#বুকপকেটের_বিরহিণী
২৮ এর বিশেষ:
কলমে: মম সাহা
(৩৮)
করবীর ফুলো মুখ। গালের এক সাইডে দেখা যাচ্ছে অযত্নের ব্রণ। চুল গুলো বাউণ্ডুলে, এলোমেলো। নীল রঙের জামাটা ঝকঝকে। ফর্সা শরীরে মনে হচ্ছে যেন একখণ্ড আকাশ জড়ানো। ধীর পা জোড়া হাঁটতে চায় না তবুও জোর করে তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সপ্তাহ খানেক হলো টিউশনিতে যায়নি। আর যে দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করা যায় না!
ক্লান্ত বুক চিরে বেরিয়ে আসে তিক্ত শ্বাস। চোখ গুলো টলমল করে ওঠে নোনা জলে। আকাশে অগণিত পাখি উড়ছে। কিচিরমিচির শব্দ কানে লাগছে বড়ো। করবী সেই আকাশের পানে তাকায় এক বুক আশা নিয়ে। এ নতুন নয়। গত কয়েকদিন যাবতই সে পাখির শব্দ শুনলেই ছুটে আসে। আকাশের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি বাণীটা উড়ে এলো। ভাঙা ভাঙা করে কতগুলো কথা বলল! অথচ এমন কিছুই হয় না। আশার আলো জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায় অথচ বাণীটা ফিরে না। এই আটশ কোটির পৃথিবীতে তার নিজের বলতে কেউ নেই— এই বাক্যটির চেয়ে নির্মম বাক্য আর হয়? হয় না বোধকরি।
‘আজ এত দেরি হলো, বাণীর মায়ের!’
খুব নিকটেই একটি পরিচিত পুরুষ কণ্ঠ পেতেই করবী চমকে উঠল। এতটাই ধ্যানে মগ্ন ছিল সে যে বুঝেইনি তার সামনে হীরণ দাঁড়ানো।
করবীকে চমকাতে দেখে হাসল হীরণ, ‘কী ভাবে বাণীর মায়?’
মেয়েটাও হাসির বিপরীতে জোরপূর্বক হাসে। উচ্ছ্বাসহীন কণ্ঠে বলে, ‘কিছু না।’
‘রাস্তার মাঝে এমন করে ভাবতে-ভাবতে হাঁটলে তো গাড়ি তোমাকে উড়িয়ে দিবে।’
‘তাতে খারাপ হবে না বুঝলে!’ ঠোঁটে ঝুলানো বিষাদ হাসিটা আরেকটু গাঢ় হলো মেয়েটার। হীরণ তপ্ত শ্বাস ফেলে। করবীর এত বিপর্যস্ত অবস্থা ছেলেটাকে শান্তি যে দেয় না। কীভাবে মেয়েটাকে বুঝাবে সে এটা?
‘তুমি এখানে কেন? কোনো দরকারে এসেছিলে বুঝি?’ করবীর প্রশ্নে হীরণ মাথা নাড়ায় ডানে-বামে। অর্থাৎ, না। এরপর মুখে বলে,
‘আমি রোজই এখানে আসি।’
হীরণের উত্তরে কিঞ্চিৎ অবাক হয় করবী। ডান ভ্রু টা খানিক উঁচু করে বলে, ‘রোজ আসো? কেন? তুমি না এ সময় এলাকায় আড্ডা দিতে?’
করবীর প্রশ্নে মাথা নিচু কারে হাসে হীরণ। কথার প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করে বলে,
‘চলো হাঁটি। টিউশনে যাবে তো?’
করবী সম্মতি দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। আকাশে তখন সূর্যের তেজ নেই। গরমটাও কমে এসেছে। চারপাশে কোলাহল। বিকেলের ফুটপাতে কিছু কিছু জায়গায় কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠেছে।
‘কিছু খাওনি কেন?’
হুট করে হীরণের অদ্ভুত প্রশ্নে ভ্রু দু’টো কুঞ্চিত করল করবী। সে খায়নি একথাটা হীরণ জানলো কীভাবে তা ভেবেই অবাক হওয়া। হীরণ আবার বলে,
‘চলো, কিছু খেয়ে নিই। আমিও খাইনি।’
করবী শুধাল, ‘খাওনি কেন, হুতুমের মাস্তান?’
‘তোমার সাথে খাব বলে।’
করবী ছোট্টো শ্বাস ফেলল, ‘ইচ্ছে নেই।’
হীরণ জোর করল না। বরং শান্ত ছেলের মতন মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘বললে না, রোজ এ রাস্তায় আসো কেন?’
‘আসি আরকি একটা কারণে।’
‘কবে থেকে আসো? কই দেখিনি কখনো তো!’
‘যেদিন থেকে আমার এলাকার চাঁদটা এই এলাকায় জোছনা দেওয়া আরম্ভ করল, ঠিক সেদিন থেকে।’
করবী ঠিক ধরতে পারল না কথাটা। অবুঝ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কী!’
হীরণ নিশ্চুপ রয়। হীরণের এই নৈঃশব্দ্যতার ভেতরেই যেন করবীর সকল উত্তররা জ্বলজ্বল করে উঠে। করবীর মস্তিষ্ক কথাটা ধরতে পেরেই থেমে যায়। ছেলেটা এতটা পাগলামো করে কেন!
‘এই যে এত অবুঝের মতন করো, ক্লান্ত লাগে না? কতবার প্রত্যাখানের পর একজন মানুষ মুখ ফেরায় বলো তো?’
‘মানুষেরটা তো জানিনা, তবে হীরণ শেষ নিঃশ্বাস অব্দি ফেরাতে পারবে না। ক্ষমা করো।’
হীরণ ভেবেছিল তার এমন একটা কথার পর করবী রেগে যাবে, প্রতিক্রিয়া দেখাবে.. কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং মেয়েটা উন্মনা হয়ে হাঁটল কেবল। হীরণ আবেগ ভোরা চোখে তাকাল। করবীকে চুপ থাকতে দেখে তার প্রেমের সাহস যেন কিছুটা বেড়ে গেল। হুট করে বলল,
‘আচ্ছা, কতবার প্রত্যাখানের পর একজন মানুষ ভালোবাসতে বাধ্য হয় বলো তো!’
করবীর ঠোঁটের কোণায় অনুরাগ দেখা যায়। খুব বলতে ইচ্ছে করে, হীরণের মতন মানুষ হলে মিছে মিছি দুই প্রত্যাখানের পরই ভালোবাসা এসে পরে। প্রথম প্রত্যাখ্যান মন থেকে আর দ্বিতীয়টা দেখানোর জন্য। অমন সোহাগ জানা পুরুষ ক’জনই বা ফেরাতে চায়? কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না এই অনুরাগপূর্ণ কথা গুলো। বুকের কোণাতেই থেকে যায় তারা কড়া শাসনের ফলে।
বাকি পথটুকু নীরবই হাঁটে দু’জন। এরপর যখন করবী টিউশনি বাসায় ঢুকতে যায় ঠিক সে সময় ছেলেটা তাকে দাঁড় করিয়ে কোথায় যেন গিয়ে আবার ব্যস্ত পায়ে ফিরে এসে করবীর হাতে কেক, জুস ধরিয়ে দেয়। ভীষণ আবদার ভোরা কণ্ঠে বলে,
‘মনের দুঃখ পেটকে দিয়ে লাভ নেই। বাঁচতে যেহেতু হচ্ছে শুধু শুধু দেহকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী? খেয়ে নিও। আমি অপেক্ষায় আছি একসাথে ফিরব। কেমন?’
করবী নিষেধ করল,
‘না না, চলে যাও তুমি। আমি একা যেতে পারব।’
হীরণ মাথা নাড়ায়। বুঝায় সে চলে যাবে। কিন্তু করবীর মন জানে, ছেলেটা যাবে না। এখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকবে। দুঃখের সময় ছেলেটা রুমাল হতে যে ভালোবাসে!
#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৯
কলমে: মম সাহা
কেমন যেন সাধ হয় এই ক্লান্ত সংসার ছাড়িবার,
আদেশ নেই প্রস্থানের আর ইচ্ছে নেই রহিবার।
বিদিশার ডায়েরি জুড়ে এই দুটি লাইন লিখা। একবার, দু’বার না, গুনলে হয়তো শতসহস্র বার পাওয়া যাবে। কিন্তু জামাল ভূঁইয়া গুনলেন না। মেয়ের ব্যক্তিগত কষ্ট কোনো বাবা-ই সহ্য করতে পারেন না। তার উপর কষ্টের পরিমাণ কেই-বা যাবে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে দেখতে?
বিদিশা ফ্লোরে বসে আছে খাটে হেলান দিয়ে। বেখেয়ালি বাতাসে উড়ছে ডায়েরির পাতা গুলো। শব্দ হচ্ছে পাতায়-পাতায় সংহারের। জামাল ভূঁইয়া দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন মেয়ের মন মরা এই দৃশ্য। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু তিনি মেয়ের দুঃখকে বাড়াতে চাইলেন না। তাই আবার পর্দা ঠেলে ঘরের বাহিরে গেলেন। গলা উঁচিয়ে ডেকে বললেন,
‘কী করো, আম্মু?’ কথা বলতে বলতে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলেন। ততক্ষণে বিদিশা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একদম পরিপাটি হাবভাব। একটু আগে অব্দি যে বিদিশা ফ্লোরে মনমরা হয়ে বসে ছিল, সে বিদিশার সাথে এই বিদিশার যেন বহু তফাত। মনে মনে হাসলেন বাবা। মেয়ের চতুরতায় বড়ো খুশিও হলেন। দুঃখ লুকানোর ক্ষমতা সবার নেই। উনার মেয়ের আছে সেটা অবশ্যই গর্বের ব্যাপার।
‘কিছু করছি না, বাবা। কিছু বলবে?’
‘কিছু না বললে বুঝি আসা যায় না? ‘
বাবার কথার প্যাঁচে পড়ে হাসল সে, ‘অবশ্যই যায়। বসো।’
বাবা বসলেন কাঠের চেয়ারটা শব্দ করে টেনে। দু’জন মানুষের ভেতরই কথার পাহাড় অথচ শুরু করার উপলক্ষ না পেয়ে শুনশান নীরব হয়ে স্থির থাকল দু’জন। বাহির থেকে তখন বিদিশার মায়ের নাক টানার শব্ত পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো শব্দহীন কাঁদছেন। আজ বিকেলে কিছু আত্মীয় এসে ছিলেন। উনাদের হা-হুতাশ বিদিশার সংসার ভাঙা ঘিরে। মায়ের মন সেই হা-হুতাশে ব্যথিত হয়েছে ভীষণ। মানুষ গুলো যাওয়ার পর থেকেই যে নাক টেনে টেনে নীরব কান্না চলছে, তা এখন জারি রেখেছেন।
বাবা-মেয়ের কান সেই কান্নাতেই আটকে গেল। বিদিশা ছোটো স্বরে বলল, ‘মা বোধহয় কাঁদছে।’
বাবা আনমনে বললেন, ‘হয়তো!’
‘আমি আসাতে তোমাদের বড্ড যন্ত্রণা হয়ে গেল, তাই না বলো?’
জামাল ভূঁইয়ার অন্যমনস্কতা কেটে গেল। চপল চোখ গুলো মেয়ের দিকে স্থির করে বললেন, ‘এমন বলছো কেন?’
‘আমি কই বললাম? মায়ের কান্না বলছে।’
বিদিশা ঠাহর করল তার কথার পরপরই কান্নার শব্দ একদম মৃদু থেকে মৃদুতে চলে গেল। দরজার পর্দাটাও কেঁপে উঠল। কাঁপল নারী ছায়াটাও। মা যে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে শুনেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘তুমি আসার যন্ত্রণায় এ কান্না নয়। এই কান্না তোমার যন্ত্রণায় অন্তর পুড়ে আঙ্গার হয়ে যাওয়ার। কান্না ধরণ বুঝলে না আজও?’
‘আমার যন্ত্রণা কই হলো? মুক্তিতে কারো যন্ত্রণা হয় না-কি?’
মেয়ের কথা ঘুরানোর কৌশলে বাবা মাথা নাড়ালেন মৃদু। উঠে যেতে যেতে বললেন, ‘মুক্তিতে যন্ত্রণা হয় কে বলল? যন্ত্রণা হয় মৃত্যুতে। আর তোমার সংসারের জীবনের এই মৃত্যুতে তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমি বুঝি।’
(৩৯)
ঘুড়ি মন খারাপ নিয়ে পড়তে বসেছে। যেমন-তেমন মন খারাপ না, ভীষণ মন খারাপ। একটি উজ্জ্বল তারা আকাশ থেকে খসে পড়লে যেমন আকাশের মন খারাপ হয় ঠিক তেমন মন খারাপ। করবী এসে বসার পরপরই সে মন খারাপ নিয়ে উঠে গেছে। তারপর এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে দিয়েছে। মন খারাপ নিয়েই সব পড়া এগিয়ে দিয়েছে। করবী বেশ খানিকক্ষণ যাবতই ঘুড়ির এই মন খারাপ খেয়াল করছে। অতঃপর বলল,
‘কী হয়েছে বলো তো? আজ আকাশ অন্ধকার কেন?’
ঘুড়ি চঞ্চল চোখে বারান্দা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। অন্তরিক্ষের নীরদ তখন আনমনে উড়ছে। বিকেলের কমলা রঙ তখন বুক ফুলিয়ে হাসছে গগণ বক্ষে। কই আকাশ তো অন্ধকার নয়। ঘুড়ির সরল ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। আর্দ্র স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় অন্ধকার?’
‘এই যে অন্ধকার— চোখ দু’টিতে, অন্ধকার- ঘুড়ির চঞ্চল ঠোঁটে। মনে হচ্ছে মনের ভেতর ঝড়ের ভীষণ তোলপাড়…. এই যে এত এত অন্ধকার, দেখছো না বুঝি?’
করবীর কাব্য গাঁথা কথায় ছোটো মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠল। খানিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘ওহ্, আমার কথা বলে ছিলেন! বুঝিইনি।’
‘তা বললে না তো মন খারাপ কেন? কিছু হলো?’
ঘুড়ি ফুস করে শ্বাস ফেলল। হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘কেবল কিছু নয়, অনেক কিছু হয়েছে। আপনি তো আসেননি এক সপ্তাহ তাই জানাতে পারিনি।’
‘কী হলো এমন?’
‘ভাবি আছে না? সে চলে গিয়েছে।’
ঘুড়ির কথা বোধগম্য হলো না করবীর। বোকা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় গিয়েছে?’
‘তার বাবার বাড়ি। একবারের জন্য চলে গিয়েছে।’
করবী কিছুটা অবাক হলো। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে অস্বচ্ছ।
‘ভাবী চলে গিয়েছে কেন? কী এমন হলো?’
ঘুড়ি এবার সবটা খুলে বলল। বিদিশার বিয়ের প্রথম থেকে শেষ ভাগের সবটুকু। যেতে যেতে বিদিশা কেমন পাথর হয়ে প্রস্থান নিয়েছে তা বলতেও বাকি রাখেনি। করবীর বড়ো আফসোস হলো মেয়েটার জন্য। চোখ-মুখে উদ্বিগ্নতা দেখা গেল। চাপা স্বরে বলল, ‘ভাবির বাবার বাড়ির ঠিকানা জানো?’
ঘুড়ি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাতেই করবী জানাল সে ভাবিকে দেখতে যাবে। তা শুনে বায়না জুড়ল ঘুড়িও। করবী রাজি হলো। ঘুড়িকে সাথে নিয়েই বিদিশাকে দেখতে যাওয়ার দিন নির্ধারণ করল। মনে মনে বিদিশার পরিবারটির বিরুদ্ধে বিরূপ প্রভাব পড়ল মনে। এত নিচু মন-মানসিকতা মানুষের! ভাবতেই তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
তখন বিকেল পেরিয়ে সাঁঝ নেমেছে ধরায়। রাস্তার হলুদ, নীল, সাদা আলো গুলো জ্বলে উঠেছে জোনাকির মতন। ফুটপাতের নীল পলিথিনে দোকান গুলোতে বসেছে কত মুখরোচক খাবারের সমাহার। কোথাও বা বসেছে ভ্যান ভর্তি ঝুমকো, নেলপলিশের হাঁট। করবী যখন ঘুড়িদের বাসা থেকে নামল তখন বাজে সাড়ে সাতটা। সিঁড়ি পেরিয়ে গেইটের সামনে তাকাতেই দেখল হীরণ নেই। করবী হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল। যাক, ছেলেটা কবে এতক্ষণ অপেক্ষা করেনি। তবে কোথাও যেন মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার আভাস ধামাচাপা দেওয়ার তুমুল চেষ্টা চলল।
যেই গেইট পেরিয়ে রাস্তায় পা ফেলল ঠিক সেই মুহূর্তে হীরণের হাস্যোজ্জ্বল মুখটি নজরে পড়ল। ঠোঁটে একটি মহা মূল্যবান খাঁদ বিহীন হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘তুমি বুঝি একটু বেশি সময় ধরে পড়াও? প্রায় দু’ঘন্টা পড়ালে।’
‘তা নয়, অনেক বন্ধ পড়েছে বিধায় একটু বেশি পড়ালাম। তুমি যাওনি কেন?’
‘যাওয়ার কথা তো ছিল না।’
‘ছিল।’
‘কখন ছিল?’
‘আমি তো বলে ছিলাম চলে যেতে।’
‘তুমি কী আমায় আসতে বলে ছিলে?’
‘না।’
‘তবে, যাওয়ার কথাও-বা বলবে কেন? যে নিজ ইচ্ছেতে আসে সে যেতে হলে নিজ ইচ্ছেতেই যাবে। তাকে শুধু শুধু যেতে বলে দুঃখ দিও না।’— কেমন দুঃখী দুঃখী একটি কথা হীরণ শুদ্ধতম হাসি দিয়ে বলে ফেলল। অথচ কথাটির ভেতরে ছিল কেমন গাঢ় অভিমান, অভিযোগ! করবী অবশ্য অতটুকু ভেতর ছুঁতে পারল। কিছুটা বিরতি নিয়ে হাঁটা আরম্ভ করল। হাঁটতে লাগল হীরণও। বেশ খানিকক্ষণ রঙিন পথটা হেঁটে পার করল নিশ্চুপে। হীরণ অপরাধী স্বরে বলল, ‘রাগ করেছ?’
করবী বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘রাগ করার মতন কিছু বলেছ?’
‘না।’
‘তবে রাগ করব কেন?’
‘কী জানি, রুবী! আমি তো বলি ভালোবাসতে পারার মতন কথা অথচ তুমি ভালোবাসো না। তাই বুঝি না কোন কথাতে রাগ করবে আর কোন কথাতে অনুরাগ!’
করবীর রুষ্ট চোখে তাকাল। প্রশ্রয় না দিয়ে বলল, ‘একদম এমন কথা গুলো বলবে না। এসব বললে আমার সাথে কথা বলবে না।’
‘কী অদ্ভুত তাই না? যার জন্য ভালোবাসা সে বুঝে না অথচ গোটা পৃথিবী জানে, হীরণ নামের একটি বখাটে ছেলে ভদ্র রুবীতে মুগ্ধ হয়ে মরেছে। অথচ যার জন্য মরলাম সে এক মুঠো প্রেমও দিল না সমাধিতে।’
করবী চমকে তাকাল। হীরণ এত সুন্দর কথা বলতে পারে তার ধারণাতে ছিল না। ল্যাম্পপোস্টের জ্বলজ্বলে আলোয় শ্যামলাটে হীরণকে তার জনম জনমকার প্রেমের পিয়াসু মনে হচ্ছে। কী মায়া আছে ঐ অবিশ্লেষিত চোখ দু’টোতে, কে জানে? তাকালেই মনেহয় আটকে যাবে মন। ফেঁসে যাবে বুকের ভেতর শাসনে থাকা সেই প্রেম। সোহাগ জানা পুরুষ তখন জেনে যাবে, ভদ্র রুবীর মন অবাধ্য হতে চায়। অভদ্রের হাত ধরে জীবন দেখতে চায়।
কিন্তু এ কথা যে জানতে দেওয়া যায় না। বিধানে নেই। বিন্দুর প্রেমের মানুষকে নিয়ে নিলে মেয়েটা কাকে ধরে বাঁচবে? কাকে দেখে মুগ্ধ হবে? কার জন্যই বা ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের জামা পরবে? বিন্দুর শখ – আহ্লাদ যাকে ঘিরে, তাকে ঘিরে সংসার সাজানো যায় না। উচিত নয়।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায় তারা। করবীর পা থেমে যায় পরিচিতদের দেখে। একটি ছোটো মেয়ের হাত আঁকড়ে ধরে আছে আরকটি ছোটো হাতকে।
বিন্দুদের আকস্মিক দেখে করবী কিছুটা হোঁচট খায়। ভয়ও হয় খানিক। হীরণকে পাশে দেখে বিন্দুটা কী ভাববে সেটা ভেবে মনও উতলা হয়। অথচ বিন্দুর ঠোঁটের বিশাল হাসি বিশালই থাকে। চঞ্চলা স্বরে বলে,
‘আরে হীরণ ভাই, তুমি এইহানে? আপার লগে আইলা? ভালাই হইছে তুমি আছো আপার লগে। আমার যে কী দুর্ভাগ্য! আপার খারাপ সময়ে থাকতে পারতাছি না। হীরণ ভাই তুমি একটু আপার আগে-পিছে থাইকো কয়ডা দিন। আপার ভালো লাগবো।’
বিন্দুর এত সরলতা, এতটা স্বাভাবিকতা আশা করেনি করবী। ভেবেছিল মেয়েটা একটু হলেও দুঃখ পাবে হয়তো মনে মনে! ততক্ষণে হুতুম এসে বাণীর মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরেছে। হুতুমের মাস্তান গাল টেনে দিল বাচ্চাটার। দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকা বিন্দু শুষে নিল চোখের জলটা সবার অগোচরে। নিজে নিজে বিড় বিড় করে বলল—
‘আমি এত স্বার্থপর নাকি যে আমার আপার সুখ দেখলে আমার দুঃখ হইবো! আপার সুখ আর হীরণ ভাইয়ের সুখ যেইহানে আইস্যা থামে, আমি যে তার থেইক্যা বহুদূরে হেইডা কী আর আমি জানি না! জানি। তবুও, ভালোবাসলে একটু তো পাইতে মন চায়ই। ছাঁদের ঘরটায় আমার বালিশের পাশের বালিশটায় তোমারে তো একটু দেখতে মন চায়ই, হীরণ ভাই। তাই বইল্যা তোমারে দুঃখ দিমু না-কি? না আপার সুখ দেইখা জ্বলমু? আমার বালিশের পাশে তোমার বালিশটা চির জীবন নাহয় খালিই থাকব। আমার যে তাও হুতুম আছে। আপার তো কেউ নাই। কেউ না। আপার হইয়া নাহয় তুমিই থাকলা।’
#চলবে