বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২৬+২৭

0
262

#বুকপকেটের_বিরহিণী
হীরণ সমাচার পর্ব: ২৬

কলমে: মম সাহা

কিছু মানুষ চির জীবনের জন্য ঘুমিয়ে আছে মাটির ভেতরে। তার সাথে ঘুমিয়ে গিয়েছে কত শখ, কত স্বপ্ন, কত না বলা কথা, কত আফসোস, কত মায়া, আরও কত কী…জায়গাটি কবরস্থান। প্রতিটি মানুষের শেষ গন্তব্য স্থান। যেখানে এসে একদিন সবাইকে থামতে হবে। সবকিছুকে বুকে যত্নে করে পোষ মানিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে এখানে। চির জীবনের ঘুম।
ঠিক এই জায়গাটার চারপাশ জুড়ে যে বেড়া লাগানো, সেই বেড়ার বিপরীতে এক জীবিত পৃথিবী। যেই পৃথিবী প্রতিনিয়ত স্বপ্ন পুষে বুকে, চলছে বহুদূর। শেষ গন্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে ক্ষণস্থায়ী গন্তব্যকে পাওয়ার আশায় ছুটছে। এই ছুটার শেষ নেই। তারা ভুল করেও একবার স্মরণ করে না একদিন তাদের ব্যস্ততা এসে ঘুমিয়ে যাবে কবর দেশেতে। একটা সামান্য বেড়া, অথচ দু’টো পৃথিবীকে আলাদা করে দিয়েছে কত গুরুতর ভাবে। সেই বেড়া ধরে ব্যস্ত পৃথিবীর একজন প্রাণী শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত পৃথিবীটির দিকে। কারণ আজ তার শখের মানুষটি ঘুমিয়ে গিয়েছে চির নিদ্রায়। সেই ঘুম কেমন, কতটা একাকীত্বের তা-ই দাঁড়িয়ে দেখছে মেয়েটি।

বাতাস নেই চারপাশে। গুমোট, অস্বস্তিকর একটা গরম পড়েছে। তবে জোছনা রাত। এক আকাশ জুড়ে একটি অর্ধ-খণ্ডিত চাঁদ চুপ করে আছে বিচ্ছেদের দেবদাসের মতন। সেই জোছনার আলো ঝলমল করছে নতুন কবরটার উপর।

‘বাড়ি চলো। ভোর হবে তো কিছুক্ষণ পর।’
এই নিশ্চুপ, অপরিচিত পরিবেশে পরিচিত কণ্ঠে খানিক কাঁপল করবীর শরীরটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল হীরণের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখটি। করবীর অবাক হওয়া উচিত হুট করে এখানে হীরণকে দেখে। বিস্ময়ও প্রকাশ করা উচিত। অথচ সে কিছুই করল না। কেবল নির্জীব কণ্ঠে থেমে থেমে বলল,
‘কখন এলে?’
‘আমি এখানেই ছিলাম।’
‘এখানে ছিলে?’
করবীর মুখে এবার খানিক বিস্ময় দেখা গেল। হীরণ এসে করবীর পাশাপাশি দাঁড়াল। দৃষ্টি রাখল করবীর মুখমণ্ডলে। উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু.. কেন?’
‘আমি জানতাম তুমি আসবে।’
করবীও এবার সরাসরি তাকাল হীরণের দিকে, ‘তুমি জানতে আমি আসব! কীভাবে?’
‘যে মেয়েটি তার সকল শখ, আহ্লাদ কেবল উৎসর্গ করেছিল তার বাবার পেছনে, সেই মেয়েটি যে বাবার সাথে এত সহজে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না, সেটা আমি জানি।’

করবীর চোখে জল এলো। কান্নারা এমনই। আহ্লাদ পেলে প্রকাশ্যে আসতে চায়। হীরণ করবীর মনের অবস্থা বুঝল। করবীর ডান হাতটা শক্ত করে ধরল, ‘কেঁদো না। যে চলে গেছে, কাঁদলেও সে ফিরে না।’
ছন্নছাড়া, ভবঘুরে ছেলেটির নিখাঁদ স্বান্তনায় করবীর কান্না থামার বদলে বেড়ে গেল। ফুপিয়ে ওঠল সে,
‘কেন ফিরে না? তারা জানে না, তাদের ছাড়া আমাদের কষ্ট হয়।’
‘জানে। কিন্তু ফিরে আসার যে নিয়ম নাই। থাকলে হয়তো তারা আসতো। এত আপন মানুষকে রেখে যেতে কেই-বা চায় বলো?’

‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ বাচ্চাদের মতন কী সহজ সরল স্বীকারোক্তি মেয়েটার! হীরণের খারাপ লাগে। তার ডান হাতে থাকা করবীর হাতটাকে সে বাম হাতে বুলিয়ে দেয় স্নেহের ছোঁয়ায়। বলে,
‘তোমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে সেটা আমি জানি। বুঝি। মা যখন মারা গেল, তখন আমার কষ্ট বুঝার বয়স হয়নি। একদিন দেখলাম বাবার সাথে মায়ের কী নিয়ে যেন প্রচণ্ড ঝগড়া হলো। ঝগড়া ভয় পেতাম তাই ভয়ে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝিনি।’
হীরণের কথা থামে। পরপরই ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস। ততক্ষণে করবীর কান্না কিছুটা দমে এসেছে। হীরণের এ’জীবন সম্পর্কে তারা অবগত নয়। তা-ই স্বভাবতই কৌতূহল জন্মালো তার,
‘তারপর?’

হীরণ বুক ভোরে শ্বাস নিল। কষ্টের কথা বলতে তার ভালো লাগে না। তবুও করবীর কষ্ট সামান্য নিয়ন্ত্রণে আনতেই এই কথাগুলো বলা। কারণ মানুষ যখন নিজের কষ্ট নিয়ে প্রচণ্ড হতাশায় ভুগে তখন তাকে অন্যের কষ্টের কথা জানাতে হয়। তখন অন্যের কষ্টের সাথে নিজের কষ্টের তফাত খুঁজে পেয়ে খুব সহজেই নিজের দুঃখটা লাঘব করতে পারে।

হীরণকে চুপ থাকতে দেখে করবী আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কি, ঘুম থেকে ওঠলাম প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দে। মায়ের ঘর থেকে চিৎকার আসছিল। ছোটো মন ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। দ্রুত মায়ের রুমের কাছে যেতেই জীবনের নির্মম দৃশ্যটুকু দেখে ফেললাম। মায়ের শরীরে দপদপ করে আগুন জ্বলছে। মা নিজেই লাগিয়েছে আগুনটা। আমি মায়ের কাছে ছুটে যেতে চাইলেও দাদী আটকে দেয়। মা-ও এই জ্বলন্ত শরীর নিয়েও বার-বার হাত নেড়ে ইশারা করছিল আমি যেন তার কাছে না যাই। বাড়ির কাজের লোকরা ছুটে গিয়ে পানি আনল। মায়ের শরীরের আগুন নেভালো। কিন্তু ততক্ষণে সবটুকু পুড়ে ছাঁই। মায়ের শরীর, মায়ের দুঃখ, মায়ের অভিযোগ…. সবকিছু।’

কথা থামল। বোবা বাতাস ছুঁয়ে গেল শরীর। করবী তার হাতের তালুতে থাকা হীরণের হাতটা শক্ত করে ধরল। এই শক্ত করা অর্থ হলো আশ্বাস দেওয়া।

‘কষ্ট পেও না।’ ছোটো, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল সে।
হীরণ হাসল। আবারও বুক ভোরে কতগুলো বোবা বাতাস টেনে নিল অন্তরে,
‘কষ্ট পাই না। কষ্ট পেয়েও বা আর কী হবে? মা ফিরবে না। তবে একটা জায়গায় আমার আফসোস থেকেই গেছে, জানো। আমি সাত বছর থাকাকালীন মা মরেছিল। মায়ের বিদায়ে কান্না করার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ ছিল না। আমি তো ছোটো মানুষ, ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কান্না করার সুযোগ পাইনি। অথচ আব্বু, দাদী, ফুপি কেউ কাঁদল না। দেখলাম মায়ের লাশ কবরে ওঠার আগেই বাড়িতে বিশাল আড্ডা বসল। সেই আড্ডায় আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রী কেমন আনতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত সকলে। অথচ তখনও বাড়িটায় একজন মানুষের অস্তিত্ব পুড়ে যাওয়ার গন্ধ ছিল। একটা মানুষ এত বছর এই পৃথিবীটাতে ছিল। সংসার গুছানোর তাগিদে নিজেকে কখনো গুছানোর সুযোগ পেল না, সংসারের জন্যই শেষমেশ জীবন দিল অথচ দুর্ভাগ্য দেখো, সেই সংসারেই তার শূণ্যতায় কান্না করার মতন কেউ ছিল না। কেউ না। আমার মায়ের পুরো এক জীবনের মায়া, শ্রম সবই বৃথা ছিল। অথচ চাচার ভাগ্য সেক্ষেত্রে ভালো। তার কবরের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকার জন্য একজন মানুষ তিনি পৃথিবীতে রেখে গেছেন।’

করবী স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা পেল না। কেবল শক্ত হাতে ধরে রাখল হীরণকে।
হীরণ তপ্ত শ্বাস ফেলল,
‘জানো, আমার আফসোস কী?’
করবী আগ্রহী মনে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
‘যে মানুষটা আগুনে ঝলসে যাওয়ার সময়ও আমার কথা ভেবে আমাকে তার কাছে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সে মানুষটার জন্য আমি কিচ্ছু করতে পারিনি। কিছুই না।’

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৭ (অর্ধেকাংশ)
কলমে: মম সাহা

(৩৭)
সকাল বেলা ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে বিদিশা। সূর্য সবে লাল টুকটুকে রঙ ধরে গগণে হাসতে শুরু করেছে। ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। কর্কশ কণ্ঠে একাধারে একটি কাক ডেকে যাচ্ছে ভোরটিকে পরিপূর্ণ করতে।
হুট করেই ছাদের গেইট খোলার শব্দ পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বিদিশা। তাকাতেই তুষারের ঘুম-ঘুম চোখমুখ দৃষ্টিতে এলো। এত সুন্দর পুরুষ মানুষ হয় কি-না তার সন্দেহ। লোকটি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সুন্দর বোধহয়।
‘ছাদে যে?’
তুষার প্রশ্নটি বিদিশাকে উদ্দেশ্য করেই করেছে কিন্তু বিদিশা তবুও মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে রইল। তুষার আরেকটু এগিয়ে গেলো। বিদিশা থেকে তিন-চার হাত দূরে প্রাচীরটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ঘুম মাখানো কণ্ঠ তার,
‘এত সকালে ছাদে কী করেন?’
বিদিশা উত্তর তো দিল না বরং চলে যেতে উদ্যোত হতেই তুষার বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করল, ‘আরেহ্, আপনি কথা বলতে পারেন না না-কি? ‘
‘কেন? কথা বলতে পারলেই আপনার সাথে কথা বলতে হবে এর কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বুঝি?’

মেয়েটার ধারালো উত্তরে তুষার দিনে দিনে কেবল তাজ্জবই বনে যাচ্ছে যেন।
‘এভাবে কথা বলেন কেন আপনি?’
‘কীভাবে বলি?’
‘এই যে মাধুর্যহীন।’
‘আপনার সাথে মাধুর্যতা দেখানোর প্রয়োজনবোধ করি না, তাই।’

তুষার যেন আরকিছুই বলার ভাষা পেল না। ঘুম উড়ে গেছে সেই কখন। মেয়েটিকে সে যতটুকু দেখেছে মেয়েটা এত রুক্ষ নয়। সবার বেলাতো নয়ই। এই তো পরশুদিন মধ্যরাতে যখন তিমির বাড়ি ফিরল তখন কী সুন্দর করে যত্ন করে তিমিরকে ভাত বেড়ে দিল। কেন বাড়িতে ফিরেনি দু’দিন তা-ও জিজ্ঞেস করল। তিমিরের ক্লান্ত মুখ দেখে কেমন স্নেহ করল! যদিও তিমির মেয়েটা থেকে বহুগুণ বড়ো তবুও সম্পর্কের দিক দিয়ে মেয়েটা বড়ো অভিভাবকের মতনই আচরণ করল। তাছাড়া ঘুড়ির সাথে থাকলেও তো কত সুন্দর করে মিশে। কিন্তু তার বেলাতে এলেই এমন শক্ত আচরণ করে কেন?
মনের প্রশ্ন মনে রাখল না তুষার। সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আমার সাথে এমন আচরন করেন কেন?’

বিদিশা ছাদের মাঝ বরাবর এসে থামল। পেছন তাকিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, ‘আপনি এটাই প্রাপ্য। সেজন্য।’

‘আমার দোষ কী?’
তুষারের প্রশ্নে এবার হু হা করে অপ্রত্যাশিত ভাবে হাসল বিদিশা। হাসি বজায় রেখেই বলল,
‘আপনার দোষ, আপনি আপনার মায়ের মতনই হয়েছেন।’

বিদিশার উত্তর ধাঁধা। তুষার সে-ই ধাঁধা ধরতে পারল না।
‘মানে!’

বিদিশা তপ্ত শ্বাস ফেলল, ‘আপনার মা যেমন তার ভুলটা কী সেটা উপলব্ধি করতে পারেন না কখনো, ঠিক আপনিও তাই। আপনাদের এই উপলব্ধি করতে না পারার ব্যাপারটাই আপনাদের জীবনের বড়ো ভুল। বড়ো অন্যায়।’

তুষার রেগে গেল এবার, ‘এতই যখন আমরা অন্যায় করেছি, ভুল করেছি তো চলে যাচ্ছেন না কেন?’

বিদিশার ঈগলের মতন তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া এবার শীতল হয়ে এলো। কর্কশ মুখমন্ডলটিও নরম হলো। থেমে গেল তার শক্ত-পোক্ত অভিনয়ের চেষ্টাটি। বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে বলল— ঠিকই তো! আমি চলে যাচ্ছি না কেন? থেকে গেছি কীসের আশায়? যেখানে আমি কোথাও নেই সেখানে সংসার পাতার আশায়? হাহ্!

বিদিশার মুখাবয়ব নরম হয়ে আসতেই তুষার অপরাধবোধ অনুভব করল। তার বোধহয় মেয়েটাকে এমন ভাবে বলা উচিত হয়নি।
বিদিশা নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে করতে ছাদ থেকে নেমে গেল। যে উত্তর বললে মানুষ দুর্বল ভাববে সে উত্তর নাহয় না-ই বলল। থাকুক কিছু লুকিয়ে।

বাবা বিহীন করবীর ছোট্টো সংসার। শূন্য, নিষ্প্রাণ রুম গুলো। বাবা বলে ডাকলেও সে ডাক প্রতিধ্বনিত হয় দেয়াল গুলোতে। এতটাই ফাঁকা চারপাশ। শোক-শোক করে বাবা বিহীন কেটে গেছে মেয়েটির একটি দিন। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল ঠান্ডা ফ্লোরে। যখন জানালা ভেদ করে ভারী রোদ মুখে এসে পড়ল তখনই তার ঘুম ভাঙল। এক কাঁধ ব্যথা হয়ে গিয়েছে। ঘুম ভাঙতেই স্মৃতি ভুলে ডাক দিয়ে বসে অভ্যাসবশত বাবাকে। সেই ডাক চারপাশে ধাক্কা খেয়ে তারই কাছে আবার ফিরে ফিরে আসে। তখন তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়। তীব্র শূন্যতায় খা খা করে ওঠে জীবনটা। এ জীবনটাকে মনে হয় হৈমন্তের ধান উঠিয়ে ফেলার পর ফাঁকা জমিনটার মতন। কোথাও কিচ্ছুটি নেই। কেবল আধখষা কিছু স্মৃতি পড়ে আছে জীবনের আনাচে-কানাচেতে।

করবী অভিমান বুকে পুষে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দায় ঝিমুনি কাটতে থাকা বাণীর কাছে যায়। কেউ নেই জীবনটায় অবহেলার কাকতাড়ুয়া হয়ে বসে থাকা বাণীটির প্রতিও তার অভিমান জন্মে। সবচেয়ে বুঝদার করবী বাচ্চা হয়ে যায় যেন! বলে,
‘কিরে, আব্বু নেই বলে আজ ডাকলি না আমায়!’

বাণীর ঝিমুনি অব্যাহত থাকে। ফিরে তাকায় না করবীর দিকে। এতে করবীর ভুলভাল অভিমানটি গাঢ় হয়। ধমকে ওঠে সে,
‘কথা বলছিস না কেন? নাকি আব্বু বুলি শিখিয়েছে বলে তার অভাবে বুলিও ভুলে গিয়েছিস?’

বাণী এবার অলস ভঙ্গিতে নড়েচড়ে। তবুও কথা বলে না। করবী উদাস হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর কী যেন ভেবে খাঁচাটা খুলে দেয়। অভিমানী কণ্ঠে বলে, ‘কথা-ই যদি না বলিস তবে উড়ে যা। বোবা সঙ্গী হয়ে থাকার কী দরকার!’

এবং করবীকে অবাক করে দিয়ে বাণী সত্যি খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এবং এক, দুই, তিন সেকেন্ডের মাথায় ডানা ঝাপটে বারান্দার রেলিং গলিয়ে বের হয়ে গেল বারান্দার বাহিরে বিরাট আকাশটার নিচে। করবী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কেবল তাকিয়ে রইল। ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
‘শেষমেশ তোরও কি-না আমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হলো?’

কথা জানা চঞ্চল বাণী বোবা ভাষাতেই বোধহয় সম্মতি জানাল। তারপর মিনিট খানিক তাকিয়ে থেকেই উড়ে গেল তার পরিচিত ছোট্টো বারান্দাটা ছেড়ে বিশাল অপরিচিত আকাশটাতে। ফিরেও তাকাল না একটি বার। যেন সকল পিছুটান ছিন্ন করে ফেলেছে সে বাবা মারা যাওয়ার সাথে সাথেই। করবীর চঞ্চল চোখ দু’টো বেয়ে বেয়ে নীরব অশ্রুরা ঝরে পড়ল অনবরত। বাণীর এহেন আচরণ তার ভেতরটা যেন চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। তবে কী পাখিরাও মায়া কাটাতে শিখে গেছে মানুষের সান্নিধ্যে থেকে? যেমন করে আব্বু মায়া কাটিয়েছে! কাটিয়েছে আম্মুও….

বিন্দুর আজ মনে বসছে না কাজে। প্রতিদিনের মেশিনের শব্দটি আজ বিরক্তির ঠেকছে। আপাটাকে ছেড়ে আসতে মন চায়নি তবুও বাস্তবতার টানে তাকে আসতেই হয়েছে। ঘরে ছোট্টো একটি বাচ্চা, বৃদ্ধ একজন মানুষও আছেন। রোজগার না করলে মানুষ গুলো কী খাবে? রক্তের সম্পর্কের চিন্তা করতে গিয়ে আত্মার সম্পর্ককে যে একটু পিছনে ফেলতেই হয়! আমাদের জীবনটাই যে এমন। অদ্ভুত, নাটকীয়।

কাজে দু’বার ভুল করে ফেলেছে সে। ম্যানেজার এসে শাসিয়ে গিয়েছেন কড়া ভাবে। তবুও তৃতীয় বারের মতন ভুলটা করে বসল। সেলাই করে ফেলল উল্টো পিঠে। এবার ম্যানেজার রেগে অগ্নিশর্মা। গার্মেন্টসের একটি অদ্ভুত খারাপ নিয়ম আছে। ম্যানেজাররা কর্মীদের খুব বেশিই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। এবং মেয়ে কর্মীদের তো গালি দেওয়ার সময় কোনো রাখঢাকই রাখেন না। বিন্দুর বেলাতেও তা-ই হলো। তৃতীয় বার ভুল করতেই ম্যানেজার রেগে গেলেন। বিন্দুর বসে থাকা চেয়ারের পায়া’তে মৃদু লাথি মারলেন,
‘তোদের কাজে মন থাকলে আসিস কেনরে এখানে? তিন তিনটা মাল নষ্ট করলি। মন যদি না বসে তাহলে কাজ থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।’

বিন্দু কেঁপে উঠল লাথিতে। ভীত কণ্ঠে ক্ষমা চাইল,
‘বুঝি নাই স্যার। এই বারের মতন মাফ করেন।’
‘হ, আমি তো দান শালা খুলছি। তোরা ভুল করবি আর আমরা মাফ করবো। টাকা কী বলদের *** দিয়ে আসে?’

ম্যানেজারের ভাষা খারাপ। রাগলে আরও বিশ্রী রকমের খারাপ হয়ে যায়। বিন্দু অভ্যস্ত। তাই মাথা নত করে বিনীত স্বরে বলল, ‘আর হইবো না, স্যার। সত্যি কইলাম।’

‘তিনডা মালের ক্ষতি হইলো। এই ক্ষতির টেকা কে দিবো? তোর বাপ?’

বিন্দু উত্তর দিল না আর। কথা বললেই কথা বাড়বে এরচেয়ে সে চুপ থাকলে ম্যানেজার নিজেই চুপ হয়ে যাবে। হলোও তা-ই। কিছুক্ষণ হুমকি-ধমকি দিয়ে ম্যানেজার চুপ করলেন। যেতে-যেতে চাকরি খাওয়ার হুমকিও দিয়ে গেলেন। বিন্দুর গালি-গালাজ শুনে অভ্যাস আছে তবুও খারাপ তো লাগেই। কী ভাগ্য ছিল আর কোথায়ই না এসে পড়ল! সবই ভাগ্যের খেলা। ফুঁস করে হতাশার শ্বাস ছুটে এলো অন্তর থেকে। এত ক্লান্ত লাগে এ জীবন! আঠারো বছরের এ জীবনে আঠারো যুগের দুঃখ চেপে বেঁচে থাকাটা সত্যি কষ্টসাধ্য। তবুও বাঁচতে হয়। এত সুন্দর জীবনের মায়া যে কেউ-ই কাটাতে পারে না।

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৭ এর বাকি অংশ
কলমে: মম সাহা
দ্বিপ্রহর শুরু হয়েছে উত্তপ্ত রোদ্দুর অম্বরে নিয়ে। ঘরে বসে অবশ্য সেই রোদ্দুরের প্রখরতা বোঝার উপায় নেই। তার উপর এসি অন। বাহিরে গাঢ় রোদ হলেও ঘরের ভেতরটা শীতল, ঠান্ডা। ঘুড়ি বারান্দায় বসে আছে। গিটারটা হাতে। আজ খুব গিটার বাজাতে ইচ্ছে করছে। বহুদিন পর, কণ্ঠ আজ গাইতে চাচ্ছে। গাইতে চাওয়ার অবশ্য আরও একটি ভিন্ন কারণ আছে। আজ তার মন খারাপ। মন খারাপ হলে তার বরাবরই গাইতে ইচ্ছে হতো। আজও ব্যতিক্রম নয়। বহুদিন পর গিটারে টুং করে সুর তুলল। জুড়িয়ে গেল অন্তরটা। সুর আবার তুলল। এবার ভাঙা সুর না। গলা উঁচুতে ওঠল,
‘বাহির বলে দূরে থাকুক,
ভেতর বলে আসুক না।
ভেতর বলে দূরে থাকুক,
বাহির বলে আসুক না….’

কী করুণ স্বর! কী আকুতি! মনে হচ্ছে হৃদয় থেকে আহ্বান করছে কাউকে খুব কাছে আসার। তার পাশে বসার। দুঃখ মোছার এই আকুতি।
গাইতে গাইতে পুরোটুকু গান মন্ত্রমুগ্ধের মতন শেষ হলো। একবারও ছন্দপতন হয়নি। একবারও থেমে যায়নি কণ্ঠ।

‘সুন্দর হয়েছে তো! ভালো গান জানো তো!’
স্পষ্ট পুরুষালী কণ্ঠ পেতেই ঘুড়ির চোখ খুলে গেলে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সেদিকে। তিমির দাঁড়িয়ে আছে। কালো টি-শার্ট পরনে। গোসল সেরে এসেছে বোধহয়। ফ্রেশ দেখাচ্ছে।

ঘুড়ি চমকাল। তিমির নিজে থেকে কখনো কথা বলে না। প্রশংসা তো করে না বললেই চলে। হঠাৎ আজ লোকটার প্রশংসা অমাবস্যার চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন মনে হলো। অবিশ্বাস্যকর।

‘গান শিখেছিলে বুঝি?’
উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে তিমির উত্তরের আশায়। ঘুড়ি গিটার পাশে রেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, ‘হ্যাঁ।’

‘দারুণ কণ্ঠ তোমার।’

ঘুড়ির কাছে পুরো ব্যাপারটাই ভ্রম মনে হলো। তিমিরই বহু আগে একদিন তার গান শুনে বলেছিল বিরক্ত লাগছে। অথচ এই মানুষটাই আজ তার গানের প্রশংসা করছে! কী বিষ্ময়কর কান্ড! ঘুড়ির মন ভালো হয়ে গেল আচমকা। এত সুন্দর প্রশংসার পর বোধহয় কারোই মন খারাপ থাকতে পারে না।

তন্মধ্যেই ঘর থেকে তিমিরের ডাক ভেসে আসতেই সে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। ঘুড়ি দাঁড়িয়ে রইল মন ভালো করা এই সময়টুকু নিয়ে। হুট করে চারপাশটা এত সুন্দর লাগছে!

তাসনীম বেগম বসে আছে সোফায়। চোখ-মুখ বেজায় কঠিন। গুরু-গম্ভীর। তার সামনের সোফাতে বসে আছে বিদিশার বাবা-মা। তারাও চিন্তিত। তিমির ড্রয়িং রুমে এসে বিদিশার বাবা-মা’কে দেখে কিছুটা চমকালো বটে তবে প্রকাশ করল না। বিদিশা ড্রয়িং রুমের এক কোণায় দাঁড়ানো। শক্ত-পোক্ত মুখের আদল। আরেক পাশে ছোটো টুলটাতে বসা তুষার। তিমির বিনয়ী ভঙ্গিতে সালাম করল বিদিশার বাবা-মা’কে। এরপর ভিন্ন একটি সোফাতে গিয়েই বসল। তিমির বসতেই বিদিশার বাবা জামাল ভূঁইয়া প্রথম কথা বললেন,
‘আমাদের মেয়ে জামাই এলো অথচ আমাদের এতদিনে খবর দেওয়া হলো, আপা?’

প্রশ্নটি তিনি তাসনীম বেগমের উদ্দেশ্যেই করলেন। তাসনীম বেগম একবার চোখ ঘুরিয়ে বড়ো ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি ঝামেলা করতে চাননি। সবটা ধীরেসুস্থে মিটমাট করতেই চেয়ে ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বিদিশার ব্যবহার এত অসভ্য হচ্ছে যে তিনি আর বিদিশার বাবা-মা’কে না ডেকে পারলেন না।

মা’কে চুপ থাকতে দেখে তুষার বলল, ‘কাউকেই তো তেমন জানানো হয়নি।’

‘আমরা তো জানার অধিকার রাখি না-কি?’

ভদ্রলোকের প্রশ্নে এবার তিমির অপরাধী স্বরে বলল, ‘আসলেই ভুল হয়েছে আমাদের। ভাইয়া হুট করেই আসছে। সেজন্যই বোধহয় আজ আপনাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।’

তিমিরের কথাটা তুমুল তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিল বিদিশা, ‘দাওয়াত! হাহ্! আমার বাবা-মায়ের তেমন ভাগ্য আছে না-কি?’

বিদিশার রূঢ়ভাষী উত্তরে তিমির ভ্রু কুঁচকালো। অবাক হলো তার বাবা-মাও। তিমির হুট করেই বুঝতে পারল ঘরে কোনো গন্ডগোল হয়েছে যা সম্পর্কে সে অবগত নয়। নাহয় ভাবির কথা বলার ধরণ এমন হতো না। এত বছরে তো হয়নি!

জামাল ভূঁইয়া মেয়ের দিকে তাকালে, কিছুটা চাপা ধমক দিয়ে বললেন, ‘কীভাবে কথা বলছো তুমি!’

তাসনীম বেগম যেন এই মোক্ষম সুযোগটিরই অপেক্ষা করছিলেন। মুহূর্তেই তিনি জবাব দিলেন,
‘আপনাদের মেয়ে এখন এভাবেই কথা বলে। এবং সেজন্যই আপনাদের এখানে আনানো হয়েছে।’

কথাটি যেন বিস্ফোরণ ঘটালো ড্রয়িং রুমের মাঝে। তুষারও অবশ্য অবগত ছিল না মায়ের এমন কান্ড সম্পর্কে। তবে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে রইল বিদিশা। বিদিশার মা লিপি ভূঁইয়া চট করে সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালেন। তিনি বোধহয় সবটুকুই আঁচ করতে পেরেছেন এতক্ষণে। নারী মন, বড়োই তীক্ষ্ণ। এরা পরিস্থিতি দেখলেই ঘটনা বুঝার সক্ষমতা রাখে। তিনি মেয়ের কাছে গেলেন ভারী রুষ্ট চোখে তাকালেন। বললেন,
‘কী করেছিস, বিদু?’

‘আমি তো তোমাদের ডাকিনি। যে বা যিনি বা যারা ডেকেছে তাদের জিজ্ঞেস করো।’

বেপরোয়া এই মেয়েটিকে বাবা-মায়ের কাছে বড়ো অপরিচিত ঠেকল। মায়ের মন তো ভীত হলো অনেক। মেয়ের সংসার ভাঙার আভাসে কেঁপে উঠল অন্তর। তাই তিনি ধমকালেন,
‘সাবধানে কথা বল। কোথায় কী বলতে হয় জানিস না?’

বিদিশার ভেতর ধমকের কোনো প্রভাব দেখা গেল না। পরিস্থিতি বিপরীতে চলে যাচ্ছিল বিধায় তিমির ওঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলাকে টেনে এনে বসাল সোফায়, স্থির স্বরে বলল,
‘ঠান্ডা হন, আন্টি। ভাবি হয়তো ডিস্টার্বড্।’

ভদ্রমহিলার মন ঠান্ডা হলো না বরং চঞ্চল হয়ে গেল ভীষণ। জামাল ভূঁইয়া নিজের স্ত্রীকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন ঠান্ডা হওয়ার জন্য অতঃপর নিজেই তাসনীম বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে যদি খুলে বলতেন।’

‘কী হয়েছে চোখের সামনেই তো দেখতে পারছেন। আপনাদের মেয়ে আমাদের সাথে এমন অসভ্য আচরণই করে যাচ্ছে। এমন হলে তো…’

বাকি কথা শেষ করলেন না তিনি। অবশ্য শেষ করার প্রয়োজনও নেই কারণ সকলেই কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে গিয়েছে অনায়াসে।
তিমিরের কাছে সবটাই অস্বচ্ছ এবং নতুন। সে মায়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাল,
‘কী বলছেন এসব?’

‘যা বলছি সবটাই সঠিক। তুমি তো বাড়ি থাকোনি বেশি সময় তাই জানো না ইদানীং ও কী কী করেছে। কোনো বেয়াদবি বাদ রাখেনি।’

‘মুখ সামলে কথা বলুন। ভাবি সম্পর্কে বাজে কিছু বললেন না।’ রীতিমতো রেগে গিয়েছে তিমির। ঘটনা বিগড়ে যাচ্ছে কথার পৃষ্ঠে কথা উঠে। বিদিশা উদাস নয়নে তাকাল। তিমিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ভুল কিছু বলেননি তোমার মা।’

‘হ্যাঁ তুমিই বলো তুমি কী করেছ। আমার ছেলেরা তো আর আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করে না।’ তাসনীম বেগমের কণ্ঠে অভিযোগের ছাপ। তিমির রাগে ফুঁসছে,
‘তার জন্য আপনিই দায়ী। কখনো নিজের ভুলটা মানতে শিখলেন না। সবসময় এর ওর ঘাড়েই দিয়ে গেলেন।’

কথার সূচনা এক হলেও তা গুরুতর ঝামেলার দিকে মোড় নিচ্ছিল। তাই বিদিশাই কথা থামানোর জন্য বলল,
‘ভাইয়া, তুমি কিচ্ছু বলো না। আমিও চেয়ে ছিলাম বাবা-মা আসুক। অনেক তো হলো এখানে সংসার করা, আর সাধ নেই। আমি ফিরে যেতে চাই।’

দ্বিতীয় বোমাটা যেন ফাটল এবার। তাসনীম বেগমকে অব্দি সেই ভয়ংকর বাতাস ছুঁয়ে গেল। তিনি ভেবে ছিলেন মেয়েটার বাবা-মাকে আনলে তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে গেলে মেয়েটা আবার হয়তো আগের মতন হয়ে যাবে। অথচ তেমন কোনো আশঙ্কাই নেই। এই বিদিশা আর আগের মতন হওয়ার নয়।

বিদিশার মা রেগে গেলেন, ‘ফাজলামো হচ্ছে এখানে? কী বলছিস, বিদু? সংসার কোনো ছেলেখেলা নয়।’

‘আচ্ছা! তাই নাকি? অথচ আমার তো মনে হলো সংসারের নাম দিয়ে এত বছর আমাকে দিয়ে ছেলেখেলাই করানো হলো। তখন তোমার কথা কই ছিলো, মা?’

জামাল ভূঁইয়া বুদ্ধিমান মানুষ। মেয়ের কথা বুঝতে তার সময় লাগল না। তিনি এবার নরম স্বরে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘তুমি কী চাচ্ছ, মা?’

বিদিশার কঠিন চোখ-মুখ বাবার কথায় নরম হয়ে এলো। যাক অবশেষে কেউ অন্তত জানতে চাইল তার কী চাই! নয়তো এ সংসারে যেমন মূল্যহীন হয়েছিল, কেউ তো মানুষই মনে করতো না। ভাবত খেলার পুতুল।

বিদিশা বাবার কাছে গেল। পাশে গিয়ে বসল। বাবার বুকে মাথা দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
‘আমি একটা শক্ত বুক চাই, বাবা। যেখানে আমি থেকে যেত পারব অনায়াসে। আর এ পৃথিবীতে সেই বুক তোমার ছাড়া আর কারো নেই। এই সংসারে এতগুলো বছর যাবত আমি ছিলাম। এ ঘরের প্রতিটা আনাচে-কানাচে আমি স্বপ্ন পুষে ছিলাম। বিয়ের পরের দিন যে মেয়েটার স্বামী সংসার ছেড়ে চলে যায় সে মেয়েটার এত গুলো দিন এ সংসারে থাকার কথা নয়। তবুও আমি থেকে গিয়ে ছিলাম কোন লোভে কে জানে! বহু সাধ্যসাধনা করেছি এ সংসারকে আপন করতে কিন্তু আমি ব্যর্থ, বাবা। আর যে পারছি না। এই সংসার আমার আপন নয়, বাবা। আমার দম বন্ধ লাগে। আমায় তুমি নিয়ে যাও। আমি আর পারছি না।’

তুষার এতক্ষণ নীরব দর্শক ছিল। এখনও তাই। তবে মনের কোথাও একটা অপরাধবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু তার মস্তিষ্ক সেই অপরাধবোধ মানতে প্রস্তুত নয়।
বিদিশার মা হয়তো কিছু বলতেন কিন্তু তার আগে জামাল ভূঁইয়া তাকে থামিয়ে দিলেন। গমগমে গলায় বললেন,
‘নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে আনো, মা। তোমার আজ ছুটি। আমারই ভুল ছিল। যে ছেলে এমন একটা বিবেকহীন কাজ করতে পারে সে ছেলের ভরসায় তোমাকে রেখে যাওয়া উচিত হয়নি।’

কথাটা ভীষণ মানে লাগল তুষারের। সে সশব্দে টুল ঠেলে ওঠে গিয়ে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। তা দেখে জামাল ভূঁইয়া তাসনীম বেগমকে খোঁচা মেরে বললেন, ‘আমার মেয়েকে অসভ্য বলার আগে নিজের ঘর ঠিক করা উচিত ছিল আপনার, আপা। বড়োই দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আপনাদের রক্তে স্বার্থপরতা বেশি। আমার মেয়েকে আমার চেয়ে ভালো যে কেউ চেনে না!’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে