বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৬+৭

0
279

#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা

ষষ্ঠ পর্ব:

১০.

প্রাত্যহিক জীবনের প্রত্যাশিত দিনটির মতন আজকের দিনটি নয় করবীর। আজকের দিনটি ভিন্ন এবং মন ভালো দিন। প্রায় অনেকদিন তার জীবনে এত ভালো দিনের আগমন নেই। আকাশে মেঘ ভাসছে মহা সরোবরে। চারদিকে বোধহয় শিউলি ফোঁটা মুগ্ধতা। করবী বিকেলে ঘর থেকে বেরুতেই তাদের গলি পেরিয়ে একটা বড়ো রাস্তায় উঠতেই একজন ভদ্রমহিলা তাকে ডাকলেন। টুকটাক জিজ্ঞেস করেই জানালেন, তিনি প্রায় করবীকে দেখেন আসতে যেতে। শুনেছেন করবী টিউশন করায় তাই তিনি এসেছেন করবীর কাছে। তার মেয়ের জন্য একজন শিক্ষক প্রয়োজন। করবী যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল হাতে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বেতন ঠিক হলো সাড়ে ছয় হাজার। করবীর কাছে ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিতই ছিল বটে। হুট করে এত ভালো কিছু পেয়ে যাবে সে বুঝতে পারেনি। আনন্দ ভাগ করতে ইচ্ছে করল তার। এবং সেই মোতাবেক সে কল দিল বিন্দুকে। অপরপাশে বিন্দু বোধহয় একটু ব্যস্ত তাই প্রথমবার কলটা রিসিভ হলো না। করবী দ্বিতীয়বার আবার কল দিল। এবার দীর্ঘক্ষণ কল বাজার আগেই রিসিভ হলো। অপর পাশ থেকে বিন্দুর স্বচ্ছ কণ্ঠ,
“আরে আপা, এহন কল দিছো যে? কিছু কী হইছে? কোনো সমস্যা হইছে, আপা?”

করবী হাসল। জবাব দিল,

“কোনো সমস্যা না। তুই কী এখন ছুটি নিয়ে আসতে পারবি, বিন্দু? একটা খুশির খবর আছে।”

“কী খবর, আপা?”

“তুই এলেই বলব। কলে বলে মজা নেই।”

“ছুটি হয় আটটায়। এহন চাইরটা বাজে। দাঁড়াও, মালিকরে বইল্যা এহনই ছুটি নিতাছি। তোমার খুশির খবর আর আমি থাকমু না তা কী হয় নাকি! আইতাছি।”

করবী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “তোর অসুবিধা হলে আসিস না, বিন্দু।”

“আমার কিয়ের অসুবিধা? তুমি এত চিন্তা কইরো না তো। আমি আইতাছি।”

করবীকে আর কথা বলার সুযোগ দিল না বিন্দু। তার আগেই কল বিচ্ছিন্ন হলো। করবী তার গলিতে ফিরে গেল। সেখানে ক্রিকেট খেলছিল এক ঝাঁক ছেলেপেলে। তাদের মাঝে একজনকে ডেকে হুতুমকে নিয়ে আসতে বলল। করবী বলতেই ছেলেটা ছুট লাগালো। করবী মিনিট কয়েক দাঁড়াতেই হুতুম চলে এলো। তার গায়ে লাল রঙের ফ্রকটা। করবী যেটা বানিয়ে দিয়েছিল। বাচ্চাটা কি তবে বুঝে গিয়েছে করবী আজ তাকে ঘুরতে নিবে! হুতুমের দারুণ বুদ্ধি। এতটুকু একটা মেয়ে অথচ তার আই-কিউ লেভেল অসাধারণ। হুতুমের পেছনে আসতে দেখা গেলো বাণীকেও। কী সুন্দর আনন্দ নিয়ে উড়তে উড়তে আসছে! করবী হাসল। তার আনন্দ, দুঃখ ভাগ করার পৃথিবী হয়তো ছোট্টো কিন্তু আফসোস নেই তাতে। মানুষ গুলো যে নিখাঁদ!

হুতুম এসেই জাপটে ধরল করবীকে। কেমন সুন্দর ঝলমলে হেসে শুধালো,
“এই যে বাণীর মা, আইজক্যা আমাগোরে তুমি ঘুরতে নিবা তাই না?”

করবীও বিপরীতে হাসল। বলল, “হুতুম যদি চায় তাহলে নিতেই পারি।”

হুতুম আনন্দে লাফিয়ে উঠল। থেমে নেই বাণীও। কি জানি কি বুঝলো এই দু’টো নিষ্পাপ প্রাণ! কোন আনন্দে তারা হৈ-হুল্লোড় শুরু করল!

হুতুম, বাণীসহ করবী গেল একটি ব্রীজের উপর। তাদের বাসা থেকে খানিক দূরত্বেই ব্রীজটা। বিকেল হলেই রঙবেরঙের সাজে সেজে উঠে এই ব্রীজ। মনেহয় যেন মেলা হচ্ছে। আধাঘন্টার মাঝে উপস্থিত হলো বিন্দুও। আজকেও মেয়েটা গাঢ় সবুজ রঙের একটি জামা পড়েছে। কোঁকড়া চুল গুলো ছেড়ে রাখা। লাল টুকটুকে লিপস্টিক ঠোঁটে ছড়ানো। বিন্দু আসতেই করবীর আনন্দ ভাগ করার উত্তেজনা বাড়ল। প্রায় লোক সমাগম ভুলেই ও জড়িয়ে ধরল বিন্দুকে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
“জানিস বিন্দু, আমি আজকে ভীষণ খুশি।”

বিন্দু হাসল, “এত খুশি ক্যান, আপা? বলো এবার।”

“আমি একটা নতুন টিউশনি পেয়েছি। বেতন, সাড়ে ছয় হাজার টাকা। আমার দুঃখের দিন বোধহয় ফুরিয়ে আসছে, বিন্দু। ফুরিয়ে আসছে।”

করবীর চেয়েও বোধহয় দ্বিগুণ খুশি হলো বিন্দু। প্রায় কিছুটা চেঁচিয়েই উঠল সে। যেন হিমালয় পেয়ে গেছে হাতের মুঠোয়। বিন্দুকে আনন্দে চিৎকার করতে দেখে লাফালো হুতুম ও বাণীও। করবী অবাক চোখে দেখল ওদের। আজকাল পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা অন্যের খুশিতে আনন্দিত হয়! বিন্দুকে না দেখলে সে জানতোই না পৃথিবীতে কেউ কেউ আজও নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে থাকে।

ব্রীজের একটি ফুচকার স্টলে ঢুকল করবী ওরা। এক ঝাঁক তরুণ সেখানে বসে মহা আনন্দে গান বাজনা করছে। মূলত এটা দেখেই হুতুম বায়না জুড়ে ছিল এই দোকানটাতে আসার জন্য। অবশ্য বায়না করার ফলস্বরূপ তার পিঠে একটা কিলও দিল বিন্দু। কিন্তু থেমে নেই হুতুমও। কেমন ঝগড়ুটে মহিলাদের মতন ঝগড়া করল বিন্দুর সাথে! করবী খিলখিল করে হাসল কেবল। এই মেয়ে দু’টো একদমই বনে না। দু’টো যেন দু’টোর শত্রু। অথচ করবী জানে, বিন্দু বুকে নিয়ে না ঘুমালে হুতুমের ঘুম হয় না।

হুতুমের গান-বাজনার প্রতি প্রচুর ঝোঁক। গান গাইতেও পারে মেয়েটা ভীষণ সুন্দর। আর তার নাচের সাথে তো কারো জুড়ি মেলা ভার! এত দারুণ এক্টিভ বাচ্চা সচারাচর দেখাই যায় না। গান-বাজনা পেতেই সে লাফাতে লাফাতে সেখানে চলে গেলো। বিন্দু ও করবী বসল তরুণদের দল থেকে কয়েকটা চেয়ার দূরে। পাল্লা দিয়ে গান, গিটার বাজছে। হুতুমও নাচছে সমান তালে। ব্রীজটা ত্রুটিপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় এখানে গাড়ি-ঘোড়ারও লেশমাত্র চিহ্নটুকুও নেই। হুতুম এবার নাচ ছেড়ে গান ধরল। ভীষণ সুরেলা কণ্ঠ তার! থেমে গেল তরুণদের গিটার, থেমে গেল বাদ্য। সন্ধ্যার সূর্য তখন তার বিদায় ধ্বনিতে মুখরিত। এক ঝাঁক শ্রোতা নির্বাক, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল চাঁদের মতন মেয়েটার দিকে। হুতুমের অপরিপক্ক কণ্ঠ তখন সুর তুলেছে,

“ঐ চাঁদের টিপে মন ভোলেনা মা।
দোলনা দোলে, মন দোলেনা মা।
রাতের চোখে ঘুম যে নামে,
চাঁদের পাশে,মেঘ যে থামে
আমার পাশে নেইতো তুমি মা…
তোমায় ছাড়া ঘুম আসেনা মা
মাগো তোমায় ছাড়া, ঘুম আসেনা মা…..”

ভীড় জমেছে তবে নিস্তব্ধতার। সন্ধ্যার রঙিন আলোয় বুঝা গেলো ভীড়ের মাঝে কারো কারো অশ্রু চিকচিক করছে। হয়তো ওদেরও মায়ের কথা মনে পড়েছে হুতুম কিংবা করবীর মতন! করবী খেয়াল করল বিন্দু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুখে ওড়না চেপে রাখায় কান্নার শব্দরা বন্দি হয়ে গেছে। করবী অবাক হলো। বিন্দুকে সে কখনো কাঁদতে দেখেনি তবে আজ এই সামান্য গানেই কাঁদছে কেন মেয়েটা? করবী প্রায় অবাক হয়েই বিন্দুর কাঁধে হাত রাখল। বিন্দুর যেন হুঁশ হলো। কিছুটা থতমত খেয়ে কান্না থামিয়ে দিল তবে থামল না গা কাঁপানো হেঁচকিটা। করবীর বিস্ময় ভোরা কণ্ঠ,
“এভাবে কাঁদছিস কেন, বিন্দু?”

বিন্দু নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল তবে তেমন সক্ষম হলো বলে মনে হলো না। বরং গা কাঁপানো কণ্ঠে বলল,
“আমার হুতুমটার ভালো হোক, আপা। ভালো হোক।”

এই বিন্দুর গাঢ় কণ্ঠ করবীর বড়ো অচেনা। অপরিচিত। হুতুমের দিকে তাকানো বিন্দুর চোখ দুটোর মাঝে যে অসহায়ত্ব, মায়াটা যেন অন্যরকম, অন্য ধরণের। তবে কেমন ধরণ তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না করবী। তার মাঝেই সকলের আহ্লাদ কুড়িয়ে ছুটে এলো হুতুম। বিন্দুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে বলতে লাগল,
“দেখ বিন্দুবালা, সবাই আমারে কত্তো আদর করছে। সব্বাই আমার ম্যালা প্রশংসা করছে। ওরা আমারে চকলেটও দিছে, বিন্দু।”

বিন্দু কোনো কথা বলল না। ঠাস করে চ ড় বসালো হুতুমের গালে। হুতুম টলমলে চোখে চাইল। চ ড়ের কারণ না জানা করবীরও যেন বিস্ময় ধরছে না শেষে। হুতুমের ঠোঁট উল্টে এলো কান্নারা। অভিমানী হলো স্বর,
“আমারে ক্যান মারলি, বিন্দুবালা? আমি তো তোর কাছে এহন আইসক্রিম চাই নাই।”

করবী মায়া করে হুতুমকে টেনে নেওয়ার আগেই বিন্দু দু’হাতের আঁজলে আঁকড়ে ধরল বাচ্চাটাকে। নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে বলল,
“তুই এত আনন্দ দেহাইস না, হুতুম। মাইনষে বদনজড় দিবো।”

করবী ফ্যালফ্যাল করে কেবল তাকিয়ে রইল। অবুঝ বিন্দু এবং এই বিন্দুর মাঝে বিস্তর তফাত দেখতে পেল সে। এই বিন্দু অন্যরকম। বিধ্বস্ত!

১১.

বিকেলটা অনবদ্য সুন্দর কাটানোর পর নীড়ে ফিরল চঞ্চল প্রাণ গুলো। বাসার গেইটের সামনে আসতেই দেখা মিলল হীরণের। হুতুম তখন আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত। হীরণকে দেখেই থেমে গেল করবীর পা। কিন্তু উৎফুল্ল দেখালো বিন্দুকে। সে-ই আগ বাড়িয়ে গিয়ে ডাকল,

“হীরণ ভাই যে! তুমি এহানে? আমাগো লাইগ্যা দাঁড়াইছো?”

হীরণ সিগারেট ছুঁড়ে মারল দূরে। হুতুমকে কাছে টেনে নিল এমন ভাবে যেন সে এখানে হুতুম ছাড়া কাউকে দেখেয়নি। হুতুমকে টেনে নিয়ে গাল টেনে দিল। চুল গুলো গুছিয়ে দিল এক ধ্যানে। আদুরে স্বরে বলল,
“কিরে? তুই রাইতের বেলা বাইরে কী করছ?”

হুতুম আইসক্রিম খেতে খেতেই উত্তর দিল, “আমি কী একলা গেছি, মাস্তান? আমি দেহো না কাগো লগে গেছি।”

“গেছোছ তো কাইল্যা বিন্দুর লগে। তোরে না কইছি কাইল্যা বিন্দুর লগে মিশবি না। নাহয় তুইও কাইল্যা হইয়া যাবি।”

হীরণের কথায়ও সরল সোজা বিন্দুর বোকাসোকা হাসিটা বন্ধ হলো না কিন্তু মুখ অন্ধকার করল করবী,
“ছোটো মানুষকে এসব বলবেন না। এসব কেমন ধরণের কথা!”

হীরণ এবার চোখ উল্টে তাকাল করবীর দিকে। লাল লাল তার চোখ যুগল। হীরণ বাঁকা হেসে বলল,
“ছোটো মানুষকে তাহলে কিসব বলে? আমি তো বুঝিনা। বুঝাও।”

করবী মুখ ফিরিয়ে নিল দ্রুত। লোকটার চোখের দিকে তাকানো দায়। কেমন ভয় ভয় লাগে যেন! সে মুখ ঘুরিয়েই হুতুমকে ডাকল,
“আসো হুতুম, বাসায় যাই। রাত হয়েছে।”

“এতক্ষণে রাত হয়েছে মনে হলো? সেদিন দেখলাম সিএনজি করে এলাকায় ঢুকছো অন্ধকারে। তা, তখন রাত ছিলো না বুঝি?”

হীরণের বাঁকা নজর, বাঁকা কথায় ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল করবীর শরীর জুড়ে। লোকটা কী তবে জেনে ফেলল! নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল করবী। কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু ঘামকে উপেক্ষা করে বলল,
“হ্যাঁ ছিল। আমার রোজগার করে খেতে হয়। সেজন্য যদি রাত করেও ফিরতে হয় তাহলেও আমার কিছু করার নেই। আপনাদের মতন তো বাপের অঢেল টাকা নেই যে এলাকা এলাকা জুড়ে ঘুরে বখাটেপনা করলেই পেট ভরবে। আমাদের পেট চালানোর জন্য বাবার রোজগার নেই। তাই আরাম আয়েস করে ঘরে থাকতে পারিনা।”

“বিয়ে করে নিলেই তো পারো, রুবী। বিয়ে করো আমাকে। কথা দিলাম, তুমি বিয়ে করলে আমি বখাটে থেকে সভ্য হয়ে যাব। তুমি আসলে আমি সব ছেড়ে দিব। আমাকে ভালো করে নিলেই তো পারো, রুবী!”

শেষের কথাটায় কেমন আবদারের সুর ছিল যেন! কেমন আকুতি মাখানো সেই স্বর! কিন্তু ছুঁতে পারল না করবীর হৃদয় দুয়ার। বরং সে এসব আবেগ উপেক্ষা করেই বাড়ির ভেতর চলে গেল। একমাত্র এই ছেলেটার জন্য এলাকার মানুষ তাকে বাঁকা চোখে দেখে। তার রূপ নিয়ে শ্লেষ কটাক্ষের প্রবণতা বাড়ে। লোকটাকে আশকারা দিলেই মাথায় উঠবে।

করবী উপেক্ষা করলেও একজন আক্ষেপ ভোরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল হীরণের লাল চক্ষু যুগলে। এই কথা গুলো তার জন্য হলে কতই না ভালো হতো! আবার নিজের ভাবনায় মনে মনে হাসলো বিন্দু। কী সব আকাশকুসুম ভাবছে সে! তা আদৌও হয় না-কি? তেলে জলে কী কখনো মিশ খায়? আপা হলো বেজায় সুন্দরী অথচ সে কয়লা। সেজন্য আপা প্রেম পেলে সে লাঞ্ছনা পাবে সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু হীরণের লাল চোখ গুলো দেখে বড়ো মায়া হলো ওর। একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
”তোমার কী শইলড্যা ভালো না, হীরণ ভাই?”

হীরণ করবীর যাওয়ার পথ থেকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল বিন্দুর পানে। কিছুটা মুখ ঝামটি দিয়ে বলল,
“না আমার শইলড্যা ভালা না, কালা। সর তুই। সবুজ রঙে ক্ষেত সেজে বসে আছোছ। কোনো কৃষক দেখলে পরে চাষ করতে চলে আসবে। দূর হ চোখের সামনে থেকে।”

বিন্দু সরল দু-পা। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ”তুমি হুতুম, আপার সাথে কত সুন্দর কইরা কথা কও। আমার লগে এমন করো ক্যান?”

“কারণ তুই আপাও না, হুতুমও না। তুই ভুতুম। সর এখান থেকে। তোরে দেখলেই আমার সাত পুরুষের নাম আমি ভুলে যাই। একটা মানুষের এমন রঙের জামা কেমনে পরতে মন চায় আমারে বুঝা। খাচ্চরের মতন পছন্দ।”

“আম্মা কয় আমারে এই রঙে ভালা মানায়।”

“তোর আম্মার চোখ না চুলা গিয়া জিজ্ঞেস কর। খাচ্চরের বংশ। হুতুমটারেও খাচ্চর বানায় ফেলবি তোরা।”

হুতুম আইসক্রিম রেখে চোখ গোল গোল করে তাকাল। রাগী কণ্ঠে বলল,
“বিন্দুবালারে কিছু কইবা না একদম। ও অনেক সুন্দর।”

হীরণ মুখ বাঁকাল, “হ, একবারে আসমানের পরী তোর বিন্দুবালা। কালা পরী।”

হীরণের তাচ্ছিল্য না বুঝেই হয়তো খুশি হলো বিন্দু। বীণা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এই কটাক্ষ মেনে নিল না। উড়তে উড়তে বলল, “গা ধা হীরণ। গা ধী বিন্দু।”

রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। করবী বই পড়ছিলো। তার রাতের নিত্যদিনের রুটিনই এটা। আজও ব্যাতিক্রম হয়নি। তবে কিছুক্ষণ আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই সে বারান্দায় গিয়ে বসলো। পুরো এলাকা তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। শুনশান নীরবতায় খা খা করছে চারদিক। করবীর রাত অপছন্দ তাও এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত! কিন্তু অপছন্দের জিনিসও আজকাল অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সয়ে গিয়েছে মস্তিষ্কে। দূর হতে দূর অব্দি, মৃত বিল্ডিং গুলো ছাড়া কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছে না। জোছনা নেই এক ফোঁটা। আকাশের কী মন খারাপ?

এই নীরবতা ভেদ করেই হৈচৈ ভেসে এলো। মারধোরের শব্দও শোনা গেল ভীষণ। বিন্দুর কান্নার শব্দ আসছে। আজকেও কী মেয়েটাকে মারছে ওর মা? করবী কান খাড়া করল। হ্যাঁ, বিন্দুর কান্নার শব্দের সাথে মহিলার কণ্ঠও পাওয়া যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাত হওয়ায় সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মহিলা ভীষণ বাজে ভাষায় গালাগালিও করছেন। করবী মনযোগ দিতেই শুনল মহিলার গলা,

“মা* আমি মরি খাইট্টা আর তুই ফূর্তি করছ? মাইনষেরে টেকা দিয়া বেড়াছ। তোর বাপ একটা দশ বছর ধইরা বিছনাতে পইড়্যা আছে আর তুই টেকা কামাইয়া মাইনষের হাতে দেছ। আরে কালী তোর টেকা না দিলেও হেই মাইয়ার জীবন চলবো। রূপ দেইখ্যা নাগররা এমনেই আইবো। তোরে কে নিবো? কে নিবো ক? নাই রূপ নাই কিছু। কলঙ্ক আছে খালি…..”

মহিলা বোধহয় আরও অনেক কিছু বললেন কিন্তু শুনলো না করবী। কান চেপে ধরল সে। ছিঃ তার জন্য মেয়েটা মার খাচ্ছে! তাকে সাহায্য করার অপরাধে? করবী নিজের মুখ চেপে ধরল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে মহিলার কথায়। সে সুন্দর বলে তার কোনো সমস্যা নেই জীবনে এটা মানুষ কীভাবে ভেবে নেয়? সুন্দর বলেই কী সে পুরুষদের মাথা ঘুরিয়ে জীবন কাটায়? তার এত কষ্টের মূল্য কই তাহলে? সবাই তো ভাবেই সে রূপ দেখিয়ে বিশ্ব কিনে ফেলেছে!
সুন্দর হওয়ার এই এক অপরাধ। মানুষ ভাবে সুন্দরদের জীবনে কোনো দুঃখই নেই! অথচ মানুষ জানেনা, সুন্দর হওয়াটাই কারো কারো জন্য সবচেয়ে বড়ো দুঃখের। যে মেয়েটার মাথার উপরে বড়ো ভাইয়ের ছায়া নেই, বাবা একজন স্ট্রেচারের সাহায্য ছাড়া এক কদম আগাতে পারে না, সেই মেয়ে জানে সুন্দর হওয়ার অপরাধে কত শাস্তি ভোগ করতে হয় তাকে প্রতিনিয়ত।

এসব ভাবনার মাঝেই করবী অন্ধকার রুমে প্রবেশ করল ওর বাবা। অন্ধকার হাতড়ে মেয়ের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই টাকা গুলো বিন্দুকে দিয়ে দিস। মেয়েটা আমাদের থেকে বেশি অসহায়।”

করবী হতভম্ব। বাবা তো টাকার কথা জানতেন না! তবে?

#চলবে…….

#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা

সপ্তম পর্বঃ

যামিনীর অম্বরে আঁধার তখন ঘনীভূত। তৈয়ব হোসেন বসে আছেন মেয়ের পাশে। একমাত্র সম্বল বাবাটির বুকেই করবীর অসহায়ত্বরা ঠাঁই পেল। তৈয়ব হোসেন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বরাবরই তিনি গম্ভীর প্রকৃতির। মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বন্ধু হতে পারেন না। বাবা হয়েই কথা বলেন। তবে মেয়েকে সর্বোচ্চ ভাবে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করেন যেন মেয়ের এই বিশাল পৃথিবীতে একা না লাগে।

করবী বাবার বুকে মাথা রেখেই প্রশ্ন করল, “তুমি টাকার কথা কীভাবে জানলে, আব্বু?”

তৈয়ব হোসেন হাসলেন। যুবক কালে তিনি ছিলেন প্রচন্ড বুদ্ধিমান লোক। লোকে ভালো-মন্দের বিচার বিশ্লেষণ করতে কতবার তার কাছে আসতো! অথচ তিনি বুঝবে না তার অগোচরে তার সন্তানই কী করছে। তা কী হয়?

“জানলাম কোনো এক ভাবে। যখন বিন্দুর সাথে দুঃখ করছিলিস তুই, তখনই শুনলাম। বাবাকে একটি বার জানালি না কেন তোর যে এত গুলো টাকা হারিয়েছে?”

করবী চুপ থাকে। তার বাবা বিচক্ষণ। মেয়ে কেন টাকার কথা জানায়নি সেটা তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন। তাই নতুন করে বাবাকে সে আর বলল না কিছু।
তৈয়ব হোসেন এবার তাড়া দিলেন,
“এখনই গিয়ে মেয়েটার টাকা গুলো দিয়ে আয়, মা। আমাদের বাপ-মেয়ের সংসার, দু’বেলা না খেলেও কিছু হবে না। আর ওদের কত গুলো পেট। আমাদের চেয়ে ওদের সমস্যা বেশি।”

করবী বাবার হাতের টাকার খামটা নিল। শুধালো, “এত টাকা তোমার কাছে কীভাবে এলো, বাবা?”

“সেই উত্তরের এখন তেমন কোনো প্রয়োজন যে নেই, মা। তুই টাকাটা দিয়ে আয়। মেয়েটা নাহয় আরও মার খাবে।”

করবীর মনে খচখচ রইল কিন্তু সে আর বসে থাকল না। খামটা নিয়েই ছুটল বিন্দুদের উদ্দেশ্যে। তৈয়ব হোসেন অন্ধকারে মেয়ের চলে যাওয়া অবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষ। তার কী সুন্দর পরীর মতন মেয়ে! এত সুন্দর সন্তানের চোখের নিচের চিন্তার দাগ গুলো তিনি বুঝবেন না তা কী করে হয়? বাবাটা ঘরে থাকে বলে বুদ্ধিও কী লোপ পেয়েছে নাকি যে মেয়ের আড়ালের কথা বুঝবেন না? দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো রজনীর ক্যানভাস। তৈয়ব হোসেন চোখ বন্ধ করলেন। মেয়েটা অবিকল মায়ের মতন হয়েছে। ওর মায়েরও তো এমন সুন্দর রূপ ছিল! স্ত্রীর কথা মনে পড়তেই ফতুয়ার বুকের পকেট থেকে তিনি স্ত্রীর ছবি বের করলেন। আফসোস করে বললেন,

“মিনু, তোমার মেয়েটা তোমার মতনই সুন্দর হয়েছে, জানো? তুমি থাকলে আমরা বাবা-মেয়ে একটা কূল পেতাম। সংসারটা এমন ছন্নছাড়া হতো না।”

অথচ ছবির মিনু জবাব দেন না। কিন্তু তার চোখ দু’টো যেন হাসছে। অসম্ভব সুন্দর নারীদের স্তব্ধ মুখের দিকে তাকালেও মনেহয় কত কথা যেন বলছে সে মুখ, সে চোখ!

সিঁড়ি ডিঙিয়েই ভীরু পায়ে ছাঁদের দরজায় দাঁড়াল করবী। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝার জন্যই এই বিরতি নেওয়া। আলোহীন রাত হলোও মানুষ অবয়ব দেখা যায় বিনাবাধায়। আর সে জন্যই চিলেকোঠার ঘরটার সামনে যে একটা ছিমছাম মেয়েলি শরীর দাঁড়িয়ে আছে তা বুঝতেও বাকি রইল না করবীর। চিলেকোঠার দরজা বন্ধ। হয়তো বিন্দুকে শান্তি দেওয়া হয়েছে সারারাত বাহিরে কাটানোর। এসব নতুন না। তাছাড়া গ্রীষ্মকালীন রাত অবলীলায় কাটিয়ে দেওয়া যায় খোলা আকাশের নিচে বসে। এতে আরাম বোধ হয়। কিন্তু শীতকালেই এই ব্যাপারটা বড়ো অমানবিক হয়ে যায়।
করবী ধীর পায়ে বিন্দুর কাছে পৌঁছালো। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

“আমাদের বাসায় গেলেও পারতিস। দু’জনে এক রাত নাহয় গল্প করেই কাটাতাম।”

এই মাঝ রাতে এমন হিমশীতল মেয়েলি কণ্ঠে বিন্দুর চমকে যাওয়া কিংবা ভয় পাওয়া উচিত ছিল। অথচ এর একটাও তার মাঝে দেখা গেল না। বরং তার বিনিময়ে পাওয়া গেল বেশ ঝলমলে কণ্ঠ,

“আমি জানতাম তুমি যে এইহানে আইবা। তাই কষ্ট কইরা আর নিচে যাই নাই-কা।”

করবী বিন্দুর কথায় অবাক হলো কিঞ্চিৎ, “তুই কীভাবে জানলি আমি যে আসবো?”

এবারের প্রশ্নে একশ আশি ডিগ্রি ব্যাসার্ধে ঘাড় ঘুরালো বিন্দু। বলল,

“প্রতিবার আমি মাইর খাওয়ার পর তোমারে দেহি ছাঁদের দরজায় দাঁড়ায় থাহো কেমন অসহায়ের মতন। মাঝে মাঝে তো আমার হাসি পায়। ভাবি, মাইর আমি খাইলাম না তুমি!”

বিন্দু কথা থামিয়েই হাসলো নিঃশব্দে। তার হাসির সঙ্গী হলো করবীও। ছোটো চ ড় দিল পিঠে। মুখ ঘুরিয়ে বলল,

“রসিকতা করিস না। ব্যাথা বেশি পেয়েছিস?”

“আরে আপা, এ গুলা কোনো ব্যাপার হইলো? আমার তো এসব গায়েই লাগে না।”

বিন্দু বেশ গা ঝেরেই উত্তরটি দিল কিন্তু করবী জানে বিন্দু মিথ্যা কথা বলছে। বিন্দুর চিৎকারই বলে দিয়েছিল সে কতটা ব্যাথা পেয়েছিল তখন। তবুও, পরিস্থিতি ঘুরানোর বিরাট ক্ষমতা মেয়েটার মাঝে আছে।
করবী এবার তার হাতের খামটা এগিয়ে দিল,
“নে টাকা গুলো। খালাকে দিয়ে দিস। শুধু শুধু কত গুলো মার খেলি!”

বিন্দু এবার দু’কদম পিছে হাঁটলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

“ছিঃ ছিঃ আল্লাহ্! আপা, তুমি টেকা দিতে আইছো ক্যান?”

“টাকাটা তোদের প্রয়োজন, বিন্দু। নে টাকা গুলো। আমাদের সমস্যা সামলে নিয়েছি আমরা। নে, ধর।”

বিন্দু হাত বাড়াল না। বরং ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,

“আপা, আমার আম্মার কথায় কষ্ট পাইও না গো। আমার আম্মা অভাবের তাড়নায় এমন করে। নাহয় হেয় এত খারাপও না।”

মা’কে ভালো প্রমাণ করার কী আপ্রাণ চেষ্টা মেয়েটার চোখে-মুখে। করবী এগিয়ে এলো তাই। বিন্দুর হাতে জোর করে টাকার খামটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“খালাকে আমি মোটেও খারাপ ভাবছি না। মানুষ অতিরিক্ত চিন্তায় থাকলে কখনো কখনো এমন রেগে যায়। আমি বুঝি সেসব। তুই টাকাটা নিয়ে নে। আমাদের তো দরকারের সময় দিয়েছিলিস। এখন দরকার শেষ। তুই খালাকে এই টাকা গুলো ফেরত দিস।”

“আপা, তুমি আমার আম্মারে অনেক খারাপ ভাবতাছো আমি জানি। কিন্তু আমার আম্মা এত খারাপ না। হেয় আছিলো বিশাল জমিদারের মাইয়্যা। আইজ ভাইগ্য দোষে এইহানে আনছে তারে তার ভাইগ্য। হেই মানুষটা মাঝে মাঝে ক্লান্ত হইয়া এমন করে। তুমি কষ্ট নিও না গো। তার হইয়া আমি ক্ষমা চাইতাছি।”

কথাটা বলে সত্যি সত্যিই ক্ষমা চাইল বিন্দু। তাও হাত জোর করে। করবী তাই কিছুটা রেগে গেল। ধমকে বলল,

“এসব কী করছিস, বিন্দু? চ ড় লাগাবো একটা। খালাম্মা ভালো মানুষ আমি বুঝি। তার আচরণে আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। তুই এসব করে আমাকে ছোটো করিস না।”

করবীর ধমকে বিন্দু হাসল। হেসে জড়িয়ে ধরল মানুষটাকে। আহ্লাদী হলো কিঞ্চিৎ,

“তাইলে টেকাটা তুমি নিজের কাছে রাহো। এহন আমাগো সত্যি কইরাই এই টেকার দরকার নাই। যদি কোনো দিন লাগে তোমার কাছ থেইক্যা ফেরত নিমু। আমাগো সাহায্য নেওয়া-দেওয়া কী এত সহজে শেষ হইবো কও? তোমারে আমার কসম, টেকাটা রাহো, আপা। নাহয় আমি বুঝমু তুমি ম্যালা কষ্ট পাইছো দেইখ্যাই টেকাটা দিতাছো।”

করবীর পথ বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে না পেরে টাকাটা আবার নিজের কাছেই ফেরত নিল। বিন্দু মেয়েটা ভীষণ ভালো। বর্তমান পৃথিবীতে অহরহ এত ভালো মনের মানুষ দেখা যায় না। বিলুপ্ত প্রায় বলা যায়। ভালো মানুষ হলেই তো যন্ত্রণা পেতে হয়। তাই আজকাল সবাই ভালো মানুষ হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চলছে। সবারই তো সুখে থাকার অধিকার আছে। সুখে থাকতে হলে যদি খারাপ মানুষও হতে হয়, তাতেও আজকাল যে কারো আপত্তি নেই।

তারপর রাত বাড়ল। করবী যেতে চায়নি বিন্দুকে একা রেখে। বিন্দুর সাথেই থাকত চাইলো। কিন্তু নাকচ করল বিন্দু। সে করবীকে জোর করে নিচে পাঠালো। এবং বলল,

“আমি এইহানে একা থাহুমও না, আপা। আমার এই পৃথিবীতে সঙ্গী হয়তো কম কিন্তু একবারে শূন্য না।”

করবী সেটারও প্রমাণ পেলো। যখনই সে দরজা পেরুলো ঘাড় ঘুরাতেই দেখলো ছোটো ছোটো পায়ে একটা বাচ্চা এগিয়ে যাচ্ছে বিন্দুর কাছে। কেমন যত্ন করে বিন্দুর মারের জায়গা গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে আলগোছে! সারাদিন ঝগড়া করা দু’টো মানুষ কেমন দু’জন দু’জনের ব্যাথা ভাগ করে নিচ্ছে এই মধ্য রাতে! করবী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়ে গুলোর অনেক ভালো হোক— প্রার্থনাটুকু করেই সে নিজের বাসার দিকে পা বাড়াল।

১২.

ভার্সিটির চত্বরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে করবী। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল মাত্র এগারোটা। একটা ক্লাস করার জন্য কতদূর পথ হেঁটে আসল! অথচ একটা ক্লাস হবে জানলে সে কখনোই আসতো না। অবশ্য নোটিশ তো দিয়েছিলই কিন্তু তার স্মার্ট ফোন না থাকায় সে এটা সম্পর্কে অবগত ছিল না। তার উপর তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবও নেই যে এই ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়ে তার এত বড়ো উপকারটা করবে।

বেলা বাড়ায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খিদেটাও। চত্বরের খুব দূরে দূরে বসে আছে ছাত্র-ছাত্রীরা। একেকজন একেক কাজে মশগুল। করবী ব্যাগে হাত দিল। আসার সময় আমেনা খালা মানে বিন্দুর মা তাকে এই টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলে ছিলেন,

“ধরো, তোমার পছন্দের খাবার রান্না করছিলাম। তোমার তো বাহির হওয়ার সময় হইয়া গেছে তাই টিফিন বাক্সতে কইরা দিয়া দিলাম। সময় কইরা খাইও।”

করবী অবশ্য কিছুটা অবাকও হয়েছিল মহিলার আচরণে। ভদ্র মহিলা এমনই। হুট করে রেগে যান। আবার এত মায়া দেখান মাঝে মাঝে! করবীর তো কখনো সখনো মনে হয় এটা তার নিজের মা বুঝি!
সে ধীর হাতে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বের করল। বেশ মাঝারি আকারের টিফিন বক্সটি খুলতেই দেখলো সেখানে ঠাঁসা তার পছন্দের বৌয়্যা ভাত এবং শুঁটকি মাছের ভর্তা, বেগুন ভর্তা সহ তিন চার পদের ভর্তা। নিজের এত প্রিয় খাবারটা দেখে করবীর তর সইলো না। হাত ধুইয়েই এক লোকমা চালান করে দিলো মুখে। সুস্বাদু খাবারের ছোঁয়া পেতেই চোখ দু’টো আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল। প্রথম লোকমাটা গিলেই চোখ মেলতেই দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পার্থিব ও তিমির। চোখ মেলেই তাদের দেখে করবী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। থতমত খেলো নিমিষেই। জিজ্ঞেস করল,

“আপনারা!”

পার্থিব এবার হাসলো। হেসেই করবী থেকে কিছুটা দূরত্বে বসলো। টেনে বসালো তিমিরকেও। তিমিরের চোখের চাহনি শান্ত, শীতল।

“এত মজা করো একা একা খাচ্ছো, করবী! আমাদেরও নিলে পারো।”

তার খাওয়ার দৃশ্য যে দেখেছে ওরা তা ভালো করেই বুঝতে পারল করবী। আমতা-আমতা করে বলল,

“হ্যাঁ, নিন না। শেয়ার করছি। আসুন।”

পার্থিব আর অপেক্ষা করল না। হাত ধুয়েই এক লোকমা মুখে তুলে নিল। সাথে জোর করে তিমিরের মুখে এক লোকমা চালান করল। আমেনা খালার রান্নার হাত ভীষণ ভালো। তাই খাবারটি মুখে দিতেই প্রাণ জুড়িয়ে এলো দুজনেরই। পার্থিব ভীষণ আগ্রহী হলো। এটা ওটা জিজ্ঞেস করা আরম্ব করল এই নতুন খাবারটির বিষয়ে। সাথে তিমিরের টিফিন বক্সটিও খুলল সে নিজে। তিনজনের খাবার ভাগাভাগি হলো নিঃসংকোচে। পার্থিব বেশ বন্ধুসুলভ হওয়ায় করবীর সংশয় কেটে গেলো নিমিষেই। ডুবে গেলো দু’জন ভীষণ আড্ডায়।
তিমির এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল করবীর দিকে। অনেক গুলো বছর আগে ঠিক এ জায়গাতেই তিমিরের গল্প ছিল অন্যরকম। অথচ আজ সে গল্পের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। অথচ সেই গল্পের প্রধান চরিত্রের নারী অবয়বের সাথে আজকের নারী অবয়বটির ভীষণ মিল। তিমির যেন এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই বসলো, তার গল্পের সমাপ্তি হয়েছে আজ বহুদিন। এবং সেই ভুল থেকে ভুলো মন করে বসল একটা বিব্রতকর কাজ। করবীর ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা খাবার টুকু সে মুছে দিল নিজের হাতে। এবং ঠিক সেই মুহুর্তেই থেমে গেল আড্ডা। করবী তো বিস্মিত হলো সাথে বাদ গেল না পার্থিবও। বন্ধুর দিকে সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। হুশ হলো তিমিরের। সে বোকার মতন কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু সে কাউকে বুঝতে দিল না। বরং এমন ভাব করল যেন এটা স্বাভাবিক, প্রায় সময়ই সে এই কাজটা করে।

লজ্জায় নুইয়ে এলো করবী। সুন্দর গাল গুলোতে দেখা দিল গোলাপী আভা। মনে হলো যেন গোলাপ ফুলের পাপড়ি! ঠিক সেই মুহুর্তে, আবেগ-অনুভূতির এলোমেলো সময়টাতেই করবীর ফোনে ম্যাসেজ এলো। করবী নিচু অক্ষি যুগল ফোনের দিকে দিতেই তার লজ্জা রাঙা মুখ নিমিষেই মলিন হয়ে গেলো। গোলাপী প্রেম কেটে ধরা দিল ভয়। ভীত চোখে চারপাশ তাকাতেই খেয়াল করল দূরে বসে রক্ত লাল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে হীরণ। অথচ ঠোঁটে বাঁকা হাসি।

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে