বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩৪+৩৫

0
113

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৪
কলমে: মম সাহা

(৪৩)

উত্তপ্ত রোদ উঠেছে অন্তরীক্ষে। রোদের বোধহয় আজ ভীষণ রাগ মনে। তাই তো সেই অসীম তেজে জনজীবন এমন করে পুড়ছে।
বিদিশার হাতে এক কাপ চা। মাটির ছোটো কাপটি। বসে আছে একটি পার্কের কাঠের বেঞ্চিতে। মাথার উপর কৃষ্ণচূড়ার গাছে থরে থরে ফুটেছে লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়া। প্রথম সাক্ষাতে ফুলগুলোকে মনে হচ্ছে নতুন বউ। যে বেনারসি পরে বসে আছে লাজুক মাথা নিচু করে। সেই ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে উষ্ণ চুমুক দিল কাপটিতে। গরমে কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এই মধ্য বিকেলেও এমন ভ্যাপসা গরম যে কোথা থেকে আসছে কে জানে! চা-টাকে উপভোগ্য করার জন্য কাঁধের ব্যাগটা থেকে ফোন বের করল মেয়েটা। উদ্দেশ্য— একটি গল্প পড়তে পড়তে চা-টা উপভোগ করবে। তার আগেই নেট অন করতেই নোটিফিকেশনে ভোরে গেল ফোনের স্ক্রিন। এত এত মেনশনের নোটিফিকেশনে যেন আহাম্মক বনে গেল সে। নোটিফিকেশনে ক্লিক করে ফেসবুকে ঢুকতেই চোখের সামনে একটা ছোটো কনফেশন এলো। তার ছবিসহ কনফেশন। ছবিটা গত বুধবারের। যেদিন ভার্সিটিতে গাছের নিচে বসে সে কপাল কুঁচকে একটি বই পড়ছিল। কেমন সহজ, সুন্দর উঠেছে ছবিটি! নিজের ছবি দেখে নিজেই এক প্রকার মুগ্ধ হলো মেয়েটা। সেই মুগ্ধতার রেশ ধরেই কয়েক লাইনের কনফেশনটার দিকে তাকালো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল—
❝পৃথিবীতে কত সুন্দর, কত আকর্ষণীয় কিংবা কত মূল্যবান জিনিসই আছে! যার হিসেব নেই। আছে সাতটা আশ্চর্যের নাম খোদাই করা। অথচ গুণী মানুষ যদি কখনো আপনাকে দেখতো তাহলে নির্দ্বিধায় ঘোষণা দিতো- পৃথিবীতে সুন্দর, আকর্ষণীয়, মূল্যবান এবং আশ্চর্যজনক জিনিস কেবল একটাই আছে। তা হলো- বিদিশার নেশা।
এই যে বিদিশার নেশা শুনছেন, কপাল কুঁচকানো আপনাকে আমার ভীষণ মায়া মায়া লাগে।

ইতি
ও পথে থাকা পুরানো❞

ব্যস্! এতটুকু একটা কনফেশনে হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছে। এটা নতুন নয়। গত দুই-আড়াই বছর যাবত এমন ছোটোখাটো কনফেশন তার নামে আসছে। ভার্সিটির কনফেশন পেইজ থেকেই আসে। তবে বেশি নয়। মাঝে মাঝে দু একটা। এবং কনফেশনের ভাষায় এমন প্রেম মেশানো থাকে যে মাত্রাতিরিক্ত এটা নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। ক’দিন চর্চায় থাকে কনফেশনটা। ভাগ্যিস তার কোনো বন্ধু নেই! নয়তো উঠতে বসতে লজ্জা দিত। তবে ক্লাসমেট গুলো টুকটাক বলে। টুকটাক লজ্জাও দেয়। প্রথম প্রথম বিদিশা কড়াকড়ি জবাব দিত। জানাতো, সে বিবাহিত। তবুও কোনো হেলদোল দেখা যায়নি বিপরীত পাশের ব্যক্তির দিকে। বরং একদিন বিদিশার এমন কড়াকড়ি জবাবের বিরুদ্ধে কনফেশন দিয়ে বলল
“আমি তো প্রেমের প্রস্তাব দিইনি। কিংবা আলটিমেটাম জারি করিনি যে, বিদিশার নেশাকে আমারই হতে হবে! তবে কেন এত কাঠিন্যতা? কেন এত রাগ? মুগ্ধতা প্রকাশে যে ক্ষতি নেই। চাওয়া পাওয়া না রেখে মুগ্ধতা জানাচ্ছি তবুও কেন আসামীর মতন অনাদর করছেন?”…. এরপর থেকে আর বাড়াবাড়ি করে না বিদিশা। কনফেশনে কোনো রকমের রেসপন্স করে না। দেখে, পড়ে তারপর শেষ। ক্লাসমেটরা কয়েকবার ঠাট্টা করেও বলেছিল, এমন কনফেশন পেলে তারা নাকি জীবনও দিয়ে দিত। অথচ বিদিশা সামান্য রিয়েক্টও দেয় না। সেসব কথা মেয়েটা ধরেনি কোনো কালেই। তার কাছে মনে হয়েছে কনফেশন দেওয়া ব্যক্তির বাড়াবাড়ি রকমের ফাজলামো করার বাতিক আছে। তাই কখনো সে কোনো রকমের আগ্রহ দেখায়নি সেদিকে।

কনফেশনে বার কয়েক চোখ বুলালো সে। তিন-চারবার পড়লো। ক্যাম্পাসের কোনো জুনিয়র এই ফাজলামোটা করছে বলে তার মনে হলো। উত্তর না দিয়ে সে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে গেলো। ফোনের স্ক্রিন বন্ধ করে ব্যাগের ভেতর রেখে দিল। চা উপভোগ করতে গিয়ে চা হয়ে গেল ঠাণ্ডা। মনে মনে তার ভীষণ রাগও হলো সেজন্য।

করবী তার বাসাটা ছেড়ে দিয়েছে। কাউকে না বলেই ছেড়েছে। বাসা ছাড়ার দু’মাস আগ থেকে জানাতে হয় বিধায় সে আজ জানিয়ে দিয়েছে বাড়িওয়ালাকে। এবং ভীষণ আকুতি মিনতি করে বলেছে এ খবর যেন গোপন থাকে। এই শহরের প্রতি করবীর আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। শহর পুরোনো হয়ে গিয়েছে। এই পরিচিত হাওয়া-বাতাসে আজকাল তার শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে না। তার বড়ো নতুনের লোভ জেগেছে মনে। নতুন করে বাঁচার, নতুন করে স্বপ্ন দেখার লোভ। এই পুরোনো শহরে তার আর মন টিকছে না। সব ছেড়ে ছুঁড়ে কোনো এক পাহাড় কিংবা সমুদ্রের শহরে সে চলে যাবে। তার একা পৃথিবীতে নতুন যে কাছের মানুষদের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে, সেই ঘ্রাণ ধামাচাপা দিয়ে সে আবার একা হতে চায়। একা থাকার এই নেশা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।
বাড়িওয়ালার বাসা থেকে বেরিয়েই সে নিচে নামল। বাজারে যেতে হবে একটু। ঘরে কিছু নেই। টুকটাক কেনাকাটা করবে। রোদ মাথায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুতেই তার দেখা হলো পরিচিত মানুষটার সাথে। বেশ অনেকটা দিন পরই এই দেখা। গরমে লাল হয়ে আছে মানুষটার মুখ। করবী আজ কোনো সংকোচ করেনি, কোনো সংশয় করেনি মানুষটার দিকে এগিয়ে যেতে। মানুষটার কাছে গিয়ে বিনা বাঁধায় বলল,
‘এখানে যে! কোনো দরকারে নাকি?’

তিমিরের মুখ-চোখ শুকনো। মনমরা মেজাজ লাগছে। শান্ত, নিবিড় কণ্ঠে জবাব দিল, ‘তোমার কাছেই এসে ছিলাম।’
‘বাসায় যাবেন? চলুন তাহলে।’
‘কোথাও যাচ্ছিলে?’
‘হ্যাঁ, বাজারে।’
‘তাহলে চলো, হাঁটতে হাঁটতেই বলি।’— তিমিরকে বেশ গম্ভীরই দেখাল। হয়তো মন খারাপ প্রচন্ড।
করবী সম্মতি দিয়েই হাঁটা শুরু করল।

‘তোমায় একটা কথা বলব?’— কথাটি জিজ্ঞেস করেই উত্তরের আশায় থামল তিমির। করবীও থামলো সাথে সাথে। শুধাল,
‘কী কথা?’

‘এই যে আমি আরেক জনকে ভালোবাসতাম, এটা তুমি জানো?’

করবী জানে তবুও ভনিতা করে বলল, ‘না তো! কখনো বলেননি তো! নাকি বলেছিলেন? আমার ঠিক মনে নেই।’

করবীর ভনিতা বুঝতে পারল তিমির। বুঝতে পারারও কথা। করবী বুঝিয়েই ভনিতাটা করেছে।
‘না আমি বলিনি কখনো।’
‘তাহলে? না বললে জানব কীভাবে?’
‘কেন আমার ভাবি বলেনি? কিংবা আমাদের বাসার আশেপাশের কেউ বলেনি?’

করবী ভ্রু নাচালো এহেন কথায়, ‘কেন? কেন? আশেপাশের কেউ বলবে কেন? তারাও কী জানে নাকি? এত ফেমাস প্রেম কাহিনি?’

তিমির ফুস করে শ্বাস ফেলল। করবী জেনেই যে ইচ্ছেকৃত এসব বলছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। সে ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘ফেমাস নয়, বলো ভয়ঙ্কর। ভালোবাসা না পেয়ে যেই পাগলামি করেছি তার কথা সবাই জানে। আমি সত্যিই ওরে ভালোবাসতাম। এখন হয়তো আর বাসি না। বাসলে তোমাকে মনের ভেতর আনতে পারতাম না।’

করবী তিমিরের এমন স্বীকারোক্তিতে ভ্যাবাচেকা খেলো। চুপ করে গেল তাই। তিমির করবীকে চুপ করতে দেখেই ওর হাতটা টেনে ধরল। মিনতি করে বলল,
‘রক্তকরবী, আমি তোমাকে বলতে কেবল তোমাকেই ভালোবাসি। অন্য কেউ হিসেবে নয়। তুমি হিসেবেই। ও চলে যাওয়ার পর আমি পাগল হয়ে গেছিলাম। তুমি চলে গেলে আমি হয়তো মরেই যাব। প্লিজ তুমি আমার একটা কথা রাখো।’

তিমিরের আকুতি মিনতিতে হতভম্ব হয়ে গেল করবী। রাস্তায় তখন বেজায় মানুষ। করবী অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কী করছেন? আশেপাশে কত মানুষ। সবাই দেখছে।’

‘করবী, আমায় তুমি বিয়ে করবে, প্লিজ! আমাকে বাঁচিয়ে নেও।’

এ যেন তীব্র বজ্রপাত ঘটালো রৌদ্র তপ্ত দিনে। করবী টেনে সরিয়ে নিলে হাতটা, ‘কী বলছেন! আপনি ভালোবাসেন সেজন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে? আমি তো ভালো না-ও বাসতে পারি!’

তিমির হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। কেমন উন্মাদ, উদ্ভ্রান্ত দেখাল তাকে। সে হাত জোর করে বলল,
‘জানি তুমি ভালো না-ও বাসতে পারো তবুও আমার হয়ে যাও না। এমন কতই তো হয়, একজন আরেকজনকে ভালো না বেসেও যুগের পর যুগ সংসার করে যাচ্ছে! যেমন ধরো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে তো ভালোবাসা-বাসির সুযোগ থাকে না, তবুও তো তাদের সংসার কেটে যায় যুগের পর যুগ। তুমি নাহয় তেমনটা ধরে নাও। কখনো না কখনো তো কারো সাথে তোমার জীবন জড়াবে তবে আমার সাথে নয় কেন? আমাকে বাঁচিয়ে নেও না করবী!’

এই আকুতি করবীকে দিশেহারা করে দিল। পালিয়ে যেতে চাইল সে পরিস্থিতি থেকে। তিমির চিৎকার করে ডাকল, ‘করবী, আমি সত্যিই মরে যাব এবার। একটা মানুষ তোমাকে পেলে বেঁচে যেত এই আফসোস সবসময় বয়ে বেড়াতে হবে তোমাকে। মিলিয়ে নিও। আমার বাঁচার সাধ ছিল অনেক। বাঁচতে দিলে না! এত নিষ্ঠুর হলে!’

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৫
কলমে: মম সাহা

❝কৃষ্ণচূড়ার লালে যেই মুগ্ধতা ঝরে, সেই মুগ্ধতার চেয়েও শতসহস্র কোটি বেশি মুগ্ধতা অঙ্গে ধারণ করার ক্ষমতা যে নারীটির আছে সে হলো- বিদিশার নেশা। তার চোখে সভ্যতার সাতসমুদ্র যেন টলমল করে। উষ্ণ গরমে তার ঠোঁটে থাকা উষ্ণ চা-কে আমার বড়ো হিংসে হয়। কখনো আমাদের নিবিড় কাছাকাছি আসার গল্প হলে আমি আপনাকে একটি বড়ো গোপন কথা বলব। কেমন করে গুনে গুনে এতগুলো বছর তাকিয়ে ছিলাম তৃষ্ণার্ত হয়ে তা-ও জানাবো।’

ইতি
ও পথে থাকা পুরোনো❞

আরও একটি কনফেশনে উথাল-পাতাল হলো নিউজফিড। এবারের ছবিটি পার্কের। অন্যমনস্ক হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার দৃশ্য। তাকে মনে হচ্ছে উনিশ শতকের কোনো চিত্রনায়িকা। টানা টানা চোখ মুখ। উদাস, উন্মনা ভাব! প্রথম অবস্থায় নিজের ছবিটি দেখে দারুণ রকমের মুগ্ধ হলো সে। এই কনফেশন দেওয়া লোকটির যে অসাধারণ ছবি তোলার প্রতিভা রয়েছো তা তার একেকটি নিখুঁত ছবিই প্রমাণ দিচ্ছে।
কত-শত কমেন্টের ভিড়ে তার চোখ নিতান্তই অমনোযোগী হয়ে বার কয়েক ঘুরে বেড়ালো ফোনের স্ক্রিনে। কনফেশনের পাতায়। একটা মানুষের মুগ্ধতা কতদিনের হতে পারে? পাঁচ মাস? দশ মাস? বড়োজোর একবছর। তাই বলে আড়াই-তিনবছর ধরে একটা মানুষ কেবল কনফেশনই দিয়ে যাবে? এত গুরুতর ভালো লাগা? নাকি নেহাৎ ফাজলামো?
ভাবনার মাঝেই ফোনে কল বেজে উঠল বিদিশার। স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার দেখে রয়েসয়ে কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ভাসা ভাসা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল,
‘বিদিশা বলছিস?’
কণ্ঠটি স্বল্প পরিচিত হওয়ায় বিদিশা সম্মতি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কে?’
‘আমি, শাহেদ। চিনতে পেরেছিস? নাকি আত্মীয় স্বজনদের ভুলে টুলে বসে আছিস?’

বিদিশা চিনতে পেরেছে নাম শুনেই। শাহেদ তার ফুপাতো ভাই। বড়ো ফুপির ছেলে।
‘হ্যাঁ, চিনেছি।’
‘কী বলিস! চিনে গেলি এত দ্রুত? যেভাবে শ্বশুর বাড়িতে খুঁটি গেড়ে বসে ছিলিস, ভেবেছিলাম তো আমাদের মনে রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা তুই বোধ করিস না।’

শাহেদ এমনই। সবসময় ঠাস ঠাস কথা বলে। বিদিশা কোনোরূপ তর্ক না করেই বলল, ‘মেয়েদের তো জীবনটা কাটাতেই হয় শ্বশুর বাড়িতে। খুঁটি গেড়ে না বসলে হবে?’

‘লাভ কী হলো? সেই তো খুঁটি ছেড়ে চলে আসতেই হলো!’ পরম হেলাতেই যেন কথাটা বলল শাহেদ। যেই তাচ্ছিল্য পছন্দ হলো না বিদিশার।
‘কোনো দরকার ছিল আপনার?’
‘কেন? দরকার ছাড়া কল দিতে পারি না? নাকি শিডিউল করে এখন থেকে কল দিতে হবে তোকে?’
“না, তার জন্য নয়। গত কয়েক বছরের কখনোই তো কল দেননি, তাই বললাম।’
‘দিবো কীভাবে? আত্মীয় স্বজন ছেড়ে দিয়ে যেমন করে সংসার করছিলিস! আমাদের সাথে কথা বলার সময়ই বা কই ছিলো তোর!’
কথাটির বিপরীতে আর কী বলবে বুঝে আসল না বিদিশার। তাই চুপচাপ রইল।

অপরপাশ তাকে চুপ থাকতে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, ‘তব্দা খেয়ে গেলি মনে হয়? আচ্ছা যাই হোক, মামিকে দে। কথা আছে। মামি কল ধরছে না।’

‘দিচ্ছি..’ বলেই যেই না কান থেকে ফোন নামাতে নিবে সেই মুহূর্তে শাহেদ নরম কণ্ঠে বলল,
‘আমার কথায় রাগ করেছিস?’

বিদিশা কোমল স্বরে বলল, ‘আরে না।’
‘করিসনি কেন? কর রাগ। তুই রাগ করলেই কী আর না করলেই কী! যা মামিকে ফোনটা দে।’

শাহেদের এমন কথায় না চাইতেও হেসে দিল বিদিশা। হাসতে-হাসতে বলল, ‘একটুও বদলাননি।’
‘বদলানোর কথা ছিল বুঝি? তুই বদলে গিয়েছিস বলে আমাকেও বদলাতে হবে?’
‘আমি বদলে গিয়েছি? কই?’
‘এই যে কাছের তুমি সম্বোধন করা আত্মীয়দের দূরের বানিয়ে আপনি ডাকছিস, এটা কী বদলানো নয়?’

শাহেদের কথায় জিবে কামড় দিল বিদিশা। সে যে শাহেদকে তুমি করে বলত তা তার ঘুণাক্ষরেও মনে ছিল না। থাকবেও বা কীভাবে? যোগাযোগ না হতে হতে, সম্পর্ক গুলো এতটা দূরের হয়েছে কবে টেরই পেল না। অথচ যে-ই সংসারের জন্য এতকিছু শেষমেশ সেই সংসারটা রইল না।

_

বিছানায় সুবাস হীন বাতাস এসে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেনামি জোছনাটা এসে করবীর অঙ্গ চুইয়ে পড়ছে। চোখে-মুখে মেয়েটার ঘুম নেই। ঘুম থাকারও না। দুপুরে যেমন ঘটনা ঘটলো তার সাথে, তারপর ঘুম আসার কথাও না। রাস্তার মানুষ যেমন চোখ করে করে তাকিয়ে ছিল তার দিকে! বাড়িওয়ালী চাচী ফোন দিয়ে সেই সম্পর্কে কয়েকটা কথাও বলেছেন।
সে তিমিরকে তখনের মতন বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন কী করবে? কী করার? তিমিরকে বিয়ে করাটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে? জীবনের কোনো মোড়ে গিয়ে কী মনে হবে তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল?
নিজেকে বড়ো অসহায় লাগল তার। চারপাশের এই খা খা শূন্যতায় বুক কাঁপল ভীষণ। বাবাটার বেঁচে থাকা উচিত ছিল। বাবা থাকলে আজ নিশ্চয় করবীকে বুঝাতে পারত কোনটা সঠিক হবে কিংবা কোনটা ভুল!

করবী বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে আলো জ্বালালো। পড়ার টেবিল থেকে বাবার ডায়েরিটা নিয়ে বসল বারান্দার ফ্লোরে। এর আগে কখনো পড়া হয়নি এই অনুভূতি ধরে রাখা ডায়েরিটার ভেতর কী লিখা আছে সেটা। বাবা ডায়েরি লিখতে ভালোবাসত। শৌখিন মানুষ ছিল ভীষণ! ভালোবাসা তার কাছে এক অনন্য শৌখিনতা ছিল বোধহয়।

ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতেই ভেসে উঠলো তারিখ,

০৩-০৬-১৯৮৭
পড়ার মোড়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটি মেয়ে, টিয়া রঙের ফতুয়া পরনে। চুল গুলো ছোটো ছোটো করে কেটে ঘাড় অব্দি করে রেখেছে। মেয়েটি এসে আবুল চাচার দোকানে বসে চা খেলো। আড্ডার সকলে তো তার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। বন্ধু আজিজ টিটকারি মেরে বলল- টিয়াপাখি। বন্ধু রিয়াজ শিস বাজালো। মেয়েটি বোধহয় ওদের আচরণে বিরক্ত হলো। কেমন করে যেন তখন তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে!

করবী অবাক হলো। এত পুরোনো দিনের ডায়েরি! আজ ২০২৪ অথচ আব্বু যখন ডায়েরিটা লিখেছিল তখস ১৯৮৭ সবে!

উৎসাহ নিয়ে পরের পৃষ্ঠা গুলো উলটাতে শুরু করল করবী—

১০-০৬-১৯৮৭
সাত দিন পর আবার দেখা আজিজের দেওয়া ‘টিয়াপাখি’ নামের মেয়েটার সাথে। মেয়েটা থাকে রায়বাহাদুর রোডে। শৌখিন আর বিলাসবহুল পরিবারের মেয়ে। আজ সব খোঁজ বের করলাম। মেয়েটার নাম রঙ্গিণী জাহ্নবী। বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। তার বড়ো দু’টো ভাই আছে।

১৯-০৬-১৯৮৭
আজ জাহ্নবীর সাথে প্রথম কথা হলো। মেয়েটা বেশ প্রাচুর্যে খামখেয়ালিতে অভ্যস্ত। ব্যবহার সহজ-সরল। এবং ভালো। মিশুকও। সুন্দর করে কথা বলে। কে দেখলো, কী করল তা ভাবে না এতকিছু। আমাকে দেখেই কত সোজা ভাবে বলল আমি নাকি দেখতে সুপুরুষ।

করবী ডায়েরির পৃষ্ঠা উলটাতে উলটাতে আরও কত কী পড়ল! তার মায়ের পুরো নামটাও বোধহয় আজ জানলো।

ডায়েরির পাতা পড়তে পড়তে গিয়ে থামল ১৯৯২ তে। লেখা-

০৮-০৯-১৯৯২
সাহেবারর সাথে এত বছরের প্রেম অথচ আজ সব বোধহয় শেষ। কী বেধড়ক মারটাই না মারল ওর ভাইরা আমাকে। আমার মা তো কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছে। আমার ভাইরা আমাকে বুঝিয়েছে যেন আর সাহেবার কাছে না যাই। আর ছোটো জন তো কতক্ষণ হম্বিতম্বি করল। সাহেবার ভাইদের দেখে নিবে জানাল। আমাকে মারছে দেখে সাহেবার সে কী রাগ! চিৎকার! কেঁদেছেও বোধহয়। মায়া হলো ওর জন্য।

০১-০১-১৯৯৩
আমি আর সাহেবা আজ পালিয়ে বিয়ে করেছি। এখন মধ্যরাত। আমার ছেলেমানুষ সাহেবা ঘুমিয়ে আছে। বড়ো ক্লান্ত কি-না! মেয়েটার মাথায় কী যে চাপলো? হুট করে বলছে, সাহেব বিয়ে করব। হুট করে বিয়ে করা যায়? মেয়েটা তো বুঝবেই না। তাই বিয়ে করে ফেলেছি। আমার জীবনে সাহেবা ছাড়া আর কীই-বা আছে? তাই ওর আবদারটুকু রাখলাম।

এরপর ডায়েরির পাতায় কথা যেতেই থাকে। সংসারের গল্প, বিবাহিত খুনসুটির গল্প, আর গল্প সাহেবার প্রতি মুগ্ধতার। করবী যেন হারিয়ে গেল বাবা-মায়ের অদেখা সংসারে। কী সুখেরই না সংসার!
কিন্তু এই সুখ হুট করে এক পাতাতে গিয়ে বড়ো ফ্যাকাশে লাগল। করবীর কপাল কুঁচকে এল,

তারিখ: ০৮-০৩-১৯৯৪
আজকাল রূপকথার সংসারে যেন কীসের ছায়া পড়েছে! আমার অনেক ভালোবাসা সাহেবা কেমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। আমার পরিবারের কারো সাথে একটুও বনিবনা হচ্ছে না তার। কথায় কথায় ঝগড়া করছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাহেবার কী মন খারাপ? এই সাহেবাকে বড়ো অপরিচিত লাগে আমার। কাউকে বলতেও পারি না। সাহেবা কেন বুঝে না তাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি?

১৫-০৫-১৯৯৪

আজ বেশি কিছু বলব না। কেবল বলব, আমার পরিবারে অতিথি আসবে। আমার ছেলেমানুষি করার সাহেবা মা হবে।

২৬-১২-১৯৯৪
সাহেবাকে এত বুঝিয়েও সংসারে ফেরাতে পারছি না। যেই মন তার বাহিরে গিয়েছে সেই মন কী আদৌ ফিরবে সংসারে? আমি তো সাহেবার এমন বড়ো অন্যায় ক্ষমা করেও আমার আসন্ন সন্তানদের সাথে নিয়ে সুখে থাকতে চাচ্ছি তবে সাহেবা নিষ্ঠুর হচ্ছে কেন?

করবী বুঝল, বাবার সুখী সুখী সংসার বোধহয় সেখানেই থেমে গিয়েছিল। কেমন লেখা গুলোতে এক রাশ অভিমান, অভিযোগ জড়ানো!

পৃষ্ঠা উল্টে গেলে সেই কাঙ্খিত দিনে,
০৮-০৩-১৯৯৫
আজ আমার ঘরে দুই রাজকুমারী এসেছে। আমার দু’টি আত্মা। ওদের নাম……

করবী বাকিটা পড়তে পারল না তার আগেই তার অনবরত বাজতে থাকা ফোনের রিং এ সে বিরক্ত হলো। এবং মনে মনে এক অপ্রত্যাশিত কথা জানতে পেরে বিস্মিতও হলো।
করবী ডায়েরিটা রেখে ফোনটা তুলল। কিছুদিন আগেই নতুন ফোনটা কিনেছিল। অপরিচিত নাম্বার দেখে কিছুটা ভেবেচিন্তে ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে একটা মেয়েলি কান্না ভেসে এলো। করবী বুঝতে না পেরে বলল, ‘কে?’

হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সেই কণ্ঠ, ‘আপা, আমি। আমি বিন্দু। আপা আমার সব শেষ আপা। হুতুমরে তুমি দেইখ্যা রাইখো। আমার সব শেষ।’

আঁতকে উঠল করবী, ‘কাঁদছিস কেন, বিন্দু? কোথায় তুই?’
‘আপা, আমি নষ্ট হইয়া গেছি। তোমরা ভালা থাইকো, আপা। হুতুমরে দেইখো।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে