#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৭)
হে আল্লাহ! বৃষ্টি এত সুন্দর হতে পারে। এই বৃষ্টি নিয়ে হাজার লাইন লিখে ফেলল মন। মুহূর্তেই অধর জোড়া হাসি উঠল। উষশী’র হাল্কা শীত অনুভব হচ্ছে। তবু সে জানালার গ্লাস সরিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করল। ঠোঁট দুটো ইষৎ নড়ছে। বুকের ভেতরের অনুভূতিরা দোল খাচ্ছে। অভিরাজ কেমন একটা ঘোরে চলে গিয়েছিল। মেয়েটার এমন কান্ডে ধ্যানে ফিরল। বিরোধ করে বলল,”জ্বরের কথা ভুলে গেলে? জানালা বন্ধ করতে দাও। আবার অসুখ না করে।”
“কিছু হবে না।”
“হবে। পরে আমায় ভুগতে হবে। ঝড়ের রাতে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পেরিয়ে ঔষধ আনতে হবে।”
“কথা শুনালেন?”
মন খারাপের সুর নেমে এল। কি যে অভিমান করল মেয়েটি। অভিরাজ অবশ্য এতে নড়ল না এক চুলও। সে বৃষ্টি দেখতে লাগল।
“উষশী’র কি হলো?”
“কি হবে। কিছুই না। মেয়েটা খুব জেদি।”
“উপরে উঠে গেল। কথাও বলল না। আমি ভাবলাম আবার বকা দিয়েছিস কি না।”
“আমি শুধু শুধু বকা দেই না।”
“জানি তো। তবে এই বাচ্চাকে বোঝাবে কে?”
“লাবণ্য, একটা কথা বল তো উষশী কি অতোটাও বাচ্চা?”
“উহু। পরিপূর্ণ কিশোরী সে। কিন্তু ওর মুখটায় একটা কিছু আছে। দেখলেই মায়া হয়। মনে হয় সদ্য জাগা ফুল।”
জবাবে কিছু বলল না অভিরাজ। সে দীর্ঘশ্বাস নামিয়ে বলল,”খাবারের আয়োজন কর।”
“বড়ো আম্মু আজ কল করেছিল।”
“কি বলল?”
“কবে ফিরবি সেটা জানতে চেয়েছে।”
“বলিস সময় লাগবে।”
“খুব প্রেসার দিচ্ছিল।”
“উষশী’র কথা কিছু বলেছিস?”
“না। চিন্তা করবে তাই আর বলি নি।”
“ঠিক আছে।”
“অভি শোন।”
“হুম।”
“এখনো রেগে আছিস?”
“না।”
“বড়ো আম্মু খুব কান্না করছিল।”
“এত ভালোবাসা দেখানোর কি প্রয়োজন? তারাই তো চেয়েছিল দূরে সরে আসি।”
“ভুল বললি।”
লাবণ্য’র দিকে এগিয়ে এল অভিরাজ। ওর দৃষ্টিটা ভীষণ কাতর। কেমন যেন শোক নেমে এসেছে।
“সঠিক কোনটা লাবণ্য?”
“রাগ করলি?”
“চল বিয়ে করে ফেলি।”
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?”
“তাহলে আর কিছু বলিস না প্লিজ। সবাই তো এটাই চায়।”
লাবণ্য হতাশ হয়ে অভিরাজের চলে যাওয়া দেখল। ওর বুকটা হু হু করছে। অভি’র প্রতি নিজের অনুভূতি কোনো নাম খুঁজে পাচ্ছে না সে।
উষশী’র ফোলা দুটি চোখ অভিরাজের চোখ এড়াল না। লাবণ্য খাবার বেড়ে দিচ্ছে। শান্ত স্থির দৃষ্টি রেখে খাচ্ছে উষশী। তার প্লেটে মাছ তুলে দিতেই বলল,”খাব না।”
“কেন?”
“এমনি।”
“সেদিন তো খুব মজা বললে।”
“আজ মজা লাগছে না।”
“না খেয়ে কি করে বুঝলে?”
“জানি না।”
উষশী অনেকটা রাগ দেখিয়ে বলল কথাটা। অসন্তোষ হলো অভিরাজ। তার কণ্ঠটা দৃঢ় হলো।
“বেশি কথা না বলে চুপচাপ খাও।”
“বললাম তো মাছ খাব না।”
“জেদ করবে না উষশী।”
“অভি।”
“তুই চুপ কর। ওকে মাথায় উঠানো আমার উচিত হয়নি।”
আগুন চোখে তাকাল উষশী। অভিরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। কোকো খাবার খাচ্ছিল। কথা শুনে এদিকে চলে এসেছে। ফট করেই উঠে পড়ল উষশী।
“কোথায় যাচ্ছ?”
“খাওয়া হয়ে গেছে।”
“চুপচাপ বসে খাও।”
“খাব না।”
“মা র খাবে তুমি।”
“আপনি আমাকে মা র বে ন?”
“প্রয়োজন হলে তাই করব।”
কপট রাগ হলো উষশী’র। মানুষটা অপমান করছে তাকে? লাবণ্য অভিরাজের হাত চেপে ধরল।
“কি করছিসটা কি?”
“ও সব সময় এমন কেন করবে!”
“তুই রাগ করিস না। আমি বুঝাচ্ছি।”
“ওকে খাবার খেতে বল। না হলে খুব খারাপ হবে।”
“আমি দেখছি।”
উষশী অন্যদিক ফিরে রইল। লাবণ্য অনেক বুঝিয়ে বসাতে সক্ষম হলো। অভিরাজ চুপচাপ খাবার খাচ্ছে।
“আপু মিস্টার রাগীকে বলে দাও আমার ফ্যামিলিকে খোঁজার প্রয়োজন নেই। কাল সকাল হলেই আমি চলে যেতে চাই।”
অভিরাজ চোখ তুলে তাকাল। লাবণ্যের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ত্ব। মেয়েটা যেমন অবুঝ, একরোখা ঠিক তেমনি জেদি, রাগী অভিরাজ। এ যেন সমানে সমান লড়াই। কেউ কাউকে চুল পরিমানে ছাড় দিচ্ছে না। আর যে খেলায় জিত নেই সে খেলা বড়ো দুঃখের হয়। সে খুব করে বোঝাল যাতে অভি কিছু না বলে। তবে উল্টো হলো। খপ করে মেয়েটার হাত ধরে টেনে তুলে নিল অভিরাজ। ছোট্ট তোলার ন্যায় মেয়েটা নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত। পেছন থেকে সমানে চেচামেচি করে চলেছে লাবণ্য। কিন্তু কোনো জবাব এল না। উষশী’র ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল অভি।
“আমি বাইরে যাব।”
“চুপচাপ বসে থাকো।”
“না। আমি চলে যাব। পথ ছাড়েন। কোকো কোকো।”
দরজার ওপাশ থেকে মিউ মিউ করে সাড়া দিল কোকো। অভি কাছে এগিয়ে এসে বলল, “কি সমস্যা তোমার?”
“আপনি বুঝবেন না।”
“ছোট ছোট বিষয় নিয়ে এত রাগ দেখাও কেন?”
“আমি এভাবেই বড়ো হয়েছি।”
“এখন তো অন্য কারো কাছে আছে। একটু তো পরিবর্তন আনতেই পারো।”
“আমি অসহায় নই যে নিজেকে পরিবর্তন করব।”
“ঠিক। অসহায় নও তবে প্রচন্ড একরোখা আর জেদি।”
নিরুত্তর উষশী। সে এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে। অভিরাজ ব্যলকনির দরজা খুলে দিল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। একটু পর পর মেঘ ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকালেই আলো ছিটকে পড়ছে ঘরে।
“যাও। ইচ্ছে মতো ভিজে আসো।”
বিস্মিত হয়ে রইল উষশী। অভিরাজের কণ্ঠ এবার বেশ শান্ত, স্থির। কিছু সময় গেলেও বিন্দু পরিমান নড়ল না উষশী। অভি দরজা লাগাতে লাগাতে বলল,”সব সময় তোমার জেদ খাটবে না উষশী। তোমার বয়সটা আবেগের। লাইফস্টাইল অন্যরকম। তবে জীবন কিন্তু তোমার বাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয়। তোমার জেদ লজিক্যাল হলেও পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখতে হবে।”
হতাশ হয়ে তাকাল অভিরাজ। মেয়েটার বাদামি চুল গুলো মুঠো বন্দী করে বলল,
“জানো আমার বয়স কত? সাতাশ, তোমার থেকে বারো বছরের বড়ো আমি। সেই মানুষ এর সাথে জেদ দেখাচ্ছ। অথচ তুমি নিজেও জানো না তোমার থেকে বেশি জেদি আমি।”
এবারও উষশীর থেকে উত্তর এল না। সে তাকিয়ে আছে অভিরাজের দিকে। দুজনের দৃষ্টি দুজনার দিকে। মেঘ গর্জন করছে। হাল্কা হাল্কা শীত লাগছে। উষশী’র শরীর শিরশির করে উঠল। অভিরাজ দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
“খাবার খেয়ে ঘুমাবে। জেদ করো না।”
“শুনেন।”
ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় অবধি পৌছে গেল কণ্ঠটা। এই ডাকটা বড়ো এলোমেলো করে দেয় ওকে। উষশী ওর মুখোমুখি হয়ে বলল,”আপুকে পাঠিয়ে দিবেন। আমার একটু প্রয়োজন আছে।”
“ঠিক আছে।”
বর্তমান
বাড়ির সব ময়লা কাপড় লন্ড্রিতে দেওয়া হচ্ছে। অভিরাজ ভোর বেলাতে ঘুমিয়েছে। লাবণ্য’র ডাকতে ইচ্ছে হলো না। ছেলেটার দিকে তাকালেই কষ্ট হয় ওর। ক্লোজেট থেকে অভি’র ময়লা কাপড় বের করার সময় কিছু মেয়েলি কাপড় নজরে এল। সেগুলো বের করতেই মন খারাপ হয়ে গেল। কাপড় গুলো উষশী’র। মেয়েটার সবকিছু এত যত্নে গুছিয়ে রেখেছে অভিরাজ। কাপড় গুলো রাখার পূর্বেই ঘুম ছুটে গেল অভি’র।
“কি করছিস?”
“ময়লা কাপড় গুলো নিচ্ছিলাম।”
“ও।”
“এগুলো তো অনেক আগের। কেমন যেন হয়ে গেছে। ওয়াস করতে দিব?”
“না। ওগুলো রেখে দে। উষশী’র গায়ের গন্ধ আছে এতে।”
বিপরীতে কথা খুঁজে পেল না লাবণ্য। কাপড় গুলো রেখে দিয়ে বলল,”চা খাবি?”
“নিয়ে আয়।”
“ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না?”
“না।”
“তোর এই বিষণ্নতা কবে যাবে অভি?”
“যতদিন না উষশীকে পাব।”
অত্যন্ত রাগ হলো লাবণ্য’র। যেই ব্যক্তিটা নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে কি আর পাওয়া যায়?
লাবণ্য চলে যেতেই উষশী’র কাপড় গুলো বের করল অভি। প্রতিটা কাপড় শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখল। একটা শান্তি অনুভব হয় এতে। মনে হয় এই তো উষশী ওর বুকে। খুব করে বলছে,”আপনার হার্ট এত বেশি বিট করছে কেন? আপনা’র কি কোনো রোগ হয়েছে?”
সেদিন বলা হয়ে উঠে নি রোগটার কথা। বলা হয়নি এই রোগের নাম উষশী। যে রোগের কোনো ঔষধ নেই। আর না কখনো হবে।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি