#বুকপকেটের_বিরহিণী
আঠারো পর্ব:
কলমে: মম সাহা
(২৯)
সারারাত বৃষ্টির পর প্রকৃতি এখন শান্ত। যেমন শান্ত থাকে প্রেমিকা হারানোর পর প্রেমিকের মরুভূমির প্রতিচ্ছবি হৃদয়। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে গা। গাছের সবুজ পাতা চুইয়ে পড়ছে জল। সবকিছু নিবিড়, কোমল।
আধভাঙা বাড়িটির সামনে একটা ছোটো গাড়ি থামানো আছে। সে গাড়িটিতে ব্যস্ত হাতে আসবাবপত্র তুলে দিচ্ছে হীরণ। এলাকার সবচেয়ে বেখেয়ালি ছেলেটাই খেয়াল করে যত্ন করে জিনিসপত্র তুলে দেওয়ার ভার নিয়েছে। তার পেছন পেছন হুতুমও ছোটো ছোটো হাতে, ছোটো-ছোটো জিনিসপত্র গুলো এগিয়ে দিচ্ছে। করবী তৈয়ব শেখকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিল সুন্দর করে। আসবাবপত্র তুলে দেওয়া শেষ হতেই হীরণ শ্বাস ফেলল। ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
“দেখো তো রুবী, আর কিছু বাদ পড়ল কি-না!”
করবী বোঝাই ভর্তি গাড়িটির দিকে তাকিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলো। আনমনে বলল, “বাদ পড়েছে তো।”
হীরণ ভ্রু কুঁচকালো, “কী বাদ পড়লো?”
“তোমাদের সকল স্মৃতি! হুতুমের আধো কথা, বিন্দুর বোকামো ভালোবাসা, আমেনা খালার শুটকি ভর্তার গল্প! সব তো বাদ পড়েই গেলো। যেগুলো মহা মূল্যবান সেগুলোই বাদ পড়ল। নিতে আর পারলাম কই?”
হীরণ এহেন উত্তর আশা না করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না বরং মলিন হাসল, “স্মৃতি নিতে হয় হৃদয়ে করে। তোমার ট্রাকে তো মূল্যবান জিনিসের জায়গা হবে না।”
“স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকে নিতে পারলে ভালো হতো! কেন যে কেবল স্মৃতি নেওয়ারই সাধ্য মানুষের! স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা সবকিছুকে কেন যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের!”
“তোমার মুখে আফসোস ভালো লাগছে না, রুবী।”
হীরণের সহজ সরল অভিযোগে করবী হাসল। মাথা নাড়াল, “আচ্ছা, অভিযোগ করলাম না। তা আমাদের বিন্দু কই? সে আপারে বিদায় দিবে না?”
করবী প্রশ্ন করতে দেরি অথচ ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেরি হলো না বিন্দুর। হাতে তার বড়ো এতটা টিফিনবক্স। শ্বাস ওঠা-নামা করছে দ্রুত। নেমেই সে ঘনঘন শ্বাস নিল। করবীর দিকে টিফিনবক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নেও আপা, এদিকে তোমাগো খাওন দিয়া দিছি। গিয়া জিনিসপত্র কহন গুছাইবা, রানবাই বা কহন! এইজন্য একটু খাওন দিয়া দিছি। চাচা তো এত বেলা অব্দি না খাইয়া থাকতে পারবো না।”
বিন্দুর ঝঞ্জাটহীন এই ভালোবাসার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাল করবী, “এসব তোকে কে করতে বলছে? শুধু শুধু কষ্ট করলি।”
“কিয়ের কষ্ট, আপা? তোমারে ছাইড়্যা থাকার কষ্ট থেইক্যা, এই কষ্ট কমই।”
এবার মেয়েটাকে নিঃসংকোচে জড়িয়ে ধরল করবী। ইশ্, এই মানুষ গুলোরে ছেড়ে সে থাকবে কীভাবে? এত ভালোবাসা আদৌ ছাড়া যায়? করবীর দিন যে ভীষণ পানসে হয়ে যাবে ওদের ছাড়া!
“বাণীর মা, তুমি কান্দো ক্যান? তুমিও কী বিন্দুবালা হইয়া গেলা?”
হুতুমের কথায় পরিস্থিতি গম্ভীর থেকে কোমল হলো। করবী এবার বিন্দুকে রেখে হাঁটু মুড়ে বসে জাপ্টে ধরল হুতুমকে। বাচ্চাটা যখন এলো তখন কত বয়স ছিল, এক-দুই মাস! নীলাভ চোখ গুলো, বাদামী চুল গুলোর এই পুতুল বাচ্চাটি ছিল করবীর জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম মুগ্ধতা। মনে হলো যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখেছিল সেদিন। বিন্দুরই-বা বয়স কত ছিল? তোরো-চৌদ্দের সদ্য কিশোরী! নারকেল তেল দিয়ে লেপটানো বেণী মাথায় কালো মিচ নিচে একটি মেয়ে হলুদ জামা পরনে। সে মেয়েটি ছিল করবীর জীবনের দ্বিতীয় প্রেম। প্রেম কী কেবল নারী-পুরুষে হয়? মোটেও না। প্রেমের আভিধানিক অর্থ ভিন্ন। আমরা প্রচলিত যেমর ভাবি তেমন নয়। আবেগ, অনুরাগ, আকর্ষণ, মমতা যার প্রতি জন্মায় সেই আমাদের প্রেম। করবীর জীবনের এই দু’টো প্রেমকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলো করবীর ভীষণ আফসোস হচ্ছে।
করবীকে চুপ থাকতে দেখে হুতুমই এগিয়ে এলো। দু-হাত বাড়িয়ে বলল, “বিন্দুবালার মতন আমারে আদর করবা না, বাণীর মা?”
এত নিপাট আবেদনের পরে বোধহয় কেউই থেমে থাকতে পারে না। করবীও পারেনি। কেঁদে দিল নিঃশব্দে। হুতুমকে জড়িয়ে বলল,
“তোমার কথা না শুনে আমি কেমন করে থাকব? আমার যে বড়ো কষ্ট হবে।”
“আমারও তো কষ্ট হইবো, বাণীর মা। তুমি ছাইড়া যাইতাছো বইল্যা আমার বুকে না অনেক ব্যাথা হইতাছে। বিন্দুবালার মা ছাইড়া গেছিল আর এমন ব্যাথা হইছিল। বাণীর মা, এমন কইরা তোমরা সবাই কেন আমাগোরে ছাইড়া যাও? আমার নাহয় বিন্দুবালা আছে কিন্তু বিন্দুবালার তো কেউ নাই। ও ক্যামন কইরা একলা থাকবো কও তো?”
এবার সশব্দে ফুপিয়ে উঠল বিন্দু। হীরণ ঘুরে গেলে উল্টে পিঠে। হয়তো কান্না লুকানোর চেষ্টা! বিদায় ক্ষণের বিষাদ গাঢ় হলো। ছেড়ে যেতেই যে হবে, কেবল কেঁদেকেটে বেলা বাড়ল। বাণী তার খাঁচায় ঘুমিয়ে ছিল। আজ বাণীটা কথা বলেনি মোটেও। বোধহয় অবুঝ প্রাণীর মনেও বিচ্ছেদ ব্যাথা বিষের কাঁটার মতন বিঁধেছিল। বিদায়ের শেষ পর্যায়ে বাণী কথা বলল, “অ স ভ্য হীরণ, অ স ভ্য বিন্দু, ভালোবাসি ভালোবাসি।”
ছাড়া-ছাড়া বাক্য অথচ ভালোবাসার গাঢ়তম। ক্রন্দনরত আবেগ আরও বাড়ল। বিন্দু খাঁচাটায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “বাণী তোরেও আমরা ম্যালা ভালোবাসি।”
বাণী শূন্য চোখে হুতুমের দিকে তাকিয়ে রইল। হুতুমও তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। তাদের দু’জনের জীবনে দু’জনই বোধহয় সবচেয়ে কাছের বন্ধু। করবীর চলে যাওয়াটা কেবল সংক্ষিপ্ত চলে যাওয়াই নয় তার বিশ্লেষণে বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ থেকে শুরু করে স্মৃতি বিচ্ছেদ সবই জড়িয়ে ছিল।
বিদায় ক্ষণ সমাপ্ত করে করবী গাড়িতে উঠে বসল আসবাবপত্রের সাথে। তার কোলে বাণীর খাঁচা। হীরণ দূরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। শেষমেশ করবী তাকে ডাকল একদম ধীরে, স্থিরে,
“হুতুমের মাস্তান, শোনো….”
হীরণের চোখ লাল। মুখে জোরপূর্বক হাসি। কাছে এসে বলল, “বলো?”
“শেষবেলায় কিছু বলতে চাও না?”
“আমি একবারে শেষেই নাহয় বলব, রুবী। এখনো তো তোমার বলা বাকি।”
করবী চমকালো হীরণের মনের কথা বুঝে ফেলার চতুরতায়। হতবিহ্বল ভাবে জিজ্ঞেস করল, “আমার কী বলা বাকি?”
“যা বলতে ডাকলে।”
করবী অবাক হলো। হীরণ যে প্রচুর বুদ্ধিমান ছেলে তা সে জানতো কিন্তু এতটা বুদ্ধিমান জানা ছিল না। করবী হতাশ শ্বাস ফেলল, “বিন্দু আর হুতুমের খেয়াল রেখো। আমি বন্ধু হিসেবে তোমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে গেলাম।”
“রাখব।”
“বিন্দু যখন এই জায়গায় এলো, আজ থেকে চার সাড়ে চার বছর আগে, তখন মেয়েটা অবুঝ। সেই অবুঝ কালের ভালোবাসা তুমি। আমি জানিনা তুমি তাকে কখনো ভালোবাসবে কি-না তবে এতটুকু জেনো, বিন্দুর জীবন অনেক কঠিন। সেই কঠিন জীবনে বহু বছরের ভালোবাসা তুমি।”
“তবে আমার ভালোবাসার চেয়ে বেশি বয়স না ওর ভালোবাসার। তাই না বলো, রুবী? তবুও দুঃখ! আমার জীবন কঠিন নয় বলে কেউ বুঝল না!”
শেষ কথাটুকু হীরণ ঠাট্টার ভঙ্গিতেই বলল। বলে হাসলোও। তবে হাসল না করবী। বরং মুখ-চোখ অসহায় করে বলল,
“তোমার জীবনও কষ্টের, আমি জানি। রুবী পাষাণ তবে অবুঝ নয়। আমি এটাও জানি, হুতুমের মাস্তান চিরজীবন ভালোবাসা খুঁজে গেছে নানান দরজায়। কিন্তু সৎ মা থেকে শুরু করে নিজের বাবা, কেউ-ই তাকে ভালোবাসেনি। মাঝবেলাতে এসে পাষণ্ড রুবীও ভালোবাসেনি। তাই তো আমি মাস্তানকে ভালোবাসায় ভরপুর একটা মেয়ের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বিন্দু কিন্তু ভীষণ ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসা না পাওয়ার যে আফসোস তা তোমার ঘুচে যাবে দেখো। ঘুচে যাবে।”
“কিছু আফসোস থাকুক রুবী। আফসোস না থাকলে যে আমার রুবীকে আমি ভুলে যাব। আমি চাই না, আমার জীবনে আসা এই উত্তম নারীকে আমি ভুলে যাই। রুবী, ভালো থেকো। ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।”
গাড়ি তার বিদায় ধ্বনি জানিয়ে যাত্রা শুরু করল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল বিন্দু যেন কেঁদেকেটেই আটকবে দিবে প্রিয় মানুষের বিদায়। হুতুম হীরণের পেটে মুখ গুঁজে কাঁদছে। করবী জড়িয়ে ধরল বাণীর খাঁচাটা। ভেতরটা তার ফেঁটে যাচ্ছে। ঠোঁটে হাসি অথচ মলিন মুখ ভেসে যাচ্ছে বিষাদ অশ্রুতে। বিন্দুর কান্নার দাপট কমাতে হীরণ ওর এক বাহু জড়িয়ে ধরল। করবী যেতে-যেতে সবটুকুই দেখল। খুব নীরবে। খুব একা। অথচ তার চোখ বলে গেল, আঁধারে ফোঁটতে চাওয়া এক প্রেমের ফুল অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। কারণ কখনো কখনো একটি অঙ্কুল বিনষ্ট হওয়ার ফলে কয়েকটি ফুল সজীব থাকে। করবী হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। বিড়বিড় করে বলল,
“কাঁদিস না বিন্দু, এবার তোর সত্যি সত্যি একটা সংসার হবে। দারুণ সংসার। আমি না-হয় কোথাও পচেগলে বেঁচে থাকব কেবল বাঁচতে হবে বলেই।”
#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: উনিশ
কলমে: মম সাহা
(৩০)
বাড়ির নাম— উদাস ভিলা। যেখানে এসে ওঠেছে করবীরা। করবী বুঝে পাচ্ছে না কেন বাড়িটির এমন নামকরণ করা হয়েছে। সাদা ঝকঝকে, ফকফকে পরিস্কার বাড়িটিকে তার কোনো দিক থেকে উদাস মনে হচ্ছে না। বরং হাস্যোজ্জ্বল একটি বাড়ি মনে হচ্ছে। বুকটাও শান্তিতে ভোরে গেছে রুম গুলো দেখে। কী সুন্দর! কী মনোমুগ্ধকর! ওরা আগে যে বাড়িটিতে ছিল, সে-ই বাড়িটির কোণায় কোণায় ফ্যাকাসে দারিদ্রতার চিহ্ন ছিল। অথচ এ বাড়িটা ভিন্ন। অন্যরকম।
করবীরা এখানে আসতেই সব জিনিসপত্র নামানো থেকে শুরু করে গোছগাছ করার দায়িত্ব পালন করেছে তিমির তাও পাঁকা হাতে। কোথায় কোন আসবাবটা রাখা হবে, কীভাবে রাখলে সুন্দর হবে….. এ সবকিছু দায়িত্ব নিয়ে করেছে সে। যদিও করবী বাঁধ সেধেছে কিন্তু লোকটা শুনেনি। কী সুন্দর সবটা গুছাতে সাহায্য করল! তৈয়ব হোসেন মেয়েকে তন্মধ্যে একবার আড়ালে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন,
“মা, এত বড়ো বাড়ির ছেলে উনি, উনি বোধহয় এসব এর আগে কখনো করেননি। উনাকে না করে দে এসব করতে। তাছাড়া আমাদের আসবাবপত্রেরও যে করুণ অবস্থা। তোর নিশ্চয় তার সামনে এসব দেখাতে লজ্জা লাগছে?”
করবীকে চিনতে বাবার ভুল হয়েছে বলে করবী হাসল। বেশ অকপটে উত্তর দিল,
“লজ্জা কেন করবে, আব্বু? ভাঙ্গা হোক, নষ্ট হোক, এই জিনিস গুলো কিনতে আমাদের তো কম পরিশ্রম করতে হয়নি! অনেক পরিশ্রম করার পরেই কিনতে পেরেছি। আমাদের যেমন সামর্থ্য তেমন করেছি। কে কী ভাবল তাতে কী আসে যায়? এগুলো তো চুরির জিনিস নয়, পরিশ্রমের।”
মেয়ের এমন চোখ ঝলমলে করা উত্তরে বাবার বুক গর্বে ভোরে উঠেছিল। ক’জন মানুষ নিজের অবস্থানে সুখী হতে পারে?
তিমিরের আগে-পিছে করবীও কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। তিমির করবীর পড়ার টেবিলটা ঠিক করছিল। টেবিলের একটা পা বাঁকা হয়ে হেলে যায় বিধায় সে সেটা ঠিক করছে ব্যস্ত হাতে। করবী তার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এলো। ঘর্মাক্ত, ব্যস্ত তিমিরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“চা-টা নিন।”
তিমির ভ্রু কুঁচকে ছিল তখনো। হাতুড়িটা পাশে রেখে চা নিল। এক চুমুক দিতেই তার চোখে-মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। প্রশংসা করে উঠল সে, “এত ভালো চা বানাতে পারো!”
করবী জেসে ঘাড় কাঁত করল। ঠোঁট উল্টে বলল, “ভালো পারি কি-না জানিনা, তবে পারি।”
“কেবল ভালো না, অসাধারণ পারো। ধন্যবাদ।”
তিমির কথা শেষ করার আগেই হাতুড়ি উঠল করবীর হাতে। বিজ্ঞ হাতে শুরু হলো খুটখাট। তিমির নিষেধ করল,
“আহা! ধরছো কেন? পারবে না।”
“গত তিন বছর যাবত এই টেবিলের হেলিয়ে যাওয়া আমিই আটকাচ্ছি। আর আপনি কি-না বলেন পারব না? এই হাত কিন্তু সব পারে।”
করবীে কথায় তীব্র আত্মবিশ্বাস। তিমির তবুও হাতুড়িটা টেনে নিল,
“এই হাত সব পারে তা জানি। তবে আমি চাই এখন থেকে এই হাত ততটুকুই পারুক যতটুকু কোমল। কঠিনটুকু না-হয় আমার জন্য রইল!”
“দায়িত্ব নিয়েন না, কঠিন গুলো কিন্তু বেশিই কঠিন। হাতুড়ি চালানোর চেয়েও বেশি। পারবেন তো?”
তিমির চা খেতে-খেতেই জবাব দিল, “সেটা নাহয় সময় বলুক।” তিমিরের চোখ স্থির হয় তখন করবীর ডান গালের পাশে তিলটায়। আপাদমস্তক সুন্দর একটি মেয়েকে অসম্ভব সুন্দর করতে ভুলভাল জায়গায় বোধহয় এমন কালো মিচমিচে তিল থাকলেই হয়। করবীর এই পলকহীন দৃষ্টিতে অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, “বাড়িটির নাম উদাস ভিলা কেন?”
“হয়তো বাড়ির মালিক কখনো বুঝতে পারেননি তার বাড়িতে এমন এক চঞ্চল নারী এসে বাড়িটিকে ধন্য করে দিবে, তাই।”
তিমির কণ্ঠে ঠাট্টার রেষ। করবী আড়চোখে তাকিয়ে হেসে দিল তাই। হাসি মিলিয়ে হাসল তিমিরও। সেই হাসি ছুঁয়ে দিল প্রকৃতিকে। তাই মেঘমুক্ত আকাশেও দেখা দিল হঠাৎ বাতাসের।
“মজা করছেন?”
“তোমার কী সত্যি মনে হলো আমার কথাটা?”
“না, তা কেন হবে?”
“তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন মজা করছি কি-না?”
তিমিরের কথার মারপ্যাঁচে করবী ভ্যাবাচেকা খেল। আঁখি দু’টো হিমশিম খেল বিপরীত দিকের আঁখিদুটিতে তাকাতে। তিমিরের হাসির কণ্ঠ ততক্ষণে চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। হাসির শব্দ ছুঁচ্ছে যেন সিলিং। করবী মুখ ভেংচালো। উঠে যেতে নিলেই তার নরম হাতটি মুঠোতে নিয়ে থামিয়ে দিল তিমির। খালি চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“উদাস ভিলার মালিক হয়তো উদাস ভীষণ। নয়তো বাড়িটি যখন করে ছিলেন তখন হয়তো তার জীবনে উদাস বাতাস বইছিলেন, তাই বাড়ির নাম সেই বাতাসের তালেই রেখে ফেলেছেন। আ’ম নট সিউর। কোনো একদিন নাহয় তুমিই জিজ্ঞেস করে নিও উনাকে।”
করবী সম্মতি দিল। চায়ের কাপ নিয়ে যেতে-যেতে বলল,”টেবিল পরে ঠিক করবেন। এখন হাত-মুখ ধুয়ে আসেন। দুপুর গড়িয়ে গেল যে! খেতে আসুন।”
তিমির তুমুল শব্দে টেবিলে হাতুড়ি চালিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে কেন বউ ডাকছে?”
করবী কী শুনল? নাকি শুনল না তা সে মুখ ঘুরিয়ে দেখেরও প্রয়োজন বোধ করল না।
–
ক্লান্ত, রৌদ্রদগ্ধ একটি আকাশ মাথার উপর ঝিমিয়ে এসেছে। সারাটাদিন তার চলে গেল ভার্সিটি, টিউশন সামলিয়ে। মাস্টার্স ফাইনাল চলছে। পড়াশোনার চাপও যাচ্ছে ভীষণ। টিউশনি বাসা থেকে বের হতেই তার পেট ডেকে উঠল, জানান দিল তীব্র ক্ষুধার। করবী পেটে হাত দিয়ে ঘড়ির দিকে চাইল। সময় সাগড়ে পাঁচটা। আরও একটা টিউশনি নিয়েছে সে। দু’দিন হলো। এখন সে বাসাতেই যেতে হবে। এদিকে খিদেও লেগেছে ভীষণ। নেতিয়ে আসা শরীরটা টেনে সে ঢুকল নতুন টিউশনির বাসায়। ক্লাস নাইনের একটি মেয়েকে পড়ানো শুরু করেছে। মেয়েটির ছোটো পরিবার। মা, বাবা আর ও। মা, বাবা দু’জনেই থাকেন অফিসে। করবীর সাথে কেবল প্রথম দিন ভদ্রমহিলার ফোনে কথা হয়েছে। ব্যস্ত থাকেন ভীষণ। মেয়েটি চুপচাপ স্বভাবের। করবী ঢুকে টেবিলে বসতেই মেয়েটি ওঠে গেল। ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এবং একটা ট্রে-তে করে বিস্কুট নিয়ে এলো। সেগুলো করবীর সামনে রাখতেই করবী চমকালো। অবাক হয়ে বলল,
“এগুলো….!”
“ভাবি বলল গতকাল, টিচার আসলে নাকি টিচারকে পানি দিতে হয়। আর খালি পানি দিতে নেই তাই বিস্কুট দিলাম। খেয়ে নিন, মেম।”
করবী বিস্মিত হলো, “ভাবি! কে?”
“পাশের ফ্লাটের ভাবি।ঐ যে যাদের দরজা খোলা দেখেন। সেই ফ্লাটেরই তুষার ভাইয়ার বউ। ভাবির সাথে বেশির ভাগ সময় আমি কথা বলি, আড্ডা দিই।”
করবী আর কিছু না বলেই পানিটা খেল। আস্তে-ধীরে বিস্কুটও খেল। তন্মধ্যেই ড্রয়িং রুমে কেউ একজন প্রবেশ করলেন। যেহেতু ফ্লাটের দরজা খোলাই ছিল। এসেই ঝলমলে কণ্ঠে বললেন,
“আপনিই বুঝি ঘুড়ির নতুন টিচার? ঘুড়ি তো দু’দিনেই টিচারের ভক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই পরিচিত হতে এলাম।”
অপরিচিত নারী কণ্ঠ পেতেই করবী ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনিই কী ঘুড়ির ভাবি?”
করবীর প্রশ্ন করতে দেরি অথচ ঘুড়ির ভাবির হাস্যোজ্জ্বল মুখ ফ্যাকাসে হতে দেরি হলো না। মেয়েটার হাত কাঁপছে যার দরুন হাতে থাকা ট্রে এবং ট্রে-এর সামগ্রীও কাঁপছে। মেয়েটির আকস্মিক পরিবর্তনে ভড়কে গেল করবী। ঘুড়িও ছুটে এলো। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কী হলো! কী হলো!”
তখনও ভাবি দরদর করে ঘামছে। অস্ফুটস্বরে করবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি, আপনি আশা…..”
করবী অকপটে তার পরিচয় দিল, “আমি রক্তকরবী। কেন? কী হয়েছে?”
ঘুড়ির ভাবি দ্রুত সোফায় বসল। ট্রে-টা রাখল সোফার সামনের সেন্টার টেবিলটায়। শাড়ির আঁচলে মুছল মুখ। কম্পনরত কণ্ঠে বলল, “সরি, সরি, আমি ঘুড়ির ভাবি— বিদিশা। পাশের ফ্লাটেই থাকি।”
#চলবে