বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২০+২১

0
250

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: বিশ
কলমে: মম সাহা

“আপনি আমাকে দেখে এমন চমকে গিয়ে ছিলেন যে!”
নীরবতা ছিন্ন হলো করবীর প্রশ্নে। থতমত খেল বিদিশা। কথা ঘুরানোর অভিজ্ঞ চেষ্টা, ‘পরিচিত লেগেছিল বড়ো!’
“ওহ্! কাকে ভেবে ছিলেন? আপনার কে হয়?”
করবীর প্রশ্নে বিদিশা হতাশ শ্বাস ফেলল। দৃষ্টি তার উড়তে থাকা পর্দায়। হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘তেমন কেউ না। মুখ পরিচিত থাকে না অনেক? তেমন।’

করবী আর প্রশ্ন করল না। জানার কৌতূহল তার থিতিয়ে এলো। বিদিশা পরিস্থিতি ঘুরাল নতুন প্রশ্নে, ‘কোথায় থাকেন আপনি?’

‘নওয়াজ গলি। বাড়ি নং- তিন।’

‘কে আছে পরিবারে?’

‘কেবল বাবা।’
করবীর উত্তরে যেন বিদিশার মুখ-মন্ডলে থাকা কালো ছায়া সরে গেল অনায়াসে যা গোপন হলো না করবীর চোখ থেকে। বিদিশা এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। প্রাণচঞ্চল ভাব দেখা গেল তার অঙ্গ জুড়ে। বলল, ‘প্রশ্ন করছি বলে রাগ করবেন না যেন, ভাই।’

করবীর সুন্দর, সাবলীল উত্তর, ‘রাগ করব কেন? কৌতূহল মানুষের থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।’
করবীর উত্তরে চকচক করল বিদিশার চোখ। না, মেয়েটা যথেষ্ট ভালো।

‘পড়েন কোথায়?’

‘হিমসাগর ইউনিভার্সিটি। মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে।’

বিদিশা এবার চমকাল। অবাক কণ্ঠে বলল, ‘মাস্টার্স দিচ্ছেন!’

করবী স্মিত হাসল, ‘জি, দিচ্ছি।’

‘আপনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। ভেবেছিলাম বড়োজোর অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।’

এবার করবীর হাসি বিস্তৃতি লাভ করল। বলল, ‘অত ছোটো লাগে নাকি?’

‘লাগে তো। আমি নিজেই এবছর অনার্স ফাইনাল দিবো। আমি আপনার ছোটো তবে! ঘুড়ির ভাবি আমি। আপনি নাম ধরে ডাকতে পারেন।’

‘ভাবি ডাকলে কি রাগ করবেন?’
করবীর সহজ-সরল আবদারে যেন বিদিশার মন পুলকিত হলো। সে দু’কদম এগিয়ে এসে তার দু’হাতে করবীর হাত ধরল। ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘আমার শুনতে ভালো লাগবে, আপু। ডেকো।”

করবী বিদিশার এমন আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলো। বেগুনি রাঙা সুতি শাড়িতে এই সুন্দর মেয়েটিকে তার নির্ভেজাল মানুষ মনে হলো। কতজন পারে এমন করে মিশতে? মানুষ তো আজকাল অহংকারের খোলসে এমন ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে আর ডানা মেলে উড়তে চায় না। তার মাঝে এমন দু’একজন হয়তো থেকে যায় সব অহংকার পিছু ফেলে।

কোমল, গাঢ় সন্ধ্যা নীল শাড়ি জড়িয়ে আসমান জুড়ে যেন হাপিত্যেশ করছে কোন সে ব্যাথায়। বেদনার নীলে আকাশ জর্জরিত। মিহি বাতাস এসে বিনা বিজ্ঞাপনে নিঃশব্দ আলিঙ্গন দিয়ে যাচ্ছে মানব শরীরে। সেই আলিঙ্গনকে সঙ্গী করে বাড়ি ফিরল করবী। দরজার সামনে আসতেই পা থেমে গেল তার। তিন জোড়া পরিচিত জুতো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে দরজায় এলোমেলো ভঙ্গিতে। করবী ত্রস্ত হাতে বেল বাজাল। সেকেন্ড পেরুতেই ঝড়ের গতিতে দরজা খুলল কেউ। সে কেউটা বিন্দু। টিয়ে রঙের সেলোয়ার-কামিজের গাঢ় কাজল রঙের বিন্দু। যার চোখে পদ্ম পুকুর উপচে পড়ে মায়া নিয়ে।
করবীর আনন্দে চোখ টলমল করে উঠল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বিন্দুকে। সকল ক্লান্তিরা হামাগুড়ি দিয়ে যেন ছেড়ে গেল দেহ। বিন্দুও জড়িয়ে ধরল তার আপাকে। ভেজা কণ্ঠ,
‘দূরে আইস্যা দূরের মানুষ বানাইয়া ভুইল্যা যাওয়ার ফন্দি আঁটো, আপা? তা তো হইব না।’
করবীরও কণ্ঠ কাঁপছে, ‘তোদের ভুলা যাবে আদৌ?’
‘ভুলতে দিলে-এ না ভুলতে পারবা।’

করবী জড়িয়ে রাখল বিন্দুকে অনেকক্ষণ। এই ব্যস্ত নগরীতে তার বুকের ভেতর কোথায় একটা ধারাল সুঁচ বসে ছিল। সে যাযাবর সুঁচের ইতিহাস বুঝতে পারেনি। এখন বুজছে। এই যে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরার পর ব্যাথার অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে, তার মানে এই সুঁচ কাছের মানুষদের দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণায় গেঁথেছে।
আলিঙ্গনে বিন্দু লেপ্টে থাকলেও করবী অনুভব করল ছোট্টো একটি দেহ জড়িয়ে ধরেছে তার পা। করবী না দেখেও অনুমান করল দেহটি কার! বিন্দুকে ছেড়ে সে ছোটো দেহের অধিকারিণীকে কোলে তুলে নিল। ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
‘হুতুম বুঝি আমাকে অনেক মিস করেছে?’

হুতুমের বাদামি নয়নে জলের সমুদ্র। টলমলে চোখের মেয়েটি অভিমানী স্বরে বলল, ‘তোমারে না মনে পড়লে কারে মনে পড়ব, বাণীর মা?’

‘তাহলে ক’টা দিন আমার কাছে থেকো?’

‘থাকতে তো মন চায়-ই কিন্তু আমি যে বিন্দুবালারে ছাড়া ঘুমাইতে পারি না। কত না মজা হইতো যদি এক লগে থাকতাম!’

হুতুমের হতাশায় সকলেরই মন খারাপ হয়। কথাটা তো কেবল একা হুতুমের না। সকলের মনেই এই এক টানাপোড়েন, ইচ্ছে আত্মাহুতি দিচ্ছে বারে-বারে। গম্ভীর পরিস্থিতি গমগমে করতে ভেসে এলো পুরুষ কণ্ঠ,
‘আমিও আসলাম। কিন্তু এমনে যে মূল্য পাবো না সেটা বুঝিনি।’
করবী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইল। হীরণ বসে আছে ড্রয়িংরুমে রাখা চৌকিটাতে। ঠোঁটে নিখাদ হাসি।

করবী হুতুমকে কোলে নিয়েই এগিয়ে গেল হীরণের কাছে। হাসি বজায় রেখেই বলল,
‘মূল্যবান মানুষ সবসময়ই মূল্যবান, নতুন করে আর কী মূল্য দিবো?’

‘তাই বলে একটু জিজ্ঞেসও করবে না কেমন আছি?’ হীরণের কণ্ঠে ফাজলামোর রেশ।
‘আপারে ছাড়া যে তুমি ভালা নাই হেইডা আপা ভালা কইরাই জানে। তাই আপা আর নতুন কইরা জিগায় নাই তোমারে।’
হীরণে প্রতিত্তোরে মজা করেই কথাটা বলল বিন্দু। কিন্তু কথাটা নিখুঁত সত্যি হওয়াই পাংশুটে হয়ে গেল করবীর মুখ। হাসি থেমে গেল হীরণেরও। করবী পরিস্থিতি ঘুরাতে বাহানায় ছুটে গেল রান্নাঘরে। বাবা ততক্ষণে চা বানিয়ে কাপে ঢেলে ফেলেছেন। বিস্কুট সাজিয়েছে প্লেটে। করবীকে দেখেই গাল ভোরে হাসলেন তৈয়ব হোসেন, ‘টাকা আছে তোর কাছে, মা?’

করবী চায়ের ট্রে-টা হাতে তুলে নিল। চোখের পলক ফেলে ইশারায় আশ্বস্ত করল, ‘আছে। চিন্তা করো না। আমি এখুনি বাজার যাব।’
মেয়ের বুদ্ধিমত্তায় খুশি হলেন বাবা। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘হুতুমটা প্রথম এলো একটু মুরগী আনিস। আর তিমির ছেলেটা একবার দুপুরে এসেছিল ফলমূল নিয়ে। ফোন নাম্বার থাকলেও ওকেও দাওয়াত করে দিস।’
করবী ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিয়েই ছুটল ড্রয়িংরুমে। ওরা ততক্ষণে রুম বদলে ড্রয়িংরুম থেকে বারান্দার রুমে চলে গিয়েছে। বাণীকে ছাড়া আড্ডা জমছে না তাই। অবুঝ পাখি—বাণীরও যেন প্রাণ ফিরে এসেছে ওদের দেখে। ছাড়া ছাড়া শব্দে, ডানা ঝাপটে আনন্দ প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে গেল পাখিটা।

করবী সুযোগ বুঝেই বাজারের ব্যাগটা নিয়ে আবার ছুটল বাজারে। সারাদিনের ক্লান্তি তার গা ছেড়ে পালিয়েছে সেই কখন। ওদের দেখলে মনের খোরাক এমনেই মিটে যায়। আর কী লাগে?

বাজার থেকে মুরগীর মাংস নিল, ইলিশ নিল একজোড়া। চকচকে রূপ ইলিশের। বিন্দুর আবার ইলিশ পছন্দ। পুরো বাজার খুঁজে চুনোপুঁটিও নিলো চওড়া দামে। হীরণের পছন্দ। বাবার জন্য শুঁটকি নিল। বাণীর জন্য বাদাম। কেবল থলের এক কোণা খালি রেখে নিলো না নিজের পছন্দের কিছু।
বাজার ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। ভারে হাত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম অথচ মনের আনন্দের কাছে তা বড়োই তুচ্ছ হলো। ঘড়ির কাটায় সময় তখন সাড়ে আটটা। নীল আকাশে তখন ভরা পূর্ণিমা। আজ বুঝি আকাশেরও আনন্দ ভীষণ। করবী তার ভাঙা মোবাইল দিয়ে তিমিরের ফোনটাতেও ছোটো একটি ম্যাসেজ করে দিল। আজ ভরপেট খাওয়া হোক। তারপর নাহয় মাস শেষে বাপ বেটি দু’দিন উপোস করে থাকবে। আজকের আনন্দ সেদিনের খিদে নিশ্চয় মিটিয়ে দিবে।

ম্যাসেজ শেষে মোবাইল ব্যাগে রাখতেই পথের বিপরীতে আনমনে দৃষ্টি গেল তার। চঞ্চল দৃষ্টি সেখান থেকে সরাতেই হৃদয় মাঝে কেমন যেন পরিচিত এক মুখ ভেসে উঠল। করবী আবার সেখানে তাকাল। ততক্ষণে পরিচিত মুখ অদৃশ্য। করবী ভীষণ মিলানোর চেষ্টা করল এ মুখ খানা কার। ভাবতে-ভাবতে হুট করে তার অস্বচ্ছ স্মৃতিতে জেগে বসল ভাবনা। বাবার বুকপকেটে থাকা নারীটির সাথে এই মুখের বড়ো মিল। বড়োই মিল। মৃত মানুষকে সে দেখল? এমন মতিভ্রম হলো তার? যাকে কখনো সে দেখেনি, ভাবেনি তাকে হঠাৎ রাস্তায় কেনই-বা দেখল?

#চলবে…

#বুকপকেটের_বিরহিণী
২০ এর বর্ধিতাংশ
কলমে: #মম_সাহা

নিঃস্ব শহরে দু’চোখ মেলে করবী দেখল, যাকে কখনো দেখার কথা ছিল না তাকেই দেখল সেকেন্ডের জন্য। বুকের উপর দেদার ওঠাপড়া শুরু হলো। শরীরে তখন অনাকাঙ্খিত ঘাম। সে সইতে পারছে না এই দৃশ্য। বার-বার স্মৃতি জানিয়ে যাচ্ছে এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য তার কাছে বড়োই যন্ত্রণার। ফুসফুস অক্সিজেনের অভাবে বার-বার থেমে-থেমে যাচ্ছে। চারপাশে এত স্নিগ্ধ বাতাস থাকতেও মনে হলো পৃথিবী ডুবে যাচ্ছে লেলিহান দাবানলে। সে সইতে পারছে না এ ডুবে যাওয়া। সে দাঁড়িয়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে তবুও কল লাগাল বাসায়। বাবার কাছে। অপরপাশে ফোন রিসিভ হলো মিনিট ব্যয়েই। করবীর কণ্ঠনালীটা কে যেন চেপে ধরে আছে। তবুও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, মা কই? মা যদি মারাই যান তবে তার মৃত্যু কাহিনী কেন বাবা গল্প করে আজও বলেনি? কেন বলেনি?

‘হ্যাঁ রে মা, বাজার করেছিস?’
বাবার প্রশ্নে কল্পনার ধূলিসাৎ হয়। করবী চমকে যায়। মায়ের গল্প শোনায়নি বলে যে বাবাকে সে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছিল সেই বাবাকেই আর মায়ের কথা বলে হয়ে ওঠে না তার। সে কথা ঘুরায়, ‘বাজার শেষ। আমি আসছি, আব্বু।’
তৈয়ব হোসেনের প্রফুল্ল কণ্ঠ, ‘সাবধানে আসিস।’
ব্যস্, কথা থেমে যায়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। অথচ করবীর কত কিছু জানার ছিল! ছোটোবেলার স্মৃতি তার কাছে আবছা কিংবা নেই বললেই চলে। কিন্তু যতটুকু জানে, তার অনেক কাছের মানুষ ছিল। আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর তারও একটা জীবন ছিল। তাহলে বাবা কেন সেই জীবনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছিলেন? নিশ্চয় গাঢ় কোনো কারণ আছে। নাহয় বাবা কখনো করবীকে এমন একা জীবন দিতেন না। আর কেউ না জানলেও বাবা তো জানত, তার মেয়েটার খুব কাছের মানুষ প্রয়োজন ছিল। তবুও যেহেতু বাবার এই কঠিন শপথ নিশ্চয় কারণ আছে। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই কারণ জানা যাবে না। এ যে সঠিক সময় নয় তা করবী ভালো করেই বুঝল। তারপর বুক ভোরে শ্বাস নিল। ছুঁড়ে ফেলল ক্ষাণিকের সেই দৃশ্য। কিন্তু মুছে ফেলতে চাইলেও কী সব মোছা যায়?

বাড়ি ফিরেই সব রান্না করল করবী। বিন্দু অবশ্য টুকটাক সাহায্য করেছে এসে। করবীর নিষেধ সে মানেনি। চঞ্চল হাতে সবকিছু এগিয়ে-পিছিয়ে দিয়ে ছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই ওরা চলে যায়। শূন্য বাসা আবারও খা-খা করে নিদারুণ শূন্যতায়। পুরো পৃথিবী নীরব হতেই করবী গিয়ে বসল বারান্দায়। বাণী ঘুমাচ্ছে। আগের মতন এ বারান্দাতেও চেয়ার আছে। তবে এ বারান্দায় বসলে বিল্ডিং দেখা যায় না। দেখা যায় একটি পার্ক। জন-মানবহীন পার্কটির মাঝে থাকা পুকুরে টলমল করে জোছনা দোলার দৃশ্য করবী নয়ন মেলে দেখে। বৈরাগী তার ভাবনারা। বাবা ঘুমিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ঘুম নেই করবীর চোখে। মা নেই ব্যাপারটা মস্তিষ্কে এভাবে জেঁকে বসেছে যে ঘুম আসছে না। কত চেষ্টা করল মায়ের মুখটা মনে করতে! মনে পড়ল না। কেবল মাথায় অদম্য যন্ত্রণা হলো। ছোটো বেলাতে এই যন্ত্রণা হতো তারপর বহুবছর গেল আর হয়নি। আজ নতুন করে কেনইবা পুরোনো সব ফিরে আসার ঘ্রাণ পাচ্ছে? যা চলে যায় জীবন থেকে তা ফিরে আসা সবসময় কী সুখের হয়? নাকি শোকের হয়? করবী ভাবতে পারছে না কিছু। দু-চোখ মেলে পদ্মহীন পুকুরটাতে তাকিয়ে রইল। জল থৈথৈ পুকুরটাতে কেবল পূর্ণিমা ভাসছে নেই কোনো ফুল। করবীর জীবনের সাথে এই ছোট্টো পুষ্করিণীর কতটা মিল! কেবল অমিল একটায়, পুকুরটার জোছনা থাকলেও করবীর তা নেই। চারপাশ কেবল অন্ধকার, কালো।

বিদিশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে, এক ধ্যানে। তন্মধ্যেই তার শাশুড়ি তাসনীম বেগম উদ্ভ্রান্ত পায়ে ঢুকল রুমে। চোখে-মুখে চিন্তা। বলল,
‘তুষারের সাথে তিমিরের কথা হয়েছে কি-না একটু জিজ্ঞেস করবে, বউ? ওদের ওখানে নাকি বরফ বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ বাসা থেকে বের হতে পারছে না। ছেলেটা সেই দূরদেশে কেমন আছে, কে জানে!’

শাশুড়ির কথায় বিচলিত দেখা গেল না বিদিশাকে। সে রইল শান্ত নদীর মতন শীতল। অথচ এই শীতলতা সহ্য হলো না তাসনীম বেগমের। সে বিরক্ত হলো, অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
‘পরেও তো চুল আঁচড়ানো যাবে। গিয়ে দেখো না তিমির কী বলে।’
‘যাবো। হাতের কাজ শেষ হোক।’
ছেলের বউয়ের এমন উদাসীনতায় বিরক্তি যেন তাসনীম বেগমের হুর হুর করে বাড়ল। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘স্বামীর প্রতি মায়া-মহব্বত তোমার অন্তরে নেই একটুও। অথচ তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে আমি আমার ছেলের শক্র হলাম।’

হিংস্র কণ্ঠে কথাটা বলেই থম মেরে গেল ভদ্রমহিলা। ততক্ষণে চিরুনি থেমে গেছে বিদিশারও। সে আয়নার মাঝেই শাশুড়ির প্রতিবিম্বর দিকে চাইল। শাশুড়ির কাচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল খানিক। তবে এ হাসি তাচ্ছিল্যের ত্রাস ছুঁড়ে মারল নিঃশব্দে। বিদিশা হাতের চিরুনি নামিয়ে রেখে খুব ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘আমি কী বলেছিলাম আম্মু আপনাকে শত্রু হতে?’
তাসনীম বেগম নিশ্চুপ। প্রতিত্তোরের ভাষা নেই।
‘বললেন না যে, আম্মু? আমি কী বলে ছিলাম এমন কিছু করতে?’
‘মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে, বউ।’
‘আম্মু, কাউকে ভুলবশত মেরে ফেললে যেমন বাঁচানো যায় না তেমন মুখ ফসকে বের হওয়া কিছু কথার ক্ষত কখনো মুছে যায় না।’

তাসনীম বেগমের লজ্জায় মুখ ছোটো হয়ে এলো। অপরাধীর মতন চুপসে গেল মানুষটা। নত মস্তকে বলল,
‘আমার কথায় কষ্ট পেও না, বউ। আসলে সন্তানের প্রতি চিন্তা থেকে বলে ফেলেছি।’
কথা শেষ করেই গটগট পায়ে প্রস্থান নিলেন ভদ্রমহিলা। বিদিশার ঠোঁটে তখনও বিষাদ হাসি লেপ্টে। শাশুড়ি বের হতেই সে ধপ করে বসে পড়ল খাটে। বিড়বিড় করে বলল,
‘আপনার এতটা কাছে থেকেও আমি কখনো কেন আপনার সন্তান হতে পারলাম না, আম্মু। কেন ছেলের বউ হয়েই দোষের ভাগীদার হয়ে থাকলাম? অথচ কোথাও আমার কোনো অন্যায় ছিল না। তবুও পুড়তে হলো আমাকে।’
হতাশার তেতো দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল স্বচ্ছ বাতাসে। বিদিশার চোখে ভেসে উঠল সুন্দর একটা সংসার হওয়ার কল্পনা। জীবনের প্রথম এক নিঃসঙ্গ দুপুরে সে যেই ছেলেটাকে স্বামী এবং পুরো জীবন ভেবে কবুল বলেছিল, সেই ছেলের ব্যাথার দাগ হয়ে থেকে যাবে কখনো ভাবতে পারেনি। অথচ ভুক্তভোগী হয়েও আসামীর মতন জীবন কাটাল সে? দিনশেষে সবাই সবার সম্পর্ক, আবদার, অভিমান নিয়ে ভালো রইল। কেবল একটি সংসারে ফেলনা আসবাবপত্র হয়ে থেকে গেল সে।
নারীর এমন কত গল্প কেউই জানবে না। কখনোই না।

রাত তখন আড়াইটা। পুরো পৃথিবী ঘুমন্ত রাজপুরী হয়ে গিয়েছে। কেবল এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে চাঁদ হাসছে অকৃত্রিম। করবীর ঘুম ভেঙে গেল হুট করেই। বাজে একটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নটা কেমন ছিল ঠিক ঠাহর করতে পারল না। কেবল কানের মাঝে স্বপ্নের কণ্ঠ গুলো তখনও বাজছে। এত দ্রুত ভুলে গেল স্বপ্নটা! কী নিয়েই-বা দেখেছিল?
ঘুম ভাঙতেই ফোনের রিং টোন নিঃশব্দতা ভেদ করে কানে বাজতে লাগল। মস্তিষ্ক তখনও সচল হয়নি। যখন পুরোপুরি স্থির হলো তখন দ্রুত গিয়ে ফোনটা তুলল। তিমিরের নাম্বার। এত রাতে লোকটার কল দেখে কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে গেল মেয়েটার। সে সাথে সাথে রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে তিমিরের সুমিষ্ট কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘ঘুমিয়ে ছিলে?’
‘হ্যাঁ। চোখ লেগে গিয়েছিল আরকি।’
করবীর উত্তরের পর-পর অপর পাশ থেকে অভিযোগ এলো,
‘এ তো ভারী অন্যায়, মেহমানকে আমন্ত্রণ করে না খাইয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছ!’

তিমিরের এহেন কথায় ভ্যাবাচেকা খেল করবী, ‘জি?’
তিমির এবার ভাব-ভঙ্গিমা ছাড়াই সোজাসাপটা বলল,
‘খিদে লেগেছে ভীষণ। আমার ভাগের খাবার গুলো নিয়ে কষ্ট করে নিচে আসবে?’
করবী চমকাল, ‘আপনি কোথায় এখন!’
‘কোথায় আর থাকবো? খাবার খেতে উদাস ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যদি একটু মায়া-মমতা হয় তবে দেখা দিও।’

কথাটা বলেই কল কেটে দিল লোকটা। করবী দিশেহারা হয়ে রান্নাঘরে গেল। সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে নিয়ে ছুটল বাড়ির নিচে। বাড়ির মেইন গেইট হা করে খোলা। দারোয়ান ঝিমাচ্ছে। নিশ্চয় তিমিরই খুলিয়েছে গেইটটা!
করবী অপেক্ষা না করে পা বাড়ায় পথে। গেইট পেরুতেই সাদা ঝকঝকে গাড়িটা চোখে পড়ে তার। কালো পাঞ্জাবি পরে গাড়িটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটিকেও অতঃপর চোখে পড়ে। করবী বিচলিত পায়ে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি গিয়েই শুধায়, ‘এত রাতে!’
‘তুমি ডাকলে আর আমি আসব না?’
তিমিরের কথায় লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে মেয়েটা। মিনমিন করে বলে, ‘বাসায় গেলেই পারতেন।’
‘আমার রাস্তায় খেতে অসুবিধা নেই।’

করবী এক হাতে থাকা পানির বোতলটা গাড়ির উপর রাখে। দ্বিতীয় হাতে থাকা খাবারের থালাটা এগিয়ে দেয় তিমিরের দিকে। শুধায়,
‘এত রাত হলো যে?’
‘তুমি জানোনা? রাত গভীর হলে চাঁদের সৌন্দর্যতা বেশি বৃদ্ধি পায়। সেই বেশিটা কতটুকু সেটাই পরীক্ষা করতে এলাম।’
তিমিরের হেঁয়ালি উত্তরের গভীরতা বুঝল না মেয়েটা। বরং বোকা চোখে নিজেও চাঁদের দিকে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘কই বেড়েছে? আগের মতনই তো!’
তিমির এবার শব্দ করে হেসে দিল। ফিচলে কণ্ঠে বলল,
‘এই সৌন্দর্য তুমি দেখতে পাবে না। এ সৌন্দর্য দেখতে পায় কেবল প্রেমিক চোখ। এই যে চাঁদের ঘুম ঘুম চোখের ফুলো পাতা, নাকের চটচটে তেল ভাব, ঠোঁটের শুষ্কতা…… এসব তুমি দেখতে পাচ্ছো?’

করবী তিমিরের কথার আগামাথা পেল না। অদ্ভুত চোখ-মুখ করে বলল,
‘চাঁদের চোখ-মুখ হয় নাকি? কী বলছেন? কই আপনার চাঁদের চোখ-মুখ?’

তিমির এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে বলল, ‘নীল ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া চাঁদ। যার সৌন্দর্য ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝকঝক করছে। যার জোছনায় প্রেমিক বুকের শিউলি কানন হৃদয়ে ফুল ফুটেছে। দেখতে পাও কী তা? প্রেমের অভাবে কীভাবে আমি রাতের নিশাচর হয়েছি, বুঝতে পারো কী তা, চাঁদ?’

#চলবে…..

#বুকপকেটের_বিরহিণী
২১ পর্ব:
কলমে: মম সাহা

(৩১)
দক্ষিণের আকাশে শরৎ আসার ঘ্রাণ। মেঘ গুলো সব ভাসা ভাসা আসমান জুড়ে। করবীর পড়াশোনার পার্ট চুকেবুকে গেছে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে দীর্ঘ ছুটি মিলল।
ঘুড়িকে পড়াতে এসেছে আজ একটু তাড়াতাড়িই। দরজা খোলা ছিল। বিদিশা ড্রয়িং রুমে বসে কাথা সেলাই করছিল সেজন্য দরজা খোলা। মেয়েটা গোসল করছে। করবীকে দেখেই গাল ভোরে হাসল বিদিশা, ‘ভালো আছো, আপু?’

করবী হেসে টেবিলে বসল। উত্তর দিল, ‘ভালো। তুমি ভালো আছো, ভাবি?’
‘এই তো ভালো। তুমি বসো, আমি আসছি। ঘুড়িরও বোধহয় গোসল শেষ হলো বলে।’

করবী ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিতেই বিদিশা উঠে গেল। নিরিবিলি ভাব ভেঙে হুট করে একটা গুনগুনিয়ে গানের শব্দ কোথা থেকে এসে যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। করবী মনোযোগ দিতেই বুঝল ঘুড়ির কণ্ঠ। মেয়েটা চমৎকার গান জানে তো! কী সুরেলা সুর!
ঘুড়ি গুনগুন করতে করতে বাহিরে এসে করবীকে দেখে বেশ বিব্রতবোধ করল। হাসল খানিক,
‘আসসালামু আলাইকুম, মেম।’
করবী সালামের জবাব দিল। প্রশংসা করে বলল, ‘তোমার গানের কণ্ঠ ভীষণ সুন্দর, ঘুড়ি। গান শিখেছিলে বুঝি?’

ঘুড়ি লাজুক হাসল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল, ‘শিখতাম। এখন আর যাই না গানের ক্লাসে।’

করবীর কৌতুহল বাড়ল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘কেন যাও না?’

কেন’র জবাব দিতে গিয়ে ঘুড়ির লজ্জায় মাখো মাখো অবস্থা হলো। করবী দেখল ঘুড়ির হাবভাব। সাবলীল ভাবে প্রশ্ন করল,
‘তোমার বাবা-মা বুঝি পছন্দ করেন না?’

করবীর প্রশ্নে ঘুড়ি চমকাল। থতমত খেয়ে বলল, ‘না, না। তেমন না।’
‘তবে..?’

ঘুড়ি মাথা নামাল, বিড়বিড় করে বলল, ‘বিদিশা ভাবীর দেবর পছন্দ করেন না।’

ঘুড়ির কথা বোধগম্য হলো না করবীর। আরেকজনের অপছন্দ দেখে মেয়েটা গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছে ব্যাপার বড়োই অসামঞ্জস্য লাগল তার কাছে। তবে সে আর প্রশ্ন করল না। ঘুড়ি এসে বসল। নিজ মনে পড়াও শুরু করল। বাহির থেকে তখন উষ্ণ বাতাস আসছে। রুমের পর্দা উড়ছে। চারপাশ নিরিবিলি। ঘর জুড়ে কেবল ঘুড়ির পড়ার শব্দ। ঘুড়ি পড়তে-পড়তে হুট করে চুপ করে গেল। করবী তখন অন্য ধ্যানে মগ্ন। ঘুড়ি দোনোমোনা করে ডাকল,
‘মেম।’
করবীর ধ্যানে ভাঁটা পড়ল। সে কিছুটা ঘোরের মাঝেই বলল, ‘হু, হ্যাঁ?’

‘একদিন বিকেলে আমি গিটার বাজাচ্ছিলাম। বিদিশা ভাবীর দেবর হুড়মুড় করে দরজায় আসলেন আমার। তারপর রুক্ষ কণ্ঠে বলেছিলেন, “ঘুড়ি, গিটারটা ধীরে বাজাও। আমার শব্দ পছন্দ না।” তারপর থেকে আমার গিটারে কখনো সুর উঠেনি।’

ঘুড়ির কথায় করবীর ভ্রু কুঁচকালো। নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘কী অ ভ দ্র লোকরে! তুমি উনার কথা শুনতে গিয়েছ কেন? অদ্ভুত!’
‘মেম, তাকে অ ভ দ্র বলবেন না। আমি গিটারের সুর তো তার জন্যই বাজতো। সে চায় না বলে আর বাজে না। তাকে মুগ্ধ করতে না পারলে সেই গিটার বাজিয়ে কী লাভ!’

করবীর কাছে এবার ব্যাপারটা স্বচ্ছ। সাদামাটা কাহিনীর ভেতরেও যে প্রেমের একটা গল্প আছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। ত্ই সে ফিক করে হেসে দিল। ঘুড়ির গাল টেনে বলল,
‘ও বাবা! এখনই এসব। তোমার কিন্তু বয়স কম, ঘুড়ি। সাবধান।’

ঘুড়িও হাসল তাল মিলিয়ে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘কেবল ভালো লাগে মেম। এর বেশি কিছু না।’
‘হয়েছে, এবার পড়ো।’

_

গুমোট গরম পড়েছে চারপাশে। হীরণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাইকের পাশে সিগারেট ফুঁকছে। চারপাশ থেকে তখন ব্যস্ত মানুষের পদচারণ। সিগারেটে শেষ টান টুকু দিতেই তার সামনে উপস্থিত হলো হুতুম। এসেই আধো কণ্ঠে বলল,
‘মাস্তান, তুমি এইহানে কী করো?’

হীরণ হুতুমকে দেখে নিটোল সুন্দর হাসল, ‘তোমার জন্য দাঁড়ায় আছি।’

‘তুমি কেমন কইরা জানো আমি যে আসুম?’
‘জাদু।’
‘তুমি জাদু জানো?’ হুতুমের চোখে চকচক করছে বিস্ময়। তা দেখে হাসল হীরণ। মাথা উপর-নীচ নাড়িয়ে বলল,
‘তা একটু জানি।’

কথা শেষ করেই হুতুমকে কোলে তুলে নিল হীরণ। চুল গুলো আলগোছে গুছিয়ে দিল। শুধাল,
‘কিছু খাবে?’
হুতুম আদুরে ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টালো। ভাবুক স্বরে বলল,
‘আমি তো বিন্দুবালার লাইগ্যা এইহানে আইসা দাঁড়াইছি। কিছু খাইতে না।’
‘খাও কিছু।’
‘খাবো? কিন্তু বিন্দুবালা যে কইলো, কেউ কিছু সাধলে যেন না খাই।’
‘সেটা তো অপরিচিত মানুষের জন্য। কাছের মানুষদের জন্য এ নিয়ম না।’
হীরণের আশ্বাস বাণীতে যেন হুতুম খুশি হলো। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
‘চলো চিপস খাই।’

হীরণ রাজি হলো। হুতুমকে গাড়িতে বসিয়ে বাইক টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে গেল। একটা দোকান থেকে চিপস্ আর কোক কিনে মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো। হুতুমের কী খুশি! খুশি যেন ধরেই না! বাদামি মনি গুলো খুশিতে চকচক করছে। গোলাপি, চিকন ঠোঁট গুলো বাচ্চাটার মুখের সবচেয়ে সুন্দর অঙ্গ যেন! হীরণ মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে রইল। হুতুম মোটেও ওর বাবা-মায়ের মতন হয়নি। বিন্দুর সাথে চেহারা খানিক মিল। বলা যায় বড়ো বোনের আংশিক পেয়েছে। কিন্তু পুরো চেহারায় বিদেশীয়ানা রয়েছে।
হীরণের ভাবনার মাঝেই হুতুম লাফিয়ে উঠল,
‘মাস্তান, দেহো দেহো, বাণীর মা যায়। বাণীর মা, ও বাণীর মা….’

হুতুমের ডাকে হীরণও সেদিকে দৃষ্টি ফেলে। রুবী যাচ্ছে ভেবে সে বার কয়েক ডাকও দেয় তবে মেয়েটা তাদের দিকে ফিরেও চায় না। হীরণের খটকা লাগে, রুবী তো কখনো বোরকা পরে না। তাছাড়া রুবীর ডান গালে থাকা তিলটাও চোখে পড়ল না! কিন্তু একটা মানুষের আদৌ এত মিল হয়! এই অতি আশ্চর্যান্বিত ঘটনায় লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল হীরণের। এতটা মিল কারো মাঝে হতে পারে? হীরণ তৎক্ষণাৎ করবীকে কল করে জিজ্ঞেস করেই জানতে পারে করবী তাদের বাসার গলিতে। বাসায় ফিরছে। তাহলে এই মেয়েটা রুবী না, অন্য কেউ।

তিমির হাঁটছে করবীর পাশে। মেয়েটার চোখে-মুখে চিন্তা। তিমির বেশ কিছুক্ষণ যাবতই খেয়াল করছে করবীর চিন্তিত ভাবভঙ্গি। অবশেষে না পেরে শুধাল,
‘কোনো সমস্যা?’
করবী আচমকা প্রশ্নে থতমত খেল। আমতা-আমতা করে বলল,’না।’
‘নতুন টিউশনিটা তো দেখি আমাদের গলিতেই নিয়েছো!’
করবী কিঞ্চিৎ অবাক হলো, ‘ওটা আপনাদের এলাকা?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভালো তো।’
‘একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো। কেমন? যাবে তো?’
শেষের প্রশ্নটায় যেন আকাশ সমপরিমাণ সংকোচ এবং সংশয় ছিল। করবী পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল তিমিরের দিকে। চোখে-চোখ পড়ল। বসন্ত এসে যেন ধরা দিলে বুকের বা’পাশে। হৃদপিন্ড বোধহয় দু-তিনবার শব্দ করতে ভুলে গেল। ব্যস্ত পথ হয়ে গেল রূপকথার রাজপুরী। করবী লাজুক হাসল,
‘যাব।’

করবীর ছোট্টো উত্তরে যেন খুশি হয়ে গেলে তিমির। হুট করে সে একটা বাচ্চামো করে বসল। কাকে যেন কল লাগাল। রাশভারি কণ্ঠে বলল,
‘ভাবি, আপনার শাশুড়িকে বলবেন, তিমির তার গন্তব্য পেয়ে গিয়েছে।’

তিমিরের করা হঠাৎ কাজে করবীর গাল লাল হয়ে গেলে। গোলগোল আঁখিদুটিতে লজ্জা ধরা দিল। মেয়েটা ছুটে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। তিমিরের মুখে হাসি। অতীত ফিরে পাওয়ার সুখ তার অঙ্গে-অঙ্গে।

রাতের গহীনে চাঁদ হারিয়ে অমানিশায় ছেয়ে গেছে পৃথিবী। করবী দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণহীন বারান্দায়। চোখ-মুখ শুকনো। তৈয়ব হোসেন বেশ কয়েকদিন যাবতই মেয়ের এহেন উদাসীনতা দেখছেন। সন্তানের এমন উদাসীনতায় তারও যে বুক পুড়ে। অবশেষে আজ না পেরে তিনি উপস্থিত হলেন। বুকের মাঝে অদম্য সাহস সঞ্চার করে এলে। ডাকলেন করবীকে,
‘রক্তকরবী…ঘুমোসনি যে?’

করবীর চমকে যাওয়া উচিত ছিল বাবার অপ্রত্যাশিত কণ্ঠে। কিন্তু সে চমকাল না। বরং ধীর স্বরে বলল, ‘অবশেষে সাহস করলে তবে?’

তৈয়ব হোসেন চমকালেন মেয়ের হেঁয়ালি প্রশ্নে। হয়তো বুঝলেন আবার বুঝলেন না ভাব করে বললেন, ‘কী বলছিস?’
‘আমাকে কেন আঁধারে রাখছ, বাবা? আমার কী সবটা জানার অধিকার নেই?’
তৈয়ব হোসেন বিব্রত হলেন তবে বুঝত দিলেন না। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী জানার কথা বলছিস?’
‘মা কোথায়, বাবা?’

করবীর সামান্য প্রশ্নে অস্বাভাবিক কম্পন দেখা দিল তৈয়ব হোসেনের মাঝে। বহু কষ্টে তিনি উচ্চারণ করলেন,
‘ম রে গিয়েছে। বেঁচে থাকলে তো সাথেই থাকতো।’
করবী হু হা করে হাসল। ভগ্ন কণ্ঠে শুধাল, ‘দূরে যাওয়া মানেই তো মরে যাওয়া না, তাই না?’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে