#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
পর্ব: ৩২ (একাংশ)
(৪২)
ছয়তলা বিশিষ্ট বাড়িটির চতুর্থ তলাতেই বিদিশাদের ফ্ল্যাট। ছিমছাম একটু ফ্ল্যাট। দুটো রুম আছে, একটি মাঝারি আকারের ড্রয়িংরুম আছে সাথে রান্নাঘর। সাদা ঝকঝকে রুম গুলো। করবী বসে আছে বিপাশার রুমের খাটে। টিয়ে রঙের একটি বিছানার চাদর বিছানো রুমটাতে। খাটের সাথে ছোটো টি-টেবিলে শরবত, কেক আর ফল দিয়ে গিয়েছে বিদিশার মা। করবীকে দেখে যে মেয়েটা ভীষণ খুশি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হুতুম বিদিশার বাবা জামাল ভূঁইয়ার সাথে ড্রয়িং রুমে বসে খেলছে।
‘তুমি এসেছ, আমি ভীষণ খুশি হয়েছি, আপু। আমি ভাবতে পারিনি তুমি আসবে।’
বিদিশা যে সত্যিই খুশি হয়েছে তা তার চকচকে চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। করবী বিদিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কোমল স্বরে বলল, ‘কেন ভাবতে পারনি? আমি কী তোমার কেউ না?’
বিদিশা জিবে কামড় দিল, ‘অমন কথা বলো না, আপু। কয়েকদিনে তুমি আমার অনেকটা আপন হয়ে গিয়েছ।’
করবী হাসল। শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুক শরবত পান করল। দৃষ্টি তার বিদিশার দিকেই। মেয়েটার চোখ-মুখ শুকনো। গালে ব্রণ দেখা যাচ্ছে। চোখের নিজে কালি। এমন লাস্যময়ী, সুন্দরী মেয়েটার মুখে এত অযত্নে ছাপ দেখে তার বড়ো মায়া হলো। নরম স্বরে বলল,
‘তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে আর কেউ, কোনো যোগাযোগ করেনি তাই না?’
‘করেছে। আমার দেবর করেছে।’
‘কেউ আসেনি?’
‘ভাইয়া আসতো কিন্তু সে তো এখন শহরের বাহিরে গিয়েছে ব্যবসায়ের কাজে। নাহয় ঠিক দেখা করত।’
করবী ছোটো করে বলে, ‘ওহ্।’
‘আচ্ছা আপু, তোমার সাথে যিনি এলো তিনি কে ছিল? তোমার তো তেমন ভাই টাই ছিল না শুনেছিলাম।’
এবার একটু হোঁচট খেল করবী। হীরণের আসলে কী পরিচয় তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল সে। তাই কতক্ষণ সময় কাটল মৌন। অতঃপর ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘বন্ধু।’
বন্ধু কথাটা শুনে ফিক করে হেসে দিল বিদিশা, ‘বন্ধু! বন্ধুই হবে হয়তো! আমি তো কী না কী ভাবলাম!’
করবীর নত মস্তকে বলল, ‘কী ভেবে ছিলে?’
‘এই তো, ভেবেছিলাম প্রেমিক হবে।’
বিদিশার কথাটা যেন ঝনঝনিয়ে কানে বাজল করবীর। তড়িৎ বেগে চোখ তুলে তাকাল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘না, না, অমন কিছু নয়।’
করবীকে বিচলিত হতে দেখে কিছুটা সন্দিহান চোখে তাকাল বিদিশা। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝেছি। তুমি এত বিচলিত হচ্ছ কেন?’
বিদিশার প্রশ্নের জবাব নেই করবীর কাছে। কেন বিচলিত হচ্ছে বলতেও পারল না। কেবল হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। এই যে বুকের ভেতর একটা সংশয় নিয়ে ঘুরছে সে, সেই সংশয়ের কথা কেমন করে বুঝাবে মানুষকে! এই যে সে যেখানেই ভালোবাসা পাচ্ছে সেখানেই গলে জল হয়ে যেতে চাচ্ছে, এমন কথা শুনলে মানুষ হাসবে না?
হাসবে। অবশ্যই হাসবে। মানুষ তাকে চরিত্রহীন বলে আখ্যায়িত করবে। বলবে তার বড়ো লোভ পুরুষের প্রতি। অথচ তেমনটা নয়। তার যে লোভটা কোথায় সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কার কাছে যাবে সে এই দ্বিধা কাটানোর জন্য? কে কাটাবে!
‘কিছু হয়েছে, আপু? কোনো সমস্যা?’ বিদিশা নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল।
করবী ছোটো উত্তর দিল, ‘না।’
‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো আপু। আমরা দু’জনে মিলে নাহয় সমাধান করব!’
বিদিশা সর্বোচ্চ ভরসা দেয়। করবীও যেন কিছুটা ভরসা পায়। জায়গাটা ভীষণ বিশ্বস্ত মনে হয়। সে কিছুটা অনিশ্চেয়তা বোধ নিয়েই বলে,
‘আসলে আমাকে যে দিত এলো সে আমাকে পছন্দ করে। মানে, ভালোবাসে।’
‘বুঝতে পেরেছি। তার চোখ মুখই সে কথা বলে গিয়েছে।’
‘বুঝতে পেরেছিলে!’
‘হ্যাঁ। তা, সে তোমাকে ভালোবাসে মানলাম। আর তুমি?’
ঠিক এই প্রশ্নটা তো তারও মন জুড়েই বিচরিত। সে-ও কী হীরণকে ভালোবাসে? নাকি সবটাই মায়া, মোহ, টান?
মেঘস্বরে সে বলে, ‘আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না আমি কাকে আসলে ভালোবাসি।’
করবীর এমন একটা উত্তর বোধহয় বিদিশা আশা করেনি। তাই কিছুটা অবাক নিয়ে বলল, ‘কাকে মানে? আরও কাউকে কী মিন করছ?’
করবী উত্তরে মাথা উপর-নীচ করে। তারপর তিমিরের সাথে প্রথমদিন দেখা হওয়া থেকে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত সব ঘটনাই টুকরো টুকরো বলে সে বিদিশাকে। হীরণের কথাও সব বলে। বলতে বাদ রাখে না বিন্দুর স্বচ্ছ প্রেমের কথাটিও। সবটুকুই মনযোগ দিয়ে শোনো বিদিশা। করবীর বাবার মৃত্যুর কথা শুনে তার মন খারাপও হয়।
সকলের গল্প বলেই বিরতি নেয় মেয়ে। মুখেচোখে তার অসহায়ত্ব। ভালোবাসা-বাসি নিয়ে তার বুকের ভেতর যে দ্বিধা তা সেই ক্লান্ত মুখটির দিকে তাকিয়েই বুঝা যায়।
‘এবার বলো তুমি, আসলে আমি কাকে ভালোবাসি? কীই-বা আমি চাচ্ছি? দু’জন মানুষকেই এমন ভাবে আশা দেখানো ভীষণ বাজে ব্যাপার। খারাপ কাজ। ধোঁকা দেওয়ার সমান। কিন্তু আমি নিজেই যে নিজের মন বুজছি না! কাকে সত্যিই আমি ভালোবাসি, কে-ইবা আমার মায়া?’
‘আমি যদি বলি তুমি কাউকেই সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো না। সেটা কী তুমি মানবে?’
বিদিশার টানা টানা চোখ গুলো করবীর পুরো মুখমন্ডল জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। করবী ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘এমনটা বলার কারণ?’
‘আসলে আপু, আমরা যদি কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি তাহলে দ্বিতীয় কাউকে ভাবতে পারি না আর। তুমি যদি হীরণ ভাইয়াকে ভালোবাসতেই তাহলে হয়তো আরেকজন তোমার জীবনে আসতে পারত না। আসলে আমরা মানুষেরা বরাবরই ভালোবাসার জন্য পাগল। আমরা ভাবি ভালোবাসা পেলে আমরা দুনিয়া ছাড়ার ক্ষমতা রাখি। আসলে তা-ই। ভালোবাসার লোভ বড়ো লোভ। তার উপর তোমার জীবনে কেউ নেই। মা, ভাই, বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন… কেউ না। তাই তুমি যেখান থেকে একটু স্নেহ, একটু ভালোবাসা পাচ্ছ সেখানেই আটকে যাওয়ার চেষ্টা করছ। যার ফলস্বরূপ দু’জন ব্যক্তির প্রতি তোমার অনুভূতি চলে আসছে। একজন ভাইয়া সুখে-দুঃখে তোমাকে ভালোবাসে গেছে নিঃস্বার্থে। তুমি সেটা জানো। তাই তার প্রতি তোমার মায়া কাজ করছে। অনেকবছর যখন আমরা কিছু পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে যাই তখন সেটা মনে হয় আমাদের অধিকার। কিন্তু আসলেই কিন্তু তা নয়।
আবার তুমি দ্বিতীয় যে মানুষটার প্রতি টান অনুভব করো সেটা আকর্ষণ থেকে। এই যে হুটহাট বিপদে একজন মানুষ তোমাকে সাহায্য করেছে বিনা স্বার্থে, তোমার প্রতি তার অধিকার দেখিয়েছে তুমি এতেই ভেবে ফেলেছ এই নশ্বর জীবনে তোমার বোধহয় নিজের একটা মানুষ হলো! এবং তাই তার প্রতিও তুমি দুর্বল ভাবছ নিজেকে। আসলে দুর্বলতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। আমাদের খুব খারাপ সময়ে কেউ আমাদের সাথ দিলে আমরা তার প্রতি দুর্বল হয়ে যাই। সে যে-ই হোক। তোমার ক্ষেত্রেও তাই। এই যে আগে কখনো তুমি ভাবোনি তুমি হীরণ ভাইয়াকে ভালোবাসো, সেটা কেন? কারণ আগে তোমার সুখে-দুঃখে সে ভালোবেসে গেলেও কোনো বিপদে তাাে পাওনি। তাই দুর্বলও হওনি। আর দুর্বল হওনি বলেই হীরণ ভাইয়া আসলে তোমাকে কতটুকু ভালোবাসে তা উপলব্ধি করোনি। এই যে এখন তোমার এমন একা সময়ে সে সাথ দিচ্ছে তাই তোমার মনে হচ্ছে তুমি তাকে ভালোবাসো। মূলত বিপদে তাকে সাথে পাওয়ার পর দুর্বলতা তৈরি হয়েছে তোমার মনে। যদি ঐ ভাইয়াটা এখন তোমার পাশে থাকত তাহলে বোধহয় জীবনে কখনোই তোমার এমনটা অনুভব হতো না। মূলত মানুষ যখন একা হয়ে যায়, তখন যাকে পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। মানুষের স্বভাবই এটা। তুমি তার বাহিরে যে নও।’
বিদিশার এত সুন্দর উপস্থাপনা এবং যুক্তির কাছে করবীর সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব যেন কর্পূরের মতন উবে গেল। মেয়েটা তার চেয়ে বয়সে ছোটো হলেও প্রচন্ড বুঝদার। এতটা বুঝদার বোধহয় সে কখনোই হতে পারবে না।
তাদের কথার মাঝেই বেল বেজে উঠল। বিদিশার মা হাঁক ছেড়ে বলল, ‘বিদু, দেখ কে এসেছে।’
বিদিশা করবীকে বসতে বলে চঞ্চল পায়ে ছুটে গেল। পরপরই ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠ। করবীর বুক ছলাৎ করে উঠল। বিদিশা ছুটে এসে বলল,
‘আপু, আমার দেবর এসেছে। আজ কী সৌভাগ্য আমার! তোমরা সবাই আসছো দেখতে!’
করবীর বুকের হৃদপিণ্ডটা থেমে-থেমে কাঁপল। বিদিশার দেবরের সাথে তিমিরের কণ্ঠের এত মিলে তার মস্তিষ্ক তাজ্জব বনে গেল।
#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
পর্ব: ৩২(বাকিংশ)
আকাশে বড়ো রূপোর থালার মতন চাঁদ উঠেছে। জোছনা হামাগুড়ি দিচ্ছে কংক্রিটের রাস্তায়। মনে হচ্ছে প্রেম বুকে পুষে রাখা শক্ত প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে বৈরাগী ভাবে।
বিন্দু পথের দু’পাশের ফুটপাতটায় বসে আছে। বাড়ি ফেরার তেমন তাড়া নেই শরীরের ভেতরে। আজকাল বড়ো ক্লান্ত লাগে নিজেকে। এই এত জনবহুল শহরটাতে তার ক্লান্তি মোছার মানুষের বড়োই অভাব। আঠারো বর্ষীয়া জীবনটায় আশি বছরের তিক্ততা যেন ভর করে আছে। এই যে শরীরের কোনো অঙ্গে ক্ষত হয়ে যখন সেটা ক্যান্সারে পরিণত হয় ডাক্তার তখন অঙ্গটা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ এইযে দুঃখটা গোগ্রাসে বুকের ভেতর যন্ত্রণা গেঁথে গেঁথে ক্যান্সার তৈরি করে দিচ্ছে তা কেটে ফেলার কোনো গতি নেই। বাজারে কোনো সস্তার মলমও নেই সেই ক্ষত কমানোর।
বিন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলল। রূপালী চাঁদ বুকে নিয়ে হাসতে থাকা মস্ত বড়ো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘খোদা, চাইর আনার জীবনে দুঃখই দিলা চৌদ্দ আনার। এবার এই জীবন বইয়া নেওয়ার শক্তিও দিও।’
বিন্দুর সৃষ্টিকর্তা নীরবে বোধহয় এই প্রার্থনা শুনে। মস্ত বড়ো আকাশ তো কথা বলতে জানে না। জানলে নিশ্চয় স্বান্তনা দিতো মেয়েটাকে। হু হু করে শূন্য বাতাস বয়ে যায় গা ছুঁয়ে।
‘কিরে, রাস্তার মাঝে এমন করে বসে আছোছ ক্যান? মনে হচ্ছে কুল-কিনারাহীন মানুষ তুই!’
পরিচিত পুরুষটির কথায় মুখ তুলে তাকাতেই ক্লান্ত মনটা শীতলতায় ছেয়ে গেল। যেন খোদা শুনে নিল প্রার্থনা। বাজারে সস্তার মলম হয়ত নেই তাই দুঃখ কমানোর মানুষ পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
‘আরে হীরণ ভাই, তুমি এইহানে যে!’
হীরণ বাইকটা আরেকটু সামনে নিয়ে রাখল। তারপর এসে বসল বিন্দুর পাশে। মিছিমিছি কপাল কুঁচকে বলল, ‘ক্যান? এইহানে কী আমার আসা নিষেধ?’
‘আরে না না, কোনো কামে আইছো কি-না জিগাইলাম।’
‘তো কামেই তো আইছি। এই যে তোর লগে বইস্যা থাকার কামে আইছি।’
বিন্দু হা হা করে হাসল। লোকটা তার সাথে কেমন যেন তার মতন নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলে! টেনে টেনে সুর ধরে।
‘হাসছিস কেন?’
‘তুমি এমন কইরা কথা কইলে আমার হাসি আহে।’
‘কেমন কইরা কইলাম?’
বিন্দু দম নেয়। হীরণ ভাই যে কথা প্যাঁচানোতে বাড়াবাড়ি রকমের অসাধারণ তা মেয়েটার জানা। তাই সে কথা আর প্যাঁচাতে না দিয়ে আগের প্রসঙ্গে গেল, ‘বললে না কীয়ের লাইগ্যা এইহানে আইছো?’
‘তুই কী বধির হয়ে যাচ্ছি, বিন্দু? বললাম না তোর জন্য আসছি। ভাবলাম এপথে যাচ্ছি যেহেতু তোকে নিয়ে যাই।’
‘মিছা কথা কইও না তো!’
হীরণ তাজ্জব বনে গেল। কী অদ্ভুত! মেয়েটা তার সত্যি কথাটাকে বিশ্বাসেই করছে না। হীরণ এবার অধৈর্য আর খানিকটা বিরক্ত হলো, ‘মিথ্যা কথা আমি বলি?’
‘না।’
‘তাইলে তুই কেন বিশ্বাস করছিস না আমি তোকে নিতে আসছি।’
সরল চোখের মিচমিচে কালো রঙের মেয়েটা এবার অদ্ভুত হাসল। মায়া মায়া স্বরে বলল, ‘ক্যান জানি আমার ভালা কিছু বিশ্বাসই হইতে চায় না, হীরণ ভাই। আমার মনডা ফাল দিয়া উডে। কলিজাডা ধড়ফড় কইরা উডে। আমি অবাক হইয়া যাই আমার এমন ভালা ভাইগ্য দেখলে! আমার এমন ভাইগ্যেও হীরণ ভাইয়ের মতন মানুষের সাথ পামু তা আমি মানতেই পারি না।’
বিন্দুর সহজ-সরল স্বীকারোক্তিতে মুখটা ছোটো হয়ে এলো হীরণের। রূপালী চাঁদ প্রেম ছড়ানোর বদলে যেন ছড়িয়ে দিল এক বুক আফসোস। হীরণ অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘এমন করে বলছিস কেন, বিন্দু? আমি কী এতটাই খারাপ!’
হীরণের প্রশ্নে ব্যস্ত হয়ে ওঠে বিন্দু। চঞ্চল কণ্ঠে বলে, ‘আরে না, তুমি খারাপ হেইডা কহন কইলাম? খারাপ যে আমার ভাইগ্য, হীরণ ভাই। আপার মতন অমন রাজ ভাইগ্য যে আমার হইল না।’
‘তোর আপার রাজ ভাগ্য?’
‘তা নয় তো কী? যেই ভাইগ্যে হীরণ ভাইয়ের মতন মাইনষের ভালোবাসা আছে হেই ভাইগ্য রাজ ভাইগ্যই তো। অমন কপালের মানুষের দিকে আমার খালি তাকাই থাকতে ইচ্ছা করে জানো? আল্লাহ ক্যান আমারে অমন একটা ভাইগ্য দিল না তা ভাইবা অভিযোগও জমে। কিন্তু এত রাগ, অভিমান, অভিযোগ কইরা কী লাভ তাই না কও হীরণ ভাই? তোমারে তো আর পামু না।’
হীরণ নিরুপায় হয়ে যায় বিন্দুর এমন সরল আফসোসে। চাঁদের আলো পড়া এই অমানিশা গায়ে মেখে হা-হুতাশ করে দুঃখ উড়ানো মেয়েটার দিকে সে তাকিয়ে থাকে পলকহীন। নিজেকে বড়ো পাষাণ লাগে। এমন একটা মানুষের ভালোবাসা স্বীকার করার সাহস তার নেই। কেন যে সৃষ্টিকর্তা যার জন্য মায়া দেওয়ার তার জন্য না দিয়ে অন্য কারো জন্য দিল! এত অদ্ভুত কাজ করল!
–
করবী বসে আছে বিছানার এক কোণে। বিস্ময়ে টইটুম্বুর তার ভেতরটা। তার সামনেই চেয়ারটাতে বসা তিমির। সে আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে চলে গিয়েছে। যদিও বিদিশাকে দু’জনই কিছু বলেনি তবে সে আঁচ করে ফেলেছে এতক্ষণে যে দু’জন দু’জনকে দেখে এতটা হতভম্ব হওয়ার কারণ কী।
‘তুমি ভাবিদের বাসাতে কোন উপলক্ষ্যে? কোন কারণে আমি কিছুই বুজছি না।’
প্রথম কথাটা তিমির বলল। করবীর ভেতরে তখন কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সব। সব হিসেব কার কাছে বড়ো এলোমেলো লাগল। ভাবি বলেছিল তার দেবর নাকি একজনকে ভালোবাসতো। ঘুড়ি বলেছিল ভাবির দেবর নাকি দেবদাস হয়েছে কোনো এক মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবেসে।
তবে কী তিমিরই সেই দেবর! কই? তিমির তো কখনো তাকে এসব বলেনি!
করবী চুপ থাকায় উত্তর দিল বিদিশা, ‘আপু ঘুড়ির মেডাম। আমাদের পাশের ফ্লাটের মেয়ে ঘুড়ি। চিনোই তো ভাইয়া?’
‘বুঝলাম।’
কথা আরও বাড়তো কিন্তু তার আগেই হুতুম কান্না জুড়ে দিল। সে আর থাকবে না এইখানে। সে বাসায় যাবে। বাসায় গিয়ে সে ঘুমাবে। সে আর এ বাসাতে থাকবে না। জামাল ভূঁইয়া কত রকমের বুঝ দিতে চাইলেন কিন্তু বাচ্চাটা বুঝলে তো! টান টান উত্তেজনা টগবগে রেখেই করবীকে বের হয়ে যেতে হলো। যদিও তিমির আসতে চেয়েছিল সাথে কিন্তু করবীর শক্ত-পোক্ত নিষেধে আর যায়নি। তাছাড়া ভাবির সাথে তার জরুরি আলাপও আছে।
করবী বেরিয়ে যেতেই বিদিশা না জানার ভাণ ধরে তিমিরকে শুধাল, ‘আপুকে চেনো কীভাবে, ভাইয়া?’
তিমির একটু দোনোমোনো করছিলো। কতক্ষণ ভেবেচিন্তে সে উত্তর দিল, ‘চিনি। একভাবে।’
ছোটো ছোটো, ভাঙা ভাঙা উত্তরে বিদিশা মুখ লুকিয়ে হাসল।
‘কেবল চেনো নাকি অন্যকিছু?’
তিমির ঠিক এই সন্দেহটাই করেছিল। বিদিশা যে তাকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে তা আর বুঝার বাকি ছিল না তার। সে সাথে সাথে উত্তর দিল না। রয়েসয়ে, জিরিয়ে জবাব দিল, ‘অন্যকিছু।’
‘অন্যকিছুটা কী? পছন্দ করো?’
‘ভালোবাসি।’
বিদিশা এতটা আশা করেনি। সে ভেবেছিল বড়োজোর তিমির মেয়েটাকে পছন্দ করে বলবে। কিন্তু সরাসরি ভালোবাসার কথাটা স্বীকার করবে ও ভাবেইনি।
কী জানি হুট করে জানা-অজানা ভাবনায় বিদিশার মনটা ছোটো হয়ে গেল। আনমনে বলল, ‘করবী আপুকে কিন্তু ভীষণ পরিচিত একজনের মতন লাগে। তাই না?’
বিদিশার ছোটো প্রশ্নে বুকে কামড় দিলো তিমিরের। যেন একসময় চুরমার হওয়া হৃদপিণ্ডটাতে আবার কেউ আঘাত করল। অতীত, যাকে তিমির বরাবরই অস্বীকার করে এসেছিল নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ চালিয়ে সেই অতীতই যেন রাজকীয় বেশে হাজির হলো এখন। যেই অতীতকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই তার। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
‘আশাবরী….?’
‘ধরতে পেরেছিলে?’
‘বহু আগেই।’
‘তবে ভালোবাসাটা কার জন্য? করবী আপুর জন্য না আশাবরীর অবয়বের জন্য? রক্তকরবী হিসেবে তাকে ভালোবাসো নাকি আশাবরীর মতন বলে ভালোবাসো, ভাইয়া?’
যে এক প্রশ্ন তিমির তার বুকে মাঝে দাফন দিয়ে ফেলেছিল, সেই প্রশ্নের নতুন করে মুখ তুলে তাকানোতে দিশে হারা হয়ে গেল সে। কী বলবে, কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারল না। বুকের ভেতর ভাষাদের তোলপাড় চললেও কণ্ঠ রইল নিশ্চুপ। যেন বাক্যহীনতায় প্রাণ দিয়েছে বাক্ শক্তি।
মৌনতার মাঝেই যেন চতুর বিদিশা উত্তর খুঁজে পেল। কণ্ঠ কিছুটা খাঁদে নামিয়ে বলল,
‘মেয়েটা বড়ো একা। এই পৃথিবীতে নাকি তার কেউ নেই। একজনকে কল্পনা করে আরেকজন মানুষকে ভালোবাসার মতন অন্যায় মেয়েটার সাথে হলে এই পৃথিবীতে নিঃস্ব মেয়েটা বাজেভাবে হেরে যাবে। ও একা তা-ও ও মেনে নিবে। কিন্তু যখন ও ভালোবাসা পাওয়ার পর জানবে ওকে দেওয়া ভালোবাসা গুলো আসলে অন্যকারো, অন্য কাউকে কল্পনা করে ওকে ভালোবেসেছ, মেয়েটা বিশ্বাস করো মরার আগে সেদিন একবার বেঁচে থেকেও মরে যাবে। কাউকে এমন ভাবে ঠকিয়ো না ভাইয়া যেন আল্লাহর দরবারে মানুষ সব দায়ভার ছেড়ে দেয়। একটু ভেবো। তুমি তো বুদ্ধিমান।’
(৪২)
বিন্দু ব্যস্ত হাতে করবীকে বার বার তাড়া দিচ্ছে। করবী রান্নাঘর থেকে ঘাম মুছতে মুছতে এলো। নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘অমন করছিস কেন? কী হয়েছে?’
‘তাড়াতাড়ি এই ফরমডা পূরণ কইরা দেও না, আপা। হুতুমডারে স্কুলে ভর্তি করামু।’
করবী তার সামনে থাকা সাদা কাগজটা তুলে নিল। বলল,
‘জন্ম নিবন্ধন ফ্রম? আচ্ছা পূরণ করছি।’
কথা শেষ করেই সে হাতে কলম তুলে নিলো। প্রথমেই লিখল হুতুমের নাম। বিন্দু জিবে কামড় দিল, ‘আরে আপা, হুতুমের নাম হুতুম দিছো ক্যান?’
করবী ভ্রু কুঁচকালো, ‘ওর নাম যেটা, সেটা দিবো না?’
‘আরে না, হুতুমের ডাকনাম এইডা। ভালা নাম তো দৃষ্টিনন্দিতা।’
‘দৃষ্টিনন্দিতা! এত সুন্দর নাম! আগে কখনো বলিসনি যে?’
খুশিতে বিন্দুর চোখ চকচক করে উঠল, ‘শখ কইরা রাখছিল ওর বাবা।’
‘আচ্ছা! হুতুমের মায়ের নাম কী দিব?’
ভ্যাবাচেকা খেল যেন বিন্দু। থতমত খেয়ে বলল, ‘কেন? আমার আম্মার নাম দিবা। আমেনা।’
‘তোর আম্মার নাম কেন দিবো? জন্ম নিবন্ধনে তো হুতুমের মায়ের নাম চেয়েছে। মেয়েটাকে কী খাতা-কলমেও অন্যের বলে স্বীকৃতি দিবি? হুতুমের মা যে বিন্দুবালা, তা দুনিয়া জানবে না?’
‘আপা…..!
#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৩
কলমে: মম সাহা
ভার্সিটির চত্বরের ঠিক বামপাশে একটি ঘোলাটে জলের পুকুর রয়েছে। সেই পুকুরের পাড় ঘেঁষে রয়েছে দুই-তিনটি গাছ। যেগুলোকে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা সেই গাছের ছায়ায় বসে আড্ডা দেয়। হাসি-তামাশা করে। সুখ-দুঃখ থেকে শুরু করে ভাগ করে নেয় দুপুরের খাবারটাও।
বিদিশা বসে আছে তেমনই একট গাছের নিচে। হাতের মাঝে একটি ইংরেজি বই। তার দৃষ্টি, মনযোগ সবটাই সেখানে নিবদ্ধ। সেই সময়েই ব্যাগের ভেতরটা থাকা ফোনটা বেজে উঠল। বিদিশার তুমুল ধ্যানে বিঘ্ন ঘটালো সেই শব্দ।
বইটা হাতের মাঝেই ভাঁজ করে রেখে ফোনটা বের করে রিসিভ করল বিদিশা। অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রথমেই শুধাল, ‘কে?’
অপরপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ উত্তর এলো না। উত্তর এলো জিরিয়ে, ‘আমি।’
পরিচিত কণ্ঠ পেতেই কিছুটা চমকাল বিদিশা। তবে সেই চমকে যাওয়ার অনুভূতি বুঝতে দিল না অপরপক্ষের মানুষটাকে। বরং নিতান্তই স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘কোন আমি?’
অপর পাশ আবারও নীরব। রয়েসয়ে বলল, ‘নাম বললে না-ও চিনতে পারেন। যেখানে কণ্ঠই চিনছেন না।’
বিদিশা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, ‘এত কথা না বলে নামটা বললেই পারেন।’
‘আমি তুষার।’
কথাটা যেন চিবিয়ে চিবিয়েই বলল লোকটা। বিদিশা বুঝল সেই ভোঁতা রাগের আবাহন।
‘হ্যাঁ বলুন। কী দরকার?’
বিদিশার এত স্বাভাবিক স্বর যেন আশা করেনি তুষার। এত গুলো বছরে সে এতটুকু বুঝেছে মেয়েটা বড়োই ভালোবাসে তাকে। তার সাথে এই মুখ দেখাদেখি বিচ্ছেদে হয়তো মেয়েটা উদাস কাটায় দিন। অথচ কই? কণ্ঠস্বরে তো তার কোনোই আভাস নেই!
তুষার আবারও কতক্ষণ চুপ থেকে অতঃপর বলল, ‘আমি দেশ ছেড়ে যাব। তার আগে তো জানতে হবে আপনার মতিগতি। তাই কল দেওয়া।’
প্রথম বারের মতন এবার আর তুষারের দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথায় বিদিশার মন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হলো না। ভাঙা জিনিস আর কীই-বা ভাঙবে? তবে মনের কোণায় জ্বলতে থাকা নিভু নিভু আশার প্রদীপটা এই একটা বাক্যে এক লহমায় নিভে গেল। তবুও সে রইল শক্ত। বুকের ভেতর যেন শ’মণের পাথর বেঁধে উত্তর দিল, ‘আমার মতিগতি বলতে? আমি কী আপনাকে দেশে আটকে রেখেছি?’
‘রেখেছেনই তো! বিয়ে বিয়ে নাটকটা করে।’
তুষারের এমন কথায় ব্যথিত হলো বিদিশা, ‘বিয়ে বিয়ে নাটক!’
‘হ্যাঁ, নাটকই তো।’
‘আপনাকে আমি যদি নাটকেই আটকাতাম তবে দেশে আপনাকে চার বছর আগেই আনাতে পারতাম। যখন চলে গিয়ে ছিলেন তখনই দেশে আসতে বাধ্য করতাম। তারপর আপনার জীবনযাপন হতো জেলে। নাটক করিনি বলেই আজ জিহ্বাটা লাগামহীন কথা বলতে পারল।’
এমন কড়া জবাবে তাজ্জব বনে গেল তুষার। প্রায় ধমকে বলল, ‘মুখ সামলে কথা বলুন।’
বিদিশা হাসল। তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘সেম টু ইউ। আমার সাথে চার বছরে যত অবিচার হয়েছে সবকিছুর দায়ভার আমি সৃষ্টিকর্তার উপর তুলে দিছি। আর আপনার উপর আমার কোনো ধরণের আকর্ষণ, আশা কিছুই নেই।’
তুষারের কণ্ঠ নরম হয়ে এলো, ‘নেই…?’
‘থাকলে তো সংসারই করতাম। যেমন চার বছর করেছি। একা একা স্মৃতির সাথে সংসার!’
তুষার আর কিছু বলল না। কল কাটার আগে বলার ভদ্রতাটুকুও দেখাল না। খট করে কেটে দিল কলটা।
বিদিশা জোরে জোরে ক’টা শ্বাস টেনে নেয় বুকের ভেতর। মনের ভেতর মরে যাওয়া ক্ষীণ আশাটার জন্য কিছু সময় উন্মনা রয়। ভুল মানুষের উপর আশা রাখলে এমন ভাবে আশা ভাঙবে তা যে স্বাভাবিক। সে এটা জানেও। তবুও মায়া যে বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস। কাটানো জটিল। ক’বছর লাগবে কে জানে? নাকি এক জীবনও যথেষ্ট হবে না!
বিদিশার ভাবনার মাঝে আবারও ফোন বেজে উঠে। মায়ের নাম্বার দেখে সাথে সাথে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মা ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠে, ‘বিদুরে, তোর মুক্তি হয়ে গেল। তুই মুক্ত। খুশি তো?’
মায়ের কান্নার কারণ জানে না বিদিশা। তবুও মনটা কু ডাকে। সে হতবিহ্বল স্বরে বলে, ‘কী হয়েছে, মা? কী হয়েছে?’
‘তুষার ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিয়ে গেল মাত্র। বলেছে তোকে সাইন করে দিতে।’
দিনে দুপুরে যেন অসময়ের বজ্রপাত হলো বিদিশার মাথার উপরে। তার মানে লোকটা তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, সব সিদ্ধান্ত নিয়েই তাকে কল দিয়েছিল?
বাহ্! মা ভুল বলেছে। মুক্তি বিদিশার নয়, হয়েছে যে সেই মানুষটার। বিদিশা যে সংসার থেকে কখনো মুক্তি চায়নি। অভিমান করে কেবল সাময়িক প্রস্থান নিয়ে ছিল। অথচ তার অভিমানের ভাষা কেউ বুঝল না। বরং অভিমানের শাস্তিস্বরূপ চির বিচ্ছেদ ধরিয়ে দিল।
অজান্তেই মেয়েটার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। এটাই হয়তো শেষ কান্না! কান্নার জন্য তার জীবনে হয়তো আর কোনো দুঃখই অবশিষ্ট থাকবে না। এইতো আজ তো তার মুক্তি। মা বলল মুক্তি হয়েছে তার।
আচ্ছা মুক্তি পেলে কী কারো যন্ত্রনা হয়? কেউ কাঁদে?
_
‘বিন্দু, হুতুমের মতন নিষ্পাপ বাচ্চাটার সাথে এমন অবিচার কেন করতে চাচ্ছিস? কোন কারণে আমাকে বলবি?’
পাথর মূর্তি বিন্দু চুপচাপ বসে থাকে খাটের কোণায়। কথা বলার ভাষা যেন হারিয়েছে সে। করবী বিন্দুর বাহুতে মৃদু ধাক্কা দেয়, ‘কী হয়েছে বল। এমন থম মেরে গিয়েছিস কেন? আমি জেনে ফেলেছি বলে?’
‘কী জানছো আপা তুমি? কী জানছো? তুমি যা জানছো তা ভুল। সবটাই ভুল। তুমিও না কীসব যে কও! পাগল হইলা নাকি?’
বিন্দুর কথা বলার ভঙ্গি বড়োই চঞ্চল। কথা লুকানোর প্রচেষ্টা দুর্বল। তা-ই তা দেখে হাসল করবী। বলল,
‘আমার কাছ থেকে কথা লুকাতে চাচ্ছিস? আমি কী এতই অবুঝ? এমন করছিস কেন সোনা? আপাকে বলবি না?’
করবী আহ্লাদে গলে জল হয়ে যায় মেয়েটা। চোখ টলমল করে নোনা জলে, ‘আপা, আপা গো, আমি যে দূরে সরাইতে চাই নাই অরে। কিন্তু আম্মা কইলো এই সমাজ নাকি বড়ো খারাপ। আমার বিন্দু নাকি কেবল আমার পরিচয়ে বড়ো হইতে পারবো না। বাপের পরিচয়ও লাগবো। কিন্তু কেমনে অর বাপের পরিচয় দিমু আমি! অর যে বাপই নাই।’
করবী হতবিহ্বল হলো। মনে ভেসে উঠল খারাপ চিন্তা। ভারী বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘কী বলছিস তুই? আমি কিচ্ছু বুজছি না।’
মাথা নুয়ালো বিন্দু। ঠোঁট কাঁপলো তিরতির বেদনায়। কম্পনরত স্বরে বলল,
‘আমার বিয়া হইছিল, আপা। আমার যহন বয়স তেরোর ঘরে পড়েও নাই তহন আমার বিয়া হইছিল। জীবন চিননের আগেই চিনছি সংসার। নরম দুই হাতে নামাইছি বিরাট ভাতের পাতিল। একটা রাক্ষসের মতন শ্বশুর বাড়ি। ভয়, আতঙ্ক চাইরপাশে। সংসার না করার কত বায়না করছি। কিন্তু ছাড়তে পারি নাই স্বামীর লাইগ্যা। অতটুকু বয়মে আমারে অমন ভালোবাসা দেওয়া মানুষটারে কেমন কইরা ছড়তাম কও? কিন্তু….. ‘
করবীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, ‘কিন্তু কী’
‘তিন মাসের বেশি আমার সংসার যে টিকলো না, আপা। বিধবা হইয়া গেলাম। স্বামীর সোহাগ মাখা সংসার করার আগেই স্বামী মুইছ্যা গেলো জীবন থেইকা। আমার ভাইগ্য আমারে যে কহনো সাথ দেয় নাই, আপা।’
বাহির থেকে হুড়মুড় করে গরম হাওয়া ঢুকছে। জানালায় লাগানো সস্তার পর্দা গুলো উড়ছে। করবীর চোখ-মুখে আকাশ সমান বিস্ময়। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বুকের ভেতর থাকা অদেখা হৃদপিণ্ডটা অবিরতি লাফাচ্ছে।
‘বিন্দু, কী বলছিস তুই এসব? তোর বিয়ে হয়েছিল এবং স্বামী মারা গিয়েছে?’
‘হ আপা, হ। আমরা তহন গেরামে থাকতাম। দিন কাল ভালোই কাটতো আমাগো। গরু পালতাম, হাঁস পালতাম। আব্বায় মাডি কাটতো। সুন্দর কইরা চলতো সংসারডা। পদ্মার লগে আছিলো আমাগো বাড়ি। একবার পদ্মায় উডলো উথাল-পাতাল ঢেউ। আমাগো বাড়ির জমিন ভাইঙা তলায় গেলো হেই ঢেউয়ের লগে। তহন সর্বস্ব হারাইয়া আমরা কাঙাল। আব্বায় হেউ শোক মানতে না পাইরা স্ট্রোক করলো। এরপর অসার হইয়া গেল আব্বার দেহ। আমি তহন এগারো বছরের মাত্র। আম্মার হেই কী যুদ্ধ! ছুডু কয়েকটা জায়গা আছিল হেডি বেইচ্চা, হাঁস-মুরগী বেইচ্চা আব্বারে ডাক্তার দেহাইলো। একটা কোনো মতে বাঁশের ঘড় উডাইলো। ভাত খাইতে ভাত পাইতাম না। এর অর বাড়ি গিয়া তাগো ভাতের ফেন আইন্যা খাইতাম। খিদায় পেট বুক লাইগ্যা যায় অবস্থা। আম্মা এই বাড়ি, ঐ বাড়ি গিয়া ধান সিদ্ধ কইরা, বাটাবাটি, কাটাকুটি কইরা আমাগো লাইগ্যা কিছু টেহা আনতো। কহনো বা চাল আনতো।
আমাগো গেরামে আছিলো একটা জমিদার বাড়ি। বিশাল বাড়ি আছিলো হেগো। একদিন হেই বাড়ি থেইক্যা আমার বিয়ার প্রস্তাব আইলো। হেই বাড়ির বড়ো পোলার লাইগ্যা। পোলা না, বেডা কওয়া যায়। বেডার এর আগে বিয়া হইছিল। সতেরো বছরের সংসার করছে এরপর বউ মইরা যায়। হেই বেডার লাইগ্যাই বিয়ার সম্বন্ধ আহে আমার লাইগ্যা। সাদা ধবধবে আছিল তিনি। চোখটি হুতুমের চোখের মতন। চুল গুলাও অমন হালকা বাদামি কোঁকড়াইন্যা। বেডার বয়স তহন হইবো পয়তাল্লিশের বেশি-কম। আম্মারে হেই বাড়ি থেইক্যা সাহাইয্য করবো জানাইছিল। পরে আম্মা গতি নাই পাইয়া আমাগো এক দেড় বছরের কষ্টের জীবনের ইতি টানোনের লাইগ্যা তার কলিজার টুকরাডারে ঐ বয়সে বিয়া দেয়। বাঁচতে যে হইতো আমাগো। আম্মা এমনে কইরা আর কতদিনই বা খাওয়াইতো?
হেই জমিদার বাড়ির সব আছিল রাজাগো আমলের মতো। হুনছিলাম দাদী শাউড়ী আছিলেন এক বিদেশির বউ। এই জন্য আমার শ্বশুর, আমার জামাইয়ের চেহারায় ঐ ছাপটা আছিল। বিয়া হইয়া যহন শ্বশুর বাড়িতে গেলাম তহন কিছুই বুঝি না সংসারের জটিলতা। স্বামীর সোহাগ কারে কয় হেইডাও জানিনা। শ্বশুর বাড়ির মানুষ দেখতাম কেমন কইরা যেন আমার লগে ব্যবহার করে। তবে স্বামী আমারে আদর করতো ম্যালা। জা, দেওর, ভাসুররা দেখতে পারতো না। কারণ আমার যদি পোলাপাইন হয় তাইলে তো সম্পত্তির ভাগ দেওন লাগবো!
শ্বশুর বাড়িতে আমার একমাত্র ভরসা আছিল স্বামী
একদিন হেই মানুষ আমারে ছাইড়া যায়। আমার অইটুকুন বয়সের প্রথম নির্মমতা। স্বামী মইরা যাওনের পর আমার জীবনে নামে দুর্ভোগ। কেউ আমার দুই আনার দাম দিতো না। এর মইধ্যে একদিন পেডে আইলো হুতুম। হগলের যেন মাথাতে আকাশ ভাইঙা পড়লো। সম্পত্তির ভাগ পাওনের মানুষ আইয়া পড়ছে! তারা আমার উপর অত্যাচার এত বাড়াবাড়ি রকমের করল যে আমার গায়ে পইয্যন্ত হাতে তুলছে। কোনোমতেই আমারে বাড়ি থেইক্যা তাড়াতে না পাইরা সবশেষে আমার গায়ে কালি লাগাইলো। কইলো আমার চরিত্রের দোষ। গ্রামে ছি ছি পইড়া গেলো। আমার বাইচ্চা থাকাটা নরক কইরা দিল। তারপর…..’
বিন্দু থামে এবার। হাঁপিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। চোখ-মুখে আতঙ্ক। পুরোনো ভয়টার স্মৃতি মনে পড়াতে বোধহয় এই আতঙ্ক। করবী পানি দিল বিন্দুকে। মেয়েটা খেলো। মুখ মুছল ওড়নার কোণ দিয়ে। করবী নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? আম্মা আমারে বাঁচানোর লাইগ্যা গ্রাম ছাড়লো। হুতুমরে পেডে লইয়া আইলাম ঢাকায়। চৌদ্দ বছরে জন্ম দিলাম হুতুমরে। আমাগো কষ্টের জীবনে আরেক ইতিহাস হইলো। হুতুম হওয়ার পরেই তো তোমাগো বিল্ডিং এ উডলাম। সবাইরে পরিচয় দিলাম অন্যকিছু। দূর কইরা দিলাম অরে আমার নামের আশপাশ থেইক্যা। অর লাইগ্যাই তো এত যুদ্ধ। ঐ ভালো না থাকলে হইবো কও?’
‘তোর জীবনে এতটা ঝড় অথচ বলিসইনি কখনো! কেন? আমি পর ছিলাম তোর?’
বিন্দু করবীর হাত চেপে ধরল, ‘না আপা, এডি কইও না। আসলে আমি কহনো চাই নাই এডা কেউ জানুক। যা ফালাই দিছি জীবন থেইকা তা জানামু কেমন কইরা কও?’
‘তা-ও তো আমি বুঝেই গেলাম। সত্য যে চাপা থাকে না। ‘
‘তুমি কেমন কইরা জানলা, আপা?’
‘হুতুমের চেহারার সাথে খালার মানে তোর আম্মার চেহারার কোনো মিল ছিল না তাছাড়া ওর চেহারা অবয়ব ছিল অন্যরকম। তোর কিছুটা মিল ছিল। তার উপর তোরা বলতিস তোর আব্বু প্যারালাইজড হয়েছে আট-নয় বছর অথচ হুতুমের বয়স চার! কী অদ্ভুত ভাবে খচখচ করতো ব্যাপারটা। এরপর হুতুম কখনো খালাকে মা ডাকতো না। তোকেও আপু ডাকত না। খালুকে আব্বু ডাকতো না। এমন অদ্ভুত ডাকে খচখচানি বাসা বাঁধে বুকে। এরপর একদিন ব্রীজে হুতুম যখন মা’কে নিয়ে গান গাইল সেদিন তোর চোখে, তোর আচরণে ছিলো ভিন্নতা। মা, মা একটা স্নেহ খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। আমার খটকা যে পরিষ্কার হয়ে গেলো সেদিন। একদিন খালা বলল, তোর জীবনে নাকি অনেক কষ্ট, অনেক ঝড় গিয়েছে, সত্য অস্বীকার করে বাঁচতে হচ্ছে তাই তোর যেন খেয়াল রাখি। আমি যেন একে একে দুই করতে পারলাম। যদিও এতটা জানিনি, বুঝিনি, আঁচ করিনি, তবে হুতুমের সাথে তোর যেন টান তা আমি বুঝে গিয়ে ছিলাম।’
বিন্দু হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল। অতীত সামনে আসা আদৌ কতটুকু ভালো হবে বর্তমানের জন্য? সবটা কী স্বাভাবিক থাকবে?
#চলবে