বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩৮+৩৯

0
251

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৮ (অর্ধেক অংশ)
কলমে: মম সাহা

(৪৫)

ধর্ষণ শব্দটা কতটা ভয়াবহ তা বিন্দু উপলব্ধি করল ধীরে ধীরে। বিশিষ্ট শিল্পপতি আশরাফুল ইসলাম যেদিন খু ন হলেন ঠিক তার পরেরদিন থেকে পুরো শহর জুড়ে খবর ছড়াতে শুরু করল। খু নের অন্তরালে থাকা ঘটনা খুড়তে খুড়তে বেরিয়ে এলো বিন্দুর নাম। বাতাসের বেগে ছড়াতে লাগল খবর। যদিও আশরাফুল ইসলামের টাকা ছিল তাই প্রথমেই ধরে ধর্ষণের নাম উঠেনি। উঠেছে— বিন্দু নামের এক কারখানার নিম্নবর্গের শ্রমিকের সাথে আশরাফুল ইসলামের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা। সেই খবর জানতে পেরেই আশরাফুল ইসলামকে খু ন করেছে বিন্দুর বড়ো বোন রক্তকরবী।
খবরটি মিথ্যে। কিন্তু প্রথম অবস্থায় এই খবরটিই হলো অন্যতম সত্য। ধর্ষণের মতন এমন ঘৃণিত কাজ তো ধনী শ্রেণীর মানুষ করতেই পারে না।

বিন্দু এ শহরের নোংরা খবর সম্পর্কে জানত না। সে তখন ছিল ঘরবন্দী। নিজের সাথে নিজের একটা নির্মম যু দ্ধ চলছিল তার। যতই ভুলে যেতে চাচ্ছিল বিদঘুটে রাতটির কথা, ততই মনে পড়ে যাচ্ছিল। চোখের সামনে নিজের নগ্ন দেহ, অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, ঘাড় থেকে মাথা আলাদা হওয়ার দৃশ্যটা তার চোখের পাতায় সিনেমার মতন আটঘাট বেঁধে যেন বসে পড়েছিল। তবুও নিজের সাথে নিজের অদম্য যু দ্ধ শেষে সে সাহস সঞ্চয় করল। হুতুমটার খিদে পেয়েছে, আব্বুকেও তো খাওয়াতে হবে অথচ চাল, ডাল নেই ঘরে। তাই অবশেষে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। মাথায় ওড়না প্যাঁচিয়ে হুতুমের হাতটা শক্ত করে ধরে ঘর ছেড়ে বের হলো। আজ দু’দিন পর বোধহয় সে সূর্য দেখল। এই দু’দিনে সে ঘর ছেড়ে বের হয়নি আর না হীরণ ভাইকে ঘরে আসতে দিয়েছে। বিন্দু ঠিক করল আজ যেহেতু সাহস করে বের হয়েছে তাহলে আপার সাথেও দেখা করে যাবে। দু’দিন হলো আপাকে দেখে না। সে কতটাই না নির্দয়! যেই আপা তার জন্য আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে সেই আপার সাথে যোগাযোগটুকুও করছে না। কতটুকু স্বার্থপর হলে এমন করে মানুষ? অথচ আপা তো তার বিপদ শুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে একবারও দ্বিধা করেনি। হাহ্! আপার মতন হতে যে তার সাত জনমও যথেষ্ট নয়।

সবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বিল্ডিং থেকে বের হয়েছে তন্মধ্যেই বিল্ডিং এর নিচ তালার ভাড়াটিয়া খালা ডাকল তাকে, ‘বিন্দু নি? হুন হুন। দাঁড়া।’

বিন্দু স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়াল। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খালা? কন।’

খালা গদোগদো হেসে এগিয়ে এলেন। বিন্দুকে মাথা থেকে পা অব্দি পরখ করে বললেন, ‘তোরে কত টেকা দিছিল, বিন্দু?’

খালার প্রশ্ন বোধগম্য হলো না বিন্দুর। কপাল কুঁচকে বলল, ‘কীয়ের টেকা, খালা?’

‘ঐ যে কারখানার অপিছারের লগে যে থাকতি মাঝে মইধ্যে। কত দিতো?’

বিন্দুর যেন মাথা ঘুরে উঠল এমন কথা শুনে। সে কারখানার অফিসারের সাথে কখন থেকেছে? তাকে তো জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাছাড়া খালা এই খবরই বা কীভাবে জানল?
‘কী কন, খালা? পা গ ল হইছেন?’

‘পা গ ল হমু ক্যা? তোর খবর দেহি পুরা এলাকা জানে। কছ না কত দিতো তোরে। এর লাইগ্যাই তো কই, এই চাকরি কইরা তুই এত টেকা কেমনে পাছ।’

বিন্দুর ঘিনে শরীর কাঁপতে লাগল। চোখ মুখে জল টলমল করল। মুখ দিয়ে আর কথাও বের হচ্ছে না যেন। রাগে, ক্ষোভে সে হুতুমকে টানতে টানতে চলে গেল। পেছন থেকে খালা বেশ কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দেয়নি সে।

রাস্তায় বের হওয়ার পর বিন্দুর ধারণা কর্পূরের মতন উড়ে গেল। সে ভেবেছিল কেবল খালা নিচু মনের মানুষ তাই এমন কথা বলেছে। কিন্তু গোটা পৃথিবীর সবাই-ই যে এমন মনের সেটা তার ছোটো ধারণাতে আসেনি। সকলের বাঁকা চোখ যেন কাঁটার মতন গাঁয়ে বিঁধছিল। যারা জানত না ঘটনা তারাও কানাকানিতে জেনে গেল। পুরো মহল্লার গল্পের টপিক হয়ে গেল সে মুহূর্তেই।

মুদি দোকানের মধ্য বয়স্ক লোকটাও বিন্দুর দিকে কেমন করে যেন বার বার তাকাচ্ছিল। সেই দৃষ্টি বিষের চেয়েও বিষাক্ত ছিল। বিন্দুর যেন আর সহ্য হলো না এইসব। সে চেঁচিয়ে উঠলো। খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠল দোকানদারের সাথে,
‘কী দেহেন এত? আমার কী রূপ বাইয়া পড়তাছে? দেহার মতন কী হইছে আমার? অসইব্য লোক।’

খ্যাপে গেলেন দোকানদার। তেড়ে এলেন দ্বিগুণ ক্ষোভে, ‘আমারে অসইব্য কছ! মা* একটা। তুই মাইনষের বিছানতে যাছ আর আমারে কছ অসইব্য?’

এত বিশ্রী গালির পরেও ঠিক থাকতে পারল না বিন্দু। শরীরে আচমকা ঝাঁকুনি দিয়ে সে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হুতুমটা হাউমাউ করে চিৎকার জুড়ে দিল। জড়ো হলো লোক সমাগম। বিন্দুটার কোনো হুঁশ নেই। চুপটি হয়ে মাটিতে মিশে আছে।

(৪৬)

করবীর বিকেলের আকাশ দেখা হয় না কতদিন। কতদিন বাহিরের হাওয়া মন-প্রাণ জুড়িয়ে আলিঙ্গন করে না তাকে! এই একধারে বন্দী জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে যেন সে। এই অপরিচিত জীবনে মানিয়ে নিতে কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! বিন্দুটাও বা কেমন আছে?

‘ভালো আছো, আপু?’
পরিচিত মেয়েলি কণ্ঠে করবীর ধ্যান ভেঙে গেল। তড়িৎ বেগে সে তাকাল শিঁকের বাহিরে। বিদিশা ভাবিকে দেখে তার বুকে মৃদু কম্পন হলো। যাক, পরিচিত কারো দেখা তো পেলো অবশেষে! কেউ একজন তো এলো তাকে দেখতে। করবী দৌড়ে গেল সেখানে। একবারে কাছাকাছি দাঁড়াল। ঠোঁট কামড়ে কোনো মতে কান্না গিলে বলল, ‘ভালো আছি, ভাবি। তুমি ভালো আছো তো? কেমন কাটছে জীবন?’

বিদিশা অনবরত কথা বলতে থাকা করবীর দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। মেয়েটা ভালো আছে বললেও চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে মেয়েটা ঠিক কতটুকু ভালো আছে।

‘মন খারাপ করো না, আপু।’
করবী হাসল ভাবির কথায়। পানসে চোখে তাকাল জেলের আধখসা দেয়ালটার দিকে। এই দেয়াল যেন তার জীবনের গল্প বলছে। এই তো তার জীবন। কোনোমতে রঙচটা হয়ে ধ্বংসাবশেষ নিয়ে বেঁচে আছে। করবী হাসি বজায় রেখে বলল, ‘মন খারাপ করব কেন?’

বিদিশা উত্তর দিল কিছুটা রয়েসয়ে, ‘ভাইয়া না হুট করে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। বাড়ির সবাইকে বলেছে যেন উনাকে না খোঁজা হয়।’
প্রথম অবস্থায় করবী বুঝতে পারল না কার কথা বলছে বিদিশা। তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কোন ভাইয়া?’
‘তিমির ভাইয়া।

করবীর মুখটা যেন রঙ বদল করল। বাঁকা চোখে তাকাল বিদিশার দিকে। কিছু যেন বলতে চাইল কিন্তু বলা হলো না আর। বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস গুলোকে আবার বুকের ভেতর চেপে ধরল। বিদিশা খুব তীক্ষ্ণ চোখে সবটাই পরখ করল। তার ভীষণ মায়াও লাগল করবীর জন্য। দুঃখিনীর কপালেই বিধাতা দুঃখ লিখেন যে কেন!

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৮ এর বাকি অংশ
কলমে: মম সাহা

(৪৬)

বৃষ্টি হচ্ছে আজ। বৃষ্টির শব্দ বাহির ছাড়িয়ে ঘরে এসে নৃত্য করছে। অসময়ের বৃষ্টির ছাঁট এসে হসপিটালের করিডোরে পড়ছে। বিন্দু ঘুমিয়ে আছে অচৈতন্য হয়ে। তার পাশেই বসা হীরণ। হীরণের কোলে হুতুম বসে আছে। মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে হীরণের বুকে। চুপটি করে বসে আঝে বাচ্চাটা। কোনো কথা বলছে না। হয়তো আকষ্মিক এতকিছু বুঝতে পারেনি। হীরণের মাথা চিন্তায় ফেঁটে যাচ্ছে। বিন্দুকে যে অবস্থায় রাস্তায় দেখেছিল, একটুর জন্য তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মেয়েটার জ্ঞান নেই, পাশে বসে ছোটো হুতুমটা কাঁদছে। কী এক অরাজকতার সৃষ্টি যেন! ভাগ্যিস ঐ মুহূর্তে ওদের গলিতে গিয়েছিল।
নাহয় মেয়েটা কতক্ষণ অমন ভাবে পড়ে থাকত কে জানে?

হীরণের এতশত ভাবনার মাঝে ফোনটা বেজে উঠল সশব্দে। পকেট থেকে সাবধানে সে মুঠোফোনটি বের করতেই দেখল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তার বাবার নামটি। সহজে তাকে কল করার পাত্র বাবা নন। তবে আজ কেন? হীরণ প্রথম কলটি রিসিভ করল না। দেখতে দেখতেই কেটে গেল তাই। পরবর্তীতে আবারও সেকেন্ড পেরুতেই কল এলো। বাবার এত জরুরী তলবে তার ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হয়ে এলো। এত ঘন ঘন কল দেওয়ার কারণ কোনোমতে খুঁজে না পেয়ে অতঃপর সে কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করতে তার বাবার বাজখাঁই গলা ভেসে এলো,
‘ইতর ছেলে। এতক্ষণ লাগে কল ধরতে? কই তুই? তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।’

বাবার এই ক্রোধ ভরা কণ্ঠ হীরণের কাছে নতুন নয়। সে যথেষ্ট স্বাভাবিক থেকেই বলল, ‘বাসায় কী?’

‘অ স ভ্য ছেলে। কাদের সাথে মিশেছিস তুই? ঐ বস্তির মানুষদের সাথে তাই না? যাদের আমি পায়ের নখের যোগ্যও ভাবি না তাদের সাথে কেইসে তোর নামও জড়িয়ে পড়েছে। আমি জানতামই না উকিল মামুন সাহেব না বললে। তুই আবার তার কাছে গিয়েছিস কেইস নিয়ে। কত বড়ো সাহস তোর।’

হীরণ মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা রেখেই বলল, ‘উকিলের কাছে তো মানুষ কেইস নিয়েই যায় বিয়ের কার্ড নিয়ে না। এখানে তো অন্যায়ের কিছু দেখছি না।’

‘তুই আবার মুখে মুখে তর্ক করিস? একটা অ ভ দ্র, অস ভ্য হয়েছিস। এতদিন পথে পথে মা স্তা নি করতিস কিছু বলিনি। তাই বলি এসব কেইসে ফাঁসবি? আমার মানইজ্জত কিচ্ছু নেই। তার উপর যে মেয়ে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তার সাথে নাকি তোকে দেখা যাচ্ছে আজকাল? অমন একটা চরিত্রহীনার সাথে তোর কী এত?’

ধৈর্য্যের বাঁধ আর ধরে রাখতে পারল না হীরণ। চেঁচিয়ে উঠল সাথে সাথে, ‘খবরদার এসব বললে আপনার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলব। যার সম্পর্কে বলছেন তাকে চিনেন আপনি? জানেন তাকে? আমি ভুলে যাব আপনি আমার বাপ হন।’

হীরণের এই অপ্রত্যাশিত হুমকি বাবা বোধহয় আশা করেননি। তার উপর সন্তানের হাতে মার খাওয়ার হুমকি কোনো বাবা-মাই আশা করেন না হয়তো। তাই ভদ্রলোকও আকস্মিক চুপ হয়ে গেলেন। তাজ্জব হয়ে গেলেন যেন। অস্ফুটস্বরে কেবল বললেন,
‘বাবার গায়ে হাত তোলার হুমকি দিচ্ছো! এত অধঃপতন হয়েছে তোমার?’

ব্যস্! এতটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিলেন। হীরণও বুঝতে পারল হটকারিতায় সে ভুল কথা বলে ফেলেছে। যতই হোক বাবাকে এসব বলা শোভনীয় নয়। সৃষ্টিকর্তার দরবারে এই পাপ যে বড়ো ঘৃণিত। কিন্তু তখন বিন্দুর নামে এমন কথা শুনে সে যে নিজেকে সামলাতে পারেনি। তারই বা দোষ কী? এত ঝামেলার মাঝে মাথা ঠিক থাকে? একদিকে তার রুবী জেলে, অন্যদিকে সহজ-সরল মেয়েটার জীবন-মরণ সংশয়, সে যাবে কোথায়? তার উপর রুবীর নামে যেই কেইস উঠেছে তা থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব। ভাবতে ভাবতেই হীরণে বুক ভারি হয়ে আসে। তপ্ত শ্বাস ফেলে তাকাতেই দেখে হুতুম তাকিয়ে আছে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে। চোখ দুটিতে জলে টলমল করছে। হীরণকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ব্যাকুল স্বরে বলে, ‘মাস্তান, এমন কইরা চিল্লাইও না বিন্দুবালা ডরাইবো যে!’

বাচ্চাটার নিখাঁদ আকুতিতে মন নরম হয়ে যায় তার। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘সরি, সোনা।’

‘মাস্তান, বিন্দুবালারে না সবাই কেমন কথা হুনাইছে। বকাও দিছে। বিন্দুবালারে সবাই বকে ক্যান? বিন্দুবালা কী করছে? আমাগো বিন্দুবালা তো অনেক ভালা। তুমি কইয়া দিও সবাইরে, আমাগো বিন্দুবালা কহনো কিচ্ছু করে নাই। অরে যেন কেউ না বকে। বিন্দুবালার মা যে মইরা গেছে। বিন্দুবালা কানলে অর চোখে পানি মুছবো কে?’

ছোটো হুতুমের এমন গভীর কথায় হীরণের বুকে উত্তাল ঢেউ উঠে। তারও কাঁদতে ইচ্ছে হয় বুক খুলে। কিন্তু সবাই কাঁদলে স্বান্তনা দিবে কে?

দু’জনের কথোপকথনের মাঝে কেবিনে প্রবেশ করে ডাক্তার সামিনা কায়সার। চিকন ফ্রেমের চশমা পরা চল্লিশোর্ধ্ব সামিনা কায়সারকে দেখে হীরণ দাঁড়িয়ে যায়। হুতুম তখনো তার কোলে। ডাক্তার এসে ঘুমন্ত বিন্দুর কিছু পরীক্ষা করেন। এরপর সহজ গলায় বলেন, ‘রোগী ট্রমাটিক। মেন্টালি হেলথ প্রচন্ড খারাপ। কী হন আপনি?’

উত্তর দিতে গিয়ে গলায় বাঁধে হীরণের। কতক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীর স্বরে বলে, ‘বন্ধু।’

সামিনা কায়সার অভিজ্ঞ চোখে একবার হীরণকে পরখ করে মাথা দুলায়। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘রোগীর সাথে যা হয়েছে সেটা অনেক খারাপ। আর রোগী সেসব মানতে পারেনি। তাই তার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে আজ। তার জ্ঞান ফেরার পর যেমন উদ্ভ্রান্ত দেখলাম মনে হচ্ছে তার মেন্টালি অসুস্থ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এই পরিবেশে থাকলে কিছুদিনের মাঝেই সে পাগল হয়ে যাবে।’

ডাক্তারের কথায় হীরণসহ হুতুমও আঁতকে উঠে। সহাস্যে হীরণের গলা জড়িয়ে ধরে বাচ্চাটা। কেঁদে ফেলে সাথে সাথে। হীরণ নিজেও গতি হারিয়ে ফেলে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সামিনা কায়সার আলগোছে হুতুমের পিঠে মায়ায় দু একবার হাত বুলিয়ে হীরণের উদ্দেশ্যে বলে,
‘উনার সামনে যতই সেসব নিয়ে কথা হবে উনি ততই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। একটা সময় পর দেখা যাবে সব হাতের বাহিরে। এবার আপনি ভেবে দেখুন বাকিটা।’

ভেবে দেখুন বললেও হীরণ ভাবতে পারে না। এই কেইসে বিন্দু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষ। তাে উপর এটা যেই ঘটনা, এই পরিবেশ বার বারই বিন্দুকে এইসব কথা শুনতেই হবে। তাহলে? কীভাবে কী করবে সে? এসব আটকানোর সাধ্য কী তার আছে?

_

প্রবল বৃষ্টি দেখে বিদিশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার শিঁক গলিয়ে ডান হাতটা বাহির করে রেখেছে। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে সেই হাতটা। তার উপর উন্মাদ করা শীতল বাতাস তার শরীরে শক্ত-পোক্ত আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি, মন খারাপ করা আকাশের দিকে। গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে সেই আকাশটি। এই শহরে তখন বৃষ্টি বড়ো বিলাসিতার বস্তু।
ফোনো টুং করে শব্দ হতেই বাম হাতে থাকা ফোনটি চোখের সামনে ধরল। দেখল তার শাশুড়ির মিসড কল দেখাচ্ছে। বিদিশা ফোনটা সরিয়ে রাখতে নিলেই আবার কল বেজে উঠে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাসনীম বেগমের কোমল কণ্ঠ ভেসে এলো, নিভু নিভু স্বরে বললেন,
‘বউমা, ফিরে আসবে কী?’

খুব দূরে কোথাও বজ্রপাত হলো। আজ আর বিদিশা ভয়ে কাঁপল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। একটি নামহীন হাসি ঠোঁট জুড়ে হামাগুড়ি দিল। সে জানত এই ফোনকলটা যে আসবে। আসাটাই শিরোধার্য যে! ভদ্রমহিলা আবার একা হয়ে গিয়েছেন যে! বড়োছেলে গতকাল দেশ ছেড়েছেন আর ছোটো ছেলে গা ঢাকা দিয়ে কোথায় গিয়েছেন কে জানে? রক্তের ধারা যে এটাই। সমস্যা দেখলেই গা ঢাকা দেওয়া।
এত বড়ো পৃথিবীর, এত বড়ো শহরটায় ভদ্রমহিলা যে একা। তার ভরা সংসার করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে একা ঘরে দিন কাটাচ্ছেন। এই চরম বিষাদ মুহূর্তে সেই বৃদ্ধ নারীটির যে পরম শুভাকাঙ্ক্ষী এই বিদিশাই। এই সত্য যে চির নির্মল। এ সত্য অস্বীকার করার জো নেই। অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই কারো। ঐ বৃদ্ধা কয়েকদিনের মায়ার বশে যে-ই বিদিশাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন সেই বিদিশাই যে বৃদ্ধার একমাত্র সম্বল সেই কথা যে ঐ সৃষ্টিকর্তা জানেন। তাই তো দিনশেষে আবার এই গন্তব্যেই থামিয়েছেন ভদ্রমহিলার সকল সমাপ্তি।

বিদিশা ভাবুক হলো। তার এখন কী করা উচিত? অকৃতজ্ঞ শাশুড়ির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে এই চরম একাকীত্বে মানুষটাকে ফিরিয়ে দিয়ে পৈচাশিক আনন্দ করা উচিত? ভদ্রমহিলার ছেলে বিদিশার এতগুলো বছরের অপেক্ষাকে ধূলোয় উড়িয়ে দিয়েছে বলে সে শাস্তিস্বরূপ এই নারীটিকে দূরছাই করে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত? নাকি বিনা স্বার্থে ডুবতে থাকা মানুষের একমাত্র ভরসার কূলের মতন এই মহিলার শেষ সম্বলটুকু হওয়া উচিত?
কোনটা করলে সমাজ মানবে? আর কোনটা করলেই বা মন মানবে?
প্রতিশোধ নাকি প্রেম? কোনটা হলে অন্তরাত্মা চরম সন্তুষ্টি নিয়ে চোখ বুজবে?

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৯

(৪৭)

এই শহরে বৃষ্টির আবহাওয়া চলছে। দিন নেই রাত নেই, ঝপঝপিয়ে আকাশ কালো করে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো মৃদু গর্জনে আকাশ ডাকছে কখনো বা তুমুল গর্জনে ফেটে পড়ছে। কখনো আবার ঝকঝকে সোনালি রোদ্দুর হাসছে।
আজকের দিনটি সোনালি রোদ্দুর হাসার দিন। ঝকঝকে এক সূর্য উঠেছে চকচকে হাসি নিয়ে। বুক ফুলিয়ে সেই সূর্য দাঁড়িয়ে আছে ঠিক আকাশের মাঝ বরাবর। গরমও পড়েছে অতিরিক্ত। বিন্দুর শরীরে অবনতি এতটাই বাজে পর্যায়ে হয়েছে যে বিন্দুর কোনো বোধ নেই। হুট করেই কাউকে চিনতে পারছে না। আবার চিনতে পারলেও কথা বলছে না। কখনো বা রেগে যাচ্ছে হুটহাট। দু’দিন আগেও হুতুমের মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। তা-ও নিচ তালার এক মহিলার প্রশ্নের বাণে অতিষ্ঠ হয়ে ছুটে এসে এটা ওটা ছুঁড়তে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত হুতুমের গায়ে পড়ে যায়। এবং মাথাটা ফেটে যায়। র ক্তা র ক্তি কাণ্ড! হীরণ এসে দেখে তো আহম্মক বনে যায়। বিন্দুর আব্বুও এসব দেখে দেখে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাই অবশেষে একটি স্বাস্থ্য কেয়ার কমপ্লেক্সে হীরণ বিন্দুর আব্বুকে পাঠিয়ে দেয়। বিন্দুর যে অবস্থা, কাউকে ওর সামনে রাখা নিরাপদ না। দেখা যায় হুট করেই কী না কী করে বসবে!

বিন্দুর অবস্থা অবনতি হচ্ছিল বিধায় আবারও সামিনা কায়সারের কাছে নিয়ে যায় হীরণ। কিন্তু ডাক্তারের এক কথা। এই পরিবেশে থাকলে বিন্দুর মানসিক অবস্থা খারাপ বৈ ভালো হবে না। এদিকে করবীর কেইস কোর্টে উঠে গিয়েছে। প্রথমদিন তো বিন্দুকে পেশ করা যায়নি। বিন্দুর অবস্থার জন্য কেইস একবিন্দু আগায়নি। তার উপর কোনো উকিল পাওয়া যায়নি। অবশ্য উকিল ঠিক করার চেয়ে বিন্দুকে নিয়েই বেশি ছুটতে হয়েছে হীরণের। একা মানুষ কোনদিকেই বা যাবে?

আজকে ঝলমলে সূর্যের মতন বিন্দুরও মন মেজাজে খানিকটা উন্নতি দেখা গেল। হীরণ বাসায় এসে দেখল বিন্দু ভাত রান্না করেছে। হুতুমকে নিজের হাতে গোসল করিয়ে সুন্দর জামাকাপড় পরিয়েছে। বিন্দুর এমন আকাশ-পাতাল পরিবর্তনে হীরণ যেন বেজায় চমকে যায়। বোকা স্বরে বলল, ‘বিন্দু! তুই ঠিক হয়ে গিয়েছিস?’

বিন্দু তখন চুল আঁচড়াচ্ছিল। হুট করে হীরণের কণ্ঠ পেতেই বুকে থুতু দিল। ভয় পেয়েছে বেশ। হীরণ এগিয়ে এলো। ব্যস্ত স্বরে শুধাল, ‘ভয়ে পেয়েছিস?’

বিন্দু কিছু বলল না। কেবল আবদার করল, ‘আইজ আপার কাছে যামু, হীরণ ভাই। ম্যালাদিন হইছে আপারে দেহি না।’

এই সব কথাই হীরণের কাছে অবাস্তব লাগছে। বিন্দুর মানসিক অবস্থা গুরুতর খারাপ। তার মাঝে হুট করে এই আবদার যেন বড়ো সমস্যার সৃষ্টি করছে। কিন্তু তবুও হীরণ দ্বিমত পোষণ করল না। কেবল বলল, ‘নিজেকে ঠিক রাখতে পারবি তো?’

বিন্দুর হাত থেমে যায় এমন প্রশ্নে। ঘাড় ঘুরায় যন্ত্রের মতন। বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘আমি কতটা পাষাণ তাই না বলো?’

হীরণ দু’কদম এগিয়ে আসে। বিন্দুর মাথায় হাত দিতে গিয়েও দেয় না। যদি বিন্দু ভয় পায় আবার! কেবল স্বান্তনার কণ্ঠে বলে, ‘কে বলেছে তুই পাষাণ?’

‘আমি নিজেই জানি, হীরণ ভাই। আপা আমার লাইগ্যা কত যন্ত্রণা ভোগ করতাছে অথচ আমি কিচ্ছুই করতে পারতাছি না। খালি দিন দিন পাগলের মতন কইরা তোমাগোরে জ্বালাইতাছি। হীরণ ভাই, হেইদিন আপারে আইতে কওয়া আমার অন্যায় ছিল। আপারে আইতে না কইলে এত সমস্যা হইতো না। আপা আমার লাইগ্যাই এমন ফাইস্যা গেলো।’

‘ভাগ্য ছিল, বিন্দু।’

‘হীরণ ভাই, আমার ভাইগ্যেই ক্যান এমন থাহে? আমার মতন অসুন্দর, বিদঘুটেই ক্যান আমার ভাইগ্যটারে হইতে হইলো?’

হীরণ চোখ রাঙায়। এমন কথা বলতে নিষেধ করে। বিন্দুকে উত্তেজিত দেখা যায়। কেমন যেন লাগে। তবুও করবীকে দেখার বায়না পূরণ করার জন্য তাকে নিয়ে ছুটে পুলিশ স্টেশন।

থানায় বেজায় কোলাহল। খু নির আসামীর সাথে দেখা করতে হলে বড়ো অফিসারের নির্দেশ লাগে। হীরণ সেটাও জোগাড় করে আনে। তারপর হুতুম, বিন্দুরে নিয়ে ঢুকে থানায়। করবীর চোখ-মুখ ভেঙে এসেছে। অযত্নের ছাপ পড়েছে মেয়েটার মুখে। যেই সুন্দর রক্তকরবী একসময় যুবকদের বুকের উত্তাল ঢেউ ছিল, সেই সৌন্দর্যতা আজ ফুরিয়ে আসার পথে প্রায়। ফর্মা চামড়ায় কত দাগ পড়ে গিয়েছে এতগুলো দিনে। চোখের নিচে কালচে গাঢ় রেখা। কিন্তু এতদিন পর বিন্দুকে দেখে সেই ক্লান্ত চোখ জোড়া যেন হেসে উঠল। ছুটে এসে লোহার বড়ো বড়ো শিক গলিয়ে ছুঁয়ে দেয় বিন্দুর মুখমন্ডল। হুতুমের মুখমন্ডল। এই আনন্দ যেন বহু যুগ পর তার জীবনে এসেছে হামাগুড়ি দিয়ে। আপন মানুষের মুখ যেন এই জীবনে বড়ো মূল্যবান জিনিস।

কেঁদে দিল বিন্দু। আপার কারগারের বাহিরে থাকা দুই হাতে চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। কাঁদতে কাঁদতে তার চিরপরিচিত বিলাপও যুক্ত করল,
‘আপা, আমারে মাফ কইরো আপা। তোমারে এত দুঃখ দেওয়ার মতন অপরাধ আমি করছি, আপা। আমারে মাফ কইরো।’

করবীও কাঁদল। বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কাঁদছিস কেন বো কা? তুই আমাকে কোথায় দুঃখ দিলি? বরং তুই ছিলিস বলে আমি নিজেকে সুখী দাবী করতে পারি। এমন বো কা কথা কেউ বলে?’

বিন্দু মানতে চায় না আপার সেই স্বান্তনা। হাউমাউ করে চিৎকার করতে করতে বলে, ‘আমারে ক্ষমা কইরো, আপা। আমার এক ভুলে তোমার জীবনডা শেষ। আপা আমার উপর অভিমান রাইখো না। আর কেউ না জানলেও তুমি তো জানো তোমারে আমি কতখানি ভালোবাসি? আমার উপর অভিমান কইরো না গো।’

তাদের এই কান্নাতেই লোক জড়ো হয়ে যায়। হীরণও মুখ চেপে কান্না সংবরণের চেষ্টা করে। তাদের জীবনটা যে এমন হওয়ার কথা ছিল না। এটা এলোমেলো, এতটা নষ্ট হওয়ার কথা ছিল না। তবে কেন এমনটা হলো? রুবীর কপালে কেন দুঃখ নামল স্রোতের মতন? বিন্দুই বা কেন এত কষ্ট পেল?

ভীড়ের মাঝে একজন কনস্টেবল বলে উঠল, ‘আরে এটা সেই মেয়েটা না যার সাথে আশরাফুল ইসলাম খারাপ কাজ করছিলো? এর জন্যই তো পরে খু ন হয়। নাকি?’

বিন্দুর কান্না হঠাৎ থেমে যায়। মাথা চাড়া দিয়ে উঠে সেই দৃশ্য। মুহূর্তেই নরম বিন্দুর রঙ পাল্টে ধারণ করে এক পাগলাটে বিন্দুর রূপ। খ্যাক করে উঠে সে, ‘কে, কে বলল? হ্যাঁ? কে?’

সকলের চোখের সামনেই বিন্দুর অগাধ পরিবর্তন ঘটে। অতি উত্তেজনায় মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। করবীর কাছে সবটাই নতুন। তাজ্জব বনে হীরণের দিকে তাকাতেই বিন্দুর আসল অসুস্থতার কথা হীরণ বিশ্লেষণ সহকারে জানায়। থম মেরে যায় করবী। ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে থাকে কেবল। তারপর কী যেন ভাবে। টানা টানা চোখে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলে, ‘একটা কথা রাখবে, মাস্তান?’

হীরণ চমকায়। করবীর কণ্ঠস্বর অন্যরকম। অপরিচিত।

করবী আবার বলে, ‘রাখবে?’

‘কী?’

খুব আড়ালে করবী একটি অন্যায় আবদার করে বসে। করবী স্বার্থপর হয় আপন মানুষদের জন্য। হীরণ কথা রাখতে চায় না। কিন্তু করবী অটুট। নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে হীরণের। এই ক্ষণটা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু পারে না। তারপর……
জীবনের গতিপথ বদলে যায় অদৃশ্য এক সম্পর্কের বাঁধনে। সবসময় কী রক্তের সম্পর্কই সব? মোটেও না। আত্মার সাথে আত্মার সম্পর্ক যে বড়ো তা রক্তকরবীরা না থাকলে পৃথিবী জানতো? জানতো না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে