#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১)
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
“এই মেয়ে ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
দেড় ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজে হসপিটালে পৌছাল উষশী। ঠান্ডায় থর থর করে কাঁপছে সে। তার দৃষ্টি এদিক সেদিক লু ট পাট চালাচ্ছে। সে হাতের ইশারায় সামনের দিকে দেখাল। সামনে থাকা ব্যক্তিটি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,”ভেজা কাপড় নিয়ে সামনে যাওয়া যাবে না। চেঞ্জ করে আসবে।”
অভিরাজের কথাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে করিডর দিয়ে ছুটে চলল কিশোরী। এক মুহূর্তের জন্য বোকা বনে গেল ছেলেটা। পর পর হাক ছেড়ে ডাকতে লাগল।
“গার্ড,গার্ড কোথায় আপনারা? হসপিটালে কি হচ্ছে এসব!”
অভিরাজের কণ্ঠ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল দুজন গার্ড। ব্যস্ত হয়ে শুধাল,”কি হয়েছে স্যার?”
“আপনাদের চোখ কোথায় থাকে? ভেজা কাপড় নিয়ে একটা মেয়ে হসপিটালে ঢুকে গেল আর আপনারা বসে বসে ঝিমুচ্ছেন!”
“সরি স্যার। গেটের কাছটা অনেক ভীড় ছিল তাই দেখতে পাই নি আমরা।”
“নেক্সট যেন এমন কিছু না হয়। এটা একটা হসপিটাল, চিরিয়াখানা নয়। মেয়েটাকে খোঁজার ব্যবস্থা করুন।”
কথা শেষে লম্বা কদমে চলে এল অভিরাজ। এমনিতেই আজ মেজাজ গরম। তারপর আবার এইসব কান্ড!
উন্মাদের মতো ছুটে চলেছে উষশী। তার আচরণ খেই হারা মাঝি’র মতো। সব যেন শেষ হয়ে এসেছে। চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। পরনের হাঁটুসম ফ্রকটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। কাঁধ সমান বাদামি চুল আর ঘোলাটে চোখের মনি। শুভ্র রঙের উষশী যেন সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের উপর এক বিন্দু শিশির কণা। পায়ে থাকা স্লিপার থেকে চপ চপ শব্দ হচ্ছে। আরেকটু ছুটতে যাবে ওমন সময় একজন লেডি গার্ড খপ করে হাতটা ধরে ফেলল। কিশোরী নিজের হাত ছাড়ানোর প্রয়াসে বলল,”ছাড়ো,ছাড়ো আমার হাত।”
লেডি গার্ড হাত ছাড়লেন না বরং টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। উষশীর শ্বেত রঙা মুখ লাল হয়ে এসেছে। দীর্ঘ সময় বৃষ্টির জল মাথায় করে ছুটে এসেছে সে। শরীরটাও অনেকটা অবশ হয়ে এসেছে। হাত ছাড়াতে না পেরে রাগ হচ্ছে। রাগের কারণে তার ঠোঁট দুটোয় কম্পন ধরে গেল। মেয়েটির দু চোখ রক্তিম। ঠিক যেন কৃষ্ণচূড়া! লেডি গার্ডের শক্তির নিকট হেরে গিয়ে বুদ্ধি খাটাল সে। চকচকে তীক্ষ্ণ দাঁতের কামড়ে ছাড়তে বাধ্য হলেন তিনি। উষশী সময় ব্যায় না করে পুনরায় ছুটতে লাগল। ছোট্ট,উন্মাদ কিশোরী এবার ধাক্কা খেল এক শক্তপোক্ত দেহের সাথে। ছিটকে পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে। রাগে দুঃখে দুটি চোখ ভরে উঠেছে নোনা জলে। কিছু বলবে ওমন সময় মিউ মিউ আওয়াজটা কানে এল। সব রাগ উবে গেল যেন। ছোট্ট দেহটাকে নাড়িয়ে পাশ ঘুরে তাকাল। পরমুহূর্তেই একরাশ আনন্দ এসে ভর করল তার চোখে মুখে। অত্যন্ত আনন্দের সাথে ডাকল।
“কোকো! কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি।”
অভিরাজ বোকার মতো তাকিয়ে। ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে সে। হসপিটালে বিড়াল ও ঢুকে গেছে! লেডি গার্ড ছুটে এসে বললেন,”স্যার এই তো মেয়েটা। শ য় তা ন মেয়ে আমায় কামড়ে পালিয়েছে।”
শ য় তা ন শব্দটি কানে এল উষশী’র। সে তার কোকো নামক বিড়ালের শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
“কি বাজে তুমি!”
লেডি গার্ড অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে ওমনি থামিয়ে দিল অভিরাজ। চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে সামনে তাকাল। উষশী তার ছোট্ট সাদা বিড়ালটিকে নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। বিড়ালটিও পরম আদরে শুয়ে আছে। অভিরাজ হুট করেই ধমকে উঠল,”এই মেয়ে। পাগল তুমি?”
পাগল শব্দটি উষশীর কানে পৌছাতেই খেপে গেল সে।
“আপনি পাগল।”
“হোয়াট!”
দ্বিতীয় বারের মতো অভিরাজকে উপেক্ষা করে চলে গেল উষশী। মেয়েটির এসব কান্ডে চরম বিরক্ত সে। কিছুটা এগিয়ে পুনরায় পিছিয়ে এল মেয়েটি। তার ভেজা চুল গুলো কানের পিঠে গুজে নিয়ে শুধাল,”বের হব কি করে?”
পৌ শা চিক আনন্দ পেল অভি। মেয়েটিকে এত সময় পর ঠিকঠাক খেয়াল করল। রোগা পাতলা গড়নের বাচ্চা এক মেয়ে। দেখতে অনেকটা বেবি ডলের মতো।
“কানে শুনেন না আপনি?”
রেগে গেল অভিরাজ। কানে শুনে না মানে কি?
“যেভাবে এসেছ সেভাবে চলে যাও।”
“কোন দিক দিয়ে এসেছি মনে নেই।”
“তো?”
“বের হবার রাস্তা বলেন।”
“পারব না।”
“কেন?”
“আমার ইচ্ছে।”
পর পর জবাবে রাগ হলো উষশীর। এসির হাওয়া এসে তার শরীর আরো শীতল করে তুলেছে। সে বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে হাঁচি উঠবে। অভিরাজ অন্যদিক ফিরতেই পর পর দু বার হাঁচি দিল সে। যার দরুণ লাল হয়ে উঠল তার নাকের ডগা। অভি কিছু বলার পূর্বেই ডানে বামে তাকিয়ে ছুট লাগাল কিশোরী। ঝড়ের মতো এসে ঝড়ের মতোই পালিয়ে গেল বাচ্চাটি। কতক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে রেগে গেল অভিরাজ। হসপিটালের সব নিয়মকানুন উধাও হয়েছে নাকি! কোনো কিছুতেই মনোযোগ নেই এদের।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছে উষশী। এখানকার ট্রান্সপোর্ট সম্পর্কে একদমই জানে না সে। এমনকি টাকাও নেই তার কাছে। ফিরবে কেমন করে জানা নেই। এদিকে বিকেল নেমে এসেছে। কোথাও একটা স্মার্ট ওয়াচটা ফেলে এসেছে। লোকেশনও জানে না। খুব কান্না পেল ওর। চারপাশে ব্যস্ত মানুষজন। কোকো একটু পর পর মিউ মিউ করে ডাকছে। সেই সকালে বের হয়েছে। নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছে। কোকোর খাওয়ার কথা চিন্তা করে ওর নিজের ও ক্ষিধে পেয়ে গেল। পেটের ভেতর ইঁদুর নাচছে যেন।
“কোকো খুব ক্ষিধে পেয়েছে? একটু সহ্য করো সোনা।”
বাক্য শেষে ডানে বামে তাকাল সে। যান চলাচল খুব বেশি। বৃষ্টির সময় একদম খালি ছিল রাস্তা। তাই আসতে অসুবিধা হয়নি। এখন তো পার হতেও ভয় হচ্ছে। দু একবার চেষ্টাও করল কিন্তু ব্যর্থ হতে হলো। মন খারাপ করে এপাশ থেকেই চলতে লাগল। ফের বৃষ্টি শুরু হলো। ক্ষিধের চোটে কোকো সমানে চেচামেচি করছে। মানুষজন ছুটোছুটি করে বৃষ্টির জল আড়াল করছে। আর উষশী,মুখ গোমড়া করে পথ চলছে। ভরা বৃষ্টিতে তার পা যুগল চুলকোচ্ছে। সে তবু হেঁটে চলেছে। চপ চপ শব্দ করে আরেকটু চলতেই জুতো ছিঁড়ে গেল। রাগে দুঃখে সেটাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলল। কোকো ভাবল এটা বোধহয় কোনো খেলা। সে লাফানোর প্রয়াস করতেই নরম,হতাশ কণ্ঠে বলল উষশী।
“ওটা আর কাজে লাগবে না কোকো। জানি না ফিরব কেমন করে।”
কোকো কি বুঝলে কে জানে। অত্যন্ত আবেগী সুর তুলে দু বার মিউ মিউ ডাকল। একটুখানি হেসে উষশী হাত বুলিয়ে দিল। সূর্য প্রায় নেমে এসেছে। আকাশ কিছুটা লাল আভায় মিশে গেছে। পরিবেশ খুব সুন্দর লাগলেও উষশীর মনে বিষাদ। সে কি করে বাড়ি ফিরবে বুঝতে পারছে না। এদিকে আরো কয়েকবার হাঁচি দিল। শীতে কুকরে গেছে কোকো। মায়া হচ্ছে খুব। বাস স্ট্যান্ড গুলো খালি পড়ে আছে। একটা মানুষের দেখা নেই। তবে কিছু নেড়ি কুকুর রয়েছে। দু একটা ঘেউ ঘেউ শব্দ করে ডাকছে। উষশী নজর ঘুরাল। তার শরীর অবশ মনে হচ্ছে। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইট কংক্রিটের বৃষ্টিভেজা রাস্তাতে। সন্ধ্যার আজান পড়ে গেছে। এবার উষশীর খুব কান্না পেল। সে হয়ত কেঁদেই ফেলত। ঠিক তখনি একটা সুন্দর মেয়ে ডাকল,”বাবু,এখানে বসে আছ কেন?”
উষশী নজর ঘুরাল। শরীরে এপ্রোন দেখে বুঝল মেয়েটি ডাক্তার। সে কিছু বলত তবে পেছনে থাকা পুরুষটিকে দেখে চুপসে গেল। বেয়াদব লোকটার কপালে ভাঁজ পড়েছে। বোঝা যাচ্ছে কতটা বিরক্ত সে।
“তুমি তো কাঁপতে শুরু করেছ! এভাবে জ্বর হবে। কিছু বলো বাবু।”
উষশী কিছু না বলে উঠে হাঁটা লাগাল। অভি রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,”দেখলি,নাম্বার ওয়ান ঘাড়ত্যাড়া।”
“তুই বেশি করছিস। ও তো একটা বাচ্চা।”
“বেশি বকছি না। আস্ত বেয়াদব।”
“অভি প্লিজ। মেয়েটা হয়ত ভয় পেয়েছে।”
“ভয়! হা,ওর মধ্যে কোনো ভয় নেই। বরং অন্যকে জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।”
লাবণ্য কথা বাড়াল না। পায়ের গতি বাড়িয়ে উষশীর পথ আটকাল।
“তুমি রাগ করেছ?”
এবার ও কথা বলল না উষশী। অভি তাচ্ছিল্য হাসল।
“ভয় পাচ্ছ?”
“না।”
“তাহলে।”
“পথ ছাড়ো।”
“কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে রাস্তা চিনো না। বার বার একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছ।”
“চিনি।”
“আমার দিকে তাকাও।”
“কেন?”
“তুমি কি হারিয়ে গেছ?”
“না।”
“তাহলে?”
“কিছু না।”
হাঁপিয়ে উঠল লাবণ্য। মেয়েটি আসলেই ঘাড়ত্যাড়া। কিন্তু এভাবেও ছেড়ে দেওয়া যায় না। ততক্ষণে অভিও চলে এসেছে।
“বাচ্চা হলে কি হবে,তেজ দেখেছিস?”
“অভি তুই!”
উষশী চোখ মেলে তাকাল। তার ঘোলাটে চোখে পানি চিকচিক করছে। লাবণ্য সেটা দেখতে পেয়ে বলল,”বাবু কাঁদে না।”
“পথ ছাড়ো আমার।”
“তুমি ওর কথায় রাগ করেছ?”
“বদ লোক।”
“কি বললে…”
“অভি,প্লিজ থাম একটু। তুই ও কি বাচ্চা হয়ে গেলি?”
কিছু বলতে যেতেই লাবণ্য সরিয়ে দিল। খুব যত্ন নিয়ে উষশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”বাসা কোথায় তোমার?”
“খুঁজে পাচ্ছি না।”
“এখানে এলে কি করে?”
“গুগল ম্যাপ দেখে।”
“দেখি।”
“হারিয়ে ফেলেছি।”
“তুমি ঠিকানা বলতে পারবে?”
“মনে নেই।”
লাবণ্য বুঝতে পারছে না কি করবে। অভি একটু দূরে সরে এসেছে। হাতের ইশারায় ডাকল তাকে।
“কি?”
“ও সম্ভবত এখানে নতুন।”
“তো?”
“কোনো ভাবে হারিয়ে গেছে। ঠিকানাও বলতে পারছে না। এখন কি করি বল তো।”
“কিছু করার দরকার নেই।”
“অভি!”
“যে তেজ,শুনবে কোনো কথা।”
“শুনবে,তুই শুধু শুধু এমন করছিস।”
“বল আমাদের সাথে যাবে কি না। না গেলে আর একটা শব্দও করবি না। আস্ত শ য় তা ন মেয়ে।”
লাবণ্য চোখ রাঙিয়ে পুনরায় উষশীর কাছে এল। মেয়েটি এবার সত্যিই ভয় পাচ্ছে।
“তোমার নাম কি?”
“উষশী।”
“আচ্ছা উষশী,তুমি তো তোমার ঠিকানা বলতে পারলে না। এই রাতে রাস্তায় থাকাও ঠিক নয়। তুমি কি আমাদের সাথে যাবে?”
উষশী ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এদিকে অভি বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে। মেয়েটির খুব রাগ হলো।
“এই লোকটাও যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“যাব না।”
“কেন?”
“লোকটা বাজে।”
ক্ষেপে গেল অভিরাজ। টেনে নিয়ে যেতে লাগল লাবণ্যকে। উষশীর নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। তার খুব অসহায় লাগছে। সে কোকো কে কোলে তুলে নিয়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগল। এদিকে লাবণ্য অভিরাজের সাথে তর্ক জুড়ে দিল।
“পাগল হয়ে গেলি তুই?”
“আমি না তুই পাগল হয়ে গেছিস। এমন তেজ ওয়ালা মেয়েকে কোথায় নিবি তুই?”
“বাচ্চা একটা মেয়ে।”
“শুধু বাচ্চা না। বল বদমেজাজি বাচ্চা।”
“সে যাই হোক,তুই বুঝার চেষ্টা কর। একা একটা মেয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে পরদিন অবধি ঠিক থাকবে?”
এতক্ষণে টনক নড়ল অভিরাজের। সে তবু বিরক্ত হয়ে বলল,”যা ইচ্ছে কর।”
লাবণ্য সামনে ঘুরে দেখল মেয়েটি আগের জায়গায় নেই। ভ্রু কুচকে গেল।
“কোথায় গেল মেয়েটা!”
“কোথায় গেল মানে?”
“নেই তো।”
চারপাশে নজর বুলাল অভিরাজ। সত্যিই কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এবার সত্যিই ভয় হচ্ছে ওর। রাত হয়ে এসেছে। বৃষ্টির মধ্যে কোথায় চলে গেল মেয়েটা?
চলবে….