বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব-২+৩

0
1135

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২)

সোডিয়ামের আলোতে ইটের রাস্তাটাকে বড়ো সুন্দর লাগছে। চারপাশ বৃষ্টির জলে পরিচ্ছন্ন হয়ে গেছে। গাছের পাতা গুলো যেন প্রাণ ফিরে পেল। হাল্কা বাতাসে দু এক বিন্দু পানি পড়ছে। তারই পাশে চুপচাপ বসে আছে উষশী। কোকো পাশেই খেলছে। ভীষণ মন খারাপের চোটে উষশীর শুভ্র মুখটা বির্বণ হতে শুরু করেছে। টানা দুটি চোখ যেন প্রাণহীন। এদিকটা পুরোপুরি নির্জন। অনেক সময় পর পর দু একটা মানুষ চলছে। বৃষ্টির চোটে কিছু গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। ভয়াবহ অবস্থা। রাতের আঁধারেও আকাশের মেঘলা অবস্থা বোঝা যাচ্ছে। খানিক বাদে বোধহয় আরো শক্তিশালী বৃষ্টি নেমে যাবে। শরীরের কাপড় শরীরেই শুকিয়ে এসেছে। এখন আর অতো শীত লাগছে না। সয়ে গেছে। মাথাটা নিচু করে পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। এ সময় একটা ডাক ভেসে এল।
“উষশী!”

নিজের নাম শুনতে পেয়ে আগন্তুকের পানে তাকাল মেয়েটি। অভি দ্রুত পায়ে ছুটে এসেছে।
“ঠিক আছ? এমন করলে কেন বলো তো। পুরো দু ঘন্টা ধরে খুঁজে যাচ্ছি।”

উষশী একটা কথাও বল‍ল না। এমনকি রাগ ও দেখাল না। কোকো মিউ মিউ করছে। অভি বিড়ালটি কে তুলে নিল।
“বৃষ্টি নেমে আসবে। আসো আমার সাথে।”

উষশী উঠল না। আগের মতোই বসে রইল। একটু এগিয়ে এসে অভিরাজ বলল,”আসো, লেট হয়ে যাচ্ছে।”

এবার ও উঠল না মেয়েটি। অভিরাজের রাগ হলো না। সে মেয়েটির হাত ধরে উঠিয়ে নিল।
“সরি।”

হুট করেই সরি বলাটা আশা করেনি উষশী। সে বিস্ফোরণ নিয়ে তাকাল। অভিরাজ হেঁটে চলেছে। আকাশ ডেকে উঠল। কোকো মিউ মিউ করছে। চলতে চলতে লাবণ্যকে কল করল। লাবণ্যর সাথে কি কথা হলো জানে না উষশী। এই মুহূর্তে তার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আসলেই কি যাওয়া ঠিক হবে?

বাচ্চাটিকে দেখতে পেয়ে লাবণ্য যেন প্রাণ ফিরে পেল। দু হাতে জড়িয়ে বলল,”এত রাগ করলে চলে বাবু? জানো কি ভয় পাচ্ছিলাম।”

“সরি।”

“ঠিক আছে। মন খারাপের কিছু নই। অভি’র কথায় কিছু মনে কোরো না।”

প্রথমবারের মতো মানুষটার নাম জানতে পারল উষশী। অভি কোকো কে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিল। তারপর লাবণ্যের সাথে কিছু বলতে লাগল। উষশী ফিরেও তাকাল না। তার পেটের ভেতরটা ভীষণভাবে লাফাচ্ছে। ক্ষুধায় ম রে যাবে যেন।
“উষশী,বাবু উঠে এসো।”

অন্যমনস্ক উষশী শুনতে পেল না। অভি নেমে এসে বলল, “গাড়িতে উঠ।”

কোকো গাড়ির ভেতর উষ্ণতা পেয়ে পরম যত্নে শুয়ে আছে। হাত বুলিয়ে দিল উষশী। হঠাৎ উষ্ণতা পেয়ে তার ও ভীষণ ভালো লাগল। ক্ষিধে পেটেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।

উষশীর ঘুম ভাঙল হর্নের শব্দে। অভিরাজ বিরক্ত হয়ে বলছে,”এই মানুষ গুলোও না। এভাবে জটলা কেন করছে!”

“এ ক্সি ডে ন্ট হয়েছে সম্ভবও।”

“দেশের ট্রান্সপোর্টের যা অবস্থা। দিনকে দিন দূর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।”

“হুম।”

অভিরাজ গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল উষশী। একটা ট্রাকের সাথে প্রাইভেট কারের সং ঘ র্ষ ঘটেছে। কে জানে গাড়িতে থাকা মানুষ গুলোর কি অবস্থা।

মৃদু বাতাসে উষশীর কাঁধ অবধি চুল গুলো উড়ে যাচ্ছে। হা হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে বাংলাদেশে এসেছে সে। বাইরেটা সেভাবে বের হওয়া হয়নি। সকালে কোকো কে নিয়ে খেলছিল। কোকো কোনো ভাবে হারিয়ে গেল। মেয়েটির কি যে কান্না। তারপর দুপুরের দিকে এক সংবাদ মাধ্যমের নিউজে দেখতে পেল কোকোকে। বিড়াল ছানাটা কি করে যে হসপিটালে পৌছাল কে জানে। কোকো আবার হারিয়ে যেতে পারে এই ভয়েই লোকেশন নিয়ে বৃষ্টির জল মাথায় করে ছুটে এসেছিল সে। কিন্তু কে জানত সে নিজেই হারিয়ে যাবে। একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। হর্ন বাজাতেই মেইন গেট খুলে গেল। অভিরাজ গাড়ি পার্ক করে বলল,”তোরা যা আমি আসছি।”

“কোথায় যাবি?”

উষশীর দিকে ইশারা করে বলল,”সম্ভবত দুপুর থেকে না খাওয়া। তাছাড়া আমরাও তো ডিনার করি নি। খাবার নিয়ে আসছি।”

“আচ্ছা,সাবধানে যা।”

উষশীকে নিয়ে ভেতরে এল লাবণ্য। সুন্দর পরিপাটি বাসাটা। কোকো লাফিয়ে নেমে গেল কোল থেকে।
“কোকো,দুষ্টুমি করবে না একদম।”

“থাক,ওকে খেলতে দাও।”

উষশী মৌন থেকে সম্মতি দিল। ওর আচরণে লাবণ্য একটু হেসে বলল,”আমি ড্রেস দিচ্ছি,গোসল করে আসো।”

লাবণ্য দেখল উষশী লম্বায় তার সমান সমান। তবে তার থেকেও রোগা পাতলা। সে তার টি শার্ট আর প্যান্ট এনে দিল। শাওয়ার নিয়ে ফিরল মেয়েটি। দীর্ঘসময় ভেজা থাকাতে কেমন যেন লাগছে এখন। কোকো পাশেই খাবার খাচ্ছে। অভিরাজ ফোনে কিছু করছিল। উষশীকে দেখে বলল,”লাবণ্য খাবার সার্ভ করে দে।”

উষশী ড্রয়িং এর পাশে থাকা বিশাল জানালার কাছে এল। বাইরে তুমুল বর্ষণ। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। সোডিয়ামের আলোয় চকচক করছে রাস্তাটা। আকাশ মেঘলা হলেও ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রূপালি চাঁদ।
“উষশী,চলো খাবার খেয়ে নাও।”

খাবারের গন্ধটা নাকে আসতেই উষশীর মনে হলো সে মা রা যাবে। প্রচন্ড ক্ষুধায় এখন তার চলতেও কষ্ট হচ্ছে। ডাইনিং এ বসে যথাসম্ভব দ্রুত খেল সে। প্রচন্ড ক্ষিধে থাকলেও বেশি খেতে পারল না। লাবণ্য কিছু মেডিসিন খাওয়াল। সারাটা দিন মেয়েটা ভেজা শরীরে,জ্বর না এলেই হয়।

সব কিছু গুছিয়ে রাখতে রাখতে এগারোটা বেজে গেল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর লাবণ্য যেন একটু বেশিই নেতিয়ে পড়ল। অভিরাজ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।
“কাজ কাজ করে মাথা নষ্ট করে ফেলবি।”

“এগুলো না দেখলে দুদিনেই বিজনেস লাটে উঠবে।”

“তাই বলে রেস্ট নিবি না?”

“রেস্ট নেই তো।”

“দেখি তো,সারাক্ষণ এটা ওটা করতেই থাকিস। কফি খাবি?”

“আমি বানিয়ে নিব। তুই ঘুমা।”

“আচ্ছা।”

“উষশী ঘুমিয়েছে?”

“হ্যাঁ। একদমই কিউট মেয়েটা।”

“সাথে তেজ ও আছে।”

“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”

“কি জানি। যাই হোক,তুই ঘুমা,কাল ভোর থেকে ইন্টার্নশিপ তোর।”

“হুম।”

কাজের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাবণ্য। ডাক্তারি পেশাটা ময়টেও সহজ নয়।

সকালের মিষ্টি রোদটা ঘুম ভাঙিয়ে দিল উষশী’র। পাশেই ঘুমোচ্ছে কোকো। তার জ্বর আসে নি। মেডিসিনটা কাজে লেগেছে। ঘুম ভালো হওয়াতে শরীরটাও বেশ চাঙা লাগছে। আড়মোড়া ভেঙে কোকো কে ডাকল সে।
“কোকো, উঠ সোনা।”

মিউ মিউ করে উঠল কোকো। ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসল উষশী। কোকের লোমে ভরা শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”সোনা বাচ্চা।”

ড্রয়িং রুমেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল অভিরাজ। কাল অনেক রাত অবধি কাজ করেছে। এলার্মের শব্দে ঘুমটা ছুটে গেল। হাই তুলতেই দেখল সিঁড়ি বেয়ে নামছে উষশী। কোকো মিউ মিউ করছে।
“চুপ থাকো কোকো,আমরা অন্যের বাসাতে।”

কোকো ধীরে ধীরে মিউ মিউ করে থেমে গেল। ওর ভদ্র সভ্য আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে হাত বুলিয়ে দিল উষশী। নিচে নামতেই অভিকে দেখতে পেল সে। গতরাতে খাওয়ার সময় একবার দেখা হলেও কথা হয় নি।
“গুড মর্নিং উষশী।”

“গুড মর্নিং।”

অভিরাজ এগিয়ে এল। উষশী’র থেকে কোকো কে কোলে তুলে বলল,”ওর নাম কী?”

“কোকো।”

“কে রেখেছে?”

“আমি।”

অভিরাজ এবার পরিপূর্ণ নজরে তাকাল। তারপর বলল,
“স্পেসেফিক কোনো ক্যাট ফুড খাওয়াও?”

“না। সব ধরনের ক্যাট ফুড খেতে পারে কোকো।”

“আচ্ছা। গত রাতেরটাই দিচ্ছি তাহলে।”

উষশী হা না কিছুই করল না। অভিরাজ কোকো কে ক্যাট ফুড দিল। ততক্ষণে চার পাশে নজর বুলাল উষশী। বাড়িটার আকৃতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারল না। শুধু মনে হলো এই বাড়িতে নিয়মিত থাকে না কেউ।
“কফি খাও তো?”

“হুম।”

গরম গরম ধোঁয়া উঠা কফিতে চুমুক বসাল উষশী। তার চাঙা শরীর আরো বেশি চাঙা হয়ে এল।
“ঐ আপুটা কোথায়?”

“বেরিয়েছে।”

“এত সকালে?”

“হুম।”

মন খারাপ করে ফেলল সে। একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে কোকোর কাছে এল। কোকো মজা করে খাচ্ছে। ওকে দেখেই মিউ মিউ ডাকতে লাগল।
“কাল আপনি ওকে গোসল করিয়েছেন?”

“হুম।”

“থ্যাংক ইউ।”

একটু বেশিই অবাক হলো অভিরাজ। এই তো কালকের সেই অহংকারী,ব দ মা শ মেয়েটাও থ্যাংকস বলতেও জানে!

“কোকো, কি করছো তুমি?”

উষশী’র জিন্স ধরে টানছে কোকো। সে বাহিরে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। উষশী তখনি তাকে কোলে তুলে বলল,”এমন করছো কেন?”

মিউ মিউ করে ডাকল কোকো। উষশী বুঝল বাইরে যেতে চাচ্ছে। অভিরাজ ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছে। ভীষণ কাজ তার। উষশী এক পলক তাকিয়ে হেসে বলল,”চলো।”

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩)

অনেকক্ষণ ল্যাপটপে ডুবে ছিল অভি। শরীর অবশ হয়ে এসেছে। হাত পা নাড়ানোর সময় খেয়াল হলো উষশী নেই। শুরুতে বিশেষ কিছু ভাবল না সে। নাস্তার সময় হয়ে এসেছে। সে মৃদু সরে ডাকল,”উষশী,ডাইনিং এ আসো। নাস্তা করবে।”

জবাব নেই। অভিরাজ আরো কয়েকবার ডেকেও যখন শব্দ পেল না তখন চারপাশে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে এল।
“গার্ড,উষশীকে দেখেছ?”

“উষশী মানে…”

“একটা বাচ্চা মেয়ে। তেরো চৌদ্দ বছর বয়সী হবে। সাথে একটা সাদা রঙের বিড়াল।”

“ও হো,একটু আগেই তো বের হলো। আমি ভাবলাম প্রতিবেশী হয়ত।”

গার্ডের কথায় গলা শুকিয়ে এল অভিরাজের। সে এক সেকেন্ড দেরি না করে বেরিয়ে পড়ল। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল চারপাশে। গত রাতের বৃষ্টিতে চারপাশ জ্যাম হয়ে এসেছে। একদম মানুষজন নেই। রাস্তায় গাছের ডাল পালা পড়ে আছে। বৃষ্টির পানিতে আশপাশ গুলো ভরে উঠেছে। কাদা পানির উপর দিয়ে ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটতে লাগল সে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে নিজের উপর। এতটা কেয়ারলেস সে!

কোকো বড্ড দুষ্টুমি করছে। উষশী হাঁপিয়ে উঠল। সে কোমরে হাত গুঁজে দিয়ে বলল,
“তোমায় রেখে চলে যাব কোকো। তুমি বড়ো জ্বালাচ্ছ।”

কোকো পাত্তা দিল না। সে যেন পরিবেশটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। হুট করেই কাদার মধ্যে লাফিয়ে উঠল। পুরো শরীর মেখে গেল কাদা জলে। ছুটে এসে ধরল উষশী। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কাঠ গলায় বলল,
“কোকো! তোকে আমি খুব মা র ব। তুই কি করলি এটা।”

কোকো মিউ মিউ করছে। ভারী মজা লাগছে তার। সে শরীর ঝাড়া দিতেই উষশীর মুখে এসে লাগল কাদা পানি। সে চোখ রাঙাল।
“তুই এত দুষ্টু হয়ে গেছিস!”

উষশী আসলেই রেগে গেল। কোকো কে ফেলে রেখে চলতে শুরু করেছে। কোকো মিউ মিউ করে ডাকল। উষশী’র সাড়া না পেয়ে সেও এল পেছন পেছন। উষশী আর রাগ করে থাকতে পারল না। কোকো কে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল।

এক ঘন্টা হয়ে গেল উষশীকে খুঁজে চলেছে অভিরাজ। পাগলের মতো খুঁজছে সে। সাতাশ বছর বয়সী অভি যেন কিশোরে ফিরে এসেছে। যার চোখে মুখে ভয়। বুকের ভেতর সংকট। এত বাজে অনুভূতি হচ্ছে। লাবণ্য’র কল পেয়ে আরো বেশি ভেঙে পড়ল যেন। সবটা বলতেই লাবণ্য বলল,”কোথায় গেল মেয়েটা।”

“বুঝতে পারছি না। আমার মাথা জ্যাম হয়ে আছে।”

“তুই টেনশন নিস না। আমি আসছি।”

“হুম।”

পুনরায় ব্যস্ত হয়ে গেল অভিরাজ। তার পা চলছে না। হাত পা ঝিম ধরে গেছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর ভীষণ ভাবে ক্ষত হচ্ছে। বাচ্চা একটা মেয়ে!

রাস্তাটা কিছুটা পরিচিত মনে হলো উষশী’র। সে এখনো তেমন কিছু খেয়াল করেনি।
“তুমি কি রাস্তাটাকে চিনতে পারছ কোকো?”

কোকো জবাবহীন। উষশী ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখছে।
“মনে হচ্ছে এর আগেও আমি এসেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না।”

কোকো মিউ শব্দ করল। উষশী’র পায়ে স্লিপার। সম্ভবত অভিরাজের। কারণ তার পায়ের থেকে বেশ বড়ো জুতোটা। কিছু সময় পর উষশী’র খেয়াল হলো সে রাস্তা চিনতে পারছে না। যেদিকেই যাচ্ছে অপরিচিত মনে হচ্ছে। কোন রাস্তা দিয়ে এসেছে মনে নেই। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কয়েকবার চক্কর দিয়েও লাভ হলো না। সামনেই একটা পার্ক দেখা যাচ্ছে। একটা মানুষও নেই সেখানে। উষশী সেখানে এল। কোকো লাফিয়ে নেমে গেল কোল থেকে।
“কোকো আমরা আবার হারিয়ে গেলাম।”

এতে অবশ্য কোকোর যায় আসে না। সে আপনমনে মেতে আছে। উষশী বেঞ্চে এসে বসল। তার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। এতটা হেলা না করলেও পারত।

অভিরাজের এই মুহূর্তে মনে হলো উষশীকে না দেখতে পেল শেষ হয়ে যাবে। এত কষ্ট হতে লাগল তার। বাচ্চা মেয়েটির কথা ভাবতেই ওর হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে। এমন অভিমানি মেয়ে কারো খপ্পরে পড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কাউকে যে বলবে তার ও জো নেই। মেয়েটার নাম আর গড়নের বর্ননা ছাড়া আর কিছুই তো জানে না সে। এমনকি একটা ছবি ও নেই। ছবি না তোলার জন্য নিজেকে ইউজলেস মনে হচ্ছে। একটা ছবি তুলে রাখলে কি হত? ফোনের রিং এ ধ্যান এল ওর। লাবণ্য কল করেছে।
“অভি,কোথায় তুই?”

“মেইন রোডে আছি।”

“ফিরে আয়। উষশীকে পেয়েছি।”

“কোথায় পেয়েছিস?”

“বাচ্চাদের পার্কটাতে। ভাগ্যিস বাইরে নজর রেখেছিলাম।”

বাড়ি ফিরে উষশীকে সোফায় বসে থাকতে দেখল অভিরাজ। প্রচন্ড রাগ হলো তার। এক প্রকার ধমকে উঠল। উষশী এবার সত্যিই ভয় পেয়েছে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে।
“আর ইউ সিলি? আমি অবাক হচ্ছি,একটা মানুষ কি পরিমাণে অদ্ভুত হতে পারে! ভদ্রতা তো বহু দূরের কথা,এটলিস্ট বলে তো যাবে। বাইরে যাবেই যখন,গার্ডেনেও থাকা যেত। কিন্তু না, চিন্তা না দেওয়া অবধি শান্তি নেই। ইউলেস এক‍দম।”

লাবণ্য কিচেন থেকে ছুটে এল। অভিরাজকে রেগে যেতে দেখে বেশ ভয় পেয়েছে উষশী। কাঁপছে তার শরীর।
“অভি এভাবে বলিস না।”

“আর সাফাই না দে লাবণ্য। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এমন ফা ল তু মেয়ে এ জন্মে দেখি নি। ওকে সাথে আনাই ভুল
হয়েছে।”

রাগের চোটে শরীর কাঁপছে অভিরাজের। মুখের চোয়াল উঠানামা করছে। ডিভানটাকে ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠে গেল। সেদিকে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ফেলল লাবণ্য। উষশী একই ভাবে দাঁড়িয়ে। নড়ছে না অবধি।

উষশী সেই কখন থেকে জানালার কাছটায় বসে আছে। ফের বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। কোকো পাশে বসে মিউ মিউ করছে। একটুও ধ্যান নেই তাতে। ওর দৃষ্টি বাইরের গাছে। সেখানে একটা পাখির বাসা। মা পাখিটা ছানা গুলোকে জড়িয়ে আছে। তারই পাশে বাবা পাখিটা বসে। সে হয়ত খাবার খুঁজতে যাবে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে। অভি’র মাথা ঠান্ডা হয়নি তখনো। লাবণ্য এসে বলল,”তুই যে কি অভি।”

“কি করেছি?”

“ওভাবে না বললেও পারতি।”

অভিরাজের থেকে উত্তর মিলল না। লাবণ্য পাশের চেয়ারটাতে বসে বলল,”মেয়েটা একদম শান্ত হয়ে গেছে।”

“ভালো হয়েছে।”

“তবু ওভাবে বলা ঠিক হয়নি তোর।”

“জানিস কতটা চিন্তা লাগছিল আমার। তুই জানিস আমি আমার দায়িত্বটাকে কত গভীর ভাবে দেখি।”

“বুঝেছি,তবে সবাই তো এক হয় না অভি। তাছাড়া এই বয়সটা ছেলেমানুষী করারই।”

অভিরাজ এবারও উত্তর করল না। লাবণ্য কিছু সময় থেকে চলে গেল। উষশী’র হাল্কা বাদামি চুল গুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। হাঁটুসম ফ্রকে তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। মেয়েটা অনেকটা অদ্ভুত। তার স্বভাবে মায়ের ছোট্ট ছানা ছানা ভাব রয়েছে। অভিরাজ দেখল উষশী’র নড়চড় নেই। কেমন যেন থমকে গেছে। ওর গিল্টি ফিল হলো। সত্যিই বেশি বলে ফেলেছে। তবে তখন এত রাগ হচ্ছিল। সে কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস নামাল সে। অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বলল,”বৃষ্টি দেখছ?”

উষশী নিশ্চিত শুনতে পেল তবে জবাব দিল না। অভি খুব বুঝতে পারল বাচ্চাটার হৃদয়ে অভিমানের পাহাড় জমেছে। সে দোলনার অপর পাশটায় বসল। এতে এক চুলও নড়ল না মেয়েটি।
“কোকোর বয়স কত?”

এবার ও উত্তর নেই। অভি খুব বুঝতে পারছে অভিমানের পাহাড়টা আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। তার সত্যিই খারাপ লাগছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা তো হয়েই গেছে। সেসব তো চাইলেও বদলানো যাবে না। উষশীর পাশে বেশ কিছু সময় বসে রইল অভিরাজ। প্রতিটা মানুষের শরীরেরই একটা ঘ্রাণ থাকে। উষশীর শরীর থেকে কেমন বেলি ফুলের মতো সুবাস আসছে। কোমল বাচ্চা মেয়েটার হাতের খুব নিকটে রয়েছে তার বড়ো হাতটি। অভিরাজ হাত সরিয়ে বলল,”সরি। আর কখনো ওভাবে বলব না। তখন এত রাগ হচ্ছিল তাই বলে ফেলেছি।”

“সরি তো আমার বলা উচিত।”

“তুমি কষ্ট পেয়েছ?”

“আমি তো অভদ্র,ইউজলেস।”

নিজের গালে ঠা স করে চ ড় দেওয়ার ইচ্ছে হলো অভিরাজের। সত্যি সত্যি কাজটি করত সে যদিনা পাশে উষশী থাকত।
“উষশী,প্লিজ ফর্গিভ মি। আমার ওভাবে বলা উচিত হয় নি। রাগের বসে বলে ফেলেছি।”

বাচ্চা মেয়েটা নজর ঘুরিয়ে ফেলল। তার চোখ জ্বালা করছে। এই মুহূর্তে কথা বলতে পারছে না সে। অভিরাজের বুকের ভেতরটা কেমন ধীম ধীম করছে। মেয়েটি কি কাঁদছে?

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে