বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩৬+৩৭

0
111

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৬ (নতুন মোড়)
কলমে: মম সাহা

(৪৪)

একটি শুনশান রাতের রাস্তা। যে রাস্তায় জোছনা পড়ছে না। রাস্তার উপর আকাশটা হাসছে না। মন ভার তার। ভীষণ শক্ত-পোক্ত রকমের মন ভার। আকাশের গম্ভীর্যতা দেখে আঁচ করা যাচ্ছে বৃষ্টি আসবে। বেশ ভালো রকমের বৃষ্টি। প্রায় একটু বাদে বাদে ভয়ঙ্কর শব্দে ডেকে উঠছে আকাশ।
ঘেমে-নেয়ে একাকার করবীর শরীর। সে দাঁড়িয়ে আছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়িটার সামনে। অপরিচিত বাড়ি। কেবল বিন্দুর বলা অস্পষ্ট ঠিকানাটা ধারণা করেই এখানে আসা। বাড়ির গেইটে দু’জন দারোয়ান আছে। ঝিমুচ্ছে একজন। আরকজন বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসা। ভেতর থেকে লোহার মস্ত বড়ো গেইটটা তালা দেওয়া।
করবী গেইটের সামনে গিয়ে সজাগ থাকা দারোয়ানটাকে ডাকল। যিনি যন্ত্রের মতন বসে আছেন এক ধারে।

‘চাচা, গেইটটা খুলুন না।’
যান্ত্রিক চোখেই সেই দারোয়ান তাকাল করবীর দিকে। তারপর বড়ো বড়ো পা ফলে তিন লাফেই যেন গেইটের সামনে চলে এলো।
‘কাকে চাই?’

করবী কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কাকা, এটা কী আশরাফুল ইসলামের বাড়ি?’
যন্ত্রের মতন রোবট মানুষটা হয়তো করবীর কথায় বেশ বিরক্ত হলেন। কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘না জেনেই এত রাতে আসছেন কেন?’

শুদ্ধ ভাষায় কড়া কণ্ঠে বিরক্ত প্রকাশ করলেন উনি।
করবী মিনতি করল, ‘চাচা, বড়ো বিপদে পড়েই এসেছি। সাহায্য করুন। গেইট টা খুলুন। আমার বোন বাড়ির ভেতরে।’

এবার ভদ্রলোক কিছুটা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘আপনার বোন?’
‘হ্যাঁ, আমার বোন। চকমো গার্মেন্টস কোম্পানির সাধারণ কর্মী। তাকে নাকি এখানে…’
‘না, না, এখানে তেমন কেউ নেই। আপনি যান তো। রাত-বিরেতে বিরক্ত করবেন না।’

ভদ্রলোকের উচ্চবাচ্যে জেগে গেলেন ঝিমুনি কাটতে থাকা দ্বিতীয় জন। তিনি হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘কে এসেছে রে, জামশেদ?’
‘তেমন কেউ না। আপনি ঘুমান।’
জামশেদ নামক লোকটার কথায় আশ্বাসিত হয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে গেলেন দ্বিতীয়জন।
করবীর হৃদপিণ্ড কাঁপছে। হাত জোর করে সে মিনতি করল, ‘খুলেন দয়া করে। আমার বোনটা ছোটো। ওর অতটুকু বয়স। ওর পরিবারে কেউ নেই হাল ধরার। বৃদ্ধ বাবা আর ছোটো একটা মেয়ে ছাড়া। ওর কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা বাঁচবে না। জামশেদ চাচা খুলেন। চাচা দোহাই লাগে আপনার।’

জামশেদ চাচার চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা দেখা গেল না লেশমাত্র। মুখ-চোখ শক্ত করে বললেন, ‘যান তো এখান থেকে। শুধু শুধু বিরক্ত করে লোক সজাগ করছেন।’

করবী লোহার গেইটের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পা জড়িয়ে ধরল লোকটার। চোখ দিয়ে তার অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কণ্ঠে করুণ মায়া, ‘চাচা, আপনি আমাদের বাবার মতন। আপনার সন্তান বিপদে পড়লে কী এমন নির্দয় হতে পারতেন। আপনার পা ধরলাম চাচা। আমার বিন্দুটার কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব! আমার যে ও ছাড়া কেউ নেই। চাচা আপনার দোহাই লাগে চাচা। আপনি দরজাটা খুলেন। আপনার কাছে মিনতি করছি।’

কী জানি! করবীর এমন অসহায়ত্বে যেন ভদ্রলোকের কিছুটা মন গলে গেলো। আশেপাশে চোরের মতন তাকিয়ে সাবধানী কণ্ঠে বলল, ‘খুললেও তুমি একা কিছু করতে পারবে না। চলে যাও। লাভ নেই। কোনো ক্ষমতাই এই বাড়ির মালিকের কিচ্ছু করতে পারবে না।’

ফিসফিস করে কথাটা বলেই ভদ্রলোক সিগারেট বের করে চলে গেলেন ডান দিকে। অসাবধানতা বশত চাবির গোছাটা ফেলে গেলেন একদম করবীর হাতের কাছটায়। প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে যেন মনে হবে অনিচ্ছায় পড়েছে কিন্তু পরোক্ষভাবে দেখলে পুরো ঘটনাটা ঘটল সম্মতিতে।
চাবির গোছাটা পেতেই করবী উন্মাদের মতন গেইট খোলার চেষ্টা করল। দু একবার ব্যর্থও হলো। অতঃপর খুলতে পারল সেই তালা। গেইটটা খুলেই করবী দৌড়ে গেল বাড়িটায়। ভেতর থেকে লক করা দরজা। অনবরত কলিংবেলটা বাজাতে লাগল সে। ব্যাগে ফোনটা বাজছে। বোধহয় হীরণ কল দিয়েছে। সে তো হীরণকে বলল পুলিশ নিয়ে আসতে। হয়তো চলে এসেছে ওরা। কিন্তু এখন ফোন ধরার সময় নেই।

বার বার কলিংবেল বাজানোর পর ভেতর থেকে গলা পাওয়া গেল। মধ্যবয়স্ক পুরুষালি কণ্ঠ,
‘পি চা শের বাচ্চা গুলা শান্তি দিল না। রা স্কে ল একেকটা।’

গমগমে স্বরে কতগুলো গালি দিতে দিতেই দরজা খুললেন আশরাফুল ইসলাম। মোটাসোটা, লম্বা-চওড়া দেহী একজন মাঝবয়সী লোক। করবীকে দেখে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
করবী বলল, ‘বিন্দু কোথায়?’

‘কে? কে রে তুই? এত রাতে আমার বাড়িতে কীভাবে? জামশেদ, জামশেদ… হাবিবুর অ্যাই হাবিবুর… বা** কোথায় তোরা। কাকে ঢুকাইছিস বাড়িতে।’

ভদ্রলোকের জড়িয়ে আসছে গলার স্বর। সেই চিৎকারে ছুটে এলেন জামশেদ ও হাবিবুর নামের দু’জনেই। এসেই বিরাট সালাম দিলেন।
‘শালারা, এই মাইয়া এখানে ঢুকল কীভাবে? কী করছিলি তোরা?’

অবস্থা বেগতিক হওয়ার আগেই করবী আশরাফুল ইসলামকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির ভেতরটায় ঢুকে গেল। আলিশান বাড়ি। সাদা ধবধবে টাইলস বসানো। রাজকীয় হাবভাব। করবীর অত দেখার সময় কই? সে তো সর্বস্ব দিয়ে হাঁক পাড়া আরম্ভ করল,
‘বিন্দু, এই বিন্দু, কোথায় তুই? আপা আসছে। বিন্দুরে..।’

ততক্ষণে আশরাফুল ইসলাম, জামশেদ, হাবিবুর তিনজনেই ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতরে। আশরাফুলের ইশারায় করবীর চুলের মুঠি টেনে ধরলেন হাবিবুর নামের বয়স্ক লোকটা। করবী প্রথম টানে বেশ ব্যথা পেলেও কনুই দিয়ে চাপা ভাঙা, আধবুড়ো লোকটার পেটে আঘাত করল।
এমন শক্ত আঘাত কাবু করে ফেলল লোকটাকে। আশরাফুল জামশেদকে হুকুম করল করবীকে ধরার জন্য। কিন্তু হেলদোল নেই সেই লোকের ভেতরে। দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি খাম্বার মতন। এতে আশরাফুল অশ্রাব্য ভাষায় কিছু গালিও দিলেন।
বিন্দু ছুটে এলো দু’তালার একটি রুম থেকে। জামাটা উল্টো গায়ে দেওয়া। সেলোয়ারের বাম পায়ের খানিকটা ছিঁড়ে গিয়েছে। এসেই জড়িয়ে ধরল করবীকে। হাউমাউ করে সে কী কান্না! মদ্যপ অবস্থায় থাকা আশরাফুল ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে গেলেন। করবী লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। প্রথম ধাক্কায় কিছুটা নড়লেও দ্বিতীয় ধাক্কায় কিছুই হলো না। আতঙ্কিত বিন্দুটা হাউমাউ করে চিৎকার করছে। আতঙ্কে, ভয়ে মুখটা ছোটো হয়ে আসছে মেয়েটার। পেছাতে পেছাতে তারা রান্নাঘরে গিয়ে থামল। এত বড়ো বাড়ি অথচ কেউ নেই। থাকবেই বা কীভাবে? এটা যে উনার আলাদা বাড়ি। পরিবার থাকে আরেকটি বাড়িতে।

জামশাদ নেই এখানে। হয়তো পালিয়েছেন। হাবিবুর মাটিতে পড়ে আছেন আগের মতন। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
দানবীয় শক্তিতে করবীর বা-হাতের কব্জি টেনে ধরলেন আশরাফুল। জড়িয়ে আসা গলার স্বরে বলেন, ‘এত তেজ! এত নাটকের কী ছিল? তোর বোন তো কাল সকালেই চলে যেত বাসায়। পাঠিয়ে দিতাম আজ রাতটুকু মজা করে। এরপর বেতনও বাড়তো, সুযোগসুবিধাও বাড়তো। শুধু শুধু এত হাঙ্গামার দরকার ছিল না।’

লোকটার কথায় ঘৃণায় ভোরে যাচ্ছিল অন্তরটা। কিন্তু কোনোমতেই উনার শক্তির কাছে পারছিল না করবী। হীরণও এলো তখনি। ছুটতে ছুটতেই ঢুকেছে বোধহয় বাড়িটাতে। হাঁপাচ্ছে সে। করবী ও বিন্দুর এ অবস্থা দেখে তার আত্মা যেন গলায় আটকে গেছে। দ্রুতই সে রান্নাঘরে ছুটে গেল। আশরাফুল ইসলামের উদোম শরীরে কয়েকটা কিল-ঘুষি দিল।
হাতাহাতি লেগে গেল মুহূর্তেই। করবী চিৎকার করে বলল,
‘পুলিশ কোথায়? পুলিশ আনোনি? জানাওনি?’

হীরণরা তখন হাতাহাতিতে ব্যস্ত। এক পর্যায়ে এসে লোকটা হীরণের বুকে একটা লাথি লাগিয়ে দিল। দানবের মতন শক্তি তার। লাথির চোটে হীরণ ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। ভদ্রলোক আরেকটি দানবীয় লাথি দেওয়ার আগেই তার ঘাড়টা মাথা থেকে আলাদা হয়ে গেল। ছিটকে গিয়ে পড়ল কাঠের চেয়ারটির পাশে। তরতাজা ভদ্রলোকের মাথা বিহীন উদোম দেহটি তুমুল শব্দে পড়ে গেল ফ্লোরে। র ক্তে ভেসে গেল ফ্লোর। কী বিভৎস সেই দৃশ্য! হীরণের মতন নির্ভয় পুরুষ অব্দি চোখ বন্ধ করে ফেলল।

#চলবে….

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৭

কলমে: মম সাহা

আজ গরম পড়েছে ভীষণ। পুলিশ স্টেশনে ভিড়ও বড়ো বেশি। কেমন হাউকাউ চারপাশে! মনে হচ্ছে যেন মাছের বাজার। থানার বড়ো সাহেব কয়েকবার জোরে জোরে ধমকে উঠেছিল। ধমকের পর সবটা শুনশান নিরবই থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার যেমনটা তেমন হয়ে যায়।
করবী দাঁড়িয়ে আছে লোহার শিকের ভেতরের বদ্ধ ঘরটায়। হীরণ বসে আছে বড়ো সাহেবের সামনে। অনবরত ঘামছে ছেলেটা। কেমন উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারা লাগছে তাকে। থানার বড়ো অফিসার রশিদ সাহেব পা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘কী ব্যাপার? এভাবে বসে আছেন কেন? বাড়ি যান। নয়তো খুনের সময় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বিধায় আপনাকেও জেলে ভরা হবে।’

রাশিদ সাহেবের কথাতেও ভয় পেতে দেখা গেল না হীরণের ভেতর। বরং সে বেজায় চিন্তিত হলো। পাংশুটে মুখে বলল, ‘আপনাদের তো আমি রাতেই ইনফর্ম করে গেলাম। উঠি-বসি? বলার সাথে সাথেই চলে যাওয়া যায়? আপনারা কী ভাবেন পুলিশদের? স্প্রাইটার ম্যান? নাকি জিন, পরী? উড়াল দিয়ে চলে যেতে পারার ক্ষমতা আছে আমাদের।’

রশিদ সাহেব যতটুকু জোরে চেঁচালেন তার চেয়ে অধিক জোরে থানার কাঠের চেয়ারটায় লাথি দিল হীরণ। রাগে কাঁপছে ছেলেটার শরীর। করবী ভেতর থেকেই ডাকল। নিষেধ করল রাগারাগি না করার জন্য। কিন্তু শুনল না হীরণ। টেবিলে জোরে শব্দ করে ঘুষি দিল।
‘খু ন হওয়ার সাথে সাথে চলে এসে ছিলেন কীভাবে? তখন কী স্প্রাইডার ম্যান হয়ে গিয়ে ছিলেন নাকি জিন, পরি?’

রশিদ সাহেবের ভালো লাগল না হীরণের অতি সাহস। ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। উঠে গিয়ে কলার চেপে ধরল তৎক্ষণাৎ। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘থানাতে এসে গুণ্ডামি? দিবো লকআপে ভরে?’

করবী ভেতর থেকেই আকুতিভরা কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, স্যার ওকে ছেড়ে দেন। ওর মাথাটা গরম হয়ে আছে সেজন্য ভুল করে ফেলছে। আমি ক্ষমা চাচ্ছি ভুলের জন্য।’

রশিদ সাহেব করবীর দিকে একবার তাকালেন। তখনই একজন কনস্টেবল এসে ছাড়িয়ে নিলেন দু’জনকে। স্যারকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে টেনে হীরণকে বের করে আনলেন থানার বাহিরে। হীরণ রাগে ফুঁসছে অনবরত। কনস্টেবল সালাহউদ্দিন হীরণকে বড়ো স্যারের সামনে থেকে কিছুটা আড়ালে নিয়ে গিয়েই দাঁড় করালেন। নম্র কণ্ঠে বললেন, ‘এসব করবেন না। আপনাদের ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। এসব করে ঝামেলা বাড়াচ্ছেন।’

হীরণ ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘শা লা, মাদার** দলেরা। ইচ্ছে করে এটা করেছে। কাল আমি যখন বলে ছিলাম তখন আমার সাথে গেলেই আজ এত কিছু হতো না।’

‘আপনার সাথে যায়নি কারণ আছে। আশরাফুল ইসলামের অনুমতি বিহীন তার বাংলোতে কেউ যাবে না। সে যে-ই হোক। এত বড়ো একজন শিল্পপতি তিনি, তার এতটুকু পাউয়ার তো চলছেই আইনের বাজারে।’

সালাহউদ্দিনের কথায় আকাশ থেকে যেন পড়ল হীরণ। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বলল, ‘কী!’

‘হ্যাঁ, আমি ঠিক বলেছি। এসব শিল্পপতিদের ক্ষমতা। আপনার, আমার মতন সাধারণ জনতা কিছুই করতে পারবে না এখানে। তাই তো আপনি সাহায্য চাওয়া স্বত্বেও সঠিক সময় আইনের লোক গিয়ে পৌঁছায়নি।’

রাজনীতির এই বিদঘুটে গল্প শুনে হতভম্ব হয়ে গেল হীরণ। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে! এখন কী করব আমরা?’

‘কেইস কোর্টে উঠবে। উকিল ঠিক করা আরম্ভ করুন। যদিও জানি আশরাফুল ইসলাম মরে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো উকিলও আসবে না। সবারই জানের ভয় আছে। বরং দেখা গেল যারা খু নীকে সাহায্য করবে তাদেরসহ জেলে ভরা হবে নানান কেইসে। এমন কত হলো! ভোগান্তি পোহাতে গিয়ে একটা সময় পর মানুষ আত্মহত্যাও করে। তাছাড়া যার সাথে ঐ লোক খারাপ কাজ করেছে তার ভোগান্তি হবে সবচেয়ে বেশি। মিডিয়ার মানুষ অতিষ্ঠ করে দিবে তার জীবনটা। ন্যায় বিচার তো পাবেনই না উল্টো সব হারাবেন। আমি তো আপনাদের আসামীকেও এসব বললাম। দেখতে দেখতে অভ্যস্ত তো।’

হীরণ পাথর মূর্তির মতন বসে রইল নিরুত্তর হয়ে। এই কোন গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেল তারা! তবে কী আর সবটা আগের মতন হবে না?
ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠল হীরণের। রিসিভ করতেই বাচ্চার কণ্ঠস্বর পেলো। এক সেকেন্ডেই বুঝল বাচ্চাটি হুতুম। কাঁদছে মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতে অনবরত বলছে,
‘মাস্তান তুমি কই? বাসায় আহো। বিন্দুবালা জানি কেমন করতাছে। আমার বিন্দুবালা মনেহয় পাগল হইয়া গেছে। মাস্তান, কই তুমি!’

বিন্দুর কথা শুনতেই তড়িৎ বেগে সে উঠে দাঁড়াল। হুতুমকে স্বান্তনা দিয়ে বলল, ‘চিন্তা করো না, হুতুম। বিন্দুবালার কিচ্ছু হয়নি। আমি আসতেছি। তুমি বিন্দুবালাকে জড়িয়ে ধরে রাখো। কিচ্ছু হয়নি।’
.

(৪৫)

আকাশে মেঘ করেছে খানিক। বৃষ্টি হবে কি হবে না তা আকাশ দেখে বুঝা যাচ্ছে না। খোলা আকাশের নিচে বসে আছে বিন্দু। ছাঁদের একদম কোণায়। চুল ভেজা। গোসল সেরে এসেছে। চোখ-মুখ শুকনো। দৃষ্টি পাথর।
হীরণ এসে ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। মিনিট পাঁচ হবেই। বিন্দুর হুঁশ নেই সেদিকে। এ-ই দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতিই বোধহয় তার ধ্যান নেই। সে এখন অন্য এক জগতে আছে। যেই জগত ভীষণ দুঃখী। হীরণ নিঃশব্দে গিয়ে বিন্দুর পাশে বসল। এক হাত দূরত্ব রেখে। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘কিরে? ভূতের মতন বসে আছিস যে! ধরল নাকি ভূতে?’

অন্য সময় হীরণের এক কথার বিপরীতে বিন্দু বলে দশ কথা। আজ তা করল না। এমন ভাবে ঠাঁই বসে রইল যেন সে শুনলোই না কথা। বিন্দুর নড়চড় না দেখে হীরণ আরও একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলল, ‘এমন চকচকে লাল রঙের জামা পরেছিস কেন? কেমন দেখা যাচ্ছে। তুই কী এসব রঙ বাদে ভালো রঙ চোখে দেখতে পাস না?’

প্রায় প্রতিবারই বিন্দুর জামা নিয়ে একটা মন্তব্য করা হীরণের চির-পরিচিত অভ্যাস। আর সেই মন্তব্যের বিপরীতে ইনিয়েবিনিয়ে নিজেকে অসম্ভব সুন্দরী দাবী করা বিন্দুর পছন্দের কাজ। অথচ আজ তেমন কিছুই হলো না। বরং বিন্দু বিরস কণ্ঠে বলল, ‘আমারে তো কুনু রঙেই ভাল্লাগবো না, হীরণ ভাই। আমি যে অসুন্দর। কালা, বিচ্ছিরি দেখতে।’

এমন মায়া মায়া গোপন অভিযোগে হীরণের বুকের ভেতর থাকা অদৃশ্য হৃদপিণ্ডটা যেন ছ্যাঁত করে উঠল। ধমকালো সে, ‘কী বলছিস? একটা চ ড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব। তুই অসুন্দর কে বলল? একদম এগুলা বলবি না।’

‘তোমারও কী সত্যি কথা হুনতে বুক কাঁপে, হীরণ ভাই? সবার মতন তুমিও কী সত্যি হুনতে পারো না? ডরাও?’

‘আমি সত্যি শুনতে পারি তবে এমন তাচ্ছিল্য করা কথা শুনতে পারি না। তুই এসব বলবি না।’

হীরণের নিষেধাজ্ঞায় হাসল বিন্দু। দূর গগণে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
‘হীরণ ভাই, আমি তাচ্ছিল্য করি নাই গো। আমার ভাইগ্যডাই এমন। আমি যেই হানে থাহি সেইহানের সব চুরমার কইরা ফালায়। আম্মা কইতো অপয়া। হয়তো রাগের বশেই কইতো। কিন্তু জানো? আম্মা ঠিকই কইতো। দেখলা না আপার ভাইগ্যডা। আমার লাইগ্যা আপারে জেলে যাইতে হইলো। আল্লাহ্ জানে আপার ভাইগ্যে কী আছে। আমি যে কিয়ের লাইগ্যা আপারে কল দিলাম! না দিলেই তো পারতাম। আমার লগে যা হওয়ার তো হইয়াই গেছিলো। আমার তো আপারে ডাকা উচিত হয় নাই। আমি একটা বার আপার কথা না ভাইবাই এত বড়ো বিপদে আপারে ডাইক্যা আনলাম। আপা হইলো কহনো এমন করতো না। বিপদ যেই হানে থাহে, আমার আপা আমারে হেই দিক থেইক্যা একশ হাত দূরে রাহে। আমি কেমনে পারলাম এইডা করতে! হীরণ ভাই, আপা আবার আমাগো কাছে আইবো তো?’

কথা শেষ করেই কান্না জুড়ে দিল বিন্দু। গা কাঁপিয়ে, হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা। ঠিক এ সময়ে নিজেকে বড়ো অসহায় লাগল হীরণের। কাকে রেখে কার কাছেই-বা যাবে সে? বিন্দুর কান্না থামানোর জন্য ডান বাহুতে হাত রাখল সে। সেই স্পর্শে কেঁপে উঠল বিন্দু। ছিটকে স্বরে গেল দূরে। ভীত, আতঙ্কিত এবং ব্যথাতুর স্বরে বলল,
‘ধইরো না, হীরণ ভাই। তুমি ধরলেও আমার ঐ লোকটার কথা মনে পইড়া যায়। তোমারে যে আমি ভালোবাসি। তোমার পবিত্র ছোঁয়ায় জা নো য়া রের আভাস পাইলে আমার যে খারাপ লাগে। আর এইহানে বড়ো ব্যথাও পাইছি।’

হীরণের মুখ চুপসে আসে। নরম কণ্ঠে বলে, ‘ব্যথা পেয়েছিস এখানে?’

‘ব্যথা না, হীরণ ভাই। কামড়াইছে বেডা। কুত্তা যেমন কামড়ায় এর চেয়েও খারাপ ভাবে। আমার পুরাডা শইল জ্বইল্যা যাইতাছে। তুমি একটু দূরে গিয়া বও তো। আমার পুরুষ মানুষ দেখলেই বুকটা কাঁপতেছে। ভয় করতাছে। ঘরে আমার পঙ্গু, নীরব আব্বা শুইয়া আছে বইলা আমার ঘরে যাইতোও ডর করতাছে। আমার হুতুম নিচে গেছে। অরে একটু আইন্যা দিবা, হীরণ ভাই? অর লগে যদি এমন হয়…. না, না। আমি জানি কী কইতাছি হীরণ ভাই। আমি কী পাগল হইয়া যাইতাছি?’

কথা বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে গেল বিন্দু। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতন এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। নিজের চুল টানতে লাগল। কপাল বারি দিতে লাগল ছাঁদের রেলিংয়ে।
হীরণ শক্ত হাতে মেয়েটাকে চেপে ধরতেই চিৎকার-চেঁচামেচি বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। কেমন হিংস্র সাথে ভীত কণ্ঠে বলতে লাগল,
‘আমারে ছাইড়া দেও, হীরণ ভাই। আমার তোমারেও ডর লাগতাছে। আর আমার শইলড্যা নষ্ট হইয়া গেছে। আমারে ছাড়ো। তুমি ময়লা হইয়া যাইবা। তোমারো বিপদ হইবো আপার মতন। ঐ দেখো হীরণ ভাই ঐ বেডার কাটা মা থাটা ঐখানে পইড়া আছে। কেমন কইরা চাইয়া আছে বেডায়। দেহো।’

উত্তেজিত ভঙ্গিতে বিন্দু ছাঁদের কোণা দেখিয়ে দিচ্ছে। অথচ সেখানে কিচ্ছু নেই। হীরণ আতঙ্কিত হয়ে গেল। হুতুম তবে এজন্যই হীরণকে কল দিয়ে অমনটা বলেছিল? বাচ্চাটা কী ভয় পেয়েছে? কোথায় গিয়েছে হুতুমটা?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে