#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১৪)
উষশী’র ভেজা চুল গুলো থেকে টপ টপ করে পানি ঝড়ছে। মেয়েটি এই রাতের বেলা গোসল করেছে। লাবণ্য বেডের উপর বসে কাজ করছিল। অভি তাকে এক বস্তা কাজ দিয়েছে। ছেলেটার নাকি খুব মাথায় যন্ত্রণা। অভি’র যন্ত্রণায় ছোট থেকেই বুক পু ড়ে লাবণ্য’র। ছেলেটার প্রতি ভীষণ মায়া ওর। উষশী’র সিক্ত চুল গুলো হুট করেই নজরে এল। বাদামী রঙা সুন্দর চুল গুলো পিঠময় ছড়িয়ে। গায়ে টি শার্ট। অতিরিক্ত ফর্সা পিঠটা নজর কাড়তে বাধ্য করে। মাখনের মতো লাগছে মেয়েটিকে। লাবণ্য কাজ থামিয়ে পুরোপুরি একবার দেখে নিল। এত সুন্দর মানুষ সত্যিই এর আগে দেখে নি সে।
“আপু,আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি?”
“এখন তো অনেক রাত উষশী। বাড়ির সহযোগিরা এ সময়ে ঘুমিয়ে থাকে।”
“কিচেন থেকে বানাতে পারি আমি?”
“তুমি পারবে? আমার হাতে অনেক কাজ না হলে আমিই বানাতাম।”
“হ্যাঁ পারব।”
উষশী আলগোছে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। রাত প্রায়ে দেড়টা। পুরো বাড়ি নির্জন। উষশী পা টিপে চলছে। কিচেনে এসেই বিশাল অবয়ব চোখে পড়ল। পেছন থেকেও বুঝতে পারল মানুষটা অভিরাজ।
“মিস্টার রাগী?”
“এই বিদঘুটে নামে কেন ডাকো উষশী?”
“বিদঘুটে নয়। এটা সুন্দর।”
“হায়রে মেয়ে। বলো এত রাতে এখানে কেন?”
“কি করছেন? আমি আসলে চা বানানোর জন্য এসেছি।”
“আমি অলরেডি চা বানিয়ে নিয়েছি। তুমি খাবে?”
“আপনার কম পড়বে তো।”
“পড়বে না। তুমি জানো না শেয়ারে কেয়ার বাড়ে।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
মিষ্টি হেসে এক কাপ চা নিল উষশী। অভি নিজের কাপটা হাতে তুলতেই মেয়েটির সিক্ত চুল দেখতে পেল।
“অসময়ে গোসল করেছ কেন?”
“ভালো লাগে।”
“তিন বার গোসল করলে। এভাবে তো ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“লাগবে না তো।”
“কেন লাগবে না। বৃষ্টি তোমার ভীষণ আপন বুঝি?”
“হুম। খুব আপন।”
“চলো তাহলে।”
“কোথায়?”
“বৃষ্টির কাছে।”
“কেন?”
“বৃষ্টিভেজা আলাপন জুড়তে।”
দু কাপ চা ই রয়ে গেল। অভিরাজ উষশীকে নিয়ে বাইরে এল। টিপ টিপ করে বর্ষণ নেমেছে। উষশী’র অধর জুড়ে হাসি এল। মেয়েটি বৃষ্টি যেন একটু বেশিই ভালোবাসে। অভিরাজ আর উষশী দুজনেই যেন বাচ্চা বনে গেল। কাদা দিয়ে খেলছে তারা। বৃষ্টির জল ছিটিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে। দুজনের বয়সই যেন হাঁটুতে নেমে গেছে। সমবয়সী বন্ধুর ন্যায় খেলছে তারা। ওদের এই বৃষ্টিভেজা আলাপন স্পষ্ট দেখতে পেল লাবণ্য। জানালার কাছ থেকে সরে এল সে। হুট করেই তার খারাপ লাগছে। অথচ এমনটা হওয়া একদমই উচিত না।
জামা বদলে ঘুমাতে এল উষশী। চার বার গোসল করল আজ। মেয়েটি পুরো পাগল। বৃষ্টি ছাড়া কিছুই যেন বুঝে না। লাবণ্য’র কাজ শেষ হলো শেষ রাতে। এসে দেখল উষশী ভীষণ শীতে জুবুথুবু হয়ে আছে। তার গায়ের উপরে থাকা চাদর সরে গিয়েছে অনেকটা। সেটা ঠিক করে বাইরে এল লাবণ্য। অভিরাজের ঘরের দরজা খোলা ছিল। সে স্বভাবতই সরাসরি প্রবেশ করল।
“ঘুমাস নি?”
“না। অনেক গুলো কাজ বাকি।”
“এত কাজ জমলো কি করে?”
“কয়েকদিন ধরেই কাজে মন বসছে না।”
“মন কোথায় থাকে? কাউকে পছন্দ করিস?”
“কাউকে বলতে?”
“উষশী।”
“তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?”
“তা কেন হতে যাবে? শুধু মনে হলো। বাদ দে,কাজ গুলো রেখে ঘুমা।”
“একটু পরই ঘুমাব। তোর কাজ শেষ?”
“হ্যাঁ।”
“ঘুমাতে যা তাহলে।”
“হুম।”
“উষশী কি ঘুমিয়ে গেছে?”
“অনেকক্ষণ।”
“গুড নাইট। কাল সকাল করে উঠিস না।”
লাবণ্য নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। তার ভালো লাগছে না কিছুই। উষশী গভীর ঘুমে তলিয়ে। মেয়েটিকে দেখলে এক টুকরো ভেজা বরফ কিংবা পেঁজা তুলোর মতো মনে হয়। সৃষ্টিকর্তা সমস্ত রূপ বুঝি একজনের মাঝেই উজাড় করে দিয়েছেন।
সকাল সকাল ছোঁয়া বেশ সেজেছে। হলুদ কমলার মিশ্রণের একটি শাড়ি পরেছে সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভোরের সূর্য। বাইরে বল নিয়ে শরীর চর্চা করছিল ঈশান। ছোঁয়া কে বের হতে দেখে বলল,”এত সেজে কোথায় যাস?”
“অলকের সাথে বের হবো।”
“বিয়ের আগে এত কিসের ঘুরাঘুরি?”
“ঘুরলে কি সমস্যা?”
“কি সমস্যা মানে? চুপ চাপ ঘরে যাবি।”
“মানে কি! আমার সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে আর তাছাড়া এর বাইরে আমরা কাজিন তাই ঘুরতেই পারি।”
“না পারিস না। সোজা ঘরে যাবি।”
“তুমি…”
“চুপচাপ ঘরে যা।”
ধমকটা এত জোরে ছিল যে চোখে জল নেমে এল ছোঁয়া’র। ছলছল নয়নে তাকিয়ে থেকে ঘরে চলে এল মেয়েটি। ঈশানের চোখে মুখে আঁধার। দোলনায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল উষশী। পুরো ঘটনা দেখেছে সে।
“ঈশান, আই হেভ আ কনফিউশন।”
“হোয়াট এবাউট?”
“এই যে ছোঁয়াপু কে তুমি তার উড বি এর সাথে ঘুরতে যেতে দিলে না। এটি কেন করলে?”
“বিয়ের আগে এত কিসের ঘুরাঘুরি?”
“ইটস ভ্যারি নর্মাল।”
“বাট,সাম টাইমস ইটস ভ্যারি ডিফিকাল্ড।”
“আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি তাকে লাইক করো।”
“কারণ তোমার মনে সমস্যা।”
থমকে গেল উষশী। কথাটা মিলিয়ে সে পুনরায় দৌড়ে এল। ঈশান চক্কর দিতে ব্যস্ত।
“তুমি আমায় অবাক করে দিচ্ছ।”
“তাই?”
“হুম। বাট আই লাইক ইউর এটিটিউট।”
“ক্রাশ খেয়েছ?”
“উষশী পল কারো উপর ক্রাশ খায় না। তার উপর অন্যদের ক্রাশিত করে।”
হো হো শব্দে হাসল ঈশান। তোয়ালে দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে বাড়ির ভেতরে এল। ছোঁয়া কান্না করছে। আর তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বাড়ির মেঝো গিন্নি লতিফা।
“ঐ তো এসেছে তোমার গুনধর ছেলে।”
“দেখছি মা। কান্না করিস না। ঈশান এদিকে আয় তো।”
“জী আম্মু।”
“ওকে বাইরে যেতে দিলি না কেন?”
“বিয়ের আগে গবেটটার সাথে এত ঘুরাঘুরি কেন করবে? আর তো কিছুদিন বাকি। তার পর না হয় গবেটটার গলায় ঝুলে থাকবে।”
“দেখলে মেঝো মা। ও সব সময় এমন করে। ছোট থেকে আমায় দেখতে পারে না।”
ঈশান ডোন্ট কেয়ার ভাব দিয়ে দাঁড়াল। লতিফা ছেলেকে বললেন,”আর এমন করবে না ঈশান। ছোঁয়া যা ঘুরে আয় মা।”
ভেঙ্চি মে রে বেরিয়ে যায় ছোঁয়া। লতিফা শ্বাস ফেললেন।
“কি হয়েছে তোর?”
“কি হবে?”
“এমন করিস কেন? ওর সাথে অলকের বিয়ে ঠিক। আর ওরা তো কাজিন হয়।”
“যা ইচ্ছে করুক।”
গটগট শব্দে উঠে গেল ঈশান। সেদিকে তাকিয়ে বড়ো মন খারাপ হলো উষশী’র। সে পেছন পেছন উঠে এল।
“ফ্রেন্ড,তুমি আমাকে সত্যিটা বললে না।”
“সত্যি বলেছি উষশী।”
“তবে সেটা ঘুরিয়ে, রাইট?”
“হুম।”
“তুমি তাকে মনের কথা বলছো না কেন?”
“কি বলব?”
“তাকে পছন্দ করো।”
“পছন্দ করিনা।”
ঈশানের ঘরের কাছে এসে থেমে গেল উষশী। অভি ছাড়া অন্য কোনো ছেলের রুমে প্রবেশ করে না সে।
উষশী আর অভিরাজের দূরত্ব কয়েক ইঞ্চি মাত্র। দুপুরের খাবার খাচ্ছে ওরা। মেয়েটিকে মাছ বেছে দিচ্ছে অভিরাজ। সেটা বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে কিশোরী। লাবণ্য আজ মাছ খেতে চাইল না। অভিও আর মাছ বাছল না। সে খেতে খেতে বলল,”ছোঁয়ার বিয়েটা এত দ্রুত না হলেই ভালো হতো না?”
অভি মূলত লাবণ্য’র বিয়ের কথাই বলতে চাইছিল। সবাই সেটা না বুঝলেও লাবণ্য বেশ ভালোই বুঝল।
“সমস্যা কি অভি? ছোঁয়া’র প্রেমের বিয়ে। আর বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া ঠিক না।”
এই কথার পর আর কোনো কথা হলো না। অভি হতাশ হয়ে শেষ বেলায় বলল,”লাবণ্য’র জন্য দ্রুত পাত্র দেখা শুরু কর তোমরা। ছোঁয়া’র বিয়ে হলে ওকেও বিয়ে দিয়ে দাও।”
“হঠাৎ ওর বিয়ে নিয়ে কেন পড়লে অভি?”
আসাদের প্রশ্নে অভি’র মুখে আঁধার নেমে এল। সে কোকোর জন্য খাবার তৈরি করতে করতে বলল,”কারণ ওর বয়স হয়েছে।”
“বয়স তো তোমার ও হয়েছে। তুমি কেন করছো না?”
“মনের মতো মেয়ে পেলে করব।”
“তোমার মন কেমন মেয়ে চায়?”
এ প্রশ্নের জবাব দিল না অভিরাজ। উষশী কোকো কে নিয়ে একটু দূরে এসে খাবার খাওয়াচ্ছে। লাবণ্য এই সময়টা চুপ ই ছিল। হঠাৎ করেই বলল,”আমার বিয়ে নিয়ে এত ভাবতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই জানাব।”
লাবণ্য চলে যেতেই অভিরাজ বলল,”দেখলে তোমরা। লাবণ্য’র মনের খবর কেউ জানতে চাও না। আমি ড্যাম সিউর ওর পছন্দের কেউ আছে। আর তোমরা কি না শুধু শুধু আমার সাথে ওকে জুড়তে চাও।”
অভিরাজের বলা বাক্য গুলো স্পষ্ট কানে এল লাবণ্য’র। মেয়েটির পা থমকে গিয়েছে। বুকের ভেতরটা করছে ভীষণ ধুকপুক।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি