বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২+৩

0
351

#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা

দ্বিতীয় পর্ব:

পথের ধারে ঝিমিয়ে এসেছে রোদ। একটি ক্লান্ত সন্ধ্যা তখন। শহরের পথ-ঘাট সেজে উঠেছে কৃত্রিম আলোয়।
করবী টিউশনি করিয়ে বের হয়েছে মাত্র। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। টিউশনির বাসায় স্টুডেন্টের আম্মুর কাছে সে আগামী মাসের বেতন অগ্রীম চাইতেই মহিলা কেমন উগ্র আচরণ দেখালেন। মুখ ঝামটি দিয়ে বললেন, ‘এত টেকা টেকা না কইরা একটু ভালো কইরা পড়াইবার মন দিলেও তো পারো। আমার পোলার হাতের লেখা দিনদিন বাজে হইতাচে হেইটা দেখবার পারো না? তাছাড়া আমরা কী হেই(সেই) মানুছ যে টিচারদের টেকা পয়ছা ছময় মতন দিবার পারি না।’
করবী আর কথা বাড়ালো না। এই স্টুডেন্টের মা একদম জন্মসূত্রে ঢাকার বাসিন্দা। তাই তার কথাবার্তায় আঞ্চলিক ভাব-সাব এবং আচার-আচরণে কিছুটা রুক্ষতা আছেই। তাই মহিলার সাথে আর কোনো কথা না বাড়িয়েই সে বাড়ি ত্যাগ করল। তার কাছে যদি সামান্য কিছু টাকা থাকতো তাহলে সে জীবনেও এ বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতো না। শিক্ষকতা পেশা সম্মানের, সেই সম্মানই যদি না পায় তবে এ’ পেশা করানোর মানে হয় না। কিন্তু কী করার! পেটের জন্য কখনো পিঠের মাইর সহ্য করতে হয়। পেট চালানোর জন্য সম্মান কখনো সখনো বিসর্জন দিতে হয়। তবে মধ্যবিত্তের যে সম্মান বেশি দামী!

বাকিদের কাছে অগ্রীম বেতনের কথা বলেনি সে, ভেবেছিল এই পরিবারটি যেহেতু বেশ স্বচ্ছল তাই চাইলেই মেডামের বেতন তারা হয়তো মাসের আগেই দিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু করবী বুঝেনি, এদের অর্থ থাকলেও যে মানসিকতায় অনেক ঘাটতি আছে। বুকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস এবং মাথায় এক ঝাঁক চিন্তা নিয়ে সে যখন ফুটপাতে হাঁটা আরম্ভ করল ঠিক তখন পেছন থেকে তার ডাক এলো,
“মেডাম, একটু দাঁড়ান।”

করবী দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে দেখলো তার বারো বছরের ছাত্রটি দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। হয়তো ছুটে এসেছে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাত্রই তো ওদের বাসা থেকে বের হলো, তাহলে কোন কারণে আবার ছেলেটি এখানে এলো? করবীর ভাবনার মাঝেই সুন্দর গোলগাল ছোটো ছেলেটি এগিয়ে এলো। মেডামের পাশে দাঁড়িয়ে সে এক গাল হাসল। করবী বাচ্চাটির মায়ের আচরণ ভুলে ছেলেটির ফুলো ফুলো গাল গুলো টেনে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“অর্পণ, তোমার এখানে কী? কোনো কাজে এসেছো?”

অর্পণ মাথা নাড়াল উপর-নীচ। তারপর ব্যস্ত ফুটপাতে একবার চোখ ঘুরিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“মেডাম, তুমি কী কষ্ট পেয়েছো আম্মুর কথায়? কষ্ট পেয়ো না, তুমি তো জানো আম্মু কেমন!”

করবী ভারী অবাক হলো অর্পণের এমন কথায়। ছেলেটা বেশ চঞ্চল ও দুষ্টু। প্রথম যেদিন ও গেল পড়াতে, সেদিন করবীর হাতে কামড় লাগিয়ে দেয় অর্পণ। চুল টেনেও ধরেছিল। কিন্তু করবী ধমকা ধমকি করেনি মোটেও। তারপর এই বাঁদর ছেলে কীভাবে কীভাবে যেন করবীর ভক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর সে এই মেডামকে ছাড়া আর কিছু কল্পনাও যেন করতে পারেনা। বাচ্চাটিও কি তবে তার মায়ের এমন পর্দা হীন আচরণে লজ্জা পেলো!

করবীর ভাবনার মাঝে অর্পণের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মেডাম, শুনো…….”

করবী ভ্রু উঁচু করে শুধায়, “কী?”

অর্পণ তখন সাবধানী হাতে পকেট থেকে টাকা বের করে। এক হাজার টাকার তিনটি কচকচে নোট। সেটা করবীর সামনেই অন্য পকেট থেকে খাম বের করে টাকা গুলো খামের ভেতর ঢুকিয়ে করবীর হাতে দেয়। তারপর গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বলে,
“নেও তোমার সম্মানী। আব্বুর কাছ থেকে জন্মদিন উপলক্ষে এটা নিয়েছিলাম। বলেছিলাম বন্ধুদের খাওয়াবো। কিন্তু আমার বন্ধুদের খাওয়ার থেকেও তোমার এইটা বেশি প্রয়োজন, তাই তুমি রেখে দাও। তোমাকে যখন আম্মু দিবে সম্মানী, তখন নাহয় আমারটা আমাকে শোধ করে দিও? বুঝোই তো প্রেস্টিজ ইস্যু। বন্ধুরা নাহয় খেপাবে।”

করবী অবাক হয়। বিস্ময় পৌঁছে যায় আকাশ অব্দি। সে দ্রুত খামটা অর্পণের দিকে বাড়িয়ে দেয়,
“এমা, অর্পণ! তুমি তোমার টাকা কেন আমাকে দিয়েছো, বোকা ছেলে? মেডামের অতটাও প্রয়োজন নেই টাকা। তুমি রেখে দাও এগুলো। আর কখনো এমন করবে না কেমন? যাও বাসায়।”

করবী টাকাটা দিলেও অর্পণ নিল না। বরং মাথা নামিয়ে ফেলল। খুব ধীরে বলল,
“আম্মুর কাছে টাকা চাওয়ার সময় যে তোমার চোখ থেকে পানি পড়েছিল সেটা আম্মু না দেখলেও আমি দেখেছি। তুমি নেও এটা, মেডাম। পরে শোধ দিয়ে দিও, কেমন?”

কথাটা বলেই বাচ্চাটা ছুটে চলে গেলো। করবী বার কয়েক পিছু ডাকলেও বাচ্চাটির মাঝে থামা থামির কোনো ভাব দেখা গেলো না। ছেলেটার ছুটন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে করবীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। একটা বারো বছরের বাচ্চাও আজ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে? সৃষ্টিকর্তা একটা পথ বন্ধ করলে আরো সাতটা পথ খুলে দেন- কথাট মিথ্যে নয়। অথচ তাও আমরা কত অভিযোগ করি!
করবীর সকালের লোকটার কথা মনে পড়লো। কতজনের কাছে সে ঋণী হয়ে যাচ্ছে! তাও আমরণ কৃতজ্ঞতা নিয়ে।

৩.

করবীর ছোটো বারান্দায় এখন রজনীর তমসা খেলা করছে। ঝিঁঝি ডাকছে অনবরত। ঘরে কারেন্ট নেই। ইদানীং রাত হলে কারেন্ট থাকে না। গরম বাড়ছে তো তাই। করবী মাত্রই খাওয়া দাওয়া করে বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। আসার সময় ছোটো ছোটো দু’টি রুই মাছ নিয়ে এসেছিল। বাবা সেগুলোই রান্না করেছে। করবীই কেটে-বেঁটে দিয়েছে, রান্নাও করতে চেয়েছে কিন্তু বাবা দেয়নি। বাবা হয়তো বুঝে মেয়ের ক্লান্তির ইতিহাস। রান্না সুস্বাদু হলেও করবী খেতে পারেনি তেমন। ক্ষুধা বেশি থাকায় অল্পতেই পেট ভোরে গেছে। তাছাড়া আজকাল অনেকদিন পর পর মাছ খেতে পাচ্ছে তো, তাই মাছের প্রতি কেমন অভক্তি এসে গেছে। অথচ এই করবীই আগে মাছের মাথা না হলে ভাত খেতো না।
সারাদিনের অজস্র ক্লান্তি যেন ঝরঝর করে লুটিয়ে পড়ল শরীরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। পুরুষ মানুষ বলে, নারীদের আর কি চিন্তা? বেকারত্ব কেবল থাকে পুরুষদের। দায়িত্ব তো থাকে কেবল পুরুষদের। কিন্তু পুরুষ যদি একবার পরিবারের সে মেয়েটিকে দেখতো, যার মাথার উপর বড়ো ভাই নেই, বাবার নেই রোজগার…… তার প্রতিদিনের যুদ্ধটা কত ভয়ঙ্কর হয়। প্রতিনিয়ত তার বাঁচতে হয় সমাজের সাথে যুদ্ধ করে, মানুষের লোলুপতার সাথে যুদ্ধ করে এবং নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে। পুরুষেরা এই ক্ষেত্রে একটা জিনিস থেকে বেঁচে গেছে। তাদের অন্তত প্রতিনিয়ত কারো লোভের সাথে যুদ্ধ করা লাগছে না। নিজের চরিত্রে দাগ লাগার ভয়ে তটস্থ থাকা লাগছে না।

বারান্দার গ্রিল ভেদ করে সামন্যই বাতাস আসছে তবে এতটুকুই শরীরকে প্রশান্তি দিচ্ছে। সেই প্রশান্তিতে করবীর চোখ লেগে যায়। ঝিমুতে ঝিমুতে এক সময় তলিয়ে যায় ঘুমের দেশে। ঘুমের মাঝেও মেয়েটা কী ভেবে যেন বার কয়েক শিউরে ওঠে। তৈয়ব হোসেন বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই দেখে। বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে। বাবা হয়ে সন্তানের দুঃখ চোখ মেলে দেখা ছাড়া তার উপায় নেই আর! কী দুর্ভাগা সে!
করবী ঘুমের মাঝে বার কয়েক কেঁপে কেঁপে উঠে। কি জানি, মধ্যবিত্তের এই সিন্ড্রেলা কোন রাক্ষসীর স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছে৷ অবশ্য গরীবের জন্য বড়ো রাক্ষসী তো তার অভাব অনটন। তৈয়ব হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই ঘুমন্ত মেয়েটির কপালের ভাঁজ শিথিল হয়ে আসে। ভরসার হাত টুকু পেতেই মেয়েটি নিশ্চিন্তে ঘুমায়। কারণ মেয়ে তো জানে, বাবা গরীব হোক কিংবা বড়োলোক…. তার কাছে তার মেয়ে সবসময় রাজকন্যা। আর বাবা কখনো সেই রাজকন্যার ক্ষতি হতে দিবে না।

৪.

টাকা হারানোর কথাটা গোপনেই রাখল করবী। বাবা অসুস্থ, এর মাঝে এই খবরটা পেলে বাবা চিন্তায় হয়তো আরও অসুস্থ হয়ে পরবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলবে। যদি আরও কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নেওয়া যায় তাহলে তো খারাপ হবে না।
সময়টা সকাল আনুমানিক দশ-টা। যথারীতি নিয়মে তৈরী হলো করবী। নিয়ম অনুযায়ী বারান্দায়ও গেলো। বাণী নামক টিয়া পাখিটা আবারও ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বলল,
“সই, সই, সই, মনের কথা কই?”

করবী সম্মতি জানালো। তবে মনের কথা বলতে পারার অনুমতি পেয়েও বাণী মনের কথা বললো না। অনুমতিকে আপোষ করে গেলো নিঃসংকোচে। করবী হাসল। যেদিন বাণী প্রথম কথা বলল স্পষ্ট, সেদিন তার সাথে দু’টি অবাক ঘটনা ঘটেছিল। রাস্তায় একটি ছোটো বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছিল। সে বাচ্চাটিকে তার বাবা-মা এর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। বাচ্চাটির মা বেশ আন্তরিকতার সাথে করবীকে বার বার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। এবং পরবর্তীতে দুই বছরের সেই মেয়ে বাচ্চাটির নাম নতুন করে সেই ভদ্রমহিলা রেখেছিলেন- করবী। যেহেতু করবীর মাধ্যমে নতুন করে আবার নিজের কন্যাকে খুঁজে পেয়েছিল। এরপর অবশ্য ওদের সাথে করবীর আর দেখা হয়নি৷ ওরাও করবীর বাসা চিনতো না যে আসবে। করবীরও আর সময় হয়ে উঠেনি যাওয়ার। এবং দ্বিতীয়টি হলো, করবীর বাবা তৈয়ব হোসেনের মুখটা হালকা বাঁকিয়ে গিয়েছিল একবার মিনি স্ট্রোক করে। অনেক চেষ্টার পরও পুরোপুরি মুখটা সোজা হয়নি। অথচ সেদিন তৈয়ব হোসেনের মুখটা নিজে নিজে সোজা হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্যকর ভাবে ভদ্রলোক আগের মতন পরিষ্কার কথাবার্তা বলতে শুরু করল।
সে যুক্তি অনুযায়ী করবীর মনেহয় বাণী যেদিন মনের কথা বলতে পারবে সেদিন হয়তো আরেকটি আশ্চর্যজনক কিছু ঘটবে। হয়তো আরও একটি বিস্মিত কিছু। করবী তাই দিন গুনে, মনে মনে ভাবে বাণী আরো কয়েকদিন সময় বেশি নিয়ে তারপর মনের কথা বলতে শিখুক। এখনও করবীর দুঃখগুলো বাঁধ ভাঙেনি। যেদিন বাঁধ ভাঙবে, পুরো পৃথিবী অসহায় লাগবে, সেদিন নাহয় এই আশ্চর্য জনক ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটবে। করবীর আবারও ধৈর্য ধরার অনুপ্রেরণা জাগবে।

আজকে কোনোমতে খাবার খেয়েই বেরিয়ে গেলো করবী। প্রথমে টিউশনি গুলো একে একে শেষ করল। চারটা টিউশনি করিয়ে বের হতে হতে বাজল আনুমানিক সাড়ে চারটা। যেহেতু প্রতিটা স্টুডেন্টের বাসা অনেকটা দূরে দূরে এবং হেঁটে আসা যাওয়া লাগে তাই বেশ খানিকটা সময়ই লেগে যায় টিউশন করাতে। টিউশনি শেষ করিয়েই সে রওনা দিল বাড়িওয়ালাদের বাসার উদ্দেশ্যে। সে যে এলাকায় থাকে সে এলাকায় বাড়িওয়ালারা থাকেন না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। যাদের টাকা আছে তারা প্রাধান্য দেয় বিলাসবহুল জীবনকে আর যাদের টাকা নেই তার সবটুকু উজাড় করে দেয় একটু বেঁচে থাকাতেই। সেই শর্তানুযায়ী বাড়িওয়ালারা বিলাসবহুল জীবন চাইবে সেটাই স্বাভাবিক।
করবীকে বাড়িওয়ালার বাসা অব্দি যেতে হয়নি। এলাকায় ঢুকতেই দেখা পেলো বাড়িওয়ালার। বাড়িওয়ালাকে দেখতেই সে মাথায় কাপড় দিল। যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখেই সে মার্জিত ভঙ্গিতে সালাম দিল,
“চাচা, আসসালামু আলাইকুম। আমি কোর্ট লেনের গলিতে থাকি আপনাদের চড়ুই ভিলাতে। দু’তালায়।”

বাড়িওয়ালা আন্তরিক হাসি দিলেন, “হ্যাঁ চিনেছি, চিনেছি। কবরী?”
করবীর মলিন হাসি আরও মলিন হলো। বলল, ” কবরী না চাচা, করবী আমার নাম।”

”ঐ তো, একই হলো। তা বলো কী বলবে? ভাড়াটা এনেছো?”

ভাড়ার কথা উঠতেই করবীর মুখটা ছোটো হয়ে এলো। দোনোমনা করে বলল,
“আসলে চাচা, আমাকে কী আর কয়েকটা দিন সময় দিবেন? আমি ভাড়ার টাকাটা অন্য একটা জরুরী কাজে ব্যয় করে ফেলেছি। আপনি কয়েকটা দিন সময় দিলে আমার সুবিধা হতো। এক সপ্তাহ সময় দিন, আমি জোগাড় করে দিয়ে যাব?”

সে কথাটা বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলেই ভীরু চোখে বাড়িওয়ালার দিকে তাকালো। সে ভেবেছিল বাড়িওয়ালা তার এমন কথায় রেগে যাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং ভদ্রলোকটির বিস্তৃত হাসি আর প্রশস্ততা লাভ করল। তিনি করবীর বাহুতে ডান হাত রেখে কেমন কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“বাড়ি ভাড়া না দিলেও তো হয়। আমার ঐ একটা ভাড়া না পেলেও কিছু আসে যায় না। তোমার এমন রূপ, এমন দেহ, এমন যৌবন থাকতে তুমি আমাকে ভাড়া দিতে চাও! বরং চলো, ভাড়ায় ভাড়ায় কাটাকাটি করে ফেলি? আমি বাসা ভাড়া দিলাম আর তুমি দেহ ভাড়া। কেমন হবে?”

কথাটা থামতেই লোকটার লোভনীয় চাহনিতে ঘিনঘিন করে উঠল করবীর শরীর। কি জানি কি হলো, সদা সকল পরিস্থিতিতে ঠান্ডা থাকা মেয়েটা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করল। সশব্দে বাবার বয়সী লোকটার গালে চ ড় বসিয়ে দিলো। নিস্তব্ধ এলাকায় এই চ ড়ের শব্দে যেন শহরের নিঃসঙ্গ কাকও ভীত হলো। অথচ করবীর দৃষ্টি তীর্যক। রাগে শরীর তার কাঁপছে। সে এক দলা থুথু মেরে বলল,
“তোর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। পাপী লোক।”

থেমে নেই ভদ্রলোকটিও। বরং আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,
“এই মাসেই আমার বাড়ি খালি করবি মা*। আর তোর রূপ কীভাবে এই রুহুল বেপারীর বিছানায় আসে কেবল সেটাই দেখিস।”

করবী আর কথা বাড়ায় না। ছুটে চলে যায় সেই স্থান থেকে। ঘৃণা-অপমানে তার মাথা ঘুরে আসে। এই নিষ্ঠুর শহরে নারীর বেঁচে থাকা যে বড়ো কষ্টের। বড়ো যন্ত্রণার। এই বুঝি প্রাণ নিলো শকূণে আর ইজ্জত নিলে পুরুষে!
হাঁটতে হাঁটতে ফুরায় না এই পথ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয় গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তা। করবী ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়। ফুটপাতের কিনারায় থাকা ছোটো প্লে গ্রাউন্ডটাতে গিয়ে বসে। ব্যাগের ভেতর থাকা ফোনটা অনবরত বাজছে। নিশ্চয় বাবা কল করেছে! কিন্তু করবীর ফোনটা রিসিভ করার শক্তি হয়। ব্যাগের চেইন খুলে ছোটো বাটন ফোনটা হাতে নেয়। বাবা লেখাটা ঝাপসা হতে থাকে চোখের পাতায়। তার বড়ো ইচ্ছে করে বাবাকে নালিশ দিতে। হাহাকার করে বলতে- এ পৃথিবী করবীদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না, বাবা। এ পৃথিবীর যে বাণীর মতন মন নেই।

কিন্তু সব কথা যে আর বলা হয় না শেষ অব্দি। যেমন বলা হলো না এই কথাটিও। ঠিক সেই মুহূর্তে করবীর মুখের সামনে একটি পানির বোতল এগিয়ে দেয় কেউ। পুরুষালী ভরাট কণ্ঠে বলে,
“যুদ্ধে নেমে কাঁদতে নেই, রক্তকরবী। অপরপক্ষ তাহলে দুর্বল ভাববে যে!”

করবী অবাক হয়। অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখে গতদিনের সেই শ্যামবর্ণের পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার মিহি হাসি।

#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা

তৃতীয় পর্ব:

সন্ধ্যার নিয়ন আলো ঝিমানো। এক ধারে বসে থাকতে থাকতে করবীর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। সে এক ধ্যানেই বসা। তার সামনেই তিমির নামক লোকটা উনার একজন বন্ধু নিয়ে পুরো পার্কের এতিম, অসহায় বাচ্চা গুলোর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই একটা করে প্যাকেট যেখানে সাদা চিকন চালের ভাত, আলু ভাজা আর দুই টুকরো করে মাংসের তরকারি। সাত-আটজন বাচ্চা সাথে উনারা দু’জন। করবীর হাতের বোতলটায় পানি এখনো অর্ধেক। লোকটিই তাকে পানির বোতলটা দিয়েছিল। করবী অবাক হলো। তিমির নামক লোকটাকে দেখলে মধ্যবিত্ত মনে হয় না। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেই মনেহয়। তার বন্ধুর মাঝেও একটা বনেদি ভাব আছে। অথচ কী সুন্দর দু’জন জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলে শিশুদের সঙ্গী হয়েছে! লোকটা কী প্রায়ই আসে এখানে? জিজ্ঞেস করা হলো না আর এই প্রশ্নটি।
ওদের খেতে দেখে করবীর পেটেও খুদারা নৃত্য করে উঠলো। তার সারাদিনের অভুক্ত থাকার গল্প মনে পরলো। তন্মধ্যেই তিমিরের পাশে থাকা তার বন্ধু পার্থিব ডাকল করবীকে,
“করবী, আসো। আমাদের সাথে যুক্ত হও।”

করবী হাসলো, আন্তরিকতার সাথে বলল,
“এইতো, দেখছি। চোখের শান্তি মিলছে।”

পার্থিবও প্রতুত্তরে হাসলো। আর ডাকল না। ততক্ষণে করবীর ফোনে শ’ খানেক কল চলে এসেছে। করবী এবার শরীর ঝারা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। না, আর এখানে বসে থাকা যাবে না। বাবাটা বোধহয় চিন্তায় শেষ। করবী তপ্ত শ্বাস ফেলে বিদায় নিতে গেল তিমিরদের কাছে,
“আমি আসছি তাহলে। আমার বাসায় যেতে হবে।”

তিমির খেতে খেতে এক পলক চাইলো। মৃদু কণ্ঠে বলল,
“ঠিক আছে।”

তবে পার্থিব কথা বাড়াল, “এগিয়ে দিয়ে আসবো?”

করবী ডানে-বামে মাথা নাড়াল। কৃতজ্ঞতার সাথে বলল, “ধন্যবাদ, ধন্যবাদ ভাইয়া। আমি যেতে পারবো। আপনি খাবারটা শেষ করুন।”

পার্থিব তবুও জোরাজুরি করল কিন্তু তিমির রইল নির্লিপ্ত। পার্থিবের অতিরিক্ত জোড়াজুড়ির এক পর্যায়ে তিমির শান্ত স্বরে বলল,
“তুই না থাকলেও ও একা যেতে পারবে। এতদিন যেমন গিয়েছে। একা হাঁটার সাহস টুকু ওর আছে। তুই খা।”

পার্থিব চুপ হয়ে গেলো এরপর। করবী যেন স্বস্তি পেলো। মনের যেই জোরটা সে হারিয়ে ফেলেছিল তা-ই যেন আবার খুঁজে পেলো। ঠিকই তো, সে তো একা হাঁটার সাহস বহু বছর ধরে রপ্ত করেছে, তবে আজ কেন পারবে না? নির্ভরতা পেলেই নির্ভরশীল হওয়া মোটেও উচিত কাজ নয়। এতে নির্ভরশীলতা হারালে মানুষ একা হয়ে যায়। তিমির নামক লোকটা করবীকে করবীর মতনই ট্রিট করছে। এটা খারাপ নয়, বরং বেশ ভালো একটা ব্যাপার। সবসময় সবাই আমাদেরকে আমাদের নিজস্বতার সাথে মিলাতে পারে না। যারা পারে, তারা অসাধারণ। কিন্তু তবুও….. করবীর কোথাও একটা খটকা লেগেই যাচ্ছে। তার এত সুন্দর রূপকেও যে পুরুষ চোখ নামিয়ে সম্মান করে সে শুধুই অসাধারণ নাকি অন্যতম? মনের প্রশ্ন মনে রেখেই করবী হাঁটা ধরল।

ঝিমিয়ে আসা রাস্তা, ঝিম ধরা এই মস্ত শহর এত বেশি অসুন্দর নয়, পাষাণও নয়। এই শহরের বুকেও কেউ কেউ বড্ড কোমল, বড্ড আদুরে। করবী তপ্ত শ্বাস ফেললো। যুদ্ধ করতে করতে কেটে গেল আরেকটি দিন। আর কতকাল এই যুদ্ধ চলবে? নিজের সাথে নিজের, জীবনের সাথে নিজের, সমাজের সাথে নিজের? আর কতকাল কেটে যাবে তপ্ত শ্বাস ফেলে ফেলে! আর কতকাল সুখ দেখবে বলে অপেক্ষায় থাকবে লাশের পাশে বসে থাকা শকুনের মতো? আর কতকাল? আর কতকাল? এই শহর করবীর প্রশ্নের জবাব দেয় না। কেবল নিশ্চুপ সঙ্গী হয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখতে থাকে তাকে।

করবী চলে যেতেই পার্থিব খেতে খেতে বলল,”এভাবে বলার কি ছিল? দিয়ে আসলে এমন কী ক্ষতি হতো? আর মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী, বল? এতটা সুন্দর সচারাচর দেখা যায় না।”

তিমির ধীর কণ্ঠে জবাব দিল, “হয়তো, খেয়াল করিনি তেমন।”

তিমিরের কথায় আশ্চর্যজনক ভাবভঙ্গি করল পার্থিব। এত সুন্দর মেয়েকেও যে খেয়াল করে না সে আদৌও পুরুষ না মহা পুরুষ!

পেটের কথা পেটে না রেখেই পার্থিব বিস্ময় ভোরা কণ্ঠে বলল,
“তুই আদৌও পুরুষ তো ভাই?”

কথাটার বিপরীতেই সশব্দে চ ড় পড়ল তার বাহুতে। তারপর আবার খেতে আরম্ভ করল দু’জনেই।

৫.

দিন যায় দিনের নিয়মে। প্রকৃতির নিয়মে সকাল থেকে রাত হয় এবং রাত থেকে আবার সকাল। করবীর দিনও চলে যাচ্ছে সেই নিয়মেই। কিন্তু দিনের ছন্দে এগিয়ে যাওয়া করবীর জন্য হয়ে পড়েছে চ্যালেঞ্জের। আর যাই হোক, তিন হাজার টাকা দিয়ে তো আর সংসার চালানো যায় না!

সময়টা ঠিক ঝাঁঝালো দুপুর। করবী বসে আছে তার বারান্দায়। হাতে একটি বই। খুব মনোযোগ দিয়ে সে বইটি পড়ছে। বাসায় কারেন্ট নেই। রান্নাঘরে শোনা যাচ্ছে খুটখাট শব্দ। বাবা হয়তো রান্না করছে। বাবাটা কেন জানি করবীকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয় না। ভাবে আগুনের তেজ হয়তো মেয়েটা নিতে পারবে না। অথচ বাবা তো আর জানে না প্রতিনিয়ত সমাজের তেজে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়ে উঠছে তার মেয়ে। সব আগুন যে পুড়িয়ে ছাই করে না। কিছু কিছু আগুন খাঁটিও করে। কিছু পুড়ে যাওয়া ভালো। কিছু উত্তপ্ততা ভালো।
আজ দিনটি শুক্রবার, তাই করবী বাসাতেই রয়েছে। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। গ্রীষ্মকালের এই সময়টা বাতাসও কেমন যেন উষ্ণ বয়। আর দুপুরের দিকে তো প্রকৃতি যেন ঝিম ধরে থাকে। কোথাও কোন বাতাস নেই। দূর থেকে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে যায় কেবল কাক। কেমন হইচই নেই, কোলাহল নেই মনে হয় যেন নিশার স্বপ্নের মতোই নিস্তব্ধ সব।

বাণী পুরো বারান্দা জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটু পর পর এসে করবীর নাম ধরেই ডাকছে স্পষ্ট ভাবে। বাণী অনেক কথাই নকল করতে পারে কেবল মনের কথাটিই আর বলতে পারে না। ঠিক গম্ভীর এই গ্রীষ্মের দুপুরে করবীদের দরজার কড়া নাড়ল কেউ। একবার, দু’বার না, বার কয়েক। করবীর বইয়ে ডুবে থাকা মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল৷ তাদের বাসায় তো কেউ আসে না সচারাচর। তাও এমন ভরদুপুরে! তবে কে এলো? বাড়িওয়ালা কী? করবীর মনে এবার ভয় ঢুকে গেল। বাবাকে সে সেদিনের কথা কিচ্ছু বলেনি। যদি আজ বাড়িওয়ালার কথায় সেদিনের পরিস্থিতি আঁচ করে ফেলে তাহলে তো বিপদ। বাবা হয়তো এটা মানতে পারবে না। তড়িৎ গতিতে তাই উঠে দাঁড়াল সে। প্রায় কিছুটা ছুটে গেলো দরজার দিকে। একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাবা কী করছে। যখন দেখল তার বাবা রান্নাতেই ব্যস্ত, দরজার শব্দ শুনেনি তখন সে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। এই ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা যায় আদৌও!
করবী নিজেকে ধাতস্থ করল। ধীর হাতে খুলল দরজা খানা। মাথায় তার ঘোমটা টানা। তার পেছনেই বাণী উড়ে বেড়াচ্ছে। দরজা খুলতেই এলাকার ছোটো একটা টিনটিনে পিচ্চিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ছেলেটা করবীকে দরজার সামনে দেখতেই সাথে সাথে বলল,
“নিচে হীরণ ভাই দাঁড়ায় আছে, ভাবী। আপনারে যাইবার কইছে। আপনাগো বাড়ির নিচেই হেয় আছে।”

ছেলেটা কথাটা উগড়ে দিয়েই ছুটে চলে গেলো। যেন রাজ্যের কাজ ফেলে এসেছে সে। হীরণের কথা শুনতেই করবীর মুখ-চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। আবারও উঁকি দিয়ে রান্নাঘরে তাকাল। দেখল এবারও বাবা রান্নায় নিমগ্ন। শুনতে পায়নি কিছু। আসলে রান্নাঘরটা মেইন দরজা থেকে একটু ভেতরের দিকে বলে দরজা অব্দি দেখা যায় না রান্নাঘর থেকে। তাই বাবা বুঝেনি হয়তো। করবী আলগা হাতে দরজাটা টেনে দিল। কিছুটা স্বাভাবিক হয়েই চলে গেলো নিচে। ধীরে ধীরে স্যাঁতস্যাঁতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই তাদের বাড়ির আধখোলা গেইটার সামনে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল হীরণ নামের ছেলেটিকে। বরাবরের মতনই ছেলেটি সিগারেট ফুঁকছে। হাতে রুমাল প্যাচানো। শার্টের বোতাম খোলা। ভেতরের কালো রঙের গেঞ্জিটি দেখা যাচ্ছে। কাটা ডান ভ্রু টা কুঁচকানো। কিছু ভাবছে হয়তো। করবী মাথা উঁচু করল, মুখের আদল আগের তুলনায় বেশ খানিকটা শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যাপার! ডেকেছেন কেন?”

করবীকে দেখেও ছেলেটা সিগারেট ফেলল না। আগের ন্যায় ফুঁকতে লাগল। কেবল পরিবর্তন হলো তার ধোঁয়া ছাড়ার স্থান। এতক্ষণ সোজা ধোঁয়া ছাড়লেও এখন মুখটা কিছুটা ডানদিকে ফিরিয়ে ধোঁয়া উড়াচ্ছে৷ যেন করবীর মুখে না লাগে। প্রশ্ন করে চুপ রইল করবী উত্তরের আশায়। হীরণ মনমতন সিগারেট ফুঁকে অবশেষে সিগারেটটা ছুঁড়ে মারল রাস্তায়৷ সেটা পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল,
“শুনলাম নতুন বাসা দেখছো?”

করবী থমকালো। এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে। এই হীরণ অব্দি না আবার খবরটা পৌঁছে যায়। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয় নিয়ম অনুসারে এখানেও সন্ধ্যে হলো। নিজের ভয়টা নিজের ভেতরই মাটি চাপা দিয়ে করবী মৃদুমন্দ কণ্ঠে শুধাল,
“কে বলেছে?”

“তুমি কী ভাবো আমাকে খবর দেওয়ার লোকের অভাব?”

“যে খবরটা দিয়েছে, ভুল দিয়েছে। এমন কিছুই না।”

করবীর কথা শেষ হতেই ঝংকার তুলে হাসল লোকটা। বাইকের গ্লাসে তাকিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“ভুল দিলে তোমার মঙ্গল কিন্তু ঠিক দিলে তোমার জন্য ভয়ঙ্কর হবে। আমার চোখের সামনে থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টাও করো না। ফল ভালো হবে না, রুবী।”

লোকটির শীতল কণ্ঠের হুমকির বিপরীতে করবী জবাব দিল না। তবে বাণী করবীর মাথার উপর উড়তে উড়তে বার কয়েক বলল,
“অসভ্য হীরণ, অসভ্য হীরণ।”

বাণীর কথায় হীরণ মুখ কুঁচকালো। কিছুটা ধমকে বলল,
“রুবী, তোমার এই টিয়ারে কিন্তু আমি একদিন মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দিব। এটার মুখ এত চলে!”

করবী বাণীকে ইশারা দিল। ডাকল, চুপ করতে বলল। কিন্তু বাণী আর শুনল কই? সে নিজের মতন বলতেই লাগল।

ঠিক সেই মুহূর্তে ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি থেকে নেমে আসতে দেখা গেলো বিন্দুকে। করবীদের বিল্ডিং এর ছাঁদের এক কোণায় যে রুমটা, সেখানেই থাকে বিন্দুরা। ষোলো-সতেরো বর্ষীয়া মেয়েটি। গায়ের রঙ বেশ চাপা। পড়ণে তার কটকটে হলুদ রঙের একটি সুতির থ্রি-পিস। গলায় পুঁতির মালা। কানেও সেই পুঁতির কানের দুল। ঠোঁটে চকচকে লাল রঙের লিপস্টিক দেওয়া। নাকে মাঝারি আকারের একটা নাকফুল। আপাত দৃষ্টিতে তাকে ভীষণ সেকেলে এবং বিদঘুটে দেখতে লাগছে। কালো গায়ে এই একটা রঙও মানাচ্ছে না। ঢেউ ঢেউ চুল গুলোতে চুপচুপে করে তেল দেওয়ার কারণে গায়ের কালো রঙটা আর তেলতেলে কালো দেখাচ্ছে। তবে করবী বিশেষ কোনো অদৃশ্য কারণে মেয়েটাকে পছন্দ করে। দেখা যায় তাদের দু’জনের অবসর সময় কাটে দু’জনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে। দু’জনের বয়সের মোটামুটি পার্থক্য থাকলেও দুঃখ ভাগ করার সময় তারা হয়ে যায় সমবয়সী।

বিন্দু সিঁড়ি বেয়ে নেমেই ঝলমলে হাসি দিল। চিকচিক করা অক্ষি যুগল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল হীরণকে। এরপর লাজুকলতার ন্যায় লজ্জা লজ্জা নিয়ে শুধাল,
“হীরণ ভাই যে! ভালো আছো?”

হীরণ বিরক্ত নিয়ে একবার বিন্দুর দিকে তাকাল, অতঃপর তার কথা শুনতে পাইনি ভাব করেই করবীকে বলল,
“বিকেলের দিকে তোমার বাসায় বাজার পাঠাবো। শুনেছি সেদিন বাজারে গিয়েছিলে মাছ কিনতে! বাজার পাঠালে কোনো রকম নাটক করা ছাড়া সেগুলো নিবে।”

করবী এতক্ষণ বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকলেও এখন বিস্ফোরিত নয়ন ফেলল হীরণের দিকে। হীরণ কী কোনো ভাবে করবীকে অক্ষম ভাবলো? করবীর ভালো খাবার কেনার সাধ্য নেই সেটা বুঝাতে চাইল?
মনে-মনে প্রশ্ন গুলো ভেবেই করবীর রাগ উঠল ভীষণ। ফর্সা মুখ লাল টুকটুকে হয়ে গেলো। চোখ-মুখে কাঠিন্যতা ছেয়ে গেল। বলল,
“আমারে কী আপনার অক্ষম মনেহয়? সারাদিন খাটাখাটুনি করে যা আয় করি তাতেই আমার হয়ে যায় যথেষ্ট। আপনাকে এত আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে হবে না।”

কথা শেষ করেই ধপধপ পায়ে চলে গেল করবী। পেছনে বাণীও গেলো বলতে বলতে,
“অসভ্য হীরণ, অসভ্য হীরণ।”

বিন্দু তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে হীরণের দিকে। হীরণ করবীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে লাথি দিল সামনের দেয়ালটাতে। যখন দেখল বিন্দু তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে তখন সে আরও রেগে গেল। চেঁচালো,
“এমন হাভাইত্যার মতন তাকায় আছোছ ক্যান? খাইয়া ফেলবি আমারে? নে খা। অসভ্য মেয়ে। যা, বাসায় যা। তোর এই ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙটা দেখে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। অসভ্য বিন্দু।”

বিন্দু তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে ফেলল। এত রাগের বিপরীতে লাজুক হেসে বলে,
“তোমারে সুন্দর লাগছে, হীরণ ভাই। মনে হচ্ছে সিনেমার নায়ক। তুমি এত সুন্দর ক্যান?”

হীরণ জবাব দিল না। বেশ গতিতে বাইকটা স্টার্ট দিয়ে শাঁ করে ছুটে চলে গেল। বিন্দু তবুও তাকিয়ে রইল। বাণী বারান্দা থেকে বার বার বলতে লাগল,
“অসভ্য হীরণ, অসভ্য বিন্দু। অসভ্য হীরণ, অসভ্য বিন্দু…… ”

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে