বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
428

#বুকপকেটের_বিরহিণী
অন্তিম পর্ব:

(৪৮)

বহুদিন পর আসমানে জোছনা উঁকি দিয়েছে। পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে এক মুঠো জোছনা মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছে। শীতকালে সচারাচর এমন মুক্তমনা জোছনা দেখা যায় না। কুয়াশায় ঢেকে থাকে আসমান, জমিন সব।
বিদিশার গাড়ি জোছনা গলিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে কেবল। সারা বাড়িময় লাল-নীল বাতি জ্বলছে। রাত গভীর হলেও তেমন বুঝার জো নেই রঙিন বাতির দাপটে। গাড়ির শব্দ পেতেই জামাল ভূঁইয়া গেইটের দিকটায় এলেন। সুন্দর, নিখুঁত একটি হাসি তার ঠোঁট জুড়ে ঝুলছে। বিদিশা হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে বের হলো। সামান্য শাড়ি এমন শীতে তাকে নাজেহাল করে দিবে সেটাই তো স্বাভাবিক! জামাল ভূঁইয়া মেয়ের কাছে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কেমন হলো অনুষ্ঠান? কবিতা দর্শকদের মন ছুঁয়েছে তো? যা শীত! ঠান্ডায় গলা বসে যায়নি?’

বিদিশা বাবার উৎসুক নয়নের দিকে তাকিয়ে হাসল। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। মৃদু স্বরে বলল, ‘ভালো হয়েছে, বাবা।’

জামাল ভূঁইয়া নিজের গায়ে জড়িয়ে রাখা সাদা রঙের শালটা খুলে অভিজ্ঞ হাতে মেয়ের শরীরে জড়িয়ে দিলেন। বাবার বুকের সবটুকু মায়া দিয়ে মেয়েকে আগলে নিলেন বুকে। হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, ‘এবার ঘরে চলো।’

বিদিশা ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখে তার মা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে সোফায়। মেয়েকে দেখে তার মুখ-চোখ আরও অন্ধকার হলো। চাপা স্বরে বলল, ‘কাল যে তোমার বিয়ে তা মনে আছে?’

‘তুমি এ অব্দি আঠারোটা কল দিয়ে সেটা এমন ভাবে মনে করিয়ে রেখেছ যে চাইলেই ভুলতে পারব না।’

মেয়ের হেঁয়ালি পছন্দ হলো না মায়ের। তার চোখে-মুখে অসন্তুষ্টি খেলে গেল, ‘তুমি নাকি অনুষ্ঠান থেকে ও বাড়িতে গিয়েছিলে?’

মায়ের ও বাড়ি কথাটার ইঙ্গিত বুঝেও বিদিশা অবুঝের মতন ভান করে বলল, ‘কোন বাড়ি?’

‘তোমার প্রাক্তন শ্বশুর বাড়ি।’
বেশ বিরক্তি নিয়েই বলল কথাটা। বিদিশা অকপটে স্বীকার করল, ‘গিয়েছিলাম।’

‘তোমার বিয়ে আগামীকাল। যদি এ কথাটা জানতে পারে কেউ, কেমন হবে?’

‘কেমন হবে? কোথাও যাওয়া কী পাপ?’

‘ও বাড়িতে তোমাকে যেতে না করেছিলাম।’

‘সে তো তুমি সাত বছর আগে ও বাড়ি থেকে আমাকে বের হয়ে আসতেও না করেছিলে, মা। কিছু কী আটকে আছে তোমার বারণে?’

কথা বলার যুক্তিতে যেন ঝিমিয়ে গেল মায়ের অন্তর। মেয়ে যে মুখের উপর এমন কথা বলবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। অবস্থা বেগতিক দেখে জামাল ভূঁইয়া নিজের স্ত্রীকে ধমকালেন, ‘যাও তো তুমি। ঘরে যাও। মেয়েটাকে এসব কেন বলছ?’

‘আমি কী ওর খারাপ চাই? সাহেল যদি ওর এই পুরোনো শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার কথা জানতে পারে কতটা কষ্ট পাবে বলো তো?’

বিদিশা নির্লিপ্ত স্বরে বলল, ‘সাহেল আমার সাথেই ছিল এতক্ষণ। ওর সাথেই গিয়েছিলাম ওবাড়ি। আর যাই হোক সাহেল অমানুষ না। অমন বৃদ্ধ একটা মানুষের অসুবিধা শুনেও একমাত্র আমার প্রাক্তন শাশুড়ি বলে ও যাবে না তা কী কখনো সম্ভব? সাহেল তো মানুষ, মা। ভালো মানুষ।’

কথাটুকু শেষ করেই নিজের রুমে চলে যায় বিদিশা। মায়ের মন কোমল হয়ে আসে। যতই হোক, সে যে মা। সন্তান একবার যেই আগুনে পুড়েছে, সে-তো সন্তানকে আবার সেই আগুনে ঠেলে দিতে পারে না। গত সাত বছর আগেই যেই সম্পর্কের ইতি টানা হয়েছিল হাতে-কলমে সেই সম্পর্ক আজও জিইয়ে রেখে কী লাভ? মেয়েটা এখন কত শক্ত শক্ত কথা বলল? অথচ আজও নিজের প্রাক্তন শাশুড়ির বিপদ শুনলে ছুটে যায়। ঐ একা নারীটির খোঁজখবর নেয়। কিন্তু এতে তার মন সায় দেয় না। এতবছর পর নিজের ননাসের ছেলের সাথে বিয়ের আয়োজন হয়েছে। যদি বিপদ হয় কোনো?

রাত বাড়ে পাল্লা দিয়ে। সাথে বিদিশার ফোনের নোটিফিকেশনের পাল্লা ভারি হয়। এই মাঝ রাতে গোসল সেরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। ফোনের স্ক্রিন অন করতেই দেখে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার গাঁয়ের হলুদের ছবি। সাথে কনফেশন,

❝এই যে বিদিশার নেশা, শেষমেশ ও পথে থাকা পুরোনোর কাছেই বাঁধা পড়লেন। পৃথিবীতে এমন অলৌকিক ঘটনাও ঘটে? যে যাকে ভালোবাসে, সে তাকে পেয়ে গেলে কত সুন্দর ইতিহাসই না হয়! বিদিশার নেশা, ঠিক কতখানি প্রার্থনা করেছিলাম বলে এত গুলো বছর পরেও আপনাকে পেলাম ভাবতে পারছেন?

ইতি
ও পথে থাকা পুরোনো।❞

কনফেশনটা দেখে আপনমনে হাসে বিদিশা। সাহেল ভাই যে তাকে পছন্দ করে সেটা সে বুঝতে পারত। কিন্তু তার মন কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে গিয়ে একজন মানুষে যে আটকে গিয়েছিল তা আর ফেরানো সম্ভব হয়নি। যখন ফিরলো তখন বড্ডো দেরি হয়ে গিয়েছে। তার সংসার জীবনের তিন বছর কেটে গিয়েছিল। তবুও সাহেল ভাই হাল ছাড়েননি। ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল নিজের অনুভূতিতে। তাই তো সংসার করবে না বলেও আবার এত বছর পর সংসার করার লোভ হলো। একবার তো অ-ভালোবাসা পুরুষকে ভালোবেসে দেখেছে, এবার নাহয় যে ভালোবাসতে জানে তাকে একবার ভালোবাসলো।

বাহিরের বাতাসের সাথে নরম কুয়াশা এসে ছুঁয়ে যায় বিদিশার শরীর। ফোনের স্ক্রিন ঘাটতে ঘাটতে আঙুল থেমে যায় একটি প্রোফাইলে। সাদা শার্টে আজও মানুষটাকে বড়ো সুন্দর লাগে! সব ঠিক থাকলে এই মানুষটার সাথেই তো তার কত যুগের সংসার হতো। অথচ……

এই যে অথচ বলার পর আরও কত কথা না বলা থেকে যায় প্রত্যেকের জীবনে। যে কথা বলা হয় না আর। কেবল জীবনের এক কোণায় একটি আফসোস ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে। ধূলো পড়ে যায় আফসোসে, তবুও মুছে না। ওরকম একটি মানুষকে বুকপকেটে রেখেই জীবনের গল্পরা বদলায়। পথ ধরে অন্য সুখের ঠিকানায়।

(৪৯)

সিলেট শহরেও শীত গুরুতর। চাঁদ দেখার জো নেই। কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে নরম চাঁদ। চিকন ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে খুব মনোযোগ নিয়ে একটি পুরোনো কাগজ বের করলেন একজন নারী। যার চুলে পাঁক ধরেছে, চোখে পড়েছে ছানি।
পুরোনো কাগজটা বের করেই কতক্ষণ বুকে চেপে রাখলেন। নোনা জলে ভেসে গেল তার চোখ। তারপর হারিকেনের আলো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে কাগজটা খুললেন। এই পুরোনো কাগজটা তার মেয়ের লিখা প্রথম এবং শেষ চিঠি যে! তাই কত যত্ন করেই না দু’হাতের আজলে রাখলেন। মুখস্থ চিঠিটা আবার নতুন করে পড়লেন,

“মা,
প্রিয় বলব না অপ্রিয় বুঝতে না পেরে কোনো সম্বোধন দিলাম না। কিন্তু আমার বড়ো সাধ ছিল বুকে, একবার মা বলে ডাকার। সেই সাধ পূরণ করলাম চিঠিতে মা লিখে। বাঁচব আর কিছু ঘন্টা, সাধ পূরণ না করে যেতে মন চায় না যে! মা, আমি তোমার মেয়ে। যাকে তুমি ফেলে গিয়েছিলে হিংস্র বাস্তবতার মুখে, আমি সে-ই মেয়ে, মা। আমি চিঠি লিখছি জেল থেকে। আজ ভোর সাড়ে চারটায় আমার ফাঁ সি। তাই আমার শেষ ইচ্ছে উনারা পূরণ করবে বিধায় আমি তোমাকে চিঠি লিখছি। শুরুতে তো তুমি ছিলে, শেষেও না-হয় থাকলে। জানো, লোকে ভাববে আমার মৃত্যু হয়েছে ফাঁ সিতে, মোটা রশিটা গলায় দৈত্যর মতন চেপে ধরবে তারপর আমার প্রাণপাখি এই দেহ ছেড়ে চলে যাবে। অথচ এটা যে বাহ্যিক মৃত্যু। আমি তো মরে গিয়েছিলাম সেদিনই, যেদিন তুমি আমাকে এই নষ্ট জীবন উপহার দিয়ে চলে গিয়েছিলে নিজের সুখের খোঁজে।
জানো মা, আব্বু তোমাকে কী ভীষণ ভালোবাসতো! কখনো ভুল করেও তোমার নামে একটা খারাপ কথা বলেনি। আমাকে লুকিয়ে তোমায় চিঠি লিখতো। আমি তো তখন জানতামই না তুমি বেঁচে আছো। আর এতটাই সুখে আছো যতটা সুখে থাকলে আমাকে আর আব্বুকে ছুঁড়ে ফেলা যায়। তুমি বেঁচে আছো সেটা জানলাম আব্বুর মৃত্যুর আগে। তার ঘর খুঁজে চিঠি পেলাম যখন তখন জানলাম। আব্বু কতটুকু ভালোবাসলে তোমাকে শেষবার দেখার আশায় চোখ বন্ধ করেনি একবার ভাবো? ভাগ্যিস! আমি চিঠি পেয়েছিলাম, জেনেছিলাম তোমার ঠিকানা। নাহয় তো আব্বুটা তোমাকে দেখার ইচ্ছে বুকে নিয়েই চিরবিদায় নিতো। আচ্ছা মা, যেদিন শেষবারের মতন আব্বুকে হসপিটালে দেখতে গেলে সেদিন তোমার বুক কেঁপেছিল কী? যেই মানুষটা তোমাকে এত ভালোবাসার পরেও ছেড়ে গিয়েছিলে সেই মানুষটা তোমাকে শেষ অবধি মনে রেখেছিল বলে অবাক হওনি? হয়েছিলে নিশ্চয়।
জানো মা, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। আমার আব্বু যেই মানুষটার ছবি তার বুকপকেটে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেই মানুষটার বিশ্বাসঘাতকতা যে আমি মানতে পারিনি। কিন্তু তবুও, মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ যে অন্তরে ছিল। ঘৃণা করতে গিয়েও যে কোথাও একটা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সেটা অস্বীকার করি কীভাবে?
সে যাই হোক। আজ মাঝ রাতের পরই আমার ফাঁ সি। এরপর এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখা হবে না। এই ভোর, এই ভালোবাসার পৃথিবীটাকে আর দেখব না ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে মা। ভুল কেইসে এত বড়ো দন্ড পেলাম! কী আর করব? ভাগ্যে যে ছিল। বিধাতা কিছু কিছু মানুষকে এমন দুঃখে মোড়ানো ভাগ্য দিয়েই যে পাঠান। এই ভাগ্য অস্বীকার করি কেমন করে? তবে আমার কাছের মানুষ গুলো ভালো আছে এতটুকুই আমার শান্তি। জানো মা, বাবা যেমন তোমাকে ভালোবাসতো, আমাকেও তেমন একজন ভালোবাসে। আমি যতই মানা করি সে শুনে না। বোকা ছেলে! এমন মায়া মায়া ভালোবাসা পেলে মরতে ইচ্ছে করে বলো? কষ্ট হয় যে বড়ো! তবুও মরতে হয়। কাল ভোরে যখন আমার দেহটা প্রাণশূন্য হয়ে পড়ে থাকবে তখন কে নিবে সেই দেহের দায়ভার? আমার মৃত দেহ দেখার মতন এই গোটা দুনিয়ায় কেন কেউ নেই মা? এত খারাপ ভাগ্য কারো হয়? বেলির গন্ধে বাগিচা ভরে যাবে, আমার সদ্য কবরে হাউমাউ করে কেউ কাঁদবে না। কাঁদার মতন একটা মানুষ পৃথিবীতে নেই বলে আমার নিজের জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে। আহারে! এই আমিটা কতই না নিঃস্ব! কতই না দুঃখ পেয় যাচ্ছি মা। আমার যেতে ইচ্ছে করে না। মাগো, এত সাধের জনম, দুঃখে দুঃখেই বিসর্জন দিলাম। মা, মা গো, আমার জন্য দু’ফোটা কাঁদবে কী মা? আমার ফাঁসি ভোর সাড়ে চারটায়। আবারও বলছি, ভোর সাড়ে চারটায়। সেই সময়টায় আমার জন্য দু’ফোটা চোখের জল ফেলো কেমন? গোটা এক আস্ত আমিটা মরে যাব অথচ কেউ কাঁদবে না তা মানতেই পারছি না। তুমি নাহয় কাঁদলে। এই বেনামি মৃ ত দেহটা তবুও শান্তি পাবে। তার বিদায়ে কেউ অন্তত কেঁদেছে ভেবে। ভালো থেকো, মা। পায়ে হেঁটে একদিন দুঃখ দূর করতে চাওয়া আমার জন্য দোয়া করো। আজ ভোরে আমি দুঃখ নিয়েই চলে যাব বহুদূর। বিদায় মা।

ইতি
আশাবরীর বোন রক্তকরবী।”

সাহেবা কেঁদে উঠলেন হাউমাউ করে। তিন বছর আগে তিনি যখন চিঠিটা পেলেন তখন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি, শহর বদলানোর কারণে চিঠিটা এসে পৌঁছায় বড়ো অসময়ে। তবুও সন্তানের খোঁজে যান তিনি। কিন্তু খোঁজ পাননি কোনো। যেই সন্তানের কথা সারাজীবনে একটিবারও ভাবেননি, সেই সন্তানের জন্য গত তিনটে বছর কেঁদেকেটে, আহাজারি করে কাটাচ্ছেন। মেয়েটার নামে মামলা হওয়ার চার বছরের মাথায় ফাঁসির নির্দেশ আসে। কেইসের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য, প্রমাণের ঘাটতি থাকায় তার মেয়েটা আজ নেই। এই পৃথিবী তার নিয়মেই চলছে অথচ এই যে প্রগাঢ় দুঃখ গুলো! তা মোছার কী সাধ্য আছে কারো?

(৫০)

এই শীতেও বিন্দু গুনে গুনে ছয়বার গোসল করেছে। তা-ও মধ্যরাতে। মাঝে মাঝেই মেয়েটা এমন পাগলামো করে। কী করবে, না করবে বুঝে পায় না। বেশিরভাগ শীত এলেই মেয়েটার মাথা বিগড়ে যায়। মানুষকে চিনতে পারে না, পাগলামো করে।
হুতুম অতিষ্ঠ হয়ে বিন্দুর উপর রাগ দেখাচ্ছে। কিন্তু শান্ত রইল হীরণ। নরম হাতে বিন্দুর মাথা মুছিয়ে দিল সে। ফ্রিজ থেকে নামিয়ে খাবার গরম করে আনল। খাইয়েও দিল। হুতুম নীরবে সবটাই দেখল। হীরণ যখন বিন্দুকে ঘুম পাড়িয়ে ঘর থেকে বের হতে নিবে হুতুম তখন পিছু ডাকল। নরম স্বরে শুধাল,
‘তোমার রাগ লাগে না, মাস্তান?’

হীরণ মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘কেন?’
“এই যে বিন্দুবালা যে এমন করে!’

‘বিন্দু তো অসুস্থ। সুস্থ যখন থাকে তখন তো এমন করে না।’

‘বিন্দুবালা কী একেবারে ঠিক হইবো না?’

‘হবে। ধৈর্য রাখো। আমাদের বিন্দু একেবারে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি যাও, ঘুমাও।’

হুতুম ঘাড় নেড়ে ঘুমুতে চলে যায়। হীরণ তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘরের বাহিরে এসে পুব দিকের বাগানটায় গিয়ে বসে। মৃদু বাতাসে তার শীত শীত ভাব গাঢ় হয়। তার সামনেই একটি পুরোনো কবর থেকে কী যেন এক অপরিচিত ফুলের সুবাস ভেসে আসে। হীরণ এক ধ্যানে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,
‘রুবী, আজও তোমার শরীর থেকে কত সুন্দর ঘ্রাণ আসছে দেখো! তবুও তুমি বোকার মতন বলো তোমাকে যেন না ভালোবাসি। এমন ফুলের মতন মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায়? যায় না। সেই তুমি রাগ করো আর যা-ই করো আমি তোমাকেই ভালোবাসবো। তোমার অন্যায় আবদার পূরণ করতে বিন্দুবালাকে পৃথিবীর সকল দুঃখ থেকে তো লুকিয়ে ফেলেছি ঠিকই কিন্তু তোমার মতন করে ভালোবাসতে পারিনি। পারবও না। আচ্ছা রুবী, তুমি বিন্দুকে যেমন ভালোবাসলে তার এক ভাগও কেন আমায় বাসলে না? তা-ও তো আমি নিজেকে একটা বুঝ দিতে পারতাম। এমনকি তোমার মৃত দেহের দায়িত্বটুকুও আমায় দিতে নারাজ ছিলে। কেন এত পাষাণ তুমি আমার বেলা? বেশি ভালোবেসেছিলাম বলেই কী এমন শাস্তি? তবুও আমি ভালোবাসব। করো তুমি অভিমান।’

কথা বলতে বলতে অজান্তেই হীরণের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে ফিসফিস করে বলল,
‘রুবী শুনছো, ভালোবাসি।’

কে জানি? রুবী শুনল কি-না? রুবী দেখল কি-না এই প্রেম। রুবী জানল কিনা তার কবরে রোজ নিয়ম করে একজন কান্না করার মতন মানুষ পৃথিবীতে অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছে আজও!
খুব দূরে কুয়াশা ঠেলে একটি পরিচিত পাখি ডাকল বিরহী স্বরে। কে ওটা? বাণী না?

পরিশিষ্ট:
________

বিন্দুর মানসিক অবস্থা বিগড়ে যাওয়ায় মামলা কঠিন থেকে কঠিনতম হয়। আদালতে প্রমাণ হয় করবী টাকার লোভে খু ন করে বিশিষ্ট শিল্পপতিকে। টাকার ক্ষমতার কাছে ফিকে হয়ে যায় সব সত্য। কোনো সঠিক তথ্য প্রমাণ না থাকায় হীরণ চেয়েও করবীকে মুক্তি করাতে পারেনি। তবে করবীর কথা অনুযায়ী বিন্দুকে আড়াল করতে পেরেছিল এই সমাজের চোখ থেকে। শহর ছেড়ে খুব দূরে এক পাহাড়ি অঞ্চলে বিন্দুকে লুকিয়ে রাখে। সেখানেই বিন্দুর চিকিৎসা চলে। তবে সেই চিকিৎসা আজও চলছে। বিন্দুর স্মৃতিতে করবী খুব কম সময়ই আসে। আর যখন আসে তখন বিন্দু উন্মাদ হয়ে যায়। তাই কেউ তাকে করবীর কথা মনে করায় না।
আর তিমির? তিমির হলো সেই চরিত্র যারা আমাদের জীবনের কোনো কিছুতেই থাকে না। কেবল ঝড়ের বেগে এসে জীবনটায় আরও এক আনা দুঃখ বাড়িয়ে দিয়ে যায়।
তবে তিমিরদেরও বুকের ভেতর একজন আস্ত বিরহিণী লুকায়িত থাকে যাদের তারা এক সময় ভালোবেসেছিল। থাকে হীরণদের বুকের ভেতরও। পৃথিবীতে ভালোবাসতে পারা বেশিরভাগ মানুষের বুকের ভেতরই বিরহিণীরা থেকে যায়। শীতের নরম কুয়াশা, গ্রীষ্মের তাপদহন কিংবা শরতের মেঘের পরিবর্তন ঘটে তবে বুকপকেটে থাকা বিরহিণীদের ঘটে না পরিবর্তন। চিরজীবন তারা চির কাঙ্ক্ষিত মানুষ হয়ে অপূর্ণতায় থেকে যায়। যেমন করে বিদিশার বুকেও রয়ে গেছে একজন!

[সমাপ্ত]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে