রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে প্রায় দশ মিনিট ধরে ইমু বসে আছে।
দশ মিনিট শুনতে খুব কম সময় মনে হলেও এই দশ মিনিটে ইমুর মেজাজ বিরক্তির শেষ সীমা অতিক্রম করেছে।
সে এখানে এসেছিল রাতুলের সাথে। রাতুল ঠিক দশ মিনিট আগে, কি এক কাজের বাহানা দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল পাঁচ মিনিট লাগবে কাজ শেষ করে ফিরে আসতে। এদিকে দশ মিনিট পার হয়ে যাচ্ছে অথচ রাতুলের এখনো ফেরার নাম নেই।
এই ছেলের সাথে কোথাও বেরুনো এককথায় মহাপাপ। মানুষের দু’একটা বাজে স্বভাব থাকে কিন্তু রাতুলের বাজে স্বভাব গুনে শেষ করা যায় না।
এই যেমন, রাতুল যখনই ইমুর সাথে রাস্তায় হাঁটতে বেরোয়, তখন সে আশেপাশে ফুটপাতের দোকানে যা দেখে তাই একবার করে গলধকরন করে।
এক ঘন্টা রাস্তায় হাঁটলে রাতুলের খাওয়ার তালিকায় যোগ হয়, ঝাল মুড়ি, ঝাল চানাচুর, শরবত, পেয়ারা, আনারস, সিদ্ধ ডিম আরও কতো কি! খাবার হাতে থাকলে রাতুলের সাথে কথা বলাও বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। সে খাওয়ার সময় আশেপাশে কি হচ্ছে তা দেখতেই পায় না।
যাহোক এখন ইমুর আরও কিছুক্ষন যে পাপের মাশুল তথা অপেক্ষা করতে হবে তা একেবারে সুনিশ্চিত।
রাতুল ফিরে এলো আধঘন্টা পর।
ইমু চুপ করে বসে আছে। ঝড় আসার পূর্বে পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে যায় এ কথা বলাই বাহুল্য।
ইমু ভাবছে এখন তার কি করা উচিত? সে কি ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে চলে যাবে, নাকি শান্ত ভঙ্গিতে রাতুল কি রাজকার্য করে এলো তা শুনবে?
এর মাঝেই রাতুল ইমুর পাশে বসে পড়েছে। ইমু রাতুলের দিকে কটমট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকাল। ইমু দেখল রাতুল মুচকি মুচকি হাসছে।
সে যে অনেক দেরি করে ফেলেছে এই নিয়ে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। রাতুল বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখ করে বলল, তোর জন্য একটা জিনিস আনতে গিয়ে একটু দেরি হলো।
ইমু কোন কথা বলল না। ফিরেও তাকালো না।
রাতুল বলেই যেতে লাগল, আমার কাজ পাঁচ মিনিটেই শেষ হয়েছিল। ফেরার পথে মনে হলো তোর জন্য খালি হাতে কিভাবে আসি। তাই অনেক খুঁজে তোর জন্য আমার এই বিশেষ নিবেদন।
এবার ইমু রাতুলের দিকে তাকালো । যা দেখল সেটিকে ঠিক কিভাবে সঙ্গায়িত করা যায় তা ইমু জানে না।
রাতুলের হাতে একগোছা লটকন। সে এগুলো ইমুর সামনে উঁচিয়ে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে।
এই একগোছা লটকন যে রাতুল ইমুর জন্য উপহার স্বরুপ এনেছে তা বুঝতে আর বাকি থাকে না।
উপহারের নমুনা দেখে মূহুর্তেই ইমুর মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। এরপর যথারীতি দুজনের মাঝে শুরু হলো কথা কাটাকাটি।
দুজনের মাঝে বললে ভুল হবে, সত্যি বলতে ইমু চিল্লাতে চিল্লাতে অনেক কথাই বলছে আর রাতুল শুনে যাচ্ছে। সব ছেলেরাই বেশ মনোযোগী শ্রোতা হয় এই সময়গুলোতে।
পরিস্থিতি শান্ত হতে আধাঘন্টা লেগে গেল।
এখন অবশ্য তাদের লটকন খাওয়ার পালা।
খারাপ সময় পার করে ভালো সময় আসবে এ-ও তো কারও অজানা নয়।
খেতে খেতে ইমু রাতুলকে বলল,
জানিস আমাদের সিলেটে আঞ্চলিক ভাষায় লটকনকে কি বলে?
না জানি না। কি বলে?
“বুবি”।
কি বলে?
হ্যাঁ ঠিক শুনেছিস, “বুবি” বলে।
শব্দটা শুনে রাতুল হা করে অনেকক্ষন ইমুর দিকে তাকিয়ে রইলো। দুএকবার কি একটা ভেবে রাতুলের চোখগুলো চকচক করে উঠলো। বিষয়টি যদিও ইমুর দৃষ্টিগোচর হয়েছে তবুও তখন তেমন গুরুত্ব পায় নি।
রাতুল কেন এমনভাবে তাকিয়ে ছিল তা জানা গেল তিনদিন পর।
তিনদিন পরে যা ঘটলো তা ইমুর জীবনকে মোটামুটি পাল্টে দিল।
এর কারন ইমুর ডিপার্টমেন্টের সবাই এমনকি স্যাররা সহ ইমুকে বুবি নামে সম্মোধন করতে শুরু করেছে। এই অতীব অসাধারণ কাজটা ঠিক কি উপায়ে রাতুল করেছে তা জানা যায় নি। একটা ঘটনা বলা যাক,
একদিন ইমু জেনেটিক্সের শিক্ষক প্রফেসর ইকবাল স্যারের সাথে দেখে করতে চেম্বারে গিয়েছে।
স্যার এমনিতে বেশ ভালো মানুষ। ছাত্রমহলে তার সুনাম সবসময় আলোচিত হয়।
দরকারি কথাবার্তা যা হওয়ার তা শেষ হয়েছে।
হঠাৎ ইকবাল স্যার জিজ্ঞেস করলেন,
কি ব্যাপার ইমু? তোমার নাকি আরেকটা নাম আছে? আমি নামটা শুনেছি। নামটা কিন্তু খারাপ না।
ইমু ঠিক এই মূহুর্তে কি বলবে ভেবে পেল না।
সেদিন ইমু রাতুলকে খুঁজে বের করে তার উপর রীতিমতো হিংস্র বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়লো। কিন্তু এতে নামের বিড়ম্বনা সমাধান করা গেল না।
অতপর ইমুকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি পাঠ চুকাতে হলো বুবি হয়ে।
তিনবছর পর, শীত যখন তার আগমনী বার্তা দিচ্ছিলো তখন ইমু আর রাতুলের বিয়ে হয়ে গেল।
এ বিয়ে সাধারণ বিয়ে নয়। শর্তসাপেক্ষে বিয়ে। শর্ত দিয়েছিল ইমু।
শর্ত হলো এই যে, বিয়ের পর থেকে রাতুল কখনো ইমুকে বুবি বলে ডাকবে না এবং সেই সাথে এই নাম শ্বশুর বাড়ির কোন মানুষ যেন ঘুনাক্ষরেও জানতে না পারে সেই ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
রাতুল কোন উপায় না দেখে মেনে নিয়েছে এবং সেই সুবাদে তারা এখন সুখী জীবন যাপন করছে। দুজনের মাঝে বেশি খুশি হলো ইমু। কারণ দীর্ঘদিন পর রাতুলের মুখ থেকে এই বুবি নামটাকে এড়ানো যাচ্ছে।
চার বছর কেটে গেল নিয়মিত রুটিনে।
তবে পরিবর্তন যে হয়নি তা বলা যাবে না।
কারন এরইমধ্যে রাতুল আর ইমুর মাঝে ফুটফুটে দেড় বছরের একটি মেয়ের জায়গা হয়েছে। মেয়েটির নাম ইরা। নামটি রাখা হয়েছে খুব সুকৌশলে। ইমু থেকে “ই” আর রাতুল থেকে “রা” মিলে হয়েছে ইরা।
বাবা মার একমাত্র আদরের মেয়ে বলে কথা।
তবে এই পরিবর্তন কে ছাপিয়ে আজ যে ঘটনা ঘটে গেল তাতে ইমু এক্কেবারে বাকরুদ্ধ।
বিষয়টি খুলে বলি।
আজ বিকেলে রাতুল সোফায় বসে পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। ইমু পাশেই বসা ছিল। তাদের একমাত্র মেয়ে ইরা ফ্লোরে বসে আপন মনে খেলছে। ইরা এখন হাঁটতে পারে তবে মুখে কথা ফোটে নি।
হঠাৎ রাতুল এবং ইমু লক্ষ্য করল ইরার মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারিত হচ্ছে।
দুজনেই উত্তেজিত হয়ে মন সেদিকে নিবদ্ধ করল।
হ্যাঁ, সত্যি ইরা কথা বলছে। আর যা বলছে তা শুনে ইমু বিস্মিত, বিমোহিত, কম্পিত এবং নিস্তব্ধ।
ইরা বাবাও বলে নি, মাও বলে নি। ইরার মুখে প্রথম উচ্চারিত শব্দ “বুবি”
সে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে বুবি..বুবি…বুবি…বুবি।
কেউ একজন সত্যিই বলেছে। History repeats…
আজকের পর থেকে বুবি শব্দটা আর এড়ানো যাবে না এ কথা ইমুর অজানা নয়।
“বুবি”
আদিল মাহফুজ রনি || সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়