বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩০+৩১

0
250

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩০
কলমে: মম সাহা

রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ ভেসে আসছে। গরম তেলে মাছ ভাজছে বিন্দু। ইলিশ মাছ। আজ কাজ থেকে ফেরার পথে একটি ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে আপার বাড়িতে এসে রান্না করবে বিধায়। করবী গোসল সেরে এসেছে। যেদিন বাহিরে যায় সেদিন সে দু বেলা গোসল করে। নাহয় শরীর বেশ আঠালো লাগে। গরমে ঘুম হয় না রাতে। হুতুম খাটে বসে পড়ছিল। করবী ওর জন্য বই কিনে রেখেছিল সেগুলোই নেড়েচেড়ে দেখছে। ভুলভাল উচ্চারণে অ,আ পড়ছে। করবী বিছানায় এসে বসতেই হুতুম গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল তার। গালের সাথে গাল চেপে বসল আদুরে ভঙ্গিতে। তার আধো বুলিতে বলল,
‘বাণীর মা, বাণী কই গেছে?’

করবী ভেজা চুলে গামছা প্যাঁচাচ্ছিল তখন। হুতুমের কথায় তার হাত থেমে যায়। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় বাচ্চাটার দিকে। অবসাদ জাগে তার ঠোঁটে, মুখে, বুকে। হতাশ স্বরে বলে, ‘চলে গেছে।’

‘ক্যান গেছে? তুমি কী তারে বকছিলা?’
হুতুমটার কথা ভীষণ সুন্দর। কেমন যেন পলক ফেলতে ফেলতে মিষ্টি স্বরে কথা বলে! করবী জাপটে ধরে তাকে। খানিক হেসে বলে, ‘বকলেই বুঝি চলে যায় সবাই?’

‘হ, বকলেই যায়। বিন্দুবালা যহন বকে তহন তো আমিও চলে যাই।’
‘তুমিও যাও! কোথায় যাও বলো তো?’
‘আমি বেশিদূরে যাই না বুজছো। আমি যাই মিনিদের বাড়ি। বেশিদূরে গেলে তো বিন্দুবালা আমারে খুঁইজ্যা পাইবো না। পরে তো কানবো। তাই কাছেই থাকি।’
‘কিন্তু বাণীকে তো আমি না বকতেই অনেকদূর চলে গিয়েছে, হুতুম। ও বোধহয় বুঝতে পারেনি ওকে হারিয়ে কেউ কাঁদবে।’

করবীর শান্ত কণ্ঠের কথায় হুতুম কোলে বসেই মাথা তুলে তাকাল। চোখে চোখ রাখল। ছোটো হাত দু’টো দিয়ে চেপে ধরল করবীর গাল গুলো। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তুমি বুঝি বাণীর লাইগ্যা অনেক কানছো? থাক কাইন্দো না। ধইরা নেও আইজ থেইক্যা আমিই তোমার বাণী, আমিই তোমার হুতুম।’

ছোটো মেয়েটির এই বিশাল স্বান্তনায় করবীর চোখ টলমল করে উঠল। ঠোঁট কাঁপল তিরতির করে। মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরল দু-হাতের শক্ত বাঁধনে। এমন করে কে তারে আর ভরসা দিবে এই পৃথিবীতে? এমন করে নিষ্প্রাণ আত্মা নিয়ে কে তার পাশে থাকবে? সবাই যে আসে খনিকের জন্য।

বিন্দুর রান্না প্রায় শেষের দিকে। ভাত, মাছের ঝোল, আলু ভাজি নামানো শেষ। এবার চুলায় বসেছে পাতলা ডালের আয়োজন। করবী হুতুমকে ভাত খাওয়াচ্ছে ড্রয়িং রুমে বসে। বিন্দুও সেখানে এসে শসা, পেঁয়াজ কাটতে বসেছে সালাদ তৈরীর জন্য। এক কথায়, দু’কথায় বিন্দু বলল,
‘হীরণ ভাই কিন্তু তোমারে সত্যিই ভালোবাসে, আপা। তুমি হেইডা মানো আর না মানো, আমি কিন্তু মানি।’

করবী ভাত চটকে হুতুমের মুখে তুলে দিচ্ছিল কেবল। তন্মধ্যে এমন কথায় তার হাত থামল। চোখ উল্টে বিন্দুর দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখ শসা কাটায়। ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলানো। করবী তপ্ত শ্বাস ফেলে এক লোকমা ভাত হুতুমের মুখে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘হুট করে এমন বলছিস যে!’

‘হুট কইরা কই কইলাম? আমি তো রোজই কই। ম্যালা বছর ধইরাই কই। তুমিই তো মানতে নারাজ।’
‘এত মেনে কী হবে!’
‘তুমিও তো তারে একটু ভালোবাসতে পারো, আপা। যে মানুষটা এত ভালোবাসে তোমারে, তারে কী তুমি এক ফোঁটা ভালোবাসা দিতে পারো না?’
‘আমি না বাসলেও চলবে। আমার হয়ে তো তুই বাসছিস।’

বিন্দু এবার সোজা হয়ে টানটান করে বসল। করবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আমারটা তো আমি আমার হইয়া বাসছি। তোমার হইয়া বাসতে পারলে না-হয় বাসতাম। তবে আপা, তোমার হইয়া আমি দুই নলা ভাত বেশি খাইলেও তোমার যেমন পেট ভরব না তেমুন তোমার হইয়া কাউরে ভালোবাসলেও তার মন ভরবো না।’

‘না ভরুক মন। সবার মন ভরানোর দায়িত্ব তো আমাদের না।’
‘সবার মন ভরাইতে হইবো হেইডা কহন কইলাম। কিন্তু যে আমাগো সবকিছুর খেয়াল রাহে তার মন তো ভরাতেই পারি। তাই না?’

করবী প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়, ‘হয়েছে। বাদ দে তো ওদের কথা।’

‘আইচ্ছা আপা, তোমার লগে হীরণ ভাইয়ের প্রথম দেখা কই হইছিল?’

করবী তখন মাছের কাটা বাছছিল। সেদিকেই দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, ‘কোথায় আর হবে, নফর চাচার একটা চায়ের দোকান ছিল গলির মোড়ে সেদিকে বসে চা খাচ্ছিল আর আড্ডা দিচ্ছিল। সেখানেই প্রথম দেখা হয়। সে তো বহু বছর আগের কথা।’

‘কী রঙের জামা পরছিল হীরণ ভাই?’
‘ছাঁই রঙের একটা টি-শার্ট ছিল গায়ে। সিগারেট ফুঁকছিল, চা খাচ্ছিল।’
‘হীরণ ভাই বোধহয় সেই দোকানেই বেশি আড্ডা দেয় তাই না?’
‘আরে না, ও তো বেশি আড্ডা দেয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলটার সামনে। ওখানেই মূলত ওদের আড্ডার বাহার।’
‘হীরণ ভাই তো তোমার মতন অত পড়ালেহা করে নাই।’
‘সর, কে বলছে তোকে এটা? হীরণ এমবিএ করেছে ফিন্যান্স নিয়ে। ওর পছন্দের সাবজেক্ট। পরে গিয়ে কয়েক মাস ফটোগ্রাফিও করেছিল। ওর তো ফটোগ্রাফি নেশা ছিল। অনেক পছন্দের।’
‘হীরণ ভাইয়ের ছবি তুলা প্রিয় আছিল? কী কও! হের প্রিয় জায়গা কোনডা গো, আপা?’

করবী মুচকি হাসল। আনমনে বলল, ‘সাজেক।’
‘প্রিয় রঙ?’
‘জাম কালার।’
‘প্রিয় ফুল?’
‘রজনীগন্ধা।’
‘প্রিয় মানুষ?’
‘আমি।’ আচমকা উত্তরটা দিয়েই থমকে গেল করবী। ড্যাবড্যাব করে তাকাল বিন্দুর দিকে। বিন্দু তখন উচ্চস্বরে, প্রাণ খুলে হাসতে ব্যস্ত। হাসতে-হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রায়। অবুঝ হুতুম হাসির গভীরতা অবশ্য বুঝল না কিন্তু বিন্দুকে এমন লাগাম ছাড়া হাসতে দেখে নিজেও হাসা আরম্ভ করল। করবী বুঝল, বিন্দু তাকে কথার জালে ফাঁসিয়েছে ইচ্ছেকৃত।

হাসতে হাসতে চোখে জল জমেছে বিন্দুর। বা’হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি ব্যবহার করে জল মুছতে মুছতে বলল,
‘হীরণ ভাইয়ের পছন্দের ফুল থেইকা শুরু কইরা পছন্দের মানুষরে অব্দি চেনো। বহু বছর আগে প্রথম দেহার দিন কোন রঙের জামা পরছিল হেইডাও পষ্ট (স্পষ্ট) তোমার মনে আছে। আর তুমি কি-না কও তুমি হেরে ভালোবাসো না! হেইডাও আমার বিশ্বাস করতে হইব, আপা? ভালোবাইস্যাও অস্বীকার করার মতন ভীতু তো তুমি না! তাইলে অস্বীকার করো ক্যান? এই বিন্দুর লাইগ্যা? এত মায়া তোমার আমার লাইগ্যা?’

(৪০)

আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এদিক ওদিকে মেঘেদের বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে বেশ। করবী বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। হুতুম তার পাশে। বাচ্চাটার হাতে কমলা রঙের একটি আইসক্রিম। গত পরশুদিন যে সে বিন্দুর সাথে এসেছে আর যায়নি। বিন্দুও নেয়নি। রেখে গেছে। আপার একলা লাগা ভাব কমাতেই হুতুমকে রেখে যাওয়া।
আইসক্রিম খেতে খেতে হুতুমের ঠোঁটটাও কমলা রঙ ধারণ করেছে। ছোটো কমলা রঙের ঠোঁট গুলো কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে করবীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাণীর মা, আইজ ম্যালা গরম পড়ছে তাই না কও?’

করবী হাঁটতে হাঁটতে ওড়না দিয়ে মুখ মুছল। হুতুমের মুখটাও মুছিয়ে দিল পরম যত্নে। অতঃপর উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ গো, ভীষণ গরম। তুমি হাঁটতে পারছ তো? নাকি রিকশা নিবো?’

‘না, না, রিকশা নিও না।’

হুতুমের ব্যস্ত কণ্ঠের না-তে ভ্রু কুঁচকালো করবী। সন্দিহান কণ্ঠে বলল, ‘ওমা! কেন রিকশা নিব না? তোমার পা ব্যথা হচ্ছে না বুঝি!’

হুতুম গোল গোল চোখে তাকাল, ‘পা ব্যথা হয় না আমার। আর তুমি জানো না এহন রিকশা ভাড়া অনেক চাইব। তোমার কত্ত গুলা টাকা নিবো ওরা।’

ছোটো হুতুমের বিজ্ঞ কথায় তাজ্জব বনে গেল করবী। ডাগর আঁখি তুলে বলল,
‘বাপরে, তুমি রিকশা ভাড়া নিয়েও ভাব?’

এবার কোমরে এক হাত চাপল বাচ্চাটা। নাক, মুখ কুঁচকে বলল, ‘ভাবব না? বিন্দুবালা তো কয়, টেকা কামাইতে নাকি অনেক কষ্ট। মাইনষের গালি, ধমক কত কিছু সহ্য কইরা টেকা কামানো লাগে।’

ছোটো হুতুমের বড়ো বড়ো কথায় প্রাণ খুলে হাসল করবী। মেয়েটা বাচ্চা হতে পারে কিন্তু জ্ঞানে বুদ্ধিতে একদম পরিপূর্ণ। বিন্দুর জীবনে এমন একটা মিষ্টি মানুষের তো প্রয়োজন। নয়তো মেয়েটা বাঁচত কীভাবে? অসুস্থ একটা বাবাকে নিয়ে বছরের বছর পার করতেও তো কত কষ্টই হতো!

‘রক্তকরবী… ‘
ব্যস্ত রাস্তায় নারীকণ্ঠে ভাবনা থেমে গেল করবীর। হাসিও থেমে গেল ডাক শুনে। চোখে-মুখে ভর করল বিস্ময়। অবিশ্বাস্য চোখে পেছনে তাকাতেই মধ্য বয়স্ক মহিলাটিকে চোখে পড়ল তার। চিকন ফ্রেমের চশমা চোখে, হালকা বেগুনি রঙের ছিমছাম সুতি শাড়ি পরনে ভদ্রমহিলার।

করবীর চোখ-মুখ অত্যাধিক শক্ত হয়ে গেল। প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই শক্ত। কঠিন থেকে কঠিনতম স্বরে সে শুধাল,
‘আপনার এখানে কী?’

‘সাহেব না-কি আর বেঁচে নেই?’

করবীর চোখের পলক নড়ল মহিলার কম্পমান কণ্ঠে। করবী মুখ ঘুরিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ। আশ্চর্য রকমের তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘সে তো মরে গিয়েছিল বহু বছর আগেই। যেদিন আপনি ছেড়ে গেলেন। এতদিন শরীরটাই তো কেবল বয়ে বেড়াচ্ছিল। এখন নতুন করে খোঁজ নিতে এলেন কেন এত বছর পর!’

মহিলাটার চোখে জল থৈথৈ, ‘আমি আজ আবার হসপিটালে গিয়েছিলাম। ওরা জানাল, সাহেব… তুমি কীভাবে একা আছো!’

করবী মহিলার এমন বিচলিত ভঙ্গি দেখে তাচ্ছিল্য হাসল। অবজ্ঞার সাথে বলল, ‘আমি তো একাই। নতুন করে আমার একাকীত্ব নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। নেহাৎ সেদিন আব্বুর শেষ ইচ্ছে পূরণ করতেই আপনার দুয়ারে ছুটে যাওয়া। নাহয় আপনার ছায়াও রক্তকরবী কখনো ছুঁতো না।’

মহিলাটি করবীর এমন কথার বাণে তাজ্জব বনে গেলেন। বললেন, ‘আমি তোমার…’

করবী থামিয়ে দিল কথা, ‘কেউ নন আপনি আমার। কেবল আমার আব্বুর সাহেবা আপনি। তাছাড়া আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জন্ম থেকে আব্বু বিহীন পৃথিবীতে কাউকে কল্পনা করিনি। পাইনি পাশে। আজও কেউ নেই আমার।’

‘আমাকে অস্বীকার করো ঠিক আছে কিন্তু নিজের জন্ম তো তুমি অস্বীকার করতে পারো না। আর যার জন্য জন্ম পেলে তাকেই বলছ কেউ না!’

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা

পর্ব- ৩১

‘আরোরা’ ক্যাফেতে বসে আছে করবী। চোখে-মুখে প্রচন্ড অসন্তোষ ভাব। হুতুম সবে গরম স্যান্ডউইচে এক কামড় বসিয়েছে। কামড় বসিয়ে এক অনন্য, অপরিচিত স্বাদে তার প্রাণ জুড়িয়ে এলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বলল,
‘আরেএএ বাণীর মা, এই সন্ডুচটাতো অনেক মজা! কই, বিন্দুবালা যে একদিন আনছিল, হেইদিন এত মজা তো পাই নাই!’

করবী হুতুমের চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘বিন্দু এনেছিল? কবে?’

‘ঐ যে একদিন কই জানি গেল না? হেইদিন। মনেহয় নষ্ট আছিল।’

করবী হাসল, ‘আচ্ছা, এখন এটা খাও। মজা লাগলে আরেকটা আনব।’

হুতুম যেন বেজায় খুশি হলো এমন প্রস্তাবে। চপাস করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল করবীর গালে। তা দেখে সামনের মহিলাটা সামান্য অবাকই হলেন। শুধালেন, ‘কে ও?’

করবীর ধ্যান হুতুম থেকে সরে মহিলার উপর পরে। হুবুহু দেখতে তারই মতন ভদ্রমহিলার মুখটি। কেবল পার্থক্য বয়সে। নয়তো মানুষ ভুল করে তাদের যমজ ভেবে ফেলত।

‘বললে না তো কে ও?’
‘সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই।’ করবীর শক্ত উত্তরে ব্যথিত হলেন বোধহয় ভদ্রমহিলা। বিষণ্ণ স্বরে বললেন,
‘এমন করে কথা বলো না।’
করবীর ঠোঁটে ক্রুর হাসি, ‘আপনি তো এটারই যোগ্য।’

ভদ্রমহিলা পর পর আরও কয়েকবার শ্বাস ফেলে। তার চোখে জল জমে। হেরে যাওয়া যোদ্ধার মতন পরাজয় স্বীকার করে যেন নত মস্তকে। বলে,
‘তুমি তো এ শহরে একা। আমার সাথে চলে আসো।’

‘আপনি কী এটা বলতেই ক্যাফেতে ঢুকতে বলে ছিলেন? এটাই আপনার প্রয়োজনীয় কথা?’

‘হ্যাঁ। তোমার কাছে কী প্রয়োজনীয় লাগছে না?’

‘একদমই না। যে সদ্য বুলি শেখা শিশুকে একলা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে চলে গিয়েছিল, তার মুখে অন্তত এসব কথা হাস্যকরই লাগে।’

‘আমি তোমার মা, করবী!’

‘সেটাই আমার জন্য বড়ো আফসোসের।’ কথাটা বলেই করবী উঠে দাঁড়াল। হুতুমকে কোলে করে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে। নূন্যতম আসছি বলার ভদ্রতাটুকুও দেখাল না। ভদ্রমহিলা সেদিকে তাকিয়ে দু’ফোটা আনুষ্ঠানিকতার অশ্রু ঝরালেন। সন্তানের কাছে এতটা অবজ্ঞার পাত্রী হবেন কখনো কল্পনাও করেননি বোধহয়।

(৪১)

টিভি দেখছে তুষার। কোনো এক খবর চলছে। তাসনীম বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলের পাশের সোফাটায় নীরবে বসলেন। হয়তো কিছু বলতে চান যা উনার ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট। তবে সেদিকে তেমন ধ্যান দিল না তুষার। তার সকল ধ্যান জ্ঞান যেন সঁপেছে টিভি স্ক্রিনে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিনি গলা পরিষ্কার করলেন। দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন সুক্ষ্ম ভাবে। তুষাল বিরক্ত হলো বেশ।

‘কিছু বলার হলে সোজাসাপটা বললেই পারো।’

তুষারের কপালের তিন ভাঁজে তাসনীম বেগম যেন একটু থতমতই খেলেন। কথাে বলার সাহস হারালেন। তবুও যথেষ্ট চেষ্টা করলেন কথা গুছিয়ে বলার। এবং অবশেষে সাহসটুকু সঞ্চয় করে বললেন,
‘বউরে নিয়ে তো কিছু বললে না! কী করবে?’

মায়ের কথায় তুষারের কপালের ভাঁজ আরও ঘন হলো, ‘আমি কী করব!’

‘তুমি কোনো সিদ্ধান্ত জানাও।’

‘আমি কেন সিদ্ধান্ত জানাব? বিয়ের সময় কী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে? আমার তখনের সিদ্ধান্ত শুনতে চেয়েছিলে?’

ছেলের রাখঢাক না রেখে ছোঁড়া তীক্ষ্ণ বুলিতে তাসনীম বেগম মাথা নত করলে। ছেলের মন রাখতেই বললেন,
‘আমি কী জানতাম ও এমন করবে! ভেবেছিলাম তো ভালোই হবে।’

‘তো? ভালো নন উনি?’ প্রশ্নটা করেই বাঁকা হাসল তুষার। ঠিক এ মুহূর্তে কী বললে ছেলের মন রাখা হবে বুঝলেন না ভদ্রমহিলা। তাই চুপ রইলেন। এতে তুষারের যেন হাসি আরেকটু প্রশস্ত হলো। বেশ তাচ্ছিল্য করেই বলল,

‘মেয়েটা ভালো না-কি খারাপ সেটা বলতেও দ্বিধা করছ তাই না? এমন নীরব আছো যেন মনে হচ্ছে তুমি পছন্দ করে এনেছিলে যাকে সে অযোগ্য, ভীষণ খারাপ একটা মানুষ। কিন্তু আসলেই কী সত্যি এটা? মোটেও না। বিদিশা খারাপ নন। আমি তার সাথে হয়তো সংসার করিনি, দুদণ্ড ভালো মতন কথাও বলিনি তবুও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি উনি তোমার ভাবনার চেয়েও বেশি ভালো। একটা মানুষ যতটুকু ভালো হলে তার চলে যায় পাড়াপ্রতিবেশি হা-হুতাশ করে, ঘরের কাজের খালা অব্দি মেয়েটার সুন্দর জীবন কামনা করে, বিদিশা ততটুকু ভালো। যদি খারাপই হতো তাহলে এতগুলো বছর স্বামীর সাথে নূন্যতম যোগাযোগ না করেও এক ধারে সংসার করে যেত না। সমস্যা হলো কী, আমি, তুমি, আমরা… বুক ফুলিয়ে ভালোকে ভালো বলে মর্যাদা করতে পারি না।’

কথা শেষ করে তপ্ত শ্বাস ফেলল তুষার। টিভি স্ক্রিনে আর মনোযোগ স্থাপন করতে পারল না। হুট করেই কেমন বিরক্তি ধরে গেল চারপাশটায়। তেতো হয়ে এলো মগজ। সে উঠে দাঁড়াল। ঘরের দিকে পা বাড়াতেই তাসনীম বেগম ঝলমলে কণ্ঠে বলে উঠলেন,
‘তাহলে বউকে ফিরে আসতে বলি?’

তুষার ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। বড়ো অসহ্য লাগল তার এ মাকে। মায়েদের এতটা অসহ্য হয়তো কোনো সন্তানের কাছে লাগে না। অথচ তুষারের কাছে লাগচ্ছে। কারণ তার মা মারাত্মক রকমের স্বার্থপর একজন মানুষ। সে কেবল নিজের সন্তান, নিজের সংসার, নিজের সুখ.. এসবই ভেবে গেল। তুষার মৃদু স্বরে বলল,
‘তোমার মনে হয় উনাকে ফিরে আসতে বললেই ফিরে আসবে? কখনোই না। ফিরে আসার জন্য উনি যাননি। যতটুকু চিনেছি, আমি বলতে পারব উনি কেমন। আমরা মরে গেলেও উনি আর আসবেন না। তাছাড়া কিছুদিন আগে যে মেয়েটার প্রতি এত অভিযোগ তুলে তাকে বাড়ি ছাড়া করলে, সে মেয়েটাকেই কেন আবার ফেরাতে চাও? আমি বলেছি বলে? আমি তো তাকে ভালো বলেছি কেবল। ভালোবাসি কিংবা ভালো লাগে এটা তো বলিনি। পৃথিবীর এমন কত কোটি কোটি মানুষই ভালো, তাই বলে কী সবার সঙ্গেই আমার সংসার পাতাবে?’

তুষারের শেষের বাক্যটিতে ছিল যেন চরম মুখ ঝামটি। ছোটো হয়ে এলো মায়ের মুখটি। সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে কখন তাদের থেকে এতটা দূরের হয়ে গেল সেটা যেন মায়ের মন বুঝতেই পারল না।

_

ঘুড়িদের বাসায় আজ হুতুমসহ এসেছে। করবী নিয়ে এলো। বাচ্চাটা তো ঘরে একা থাকতে পারবে না তাই। ঘুড়ি অবশ্য বেশ খুশি হয়েছে হুতুম এসেছে বলে। নাহয় তো মুখ বিরস করেই বসে ছিল সারাটাদিন।

হুতুম খেলছে একটি লাল পুতুল দিয়ে। ঘুড়ির জন্মদিনে ওর বাবা ওকে উপহার দিয়েছিল এটা। করবী হুতুমকে খেলতে দিয়ে ঘুড়ির সাথে কথা বলছিল। মেয়েটা কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ চিন্তিত বিধায় সে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। তখনই ঘুড়ির সে কী কান্না! তার পাশের ফ্লাটের সেই গুরু-গম্ভীর মানুষটার নাকি বিয়ের কথা চলছে। গতকাল লোকটার মা এসেছে ঘুড়ির মাকে বলেছে মেয়ের খোঁজ থাকলে জানাতে। এটা শোনার পর থেকেই ঘুড়ির খাওয়া ঘুম উধাও। করবী সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনল। স্বান্তনা দিয়ে ঘুড়ির কান্নাও থামাল। কিন্তু সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না, যে লোকটার ভাবি ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে সে লোক হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলো! সে পরিবারের মানুষই বা কীভাবে এমনটা ভাবতে পারল? ঘরের বউয়ের প্রতি কোনো মায়া নেই তাদের! এসব ভেবেই মনের ভেতর একটা ক্ষোভ জন্মালো করবীর। ঘুড়িদের পাশের ফ্লাটের অপরিচিত পরিবারটার প্রতি তার যেন একটা অনীহাই চলে এলো।

ঘুড়িকে ছুটি দিয়ে করবী যখন রাস্তায় নামল তখন বিকেলের প্রায় শেষভাগ। হীরণ এসে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। হুতুম মাস্তানকে পেতেই ছুটে গেল। পেছন-পেছন এলো করবী। হীরণ হাসি মুখে হুতুমকে কোলে তুলে নিলো। ভ্রু নাচিয়ে করবীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কী ব্যাপার? আজ আসতে বললে যে?’
‘বাইক এনেছ?’

হীরণ উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা বাইকটা দেখিয়ে বলল, ‘ঐ যে, এনেছি।’

করবী নিজেদের থেকে অতটা দূরে বাইক থামানো দেখে কিছুটা অবাকই হলো যেন! অবাক কণ্ঠেই বলল, ‘অতটা দূরে রেখেছ যে!’

হীরণ মাথা চুলকালো মিছিমিছি। হুতুমের গালে চপাস করে চুমু খেয়ে বলল, ‘ভেবে ছিলাম তুমি হেঁটে যাবে। বাইক দেখলে তুমি আমাকে আর তোমার সাথে হাঁটতে দিবে না। জোর করে বাইকে পাঠাবে। তাই দূরে রেখে ছিলাম। যেন সময় করে মিথ্যে বলে তোমার সাথে হাঁটার সুযোগ পাই।’

করবী তাজ্জব বনে গেল, ‘কী বলছো! বাইকটা যদি চুরি হতো!’

‘হয়নি তো কখনো! এর আগেও তো কতবার রাখলাম।’

করবী কপাল চাপড়াল। কোনো মানুষ ভালোবেসে এমন বোকা হতে পারে হীরণকে না দেখলে বুঝতোই না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে