বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২২+২৩

0
319

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পূর্ণ মিলন পর্ব: ২২ (অর্ধেকাংশ)
কলমে: #মম_সাহা

(৩২)
বারান্দার শিক গলিয়ে দু’টো অপরিচিত ময়না এসে বসেছে ঘরে। কী সুন্দর তাদের হাবভাব! দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত একসাথে সংসার করা দম্পতি। বারান্দায় শুকাতে দেওয়া হয়েছিল কতগুলো ভাত। বিদিশার আবার শুকনো ভাত ভাঁজা খেতে ভীষণ ভালো লাগে। ময়না গুলো এসেই মনের সুখে কতগুলো ভাত মুখে পুরে নিল। তাদের পেট ভরতেই আবার কতগুলো মুখে পুরে দুই দম্পতি উড়াল দিল বিশাল আকাশে। বিদিশা তাকিয়ে দেখল এই দৃশ্য। পৃথিবীর সকল মুগ্ধতা যেন এই মুহূর্তে এই বারান্দায় এসে ঠিকরে পড়ছে। ময়না গুলো উড়ে যেতেই সে হাসল। হতাশ শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। তুষার চাইলে আজ তাদেরও নিশ্চয় একটা সংসার হতো! এমন করে ভাব করেই কেটে যেত সুখের সংসার! অথচ তা হলো কই?
বিদিশা ভাবল। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হলো। এই যে সে মনের মতন সংসার করতে পারল না তার পিছনে আদৌ সে কতটুকু দায়ী? এক ফোঁটাও নয়। তার জীবনে এক দুপুরের রোদে ঝলসে যাওয়া প্রেম ছিল তুষার। যাকে এক দেখাতেই মন বলেছিল কবুল। অথচ বিসর্জনের ব্যাথা বুকে দিয়ে সে তুষার বিয়ের পরের দিনই মায়ের প্রতি এক বুক অভিমান নিয়ে ঘর ছাড়া হলো। তারপর মাস পেরুতেই দেশ ছাড়ল। অথচ বিদিশা মা ছেলের অভিমানে সংসার করার স্বপ্ন নিয়ে মূর্তির মতন হয়ে গেল। যার ব্যাথা-বেদনা কেউ একবার খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি। মা নাকি ছেলে হারাল আর ছেলে হারাল মা’কে। আর বিদিশা যে নিজের পুরো জীবনের সুন্দর সময়টা হারাল…. সে হিসেব আজও কেউ করল না।

‘বউ, আসব?’
তাসনীম বেগমের কণ্ঠ পেতেই বিদিশা ভড়কে গেল। চোখের কোণে আসা অশ্রুর বিন্দু লুকিয়ে ফেলতে চাইল গোপনেই। নীল রঙের সুতির শাড়ি পরনে তার। চোখে কাজল, হাতে দু’টো সোনার চিকন চুড়ি। গোছা ভোরা চুলের রাজ খোপা ঝুলছে পিঠে। কান্না লুকিয়ে সে জবাব দিল,
‘আসেন, আম্মু।’

তাসনীম বেগম এলেন। এসেই খাটে বসলেন। ঘিয়ে রঙের শাড়ি জড়ানো তার শরীরে। তিনি শাড়ির আঁচলটা টেনে চোখ মুছলেন। হয়তো কাঁদছিলেন! বিদিশা এগিয়ে এলো শাশুড়ির শুকনো মুখ দেখে। বিচলিত কণ্ঠে শুধাল,
‘কিছু হয়েছে, আম্মু?’

ভদ্রমহিলা নিজেকে সামলে নিলেন। চোখের জল টুকু মুছে নিয়েই বললেন,
‘আমি মনে হয় বড়ো ছেলেটারে না দেখেই মারা যাব।’

বিদিশা চমকাল শাশুড়ির এহেন কথায়। বিয়ের পর এই মানুষটাকেই সে মা ডেকেছে। সবসময় মানুষটার আগেপিছে ছায়ার মতন ঘুরেছে। এই মানুষটার চলে যাওয়ার কথা শুনতেই তার বুক কাঁপল। দ্রুত গিয়ে ধরল শাশুড়ির দু’হাত। বলল, ‘অমন কথা বলছেন কেন, আম্মু?’

‘আমার যে তুষারকে দেখার জন্য প্রাণ কাঁদে, বউ।’

কথাটা বলেই ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দিলেন তিনি। বিদিশা শাশুড়িকে স্বান্তনা দেওয়ার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। অনবরত বাজায় সে শাশুড়িকে বসিয়েই ছুটে গেল দরজার সামনে। মেয়েলি রিনরিনে কণ্ঠে একবার শুধাল, ‘কে?’

অপরপাশ শুনশান নীরবতায় নিমজ্জিত। উত্তর এলো না। বিদিশা আবারও একই প্রশ্ন করল। অতঃপর জবাব না পেয়ে কপাল কুুঁচকে দরজা খুলতেই সে থমকে গেলে। বহুদিন আগের সেই ঝলসে যাওয়া প্রেমের দুপুর যে আজ তার দরজায় ফিরে আসবে এমন করে, সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। টের পেলে এতটা মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা হয়তো কখনো করত না।
বিদিশার বুকে দ্রিমদ্রিম শব্দ। অস্ফুটস্বর তার। ডাকল তাসনীম বেগমকে,
‘আম্মু, আম্মু…..’

পুত্রবধূর এমন কণ্ঠ পেতেই তাসনীম বেগম ছুটে এলেন। কণ্ঠে তার উৎকণ্ঠা, ‘কে আসল, বউ!’
বাকি আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলেন না ভদ্রমহিলা। তার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন,
‘তুষার, আব্বা, তুমি আসছো! আব্বা গো আমার। মায়ের উপর তোমার এত অভিমান, আব্বা? তুমি সত্যিই আসছো….’

বিদিশা কেবল এক দু পা করে পিছনে গিয়ে জায়গা করে দিল। শাশুড়ি গিয়ে জাপটে ধরলেন ছেলের বুক। হৈচৈ-এ বেরিয়ে এলো তিমিরও। নিজের সবচেয়ে প্রিয় ভাইকে দরজার সামনে দেখে থমকে দাঁড়াল সে-ও। কিন্তু ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ছুটে গিয়ে ভাইয়ের এক পাশের বুক দখল করে নিল। মা, ছেলে তিনজনেরই যেন আজ পরম আনন্দের দিন। বিদিশা দূর থেকে সবটা দেখল। কেবল দেখেই গেল। যার জন্য তার তীব্র অপেক্ষা, এত বছরের জীবন অনশন, সেই মানুষটার বুকে তাকে রাখার মতন অবশিষ্ট জায়গাটুকু নেই। কেউ একটি বার তাকে বললও না কাছে আসতে, ধরে দেখতে এত তপস্যার মানুষটিকে। সবাই যেন ভুলেই গেল, একটি মেয়ে বহুদিন মুগ্ধ চোখে পৃথিবী দেখেনি স্বামীর বিচ্ছেদে। সে-ই মেয়েটিরও যে ভীষণ অধিকার আছে স্বামীর নৈকট্যের। কেউ একটিবার মনে করল না তার কথা। সংসারে চিরজীবন সবটুকু ত্যাগ করে সে আটপৌরে পুরোনো আসবাব হয়েই রইল তাহলে? সংসারের একজন হতে পারল না। বুকটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। আর সহ্য হলো এই দৃশ্যটুকু। সে নিবিড়েই প্রস্থান নিলো। নিজেকে লুকিয়ে ফেলল তার নিজস্ব রুমটাতে। যেই রুমটা থেকেও হয়তো তাকে কিছুক্ষণ পর বের করে দেওয়া হবে। গোটা একটা জীবনে, বহুদিন অপেক্ষা করে অবশেষে সে কী পেল?
না পেল স্বামীর বুকের একাংশ এমনকি পেল না বহুদিন বাস করা রুমটাকে নিজের বলার অধিকার। হায়রে জীবন! এমন করেই হেলায় হারিয়ে যায়!

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২২ [বাকি অংশ]
কলমে: #মম_সাহা

(৩৩)

তৈয়ব হোসেনের শরীরটা গত দু’দিন যাবত খারাপ ছিল। হুট করে কোথা থেকে জ্বরের উপদ্রপ হলো। ততটুকুতেই ক্ষান্ত হয়নি অসুস্থতা। সাথে তুমুল শ্বাসকষ্টও শুরু হলো। প্রথম প্রথম শ্বাসকষ্টের মাত্রা তুলনামূলক কম থাকলেও বর্তমানে তা ধারণ করেছে ভয়াবহ রূপ। বাবার সেবা করেই মেয়েটার দিন যাচ্ছে। টিউশনির পার্ট আপাতত বন্ধ রেখেছে। এই অসুস্থ মানুষটাকে সে কীভাবে ঘরে একা রেখে যাবে? কার ভরসাতেই-বা রেখে যাবে!
বাবার মাথার পাশে বসে কত হিসেব কষছে সে। মাসের শেষের দিকটাই পড়াতে না গেলে গার্ডিয়ানরা বেতন দিতে গাইগুই করেন। অথচ বাবার এ অবস্থায় টাকা-পয়সার ভীষণ দরকার। মেয়েটা পর-পর দু’বার দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই অসুস্থ তৈয়ব হোসেনের নিষ্প্রাণ কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল,
‘মা, কী ভাবিস?’

করবীর ধ্যানে কিঞ্চিৎ টান পড়ল। ভাবনার গহীন সুর ছিঁড়ে গেলে আলগোছে। সে গা-ঝাড়া দিয়ে বসল। বলল, ‘কই, তেমন কিছু না, আব্বু।’

তৈয়ব হোসেন অসুস্থ হাতটা রাখলেন মেয়ের মাথায়। কম্পনরত কণ্ঠে বললেন,
‘মারে, এই বিরাট দুনিয়ায় তোকে বড়ো একলা করেই হয়তো চলে যাবো। বড্ড স্বার্থপর বাবা কিনা আমি!’

বাবার প্রস্থানের কথা শ্রবণ কেন্দ্রে পৌঁছাতেই গা শিরশির করে উঠল করবীর। নিঃসঙ্গ এক জীবন ভেসে উঠল চোখের পাতায়। যেই জীবনে কতগুলো বিবর্ণ বসন্ত আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই। সব শূন্য, ফাঁকা।
বাবা বিহীন পৃথিবী কল্পনা করা করবীর জন্য মৃত্যুর সমান। যা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। করবী আঁতকে উঠল, ‘কী বলছ, আব্বু? দয়া করে এসব বলো না। আমার কে আছে বলো তুমি ছাড়া?’

তৈয়ব হোসেন গাল ভোরে হাসলেন। মেয়ের মাথায় অবিরত হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘মারে, যেতে যে আমাকে হবেই। আজ নয়তো কাল। তোকে এত বড়ো পৃথিবীটাই এত একা করে যেতে চাই না। কিন্তু হায়াত যে আমার হাতে নেই।’

‘অমন বলো না, আব্বু। তোমাকে ছাড়া আমি বোধহয় বাঁচতে পারব না।’

‘কে বলেছে পারবি না? অবশ্যই পারবি। কেবল বিকেল হলে তোর একলা লাগবে, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ফাঁকা ঘর পাবি, বড়োজোর আমি না থাকায় তোর বারান্দার গোলাপ ফুলের টবটি শুকিয়ে যাবে…. এর বেশি কিছুই হবে না, মা। আমি থাকব না বলে কিছুই থেমে থাকবে না। বরং তোর বোঝা কমবে। পঙ্গু বাবার ভার কমে যাবে কাঁধ থেকে। তখন দেখবি, তুই উপলব্ধি করতে পারবি, আমি নেই বলে কারো কোনো বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়নি বরং লাভই হয়েছে। তোর বেঁচে থাকার যুদ্ধে দায়বদ্ধতা কম থাকবে।’

কথা বলতে বলতে তৈয়ব হোসেনের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বদলে গেল। অস্বাভাবিক ভাবে মানুষটা শ্বাস টানা শুরু করল। যেন পৃথিবীতে কতই না অক্সিজেনের অভাব। বাবার বুকের উঠানামায় এত অস্বাভাবিকতা দেখে করবী ঘাবড়ে গেল। তৈয়ব হোসেনকে বারংবার জিজ্ঞেস করল তার অসুবিধে কোথায় হচ্ছে অথচ মানুষটার অবস্থা হুট করেই এত অবনতিতে গিয়ে ঠেকল যে সে আর প্রকাশ করতে পারছিল না কিছু। চারদিকের বিকেলের ধবধবে রঙও ততক্ষণে ঝিমিয়ে আঁধার হয়ে এসেছে। ঘর জুড়ে কেবল করবীর উৎকণ্ঠার শব্দ আর ফ্যানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আলোও জ্বালানো হয়নি ঘরটায়। করবীর বুক ঠিকরে কান্না আসছে। এতটা অসহায় সে কখনো হয়নি এর আগে। অসহায় হওয়ার আগেই বাবার হাতটি তার মাথায় এসে স্বান্তনা দিয়েছে অথচ আজ সেই হাতই পালিয়ে যাওয়ার ফন্দিফিকির করছে। করবী ছুটে গিয়ে তার ভাঙাচোরা মোবাইলটা বের করল। হীরণের নাম্বারটা বের করে আবার কী মনে করে যেন কল দিল না। কল দিল তিমিরকে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ করে তিমির হাস্যোজ্বল কণ্ঠে শুধাল,
‘আরে, রক্তকরবী যে…’

লোকটা বাকি কথা সম্পন্ন করার আগেই করবী কেঁদে দিল। অসহায় স্বরে বলল, ‘আব্বু যেন কেমন করে। আমি একা। একটু আসুন।’

কথাটুকু বলেই মেয়েটা কান্না জুড়ল। তিমিরের কথাটাও শুনল না। হাত থেকে ফোনটা পড়ে সুইচড অফ হয়ে গেল। করবী কেবল তৈয়ব হোসেনের বুক-পিঠ ঢলছিল আর বাচ্চাদের মতন আবদার করছিল,
‘আব্বু, আমারে রেখে যেও না। যেও না, আব্বু। আব্বু, আমি একা থাকতে পারি না যে।’

আরও কতশত আবদার! কিন্তু সকল আবদারের সারাংশ এতটুকুই ছিল যে বাবা নামক বৃক্ষটা যেন শেষ অব্দি শিকড় আঁকড়ে পড়ে থাকেন। তৈয়ব হোসেন কথা বলতে পারছিলেন না অথচ মেয়ের এমন পাগলামো অবস্থা দেখে ঠিকই কাঁদছিলেন। চোখ গুলো দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।

সন্ধ্যা ধরেছে রাজলক্ষ্মী রূপ। কী সুন্দর লাজুক সন্ধ্যা! কমলা রঙ আকাশের এক কোণে বসে নতুন বউয়ের মতন হাসছে। আর পুরো আকাশ জুড়ে সে হাসির রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সন্ধ্যার নাম নিয়ে।
বিদিশা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। সবুজ শাড়িটা পড়নে। আজ আর চোখে কাঁজল দেয়নি। যত্ন করে হাত খোঁপাও বাঁধেনি। হাসিকেও বাক্সবন্দী করে উড়িয়ে দিয়েছে অজানায়। চারপাশে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। সেই শান্তির ধ্বনি ব্যাতিত আর কিছুই তার কর্ণগোচর হচ্ছে না। এখানেই তার একমাত্র সুখ। নাহয় জীবনে যে পরিস্থিতি আছে, বাঁচার কথা ভাবতে পারছে না।

নীরবতা ভেঙে দরজায় টোকা পড়ল। প্রথমবার শুনতে না পেলেও দ্বিতীয়বার শুনতেই ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাসনীম বেগম। দরজা খুলতেই ভদ্র মহিলার হাসিখুশি মুখে আবছা অন্ধকার দেখা দিল। তিনি কপাল কুঁচকে বললেন,
‘দরজাটা আটকে রেখেছ কেন, বউ? আহা! ঘরটাও অন্ধকার করে রেখেছ যে! কী অদ্ভুত! ভূত-প্রেতে পেয়েছে?’

বিদিশার চোখ তখন তাসনীম বেগমকে পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা তুষারের দিকে। টাউজার আর নীল টি-শার্টে সুপুরুষই লাগছে বটে মানুষটাকে।
বিদিশাকে চুপ থাকতে দেখে অধৈর্য্য হলেন তাসনীম বেগম,
‘কথা বলছ না কেন? মনে হচ্ছে বোবায় ধরেছে!’

বিদিশার দৃষ্টি চঞ্চল হলো। এধার-ওধার ঘুরে শেষমেশ এসে নিবদ্ধ হলে মধ্য বয়স্কা এই নারীর দিকে। সে উদাস চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কিছু বলবেন, মা?’

তাসনীম বেগম এবার ফুস করে শ্বাস ফেললেন। চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন তুষারের দিকে। ছেলেটার মনযোগ টিভির দিকে। তা দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। বললেন, ‘বউ, তুমি যদি ঐ সাইডের রুমটায় গিয়ে থাকতে তাহলে খুব ভালো হতো। তুষারের তো এই ঘরটা অনেক পছন্দের ছিল…’

বিদিশা এবার হু হা করে হেসে উঠল। এত অস্বাভাবিক ভাবে হাসল যে তুষার অব্দি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। হন্তদন্ত করে ছুটে এলো দরজার কাছে। তাসনীম বেগম কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তাজ্জব কণ্ঠে বললেন, ‘হাসছো যে!’

বিদিশার হাসি যেন থামছেই না। পৃথিবীর সকল হাসির কারণ যেন তার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। বহু কষ্টে অবশেষে সেই হাসি সংযত করল। চোখে জলে টইটুম্বুর। যেন বর্ষার ভরা পুকুর। আপাত দৃষ্টিতে দেখে উনারা ভাবল যে হাসতে হাসতে জল জমেছে চোখে। অথচ গাঢ় চোখে দেখলে বুঝতে পারত, ভেতরটা কতটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মানুষ এমন ভাবে হাসির উছিলায় কাঁদে।

‘তেমন কিছু না, মা। এমনেই হাসলাম।’
তাসনীম বেগম সন্তুষ্ট হলেন না এমন উত্তরে। বরং বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘কী যে করো না আজকাল! তোমার মতিগতি বুঝা দায়।’

‘আমার মতিগতি বুঝতে পারছেন না, মা! হাসালেন। যাই হোক, আমি রুমটা আজই খালি করে দিবো। এরপর যে থাকার থাকবে।’

বিদিশার উত্তর পছন্দ হলেও খুশি হতে পারলেন না তাসনীম বেগম। তিনি চাননি ছেলের সামনে বিদিশার কোনো ব্যাপারই আসুক। তাই তো গত দু’দিন যাবত মেয়েটা সর্বক্ষণ দোর দিয়ে রাখলেও মাথা ব্যাথা দেখাননি। না খেয়েও, ‘খেয়েছি’ বলার পরও খোঁজ নিয়ে দেখেননি। তিনি পারলে যেন বিদিশাকে অদৃশ্য করে দিতেন। পাছে ভয় পান তিনি, ছেলে যদি আবার বিদিশার রেশ ধরে রাগ করে বাড়ি ছাড়ে!
অথচ মায়ের বোকা মন বুঝলই না ছেলের রাগ বিদিশার উপর ছিল না, ছিল- মায়ের উপর। কেন মা তার মতামতটুকুর গুরুত্ব দিলেন না।

এতক্ষণ যাবত তুষার নিশ্চুপ থাকলেও এখন কথা বলল। মা’কে উদ্দেশ্য করে অবাক স্বরেই বলল,
‘রুম ছাড়তে বলছ যে? উনি রুম ছাড়বে কেন?’
‘রুমের মালিক চলে এসেছে তাই আশ্রিতার বিদায় হবে। এটা না বুঝার কী আছে?’

বিদিশার উত্তরে তাচ্ছিল্য। চোখে-মুখে হতাশা। তাসনীম বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন পুত্রবধূর কথায়,
‘কী বলছ এসব! অদ্ভুত সব ভাষা!’
‘আপনি অদ্ভুত আচরণ করলে ভাষাদেরও যে অদ্ভুত হতে হয়, মা।’
‘আমি অদ্ভুত আচরণ করেছি!’ তাসনীম বেগমের চোখে-মুখে বিস্ময়। এ বিদিশা অন্যরকম। উদ্ভ্রান্ত, পাগল। নিজের শেষ সম্বলটুকু হারানোর পর মানুষ যেমন আবেগহীন হয়ে যায়, এই বিদিশা ঠিক তেমন।

‘আপনার রুম ছাড়তে হবে না। আপনি কত যত্ন করে রুম সাজিয়ে তারপর এখানটায় ছিলেন তা দেখেই আন্দাজ করা যায়। আমি এসেছি বলেই আপনার যত্ন বৃথা হয়ে যাবে তেমনটা না। এখানে একসময় আমি থাকতাম এটা ঠিক। তবে সেটা অতীত। আর রুমটায় এখন আপনি থাকেন এটা বর্তমান। মনে রাখবেন অতীত মানেই ভ্রম, কল্পনা। বর্তমান মানেই সত্য। আর আজকের সত্য রুমটা আপনার এবং আপনারই থাকবে। কেমন?’
তুষার কথাটা বলেই প্রস্থান নিল। চোখে এক রাশ প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল বিদিশা। অথচ তাসনীম বেগম রুষ্ট হলেন। ত্রাসিত চিত্তে বললেন,
‘তোমার এমন আচরণ মোটেও শোভনীয় নয়। এখন তোমার জন্য ছেলেটা আবার আমাকে ভুল বুঝলে! ও তো ভাববে ওর মা খারাপ। তোমাকে সংসারে আনার পর থেকেই আমি ছেলের চক্ষুশূল হলাম। কোন কুক্ষণে যে এসেছিলে!’
শাশুড়ির তিরস্কারে হাসল বিদিশা,
‘জানেন মা? আমার আব্বু ছোটোবেলায় একটা কথা বলতেন, রঙ বদলানোর ধর্ম নাকি গিরগিটিদের। অথচ বড়ো হয়ে দেখলাম আব্বু ভুল জানতেন। মানুষের চেয়ে বেশি রঙ কেউ বদলাতে পারে না। এমনকি গিরগিটিও না।’

কথাটা বলেই ধীর হাতে দরজায় খিল দিল বিদিশা। তাসনীম বেগম দাঁড়িয়ে রইলেন ঠাঁই। তার অন্যায় কোথায় সে যেন দেখতেই পেলেন না।
যেতে-যেতে সবটুকুই শুনল তুষার। মায়ের প্রতি বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। মা নামক মানুষটা অতিরিক্ত ভালো চাইতে গিয়ে এতটা কঠিন হচ্ছেন যে তার প্রতি আর কারো আবেগই বেঁচে থাকার না।

#চলবে….

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৩
#মম_সাহা

হুতুম খেলছে ঘর জুড়ে। বিন্দু রান্না করছে। আজ হীরণের দাওয়াত এ বাসায়। তাই ভালো-মন্দ রান্না হচ্ছে। যদিও করবী আপাকে কল করা হয়েছে কয়েকবারই কিন্তু মানুষটা ফোন তুলছে না। তাই বিন্দু ঠিক করল রান্নাবান্না শেষ করে যাবে আপাদের বাসায় খাবার নিয়ে। পিকনিকের মতন খাওয়া দাওয়া হবে।
খেলতে খেলতে হুট করে হুতুমের নীল ফ্রকটা দরজায় পুরোনো তারকাঁটায় লেগে কিছুটা ছিঁড়ে গেল। ব্যথাও পেল মেয়েটা। বিন্দু তখন মাত্র ভাতের মাড় গালতে নিয়েছিল। হুতুমের চিৎকারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে। কিঞ্চিৎ মাড় পড়ে গেলে নিচে। গরম আঁচ লাগল হাতে। সেখানে ভ্রুক্ষেপ না করেই ছুটে গেল হুতুমের কাছে। দু’ হাতের আঁজলে আগলে নিল মেয়েটাকে। চিন্তিত কণ্ঠে বারংবার শুধাল,
‘কই লাগছে, হুতুম? কই লাগছে?’

হাঁটু কেটে গেছে ভালোই। র ক্তও বের হচ্ছে। ঠোঁট উল্টে কাঁদছে মেয়েটা। বিন্দু বার বার বলেছিল এভাবে ছুটোছুটি করে না খেলতে। পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে। মেয়েটা শুনলে তো! রাগে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিতেই হীরণের আগমন ঘটল। এসেই হুতুমকে মারার দৃশ্য দেখে ছেলেটা ছুটে আসল। এক টানে বাচ্চাটাকে ঘুরিয়ে নিল নিজের কাছে। বিচলিত চিত্তে ধমকে ওঠল বিন্দুকে,
‘মারছিস কেন? কী আজব!’
বিন্দুর চোখে জল টলমল। যতই মারুক তবে এই পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি হুতুমকে কেউ ভালোবাসে না।
হীরণ হুতুমকে থামানোর চেষ্টা করল আদুরে হাতে। চোখ রাঙাল কয়েকবার বিন্দুর দিকে। হুতুম কিছুটা ধাতস্থ হতেই হীরণ আবার ধমকাল বিন্দুকে,
‘বেশি বড়ো সাজার চেষ্টা করিস না? চাচী তোর উপর ওর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে বলে সবসময় শাসন করবি তা কিন্তু হবে, বিন্দু।’
বিন্দু হীরণের শাসনে মুখ ভেংচাল, ‘শাসন করতেই হইবো। এত দুষ্টামি কেডা সহ্য করব?’
‘তুই সহ্য না করতে পারলে বলে দে, আমি নিয়ে যাই ওকে। তোর এত মাতব্বরি আমার পছন্দ না।’
‘হ, হ, তুমি নিয়া গেলে যাও। কিন্তু অর যত্ন করব কে?’

বিন্দুর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো হীরণ। জবাব দিল, ‘কেন? তোর কী আমারে চোখে লাগে না? আমি নিবো যেহেতু, সেহেতু আমিই যত্ন করব।’
‘তুমি যত্ন করবা?’ প্রশ্নটা করেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠল বিন্দু। হীরণকে যে বিদ্রুপ করেই এই হাসিটা তা আর বুঝার বাকি নেই হীরণের। তাই সে আরও চটে গেল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘বে ক্ক লের মতন হাসবি না। তোর কী মনেহয় আমি যত্ন নিতে পারব না?’
‘তোমার যত্ন নেওয়ারই কেউ নাই আর তুমি নিবা আরেকজনের যত্ন!’

হীরণ আঁড়চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল বিন্দুর দিকে। তারপর ছোটো করে বলল,
‘কে বলল কেউ নাই? এই যে তুই আছিস। যে ঝড়ের দিনে মাথার উপর ছাতা ধরে রেখেছিল আমার জ্বর আসবে বলে, সে থাকতে আমি কেন বলব কেউ নেই?’

হীরণের কথায় চমকে গেল বিন্দু। খুশিতে চকচক করে উঠল চোখদুটো। প্রায় আত্মহারা হয়ে বলল,
‘তার মানে তুমি আমারে কেউ কেউ ভাবো?’

হীরণ চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। বিন্দু যেটা ভেবে খুশি হয়েছে হীরণ সে প্রসঙ্গে বলেনি। সে কেবল বুঝাতে চেয়েছিল বিন্দুর মতন নিখুঁত শুভাকাঙ্খী ক’জনেরই বা ভাগ্যে জুটে? অথচ মেয়েটার চঞ্চল মন বুঝে নিল অন্যকিছু! বিন্দুর খুশিতে হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছে হলো না আর। তাই ভুলও ভাঙালো না।
অন্যদিকে বিন্দু প্রায় খুশিতে দিশেহারা। বিড়বিড় করে করবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল,
‘আপা, তোমারে ম্যালা ভালোবাসি। তুমি জানো? আমি যারে ভালোবাসি, হেয়ও আমারে কেউ কেউ ভাবে। ইশ্ তুমি থাকলে এই খুশিডা ভাগ কইরা লওয়া যাইতো। তোমারে না কইতে পারলে শান্তি লাগতাছে না। বিন্দুবালা কালা বইল্যা হীরণ ভাই মুখ ফিরায় নাই, আপা। হীরণ ভাই অন্যরকম। এক্কেবারে অন্যরকম।’

(৩৪)

হসপিটালের কড়া ফিনাইলের ঘ্রাণে যেন মানুষ হারানোর একটা বিজ্ঞাপন থাকে। করবীর কেবলই মনেহয় মৃত্যুর যমদূত আশেপাশে থাকে বিধায় হসপিটালের ভেতরে ঢুকলে তার শরীরটা কেমন ভার হয়ে আসে। ফিনাইলের গন্ধে তার মাথা ঘুরে। কবে, কাকে, কীভাবে হারিয়ে ছিল তা মনে পড়ে যায়।
সারাটা বিকেল কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে এসেছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। রাত তখন শেষের দিকে। মৃদু বাতাসে তার শরীর শিরশির করছে। হুট করেই দেখল হসপিটালে খোলা বারান্দাটায় আমেনা খালা দাঁড়িয়ে আছেন। আকাশের আবছা আলোয় অস্পষ্ট আমেনা খালার মুখটি। ঘোমটা দেওয়া চল্লিশোর্ধ্ব নারীটিকে সে চেনে। অনেক কাছ থেকে চেনে। তাই আবছা ছায়ামূর্তি দেখেও সে ধরতে পারল এটা আমেনা খালা। করবী বার কয়েক ডাকল ‘খালা, খালা’ বলে অথচ মানুষটা উত্তর দিল না। কেবল রোবটের মতন বারান্দা থেকে ভেতরে এলেন করবীর সামনে দিয়ে হেঁটেই তৈয়ব হোসেনের কেবিনটাতে প্রবেশ করলেন। আমেনা খালাকে বাবার রুমে যেতে দেখে করবীও ওঠে দাঁড়াল। পিছে পিছে ছুটল কেবিনটায়। অথচ করবী ঢোকার আগেই কেবিনটার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। করবী কতবার দরজা ধাক্কালো, কতটা শক্তি দিয়ে অথচ দরজাটা খুলছেই না। কেবিনের দরজার গ্লাস দিয়ে দেখা গেল আমেনা খালা বাবার কাছে গিয়ে বসেছেন। বাবার তখনো শ্বাস চলছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমেনা খালা বাবার হাত ধরে বললেন, ‘ভাই সাব, চলেন’ ঠিক সেই মুহূর্তে বাবার শ্বাসটা থেমে গেল। বাবা আর বুক ভোরে শ্বাস নিলেন না। ইসিজি মেশিনটার লম্বা দাগ বুঝিয়ে দিল বাবার হয়েছে চিরবিদায়।
করবী পাগলের মতন কেবল দরজা ধাক্কাচ্ছে। চিৎকার করে বলছে,
‘আব্বু, আব্বু যেও না। আব্বু….’

দীর্ঘ একটা স্বপ্ন ভেঙে গেল। করবীর শরীর কাঁপছে মৃদু। ঘেমে চুপসে গেছে তার শরীর। ঘুম ভাঙতেই তিমিরের চিন্তিত মুখটা দৃশ্যমান হলো করবীর চোখে। লোকটা করবীর অগোছালো চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করছে,
‘কী হলো? কী হলো? দুঃস্বপ্ন দেখেছ? কী হলো!’

মস্তিষ্ক সজাগ হতেই করবী ঠাহর করল সে তিমিরের বাহুতে ঘুমিয়ে ছিল। এখনও সে অবস্থাতেই আছে। নিজেকে ধাতস্থ করেই সে দ্রুত মাথা উঠিয়ে ফেলল। হম্বিতম্বি করে ওড়না ঠিক করল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। এত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছে যে এখনো বুক কাঁপছে।
তিমির হয়তো বুঝতে পারল স্বপ্নের ব্যাপারটা। তাই করবীর মাথায় ভরসার হাত রাখল। নিবিড় স্বরে বলল,
‘শান্ত হও। আঙ্কেল ঠিক আছেন। একটু আগেই আমি গিয়ে দেখে এলাম। ঘুমাচ্ছেন।’
‘শ্বাসকষ্টটা কমেছে?’
‘তখনের মতন অতটা নেই তবে এখনো আছে। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। চিন্তা করো না।’

তিমির ভরসা দিলেও করবী ভরসা পেল না। তার চোখে কেবল ভেসে ওঠছে বিকেলের সেই দৃশ্য। বাবা কেমন শ্বাস টেনে যাচ্ছিলেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই, কথা বলতে পারছিলেন না! করবী হাউমাউ করে কেঁদে তিমিরকে ডাকল। এরপর বিশ মিনিটের মাথায়ই তিমির পৌঁছালো তার কিছু মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্সও এলো। তিমিরই আনিয়েছিল। এরপর তিমিরের প্রচেষ্টায় বাবাকে হসপিটালে আনা হলো দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা হলো। ভাগ্যিস তিমির ছিল। নাহয় সে একা হাতে কীভাবে সবটা সামলাতো! তার যে তখন বড়োই অসহায় লাগছিল!
সেই বিকেল থেকে লোকটা তার সাথে। এখন মধ্যরাত। কিচ্ছু খায়ওনি। করবীর ভাবনার মাঝেই তিমিরের কোমল স্বর পাওয়া গেল,
‘চলো, নিচে যাই। নিশ্চয় সারাদিন কিছু খাওনি? আসো।’

করবী অনীহা প্রকাশ করল, ‘খিদে নেই। আপনি গিয়ে কিছু খান। সেই কখন আসছেন এখনো বাড়িতে যাননি। নাহয় এখন চলে যান। দরকার হলে আবার ডাকব।’
‘চুপ করো। তোমার মনেহয় তোমাকে একা রেখে এখন আমি চলে যাব? অযৌক্তিক কথা বলো না। আসো নিচে যাই। অন্তত আমার জন্য আসো। আমার খিদে পেয়েছে।’

করবীর অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওঠল। একবার বাবার কেবিনে উঁকি দিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলল। তারপর ক্লান্ত পায়ে হাঁটা আরম্ভ করল। এতটা নিঃস্ব লাগছে আজ! মনে হচ্ছে এ দুনিয়ায় তার কেউ নেই। কেউ না। ভেতরে এই একটা অনুভূতি তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে অন্তর। কেবল মনে হচ্ছে আব্বু ছাড়া এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কী মানে? কী জন্য বেঁচে থাকবে সে? তার কে আছে নিজের বলতে?

ঠিক সেই মুহূর্তে একটি হাত তার ছোটো, কোমল তালু জড়িয়ে ধরল। ভরসা দিল শক্ত মুঠো,
‘চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
করবী ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। মনকে শীতল করতে চায়। তিমিরও ভেতর-ভেতর অপরাধ বোধে ভোগে। যতই সে বলুক সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু সে তো জানে, কিচ্ছু ঠিক হওয়ার নয়। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন হাতে সময় কম। কিন্তু মেয়েটাকে এটা বলা যাবে না। এত শক্ত, কঠিন মেয়েটি এখনই ভেঙে পড়েছে। বাকিটা শুনলে হয়তো আর সামলাতে পারবে না।
রাতের শহরে ভেসে গেল দীর্ঘশ্বাস। কেউ ঘুমুতে ব্যস্ত আর কেউবা চির নিদ্রার খুব কাছাকাছি।

_

তিমির ফিরছিল না। রাত বাড়তে বাড়তে প্রায় শেষের দিকে। সজাগ বিদিশা। আগেও সে তিমিরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করত। তিমির যতক্ষণ না আসতো সে সজাগ থাকতো। যতই তিমির সম্পর্কে তার দেবর হোক সবসময় সম্মান করেছে বড়ো ভাইয়ের মতন। তিমিরও শ্রদ্ধা করেছে আবার স্নেহও দিয়েছে। এই বাড়িতে এই একটা মানুষ হয়তো বিদিশাকে একটু মানুষ ভেবেছিল।

ড্রয়িং রুমে ড্রিম লাইটের নীল আলো জ্বলছে। যে আলোয় রুমটাকে মায়া পুরী মনে হচ্ছে। সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে বিদিশা।
‘আপনার রুম কী হয়েছে? এখানে শুয়ে আছেন যে!’
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে হালকা তন্দ্রাভাব কেটে গেল বিদিশার। চোখ খুলতেই তুষারকে দেখতে পেল। তুষারকে দেখতেই তার চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেল, ‘এ বাড়িতে আমার রুম বলতে কিছু নেই।’

বিদিশার শক্ত-পোক্ত জবাবে কপালে তিন ভাঁজ পড়ল তুষারের। অবাক স্বরে শুধাল,
‘আপনি এভাবে কথা বলেন কেন?’
বিদিশা ভ্রু বাঁকাল, ‘কী ভাবে কথা বলি?’
‘কেমন হিংস্র স্বরে। মনে হয় যেন কাউকে সহ্যই করতে পারছেন না।’
‘পারছি না-ই তো।’
বিদিশার এহেন উত্তরে এবার কিঞ্চিৎ রাগ হলো তুষারের। সে-তো মেয়েটার সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহারই করছে। তবে মেয়েটার এত দেমাগ কেন হবে?
‘সহ্য করতে না পারলে থাকছেন কেন?’
তুষারের এমন একটা প্রশ্নের আশাই করেছিল বোধহয় বিদিশা। মোক্ষম প্রশ্নটা পেতেই সে উঠে দাঁড়াল। দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকে গুঁজে বলল,
‘থেকে ছিলাম একটা জিনিস দেখতে।’
‘জিনিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী জিনিস?’ তুষারের প্রশ্নের সাথে সাথে জবাব দিল না বিদিশা বরং কিছুটা সময় নিল। তারপর বেশ তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘কাপুরুষ দেখতে কেমন হয়।’

বিদিশার উত্তর বোধগম্য হলো না তুষারের, ‘কাপুরুষ? বুঝলাম না। কাপুরুষ কে? কাকে মিন করছেন?’
‘কেন? এটা না বুঝার কী আছে? কাপুরুষ বলতে আমি আপনাকেই মিন করেছি। যে বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে অথচ বউকে রেখে বিদেশ চলে যায় সকল দায় দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে।’

বিদিশার এহেন উত্তরে রেগে অগ্নিশর্মা তুষার। ধমকে বলে উঠল,
‘খবরদার। কাকে কী বলছেন ভেবে বলবেন। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। আমার অমতে হয়েছে এই বিয়ে।’

এবার বিদিশা সশব্দে হেসে ওঠল,
‘পুরুষের অমতে কখনো পুরুষকে বিয়ে দেওয়া যায় না। এটা সম্ভব না। পুরুষের এতটুকু ক্ষমতা আছে যতটুকু ক্ষমতা থাকলে তার অমতে কিছু করা সম্ভব না। অবশ্যই মত ছিল বিয়ে করার। এরপর বিয়ে করে মান-অভিমানের ঢঙ করে দেশ ছাড়লেন। আপনাদের মা ছেলের এই রাগ-অভিমানে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হলো কার? আমার। অথচ আমার কোনো দোষ ছিল না। দোষ না করেও আপনার জন্য আমি শাস্তি ভোগ করেছি। যে আমার জীবন নরক বানিয়েছে তাকে আমি নিশ্চয় পুরুষ বলব না? কাপুরুষই বলব।’

তুষার যেন আর কথা খুঁজে পেল না। আসার পর থেকে যে মেয়েটাকে নির্লিপ্ত পেয়েছে সে মেয়েটা হুট করে এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা যেন সে বুঝে ওঠতে পারল না।
বিদিশা কথা শেষ করে রুমে যেতেই তাসনীম বেগমের গলা পাওয়া গেল। তিনি সবটা শুনেছেন। তাই কিছুটা উগ্র কণ্ঠেই বলছেন,
‘বউ, তোমারে এই বাড়িতে আনা আমার জীবনের বড়ো ভুল ছিল। অযোগ্যদের যোগ্য স্থানে আনলে যা হয়। আমি শীগ্রই তোমার বাবাকে আসতে বলব…’

ভদ্রমহিলা আরও কিছু বলছিলেন অথচ বিদিশা শোনার প্রয়োজন বোধ করল না। ঘরে ঢুকেই মুখের উপর দরজা দিল। তার শান্তি দরকার। এতদিন সংসার সংসার করে শান্তির খোঁজ করতে পারেনি। এখন করবে। এই সংসার থেকে তার পাওয়ার কিছু নেই তাই সংসারের মায়া সে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। এখন একটু নিজের জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে