বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২৪+২৫

0
289

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৪

কলমে: মম সাহা

আজ দিনটি ভালো নয়। অন্তরিক্ষে নীরদ মুখ ভার করে বসে আছে ছোট্টো কিশোরের ন্যায়। মনে হচ্ছে মায়ের বকুনি খেয়েছে সে। এক্ষুণি কেঁদে দিবে। মানুষ তখন সেই কান্নার নাম দিবে বৃষ্টি। বিদিশা খাটের এক কোণায় বসে মন ভার থাকা আকাশকে দেখছে। মৃদুমন্দ পবনে ইচ্ছেমতন উড়ছে বাতায়নের কোল ঘেঁষে থাকা জানালার পর্দা গুলো। বিদিশার চোখে নিগড় শূন্যতা। ড্রয়িং রুম থেকে চামচ নাড়ার টুংটাং শব্দ হচ্ছে। হয়তো দুপুরের খাবার তৈরী হয়ে গিয়েছে।
ভাবতে ভাবতেই তাকে ডাকতে এলো কাজের মহিলাটা, ‘বউমা, খাইতে আসেন।’
বিদিশা ধ্যান দিল না সে ডাকে। তার ধ্যান যেন কোনো এক অরণ্যে কিংবা নিবিড় সমুদ্রে। এই জনজীবন থেকে বহুদূরে। ধরাছোঁয়ার বাহিরে।
মহিলাটি আবার ডাকল, ‘খাইতে আহেন, আম্মা। সকালেও খান নাই।’
এবার বিদিশার শ্রবণেদ্রিয়ের পাশাপাশি মস্তিষ্কও সজাগ হলো তবে নড়চড় দেখা গেল না দেহের ভেতর। আগের মতনই দুই হাঁটুর উপর হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশে। কেবল প্রাণহীন কণ্ঠে বলল, ‘খাবো না।’
মহিলাটি আর ডাকল না। তার বড়ো মায়া হলো এই মেয়েটির জন্য। বহু বছর যাবত এ বাড়িতে কাজ করার সুবাদে এই পরিবারটির সকল পরিস্থিতি সম্পর্কে সে অবগত। সে দেখেছিল, সদ্য বিবাহিত চঞ্চল মেয়েটি সংসারের দায়িত্ব কেমন কোমল হাতে গুছিয়ে নিয়ে ছিল। স্বামীর প্রত্যাহারের ব্যথা ভুলে সংসারটিকে আগলে নিয়েছিল চড়ুইয়ের বাসার মতন। অপেক্ষা কতটুকু সময়ের জন্য তার নির্দিষ্টতা না জেনেই দিনের পর দিন কেবল অপেক্ষা করে গেছে। অথচ সেই মেয়েটির ভাগ্যেই কি-না শেষবেলা কিছুই মিলল না? অপেক্ষার ফল সবসময় মিষ্টি হয় না তার উজ্জ্বল প্রমাণ যেন সে!
রাবেয়া খাতুনের বুক থেকে পরপর বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। তিনি গিয়ে আক্ষেপের সাথে তাসনীম বেগমকে জানান বিদিশার না সূচক উত্তরটির কথা। বিদিশার না-তে বাড়ির সামান্য গৃহ ভৃত্যের মায়া লাগলেও মায়া হলো না তাসনীম বেগমের। বরং সে ফুঁসে ওঠলেন। গলার স্বর ইচ্ছেকৃত উঁচুতে তুলেই বললেন,
‘খাবে না কেন? এখন কী এ বাড়ির খাবারও রুচিতে নিচ্ছে না? এতদিন তো ঠিক নিয়েছিল।’

বিদিশা ঘর থেকে ঠিক শুনতে পেল তবে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনটুকু বোধ করল না। এতে তাসনীম বেগম অসন্তোষ হলেন। এবার হনহন করে তিনিই গেলেন বিদিশার রুমে। বরাবরের মতন রুমে প্রবেশ করার অনুমতিটুকুও আজ আর নিলেন না। রুমে ঢুকেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘বৈরাগী ভাব ধরেছ নাকি? তোমার কাহিনি তো কিছুই বুজছি না।’
প্রশ্ন এলো একের পর এক। উত্তর দেওয়ার মানুষটি রইল নির্লিপ্ত। তাসনীম বেগম এগিয়ে গেলেন আরও দু’কদম। বিদিশার ভাব-গতিক কিছুই তার স্বাভাবিক লাগছে না। মেয়েটা এতটা উদ্ভ্রান্ত হলো কেন? এবার একটু নরম হলেন তিনি,
‘তোমার ঠিক সমস্যাটা কী বলবে আমাকে?’
বিদিশা এবার জবাব দিল না ফিরেই, ‘আমার সমস্যা নেই।’
‘তাহলে এমন করছ কেন?’
‘কেমন করছি?’ প্রশ্ন করেই তাকাল সে শাশুড়ির দিকে। চোখে চোখ রেখে জবাব চাইল। দৃঢ় সেই দৃষ্টির ভাষা।
তাসনীম বেগম চোখ ঘুরিয়ে ফেললেন। বললেন, ‘আমার ছেলে আসাতে তুমি খুশি হওনি মনে হচ্ছে। তুমি কী চাওনি ও আসুক?’
‘আপনার ছেলের সাথে আমার খুশি কিংবা কষ্টের কোনো যোগসূত্র আদৌ নেই।’
‘নেই!’ তাসনীম বেগম কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যে মেয়ে স্বামীর সান্নিধ্য না পেয়েও দিনের পর দিন অপেক্ষা করে গিয়েছে স্বামীর ফিরে আসার সে মেয়ে কিনা বলছে যোগসূত্র নেই?

‘না, নেই।’
তাসনীম বেগমের আর ধৈর্য হলো না বিদিশার খামখেয়ালি মেজাজ মেনে নেওয়ার। তাই তার কণ্ঠ এবার কাঠ কাঠ হলো,
‘না থাকলে চলে যাচ্ছ না কেন?’
বিদিশার দৃষ্টি এবার কাঁপল। খুব ক্ষীণ। হৃদপিণ্ড কেঁপেছে কিন্তু সেটা ক্ষীণ নয় অস্বাভাবিক ভাবে দ্রুত। চলে যাওয়ার হলে সে তো বহু আগেই যেত। সে তো যায়নি। বিনা যত্নে, বিনা প্রেমেও তো সে থেকে গেছে কতগুলো দিন। অথচ আজ কী সুন্দর সাবলীল ভাবে তাকে চলে যাওয়ার নিমন্ত্রণ ছুঁড়ল মানুষটা!
‘যাব। তবে এভাবে নয়।’
‘কীভাবে? কীভাবে যাবে? তোমার এই অশান্তি আর ভালো লাগছে না। আমার ছেলেটা এত বছর পর বিদেশ থেকে এলো, আমি শান্তি চাচ্ছি। তুমি পরের বাড়ির মেয়ে, পরের বাড়িতেই যাও।’
‘তাই যাব, মা। যতই হোক, পর কখনো আপন হয় না।’ তার শেষ বাক্যে কঠোর শ্লেষের আভাস। তাসনীম বেগম কথা বাড়ানোর সুযোগ পেলেন না আর। তার আগেই বিদিশা আগের মতন আকাশ দেখা আরম্ভ করে দিল। পরোক্ষভাবে যেন তাসনীম বেগমকে ঘর ছাড়ার আহ্বান করল। তাসনীম বেগমও তা বুঝলেন। চালাক মানুষ কি-না! সবই বুঝেন। কেবল এতটুকুই বুঝলেন না, যতটুকু বুঝলে পরের বাড়ির মেয়েরও যে মন থাকে সেটা জানতে পারতেন।

(৩৫)

হসপিটালের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে করবী। আশেপাশে কেউ নেই তার। মাথা ঝিমঝিম করছে। গতকাল থেকে এ অব্দি তিমির তার পাশে থাকলেও এখন জরুরী কাজে বেরিয়েছে। যেতেই হবে বলেই গিয়েছে। নয়তো সে যেত না এতটুকু করবী জানে। তার ভীষণ একা লাগছে। এই বিপদের দিনে বিন্দু, হীরণকে কাছে পেলে ভালো লাগতো। কিন্তু কিছু করার নেই। তার ফোনটা গতকাল হাত থেকে পরে যে টুকরো-টুকরো হয়েছিল সেটা আর ঠিক করা হয়নি। সেটা ঘরের মেঝেতেই তেমন ভাবে পড়ে আছে হয়তো! বিন্দুর নাম্বারটা জানা আছে। একবার কল দিয়েছিল তিমিরের ফোন থেকে সকালে কিন্তু যায়নি কলটা। তাই আর দেয়ওনি। মেয়েটা তো সবে সকল দুঃখ কাটিয়ে ওঠেছে, থাক, আর দুঃখে নাহয় সামিল না করল!
করবীর ভাবনার জাল ছিঁড়ল ডাক্তারের কথায়, ‘পেশেন্ট তো আপনার বাবা হন, তাই না?’

করবী প্রথম দফায় চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত। মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ। এখন কেমন আছে, আব্বু?’
মধ্যবয়সী পুরুষ ডাক্তারটি করবীর প্রশ্নে ভ্রু কুঞ্চিত করলেন কিঞ্চিৎ। বললেন,
‘আপনার বাবার কন্ডিশন তো গতকাল রাতেই বলে দিলাম। জানেন না আপনি?’
করবী এবার অবাক হলো। কখন বলল কন্ডিশন! তবে কী সে যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন বলেছে? কই, তিমির তো কিছু বলল না! করবীর কণ্ঠে স্বর আসে না। ভয়ঙ্কর কিছুর আভাস পেয়েই কলিজা থমকায়। তবুও সে শুধায়,
‘আমাকে তো বলেনি উনি, হয়তো মনে নেই। আপনি একটু বলুন। আব্বুর শরীর কী বেশি খারাপ?’

‘আপনার আব্বুর হাতে সময় নেই আর। তার এই শ্বাসকষ্টটি আসলে রোগ নয়, এটি তার শেষ মুহূর্তের অবস্থান।’
করবীর পা কেঁপে ওঠে। ধাক্কা খায় যেন প্রচণ্ড বেগে। মাথা চেপে ধরে দু’হাতে। কী ভীষণ যন্ত্রণায় যেন মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এত ভারি লাগছে!
ডাক্তারটির চোখে এবার উদ্বিগ্ন দেখা দিল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? এনি প্রব্লেম?’
করবীর শরীর ঠিক নেই। প্রচণ্ড রকমের ঘাম দেয় শরীরে। তবুও সে ঠিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে বেঠিক হলে জীবন চলবে কীভাবে? তার জীবন চালানোর মতন কেউ যে অবশিষ্ট নেই পৃথিবীর বুকে। আব্বু গেলেই নেইটা একবার পরিপূর্ণ হবে।

কিছুটা সময় নিয়ে স্থির করে নিজেকে। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে,
‘আব্বুর সময় শেষ তাই না?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু একটা অবাককর ঘটনা হলো কোনো মৃত্যুশয্যার রোগী এরকম শ্বাস ওঠার পর বেশিক্ষণ আর থাকেন না। অথচ আপনার আব্বুর রুহ এখনো আছে। আমার মনে হচ্ছে তার কোনো আকাঙ্খা এখনো সজাগ মস্তিষ্কে। তাই সেই আশাটুকু পূরণের জন্য এখনো শ্বাস ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। রোগীর মস্তিষ্কে হয়তো বহুদিন যাবত এই ইচ্ছেটা পুষে রাখা। তাই তিনি এতটা যন্ত্রণা সহ্য করেও শ্বাস নিচ্ছেন।’

করবীর কাছে এই প্রতিটা কথাই নতুন। সে ভাবতে আরম্ভ করল আব্বুর কোন ইচ্ছেটা বহুবছর যাবত পুষে রাখা? তেমন কোনো ইচ্ছের কথাতো সে জানে না। আব্বু কখনো বলেওনি। এমন কী ইচ্ছে হতে পারে যার জন্য মানুষটা বেঁচে থাকার এমন আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে!
ডাক্তার চলে যেতেই করবী ধীর পায়ে কেবিনে যায়। শান্ত, নিবিড় আবছা অন্ধকার কক্ষটি দেখেই করবীর লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। মনে হয় মৃত্যু দূত এসে দাঁড়িয়ে আছে এই রুমটিতে। যেই কোনো মুহূর্তেই আব্বুর প্রাণপাখিটি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে সেই দূতটি। করবীর একমাত্র সম্বলটুকু নিয়ে এই দূত চলে যাবে বহুদূর। পৃথিবীর বুকে এরপর বেঁচে থাকার গল্পে সে হবে নিঃস্ব সৈনিক। কেউ প্রতিনিয়ত আর উৎসাহ দেওয়ার জন্য থাকবে না। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে কেউ আর রান্না করে খাবার সাজিয়ে বসে থাকবে না। কেউ আর মেয়ের টাকা বাঁচাতে অমুক তমুক চাচার গল্প বানিয়ে বলবে না!
বুকের বা’পাশে থাকা অদৃশ্য হৃদপিণ্ডটি ডুকরে ওঠল। করবী খুব করে দোয়া চাইল, আব্বুর সাথে সাথে যেন থেমে যায় তার এই হৃদপিণ্ডটি। কী আর হবে বেঁচে থেকে। তার বেঁচে থাকাটুকু জুড়ে যে মানুষটি ছিল, সে মানুষটি না থাকলে বেঁচে থেকে আর কী লাভ? করবী জানে অনেক চাওয়ার মতন তার এই চাওয়াটাও অপূর্ণ থেকে যাবে।

বেডের সাথে থাকা চেয়ারটায় বসল সে। চোখে টলমলে অশ্রু। বাবার হাতটা আলগোছে তুলে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। কণ্ঠ চেপে ধরে আছে যেন কোন অশরীরী। কথা আসছে না। তবুও জোর করে কথা বলল। শেষ কথা গুলো বলা হোক। নাহয় তো জীবন খাতায় আরও আফসোস বাড়বে।
‘আব্বু, শুনছ…’
ডাকল বাবাকে সে। কণ্ঠ কাঁপছে। বাবা উত্তর দিল না। কিন্তু করবীর মনে হলো বাবা শুনছেন। সেই আশ্বাস থেকে সে আবার কথা বলল,
‘এই যে তুমি আমারে রেখে চলে যাচ্ছ তোমার কষ্ট হচ্ছে না, আব্বু?’
দ্বিতীয় প্রশ্নেরও উত্তর এলো না। করবী উত্তরের আশাটুকুও করে না। ঢোক গিলে কথা বলার শক্তি সঞ্চয় করে। ভাঙা কণ্ঠে বলে,
‘এই যে আব্বু, তুমি যে এত করে বললে ভালো চাকরি পেতে, ভালো চাকরি পেলে আমাদের ঘর সাজাবে, সে প্রতিশ্রুতি রাখবে না? তোমার মেয়ে চাকরি পাবে অথচ তা দেখার জন্য তুমি থাকবে না, তাই না? আচ্ছা আব্বু, তুমি যে চলে যাচ্ছ, আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর একমাত্র মানুষটা যে চলে যাচ্ছে, এরপর পৃথিবী আর আমার জন্মদিন মনে রাখবে বলো? আমাকেই বা মনে রাখার মতন পৃথিবীতে কেউ কেন আর থাকবে, আব্বু? এমন বৃথা জনমে তোমার মতন আব্বু পেয়ে ছিলাম কতই না সৌভাগ্য আমার। তাই না বলো? আচ্ছা আব্বু, এখন মন খারাপ হলে আমার মুখ দেখে আমার দুঃখ বুঝবে কে বলো তো? রাতের বেলা অন্ধকার বারান্দায় যখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকব তখন কে এসে আমার খোলা বইটা বন্ধ করবে? কে এসে মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে বসে থাকবে আমার পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা? খারাপ স্বপ্ন দেখে যখন ঘুমের মাঝে কপাল কুঁচকে আৎকে ওঠব তখন কে মাথায় ভরসা দিয়ে আমার ঘুমন্ত মস্তিষ্ককে ভরসা দিয়ে বলবে, চিন্তা করতে না? আমার মুখ দেখে দুঃখ বুঝতে পারা তুমিটা যাওয়ার পর আমার দুঃখ বুঝবে কে, আব্বু? আমার যেই রাতে ঘুম হয় না, সে-ই রাতে তুমি বিহীন আমি কেমন করে থাকব? আব্বু, যে আঙুল ধরে আমি হাঁটতে শিখলাম, জীবনের এই পর্যায়ে এসে সেই আঙুল ছাড়া আমি আদৌ হাঁটতে পারব? আমার না বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি নিজেকে নিঃস্ব লাগছে। জানি তোমারও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোমার আমার এই ছোট্টো দুনিয়ায় মৃত্যু নামক ভয়ঙ্কর শব্দটি না এলে কতই না ভালো হতো তাই না বলো? আব্বু, আমার কষ্ট হচ্ছে গো। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমায় রেখে যেও না, আব্বু। যেও না।’

কথা গুলো বলতে বলতে ভীষণ কান্নায় ভেঙে পড়ল করবী। থামানোর মতন কেউ নেই। কেউ না। এভাবেই পৃথিবীতে একা থেকে যেতে হয় সবাইকে। চিরজীবন কেউ যে কারো ভরসা হয়ে থাকে না।

#চলবে….

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৫
কলমে: মম সাহা

(৩৬)
করবীর চুল ভেজা। বারান্দা ছুঁয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চিকচিক করছে ভেজা চুল। পড়নে হলুদ রঙের একটি থ্রি-পিস। বাণীও আজ চুপচাপ খাঁচায় বসে আছে। হাপুস নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে আছে করবীর দিকে। বিদায়ের বার্তা নাকি অবুঝ প্রাণীরা বুঝতে পারে। হয়তো বাণীও বুজেছে। করবীও বুজেছে। বাবার সবটুকু ইচ্ছে এখন নিঃশেষ। আর হয়তো বাঁচবেন না। করবী জানে। তিমির আছে বাবার কাছে। করবী বাড়িতে এসেছে বহুক্ষণ। এখন যাবে। বাণীকে সাথে নিয়ে যাবে। তার আগে ভাঙা ফোনটা চার্জে দেওয়া হয়েছিল সেটা অন করে বিন্দুদের খবর দিতে হবে।
চারপাশে নিঃশব্দতা আলিঙ্গন করে আছে রাতকে। সেই নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে বাণী কথা বলে ওঠল,
‘সই, সই, সই,
মনের কথা কই….’
করবী হুট করে বাণীর শব্দে চমকে গেল খানিকটা। বুকের মাঝে দুরুদুরু কম্পন। বাণীটা অনেকদিন পর আবার এই কথাটা বলেছে। বাণী যেদিন এই প্রথম কথাটা উচ্চারণ করে সেদিন করবীর জীবনে মীরাক্কেল ঘটে। বাবা সুস্থ হয়ে যান। আজ আবার বাণী এ কথা বলছে যে? বাণী কী মনের কথা আজ বলতে পারবে?
করবীর মনে তুমুল সংশয়। তবুও সে ঘাড় কাঁত করল। বলল, ‘বল।’
বাণী আবার বলল,
‘সই, সই, সই
মনের কথা কই,
এক জীবনে ভালোবেসে
সুখ পাইলাম কই?’

করবীর শরীরে মৃদু কম্পন দেখা দিল। বাণীর বলা কবিতাটা নিশ্চয় বাবার শেখানো কারণ বাণীকে তিনিই কথা শেখান। বাণী মনের কথা বলতে পেরেছে। তবে সেটা বাণীর মনের কথা না, সেটা বাবার মনের কথা যা বাণীর ঠোঁটে উচ্চারিত হয়েছে। করবীর চোখ টলমল করে ওঠল। এতদিনে তবে বাবার মনের কথা সে জানল! তা-ও বাবার বিদায় বেলা! নাকি বাবা সুস্থ হয়ে ওঠবেন? কারণ গতবার তো বাণী কথা বলল যেদিন সেদিন বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেছিল। আজও কী তা-ই হবে?
করবী ছুটে গেল ঘরে৷ ওড়না জড়িয়ে নিল মাথা হতে শরীর অব্দি। কল দিল বিন্দুকে। দু’বার রিং হতেই কল ধরল মেয়েটা। উৎকণ্ঠা মেয়েটির কণ্ঠে,
‘আপা, কই আছিলা তুমি? তোমারে কত গুলান কল দিছি জানো তুমি? তোমাগো বাড়ির সামনে গিয়া হুনলাম তোমরা হাসপাতালে নাকি গেছ। কোন হাসপাতাল, কার কী হইল কিচ্ছু জানিনা। তাও হীরণ ভাই অনেক খুঁজছে। কী হইছে, আপা।’

করবীর কণ্ঠ কাঁপছে। কথা বলতে পারছে না। তবুও অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল, ‘বিন্দু, আব্বু হসপিটালে। তোরা আয়। আমি ঠিকানা ম্যাসেজ করে দিচ্ছি।’

বিন্দুকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কল বিচ্ছিন্ন করল সে। তারপর বাণীর খাঁচাটা নিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাবার কাছে পৌঁছাতে হবে। মনের এক কোণে যে আশার দ্বীপ জ্বলেছে তা যেন সত্যি হয় সে নিয়ে কত বার দোয়াও করল।

ঘুড়ির বাবা অফিস ট্যুরে বাহিরে গিয়েছে। মা গিয়েছে কোনো এক বান্ধবীর বিবাহ বার্ষিকীতে। ঘুড়িকে সেধেছেও। সে যায়নি। অপরিচিত মানুষের সান্নিধ্যে যেতে ঠিক ওর ভালো লাগে না। বাবা-মা নেই বিধায় ঘুড়ি বিদিশাকে নিজেদের ফ্লাটে নিয়ে আসছে।
বিদিশার চোখ-মুখ শুকনো। মনমরা হাবভাব। ঘুড়ি অবশ্য জানে মনমরার কারণ কী। তাসনীম বেগম গতকাল এসে তার মায়ের সাথে দুঃখ করে গেছেন। অনেক কিছুই অপ্রাসঙ্গিক বলেছেন যা ঘুড়ির পছন্দ হয়নি। কারণ সে বিদিশা ভাবিকে চেনে। ভাবি কেমন তার এতটুকু ধারণা এ কয়েক বছরে হয়েছে। তাই তাসনীম বগমের কিছু কথা একদম যুক্তিহীন লেগেছিল।

‘ভাবি, চলো আইসক্রিম খেতে যাবে?’
ঘুড়ির প্রশ্নে উদাস বিদিশার ধ্যান নড়ল। চোখের পলক পড়ল। সে ফিরে তাকাল। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘এখন?’
‘হ্যাঁ। চলো।’
বিদিশা ফুস করে শ্বাস ফেলল। মেয়েটার উচ্ছ্বাসিত মুখমণ্ডলে তাকিয়ে না করতে ইচ্ছে হলো না। তাই ফ্যাকাসে কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা, চলো।’
বিদিশা যে রাজি হয়ে যাবে এক কথায় ঘুড়ি সেটা জানতো। মানুষটা যাকে ভালোবাসে তাকে সবটুকু দিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এত গভীর, আর নিবিড় ভালোবাসা! অথচ কেউ বুঝলে তো!
আসকারা পেতেই ঘুড়ি দ্বিতীয় আবদারটি ছুঁড়ল, ‘চলো এক রঙের শাড়ি পরি।’
বিদিশা আড়চোখে তাকাল। বলল, ‘আমি তো পরেছিই।’
‘না এটা না। আমার কাছে এক রঙের দু’টো শাড়ি আছে। অনলাইন থেকে অর্ডার করেছিলাম। তোমার জন্য আর আমার জন্য। দিইনি তোমাকে। তোমাদের ঘরের অবস্থা একটু গম্ভীর তো, তাই। চলো সেটা পরি।’
ঘুড়ির কথায় ভ্রু দু’টো কিছুটা উপরে তুলল বিদিশা। টানা টানা চোখ দু’টোতে প্রশ্ন,
‘আমার জন্য শাড়ি এনেছ কেন?’
‘ওমা, তোমার কত শাড়ি আমি পরি। তো আমি দু একটা তোমাকে দিবো না? এতটা কিপটে ভেবো না আমাকে।’
‘কিপটে ভাববো কেন? এখন কী তুমি রোজগার করো যে শাড়ি দিচ্ছ? যখন করবে, তখন দিও।’
‘রোজগার না করি, এটা আমার উপহারের টাকা দিয়ে কিনেছি। ভাবি প্লিজ, চলো না।’

মেয়েটার চোখে-মুখে আকুতি মিনতি। বিদিশা এই মায়া মায়া মুখটার আকুতি ফেলতে পারল না। তাই রাজি হলো। সম্মতি দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা। চলো।’

সন্ধ্যা তখন রাতের আড়ালে ঝিমিয়ে এসেছে। ফিনফিনে বাতাস বইছে। জোছনার আলো মিশে আছে আসমান জুড়ে। সুন্দর সেই মোহনীয় রঙ। রাস্তার ধারে এক ধ্যানে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল করছে বিদিশার চোখ-মুখ। কালোপেড়ে কাঁঠালিয়া রঙের একটি শাড়ি পরেছে। ঘুড়িও তাই পরনে। ঘুড়ির বয়স কম। উঠতি বয়স মাত্র। এ বয়সে চেহারার গড়ন অতিমাত্রায় আকর্ষণীয় হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিককে এক হাত টেক্কা দিয়ে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় লাগছে তরুণী বিদিশাকে।

ওরা দু’জন এসে দাঁড়িয়েছে একটি আইসক্রিম স্টলের সামনে। সেখানে সামান্য ভিড় রয়েছে। একটি লেকের কাছে আইসক্রিমের স্টলটি। লেকের শান্ত শীতল বাতাস মনের সুখে উড়ে উড়ে আসছে এখানে। ঘুড়ির কাঁধ সমান চুল গুলো অবাধ্য বাতাসে উড়ছে। বিদিশার চুলে বরাবরের মতন খোপা বাঁধা। দু চারটি চুল কেবল কপাল জুড়ে পড়ে আছে। ঘুড়ি ভিড় ঠেলে গিয়ে আইসক্রিম নিয়ে এলো। সবেই আইসক্রিমে ঠোঁট ডুবিয়েছে দু’জন, তন্মধ্যেই একটি রাশভারী কণ্ঠ পাওয়া গেল,
‘ঘুড়ি, তুমি এখানে যে?’

উষ্ম ঠোঁট দখল করে আছে ঠান্ডা আইসক্রিমটি। সেই অবস্থাতেই চোখ তুলে তাকাল বিদিশা। তাকাতেই থেমে গেল তার মুগ্ধ চোখজোড়া। কালো শার্টের সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে হৃদপিণ্ড আবার প্রথমবারের মতন ছলাৎ করে ওঠল।
ঘুড়িও কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছিল কিন্তু পরিচিত মানুষটিকে দেখেই গাল ভোরে হাসল। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘আরে, তুষার ভাইয়া! তুমি এখানে!’

ঘুড়ির হাসির বিপরীতে হাসল তুষারও। একঝলক বিদিশার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর ঘাড় কাঁত করে বলল,
‘এলাম আরকি। ঘরে বোরিং লাগছিল তাই ভাবলাম এখান থেকে ঘুরে যাই। তুমি কখন এলে?’
ঘুড়ি একবার আড়চোখে বিদিশার দিকে তাকাল। আপাত দৃষ্টিতে বিদিশার মুখ-চোখ দেখে কিছু বুঝার উপায় নেই। সেদিকে তাকিয়েই ও উত্তর দিল,
‘এসেছি এইতো দশ-পনেরো মিনিট হবে। আইসক্রিম খাবে? দাঁড়াও অর্ডার দিই।’
ঘুড়ির প্রস্তাব নাকচ করল তুষার, ‘ না, না, আমি খাই না আইসক্রিম।’
‘আইসক্রিম খাও না? কী বলো! এত মজার একটা জিনিস।’
‘না, তোমরাই খাও। আমার ভালো লাগে না।’
‘ভালো না লাগলেও খেতে হবে। দাঁড়াও আনছি।’ কথা শেষ করে যেই না ঘুড়ি পা বাড়াতে নিবে ঠিক তখনই তার হাত ধরে আটকে দিল বিদিশা। মুখ-চোখ গম্ভীর মেয়েটার। সেই গাম্ভীর্যের রেশ কণ্ঠে ধরেই বলল,
‘যে খাবে না তাকে জোর করছ কেন? দাঁড়াও এখানে। তুমি আর আমি এসেছি এখানে। তৃতীয় কেউ আসেনি। তাই তৃতীয় কাউকে জোর করে রাখবে না।’

বিদিশার শক্ত কণ্ঠে থেমে গেল ঘুড়ি। অস্বস্তি নিয়ে তাকাল তুষারের দিকে। তুষারের কপালে ভাঁজ পড়েছে। সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
‘আপনার টাকাতে ও খাওয়াচ্ছে না। তাহলে আপনি বারণ করছেন কেন?’
বিদিশা তাকাল তুষারের দিকে। অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল,
‘কার টাকায় খাওয়াচ্ছে ব্যাপারটা বড়ো না। ব্যাপারটা হচ্ছে বিপরীত পক্ষের মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর। কারো অনিচ্ছায় কিচ্ছু করা উচিৎ না। হোক সেটা আইসক্রিম খাওয়ানো কিংবা বিয়ে দেওয়া।’

বিদিশার কঠিন জবাবে তাজ্জব বনে গেল তুষার। গোলগোল চোখে অস্বস্তি নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ঘুড়িও। এমন একটা কথার প্রসঙ্গে কার কী বলা উচিত ঠিক বুঝে ওঠতে পারল না কেউ।

_

তৈয়ব হোসেন কখনো মেয়েকে রেখে ভাত খেতেন না। মেয়ে না ঘুমানো অব্দি ঘুমোতেন না। মেয়ে না ফেরা অব্দি দরজার কাছে বসে থাকতেন অপেক্ষায়। দীর্ঘ এক জীবন যেই মানুষটা ছোটো ছোটো ব্যাপারেও নিজের সন্তানের অপেক্ষা করে গেছেন, সেই মানুষটাই শেষবেলায় এসে আর অপেক্ষা করলেন না। বিদায় ক্ষণে মেয়েকে একবার ‘বিদায়’ বললেন না। নিরবে বহুদূরে প্রস্থান নিলেন। মেয়ে আসা অব্দি তিনি রইলেন না।
পুরো হসপিটাল ভয়ঙ্কর আর্তনাদে বিমূর্ত হয়ে গেল। জ্যামের কারণে করবী পৌঁছেছিল সবার শেষে। তার আগে বিন্দু, হুতুম, হীরণ সবাই পৌঁছে গেলেও সে পৌঁছাতে পারেনি। হয়তো ভাগ্য নির্মাতা চাননি বাবার প্রস্থান মেয়েটা চোখ মেলে দেখুক। করবী যখন হসপিটালে এলো তখন বিন্দু হাউমাউ করে কাঁদছিল। হুতুমও হীরণের কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। তিমির কাগজপত্র গুছাচ্ছে লা শ নিয়ে ফিরতে হবে বলে।

যা বোঝার করবীর বুঝতে বাকি রইল না। ঠিক পরপরই গগণ বিদারক চিৎকার দিয়ে ওঠল সে। আব্বুর নিষ্প্রাণ দেহটির সামনে বসে কত বিলাপ করল! বাবার হাত চেপে ধরে কত আকুতি করল! তাকে সামলানোর চেষ্টা করল সকলে কিন্তু যে মানুষ তার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলে সে মানুষকে কী স্বান্তনার ভাষায় আটকানো যায়? যায় না।
বাবা নামক সর্বস্বকে হারিয়ে মেয়েটা হয়ে ওঠল উন্মাদ। বার বার বাবার দেহটা ধাক্কাতে লাগল। বাচ্চাদের মতন বলতে লাগল,
‘আব্বু, ফাঁকি দিলে,তাই না? তোমরা সবাই আমার সাথে এমন খেলাই খেললে গো? সবাই এমন করেই ফাঁকি দিলে? আমাকে ভালোবাসার জন্য কেউ রইল না। আব্বু, তুমি জানোনা করবী একা থাকতে পারে না! তার ভয় হয় রাত হলে। এখন কীভাবে একা থাকবে সে, আব্বু? আজ একটা বার ভাবলে না করবীর কী হবে! বাহ্, আব্বু। তুমিও স্বার্থপর হলে। আব্বু ওঠো গো। ও আব্বু ওঠো।’

করবীর পাগলামোতে বিন্দুও নিজেকে সামলাতে অক্ষম হচ্ছে। তবুও ভরসা দিতে হবে বলেই করবীর হাত ধরে আটকানোর চেষ্টা করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আপা, এমন কইরো না। চাচা কষ্ট পাইবো।’

করবী বিন্দুর হাত ঝারা দিয়ে ফেলে দিল। কান্না রেখে হাসতে আরম্ভ করল। বিকট শব্দে হাসি। হাসতে হাসতে বলল, ‘কষ্ট পাবে না। আমার আব্বুর কষ্টের দিন শেষ। সে যেই বুকভরা কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিল আজ তার মুক্তি। আমার আব্বুর কীসের কষ্ট বল? আব্বুর তো মুক্তি। মুক্তি হয়ে গেছে আব্বুর।’

করবীর ভয়ঙ্কর অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হতে লাগল। হীরণ, তিমির, হুতুম কেউ বাদ রইল না বুঝাতে অথচ মেয়েটা বুঝলে তো! বিড়বিড় করে প্রলাপ বকেই যাচ্ছে। কত কী প্রলাপ!
কেবিনের কোণায় খাঁচার মাঝে নীরব দর্শক হয়ে বসে রইল বাণী। চঞ্চল পাখিটার আজ সকল চঞ্চলতা উড়ে গিয়েছে যেন! তাকে কথা শেখানো সঙ্গীটিকে হারিয়ে গভীর শোকে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছে। কেবল অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইল সে। মৃত্যু নামক নির্মল সত্য তার কাছে বড়োই নিষ্ঠুর ঠেকল। নির্মম ঠেকল।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে