ডা চলছে। কথা বলতে বলতে সকলের সাথে উষশীর পরিচয় হলো। রত্না নামের মেয়েটি উষশী’র বিষয়ে বেশ আগ্রহ বোধ করছে।
“একজন বিদেশী এত সুন্দর বাংলায় কথা বলছে!”
“আমার মম বাংলাদেশী। পাপা ও দীর্ঘদিন এ দেশে ছিল বিধায় বাংলায় কথা বলতে পারতেন।”
“নাইস। আমার তো ভীষণ আনন্দ লাগছে।”
“ও কিন্তু খুব জেদি আর একরোখা।”
কথাটা বলেই হাসল অভিরাজ। উষশী একটু মন খারাপ করে বলল,”সবার সাথে জেদ করি না। প্রথম দিন আমার সাথে খুব বাজে আচরণ করেছিলেন বিধায় ওমন করেছি।”
দুজনেই এই বিষয়ে ছোট একটা তর্ক জুড়ে দিল। ওদের থামাতে লাবণ্য বলল,”এভাবে তর্ক না করে খাবার শেষ কর।”
অভিরাজ উষশীকে চোখের ইশারা করল। উষশী একটুও পাত্তা দিল না। ইরা বিষয়টা লক্ষ্য করে বলল,”তোমরা চোখে চোখে কি বললে?”
চমকে তাকাল লাবণ্য। উষশী আর অভিরাজ দুজনেই মৃদু হাসছে। তাদের এই হাসির অর্থ কি হতে পারে বেশ ভালোই জানে লাবণ্য।
“ভাইয়া কি বললে উষশীকে?”
“বললাম এমন দুষ্টু মেয়ে এ জীবনে দেখি নি।”
“উষশী তুমি কি বলেছ?”
“মিস্টার রাগির রাগ ছাড়া আর কি আছে!”
ইরা একটু আহাম্মক বনে গেল। উষশী পুনরায় খেতে লাগল। তাকে মাছ বেছে দিচ্ছে অভিরাজ। লাবণ্য নিজের প্লেটের দিকে তাকাল। সময়ের স্রোতে কত কিছু বদলে যায়।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৪)
মেঘলা বিকেলেই উষশীকে নিয়ে বের হলো অভিরাজ। মেয়েটি এখন ওর প্রেমিকা। এই পরিচয়টা অদ্ভুত রকমের আনন্দ দেয় তাকে। তাকিয়ে থাকার ইচ্ছেটা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে দিনকে দিন আরো বেশি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে চলছে ওরা। সামনেই বকুল তলা। মাটিতে বকুল ফুলে ছেঁয়ে আছে। ফুল গুলো তুলতে তুলতে একটা গানের লাইন শুনতে পেল।
“বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কেনও বান্ধাইলি।”
ছোট ছোট কিছু বাচ্চা গানটি গাইছে। তারা একটু দূরের মাচায় বসে আছে। ময়লা ঢিলেঢালা গায়ের পোশাক।
“ওরা ওখানে শুয়ে কি করছে?”
“আড্ডা দিচ্ছে।”
“চলেন না আমরা ও যাই।”
“না,না যাওয়া যাবে না।”
“আসেন না প্লিজ। এমন করেন কেন।”
“ওরা তো শুয়ে আছে।”
“একটু যাই চলেন।”
উষশী’র বায়নার কারণে যেতে হলো। বাচ্চা গুলো এখনো গান গাইছে। তাদের গানের তাল শুনছে দুটো কুকুর।
“তোরা এখানে কি করিস?”
“আড্ডা মা রি।”
“এখন আড্ডা মা রা র সময়? যা,যা বাড়ি যা।”
“এহনি তো আড্ডার সময়।”
বাচ্চা গুলো উঠতে নারাজ। কিছুতেই কিছু বোঝাতে সক্ষম হলো না অভি। উষশীর মুখে মেঘ জমেছে। সে এখানে শুয়ে আকাশ দেখতে চায়। অভি পকেট থেকে পাঁচশত টাকার নোট বের করে বলল,”শোন সবাই।”
বাচ্চা গুলো একটু মাথা তুলল। অভি টাকাটা এগিয়ে বলল,”যা, আইসক্রিম কিনে নিস।”
টাকাটা পেয়ে বাচ্চা গুলোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারা হৈ হৈ করে চলে যাচ্ছে। হাফ ছেড়ে বাঁচে অভিরাজ। উষশী ভীষণ আগ্রহে তাকিয়ে আছে। মেয়েটিকে উঁচু করে ধরে মাচায় বসিয়ে নিজেও উঠে বসেছে। এখান থেকে চারপাশের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। চারপাশে সোনালী ধান মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই ঘরে ধান তোলা হবে। ধানের একটা সুন্দর গন্ধ আছে। সেই গন্ধটাই এখন উষশী’র নাকে ধরা দিল। সে মুগ্ধতা নিয়ে অনুভব করছে সব। আর অভিরাজ দেখে চলেছে তাকে। মেয়েটির সরু নাকের ডগাটা কিছুটা লাল। ঠোঁট রাঙা থাকে সর্বদা। মনে হয় পদ্ম ফুল। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে উষশী বলল,”কি দেখেন?”
“তোমায়।”
“রোজ ই তো দেখেন।”
“হুম। তবে প্রতিবারই ভিন্ন রকম মনে হয়।”
মিটিমিটি হাসছে উষশী। অভিরাজের কথার জাদুতেই ম রে যাবে সে। উষশী হুট করেই মাচায় গা এলিয়ে দিল। একই ভাবে অভিরাজ ও শুয়ে পড়ল। কিশোরীর দৃষ্টি আকাশে থাকলেও অভি’র দৃষ্টি রইল মেয়েটির উপর। সে যত দেখছে তার তৃষ্ণা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বাড়ি ফিরল ওরা। চুলোয় গরম গরম ছিটা রুটি তৈরি হচ্ছে। তার সাথে রয়েছে দেশি মুরগির রসালো ঝোল। লোভনীয় খাবারের গন্ধে ‘ম’ ‘ম’ করছে চারপাশ। জাবেদ বাজার থেকে রসগোল্লা এনেছেন। এখানকার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান থেকে। সেই রসগোল্লার হাড়ি থেকে ইতোমধ্যেই চার খানা রসগোল্লা পেটে চালান হয়ে গেছে ইফতি আর মুস্তফার। তাদেল ঠোঁটের কোণ বেয়ে রস গড়িয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় হাতে নাতে ধরেছে রত্না। দুটির কান ধরে বাইরে আনল সে। তারপর হুংকার তুলে সকলকে ডেকে নিল। দুই চোর ছটফট করছে। কিন্তু রত্নার শক্তির সাথে পারছে না ঠিক।
“চাচ্চু রসগোল্লা আনতে না আনতে চারটে শেষ করে দিয়েছে ওরা। এত কষ্ট করে ছোট চাচি লুকিয়ে রাখল তারপরও খুঁজে নিয়েছে!”
জাবেদের স্ত্রী মিফতি দুই ছেলের কান টেনে ধরলেন। বরাবরই এমন করে ওরা। মিষ্টা দেখলে হুস থাকে না। ওদের কান্ডে বেশ আমোদ হলো। মাগরিবের আজান পড়ে যাওয়ায় মুক্ত করে দেওয়া হলো দুজনকে। সন্ধ্যার ঠিক পরেই বাড়ির সব মানুষ এক সাথে হলো। ছিটা রুটি খেতে দেওয়া হলো সবাইকে। তার সাথে দেওয়া হলো মুরগির ঝোল আর আম দুধ। উষশী তাকিয়ে দেখছে কেমন করে খায় এটা। সে ঠিক বুঝতে পারছিল না। অভিরাজ নিজের প্লেট থেকেই ছিটা রুটির সাথে আম দুধ মাখিয়ে উষশী’র মুখে তুলে দিল। সবাই ব্যস্ত থাকায় বিষয়টা কারো নজরে এল না।
মশার কয়েলে উষশী’র অসুবিধা হয়। ধানের সময় হওয়াতে মশা মাছি বেড়ে গেছে। কয়েল এর ধোঁয়ায় ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মেয়েটির। খবরটা ইরা দিতেই রাতের আধাঁরে বেরিয়ে পড়েছে অভিরাজ। প্রায় তিন ঘন্টার পথ পেরিয়ে ওডোমস নিয়ে এসেছে। উষশী এতে একটু রাগ করল। ছেলেটির বুকের কাছটা খামচে ধরে বলল,”এখানকার রাস্তাঘাট কতটা ভয়ঙ্কর দেখেছেন? এই রাতে কেউ এমন পাগলামি করে?”
এমন কথায় অভিরাজ গা দুলিয়ে হাসল। মেয়েটির চুল গুলো মুঠোয় নিয়ে ঘ্রাণ নিল বুক ভরে।
“এত অদ্ভুত কেন আপনি?”
“তোমার এই ব্রাউন চুলে নিশ্চয়ই মাদক রয়েছে উষশী। যখনি দেখি তখনি আমায় ঘোরে ফেলে দেয়।”
“আপনি পাগল অভিরাজ।”
এই তো প্রথমবারের মতো অভি’র নাম উচ্চারণ করেছে উষশী। কিশোরীর এমন বাক্যে অবাক হয়ে রইল সে। উষশীও যেন একটু অন্যমনস্ক ছিল। তখন খেয়াল হয়েছে তখন ভীষণ অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। একটু পরই অনুভব হলো ছেলেটার শক্ত শীতল হাত ওর কোমর ছুয়েছে। হাল্কা চাপে কাছে টানছে সে।
“এভাবেই পাগল করে দিবে রেইন?”
“পাগল তো আপনি করে দিচ্ছেন আমায়।”
“দুজনেই পাগল হলে সংসার হবে কেমন করে?”
“পাগলরা বুঝি সংসার করতে পারে না?”
“কে জানে।”
ছেলেটির খোঁচা দাড়ির আন্দোলন অনুভব হচ্ছে ঘাড়ে। ক্রমশ তা নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। একটা শির শির অনুভূতি বয়ে চলেছে সর্বাঙ্গে।
“শুরুর দিকে তোমার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না। তোমাকে আনতেই চাচ্ছিলাম না। অথচ সেই ঝড়ের রাতেই তোমার জন্য ঔষধ আনতে বের হয়েছিলাম। তখন কি পরিমাণে ঝড় ছিল তবু পিছিয়ে যাই নি। আর এখন তো তুমি আমার ভালোবাসা উষশী। তোমায় এক বিন্দু কষ্ট পেতে দিব না।”
এত সুখে উষশী ভেসে যাচ্ছে। তার জীবনের সব না পাওয়ার মাঝে অভি যেন অনন্য। সে কিছুতেই মানুষটাকে ছাড়তে চায় না। একটা লম্বা জীবনের স্বপ্নে তার ভেতরটা ক্রমশই আন্দোলিত হয়ে উঠছে।
চা দিতে এসে রত্না দেখল ফোনে কিছু দেখছে ঈশান। সে খুব লুকিয়ে দেখতে গিয়েও পারল না। চট জলদি উঠে পড়ল ছেলেটা। শরীরে তার শার্ট নেই। গরমের কারণে খুলে ঘুমিয়েছিল। সেটা পরতে পরতে শুধাল,”চা দিতে এসেছ?”
“হু। আম্মু পাঠাল। গত রাতে আপনার নাকি কাশি হচ্ছিল।”
“অল্প।”
“আদা চা এনেছি। খেলে ভালো লাগবে।”
চা নেওয়ার পর ও কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল রত্না। তারপর প্রশ্ন করল,”ফোনে কার ছবি দেখছিলেন? গার্লফ্রেন্ড বুঝি?”
“উহু। একটা চাঁদ দেখছিলাম।”
“চাঁদ!”
“হুম। চাঁদ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আমি গরীব বামন বিধায় চাঁদটা আমার নয়।”
শক্ত কথা গুলো একটুও বুঝল না রত্না। সে বারান্দার দরজা খুলে দিয়ে গাছ গুলোকে পানি দিল। ভেজা তোয়ালেটা সরিয়ে বলল,
“বিকেলে মেলা আছে। বছরের সব থেকে বড়ো মেলা। মিস করিয়েন না।”
একটা প্ল্যান করেছে অভিরাজ। সবাই মেলা দেখতে গেলে সে উষশীকে নিয়ে অন্য কোথাও ঘুরতে যাবে। এখানে এত বেশি সীমাবদ্ধতা যে মেয়েটির সাথে কথা বলার ও তেমন সুযোগ নেই। গ্রামের পথে তো হাত ধরলেও ঝামেলা। দুপুরে খাবার সবাই একসাথে খেল না। মেলার জন্য সকলেই বেশ তাড়ায় আছে। উষশী’র কাছে মেলা মানে অনেক গুলো ছোট ছোট স্টল। গ্রাম্য মেলা তার নিকট একটা কৌতূহলের বিষয়। রত্নার থেকে মেলা সম্পর্কেই শুনছিল সে।
“জানো তো উষশী। আমাদের গ্রামে এই মেলাটার জন্য খুব অপেক্ষা করে সবাই। পুরো মাঠ জুড়ে ছোট ছোট দোকান বসে। নাগরদোলা,গরু দৌড়,নৌকা বাইচ আরও কত কি হয়। রাতের বেলা আবার যাত্রাপালা। কি যে মজা।”
আগ্রহ নিয়ে শুনছে উষশী। রত্না আসলেই মিশুক প্রকৃতির মেয়ে।
“তুমি গ্রামের মেলা দেখেছ?”
“না। কখনোই দেখি নি।”
“যাত্রাপালা?”
“সেটাও না।”
“আহারে। তুমি তো তাহলে এসব খুব মিস করে গেছ। এবার দেখে নিবে। খুব মজা হয়।”
“লাবণ্য আপু বলছিল তোমরা সবাই নাকি শাড়ি পরবে।”
“হ্যাঁ। প্রায় সব মেয়েরাই শাড়ি পরে যায়। এই দিনটা অনেক স্পেশাল বুঝলে।”
রত্নার কথা গুলো বেশ ভালো লাগছে উষশী’র। সব কেমন কল্পনা মনে হচ্ছে। আসলেই সব সত্যি তো?
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি