বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-১৬+১৭

0
297

#বুকপকেটের_বিরহিণী
ষোলো পর্ব:
কলমে: মম সাহা

(২৫)
গোধূলি নেমেছে অম্বরের বুকে। কমলা রঙের গোধূলি। ঝকঝকে আকাশ, স্নিগ্ধ বাতাসে ভরপুর চারপাশটা। করবী, বিন্দু, হুতুম, হীরণ, করবীর বাবা, বাণী সকলে মিলেই এসেছে নদীর ধারে ঘুরতে। নদীর অপর পাশে একটি পরিত্যক্ত ব্রীজ আছে যেখানে সন্ধ্যে হলেই রঙবেরঙের আলো জ্বলে উঠে। আড্ডা বসে আনন্দের।
তৈয়ব হোসেন বসলেন নদীর ধারে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে তার সমস্যা হয় কি-না! এলাকার আরেকজন মুরব্বি বন্ধু পেতেই তার গল্প জমে উঠলো। করবী বাকিদের নিয়ে উঠল ব্রীজে। বিন্দুর পরনে শাড়ি। নীল রঙের শাড়ি। হালকা নীলে মেয়েটার কৃষ্ণাঙ্গ ঝলমল করে উঠছে যেন। বিন্দুর গোপনে এমন রূপ আছে তা কখনো তার সাদামাটা আস্তরণের ভেতরে থেকে বুঝা যায়নি।

ব্রীজে উঠতে পেরেই যেন আনন্দের সীমা রইল না হুতুম, বাণীর। বিন্দুর ভেতর থেকে উদাসীনতা তখনও কাটেনি। হীরণের পড়নে সেই চিরায়ত পোশাক বুকখোলা কালো শার্ট, তার ভেতরে সাদা টিশার্ট, জিন্স। সুন্দর চুলগুলো এলোমেলো। সকল নীরবতা ভেদ করে হীরণ বলল,
“আইসক্রিম খাবি, বিন্দু?”

বিন্দু চমকালো বোধহয়। বলল, “আমারে কইলা?”

“এখানে তুই ছাড়া আর কারো নাম বিন্দু বুঝি? জানতাম না তো!”

করবীও অবাক হলো। সে কখনো হীরণকে এতটা ভালো ভাবে কথা বলতে দেখেনি বিন্দুর সাথে। হীরণ বিন্দুর বিস্মিত চোখ গুলোর দিকে তাকিয়ে হাসল খানিক। হীরণ সচারাচর হাসেও না।
“আইসক্রিম খাবি কি-না, সেটা ভাবতেই তোর এতক্ষণ লাগে?”

বিন্দুর উদাস বিকেল মুহূর্তেই সুন্দর হয়ে গেল। সে বিস্ময় হেসে বলল, “খামু।”

হীরণ হাসল। ছেলেটার চেখে পাপড়ি গুলো ভীষণ ঘন। দেখতে কী সুন্দর লাগে! করবী কখনো দেখেইনি ছেলেটাকে। আজ দেখেছে আর অবাক হচ্ছে। ছেলেটার বখাটেপনার আড়ালেও সুন্দর একটা হীরণ বাস করে। যা কখনোই দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
“তোমরা দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।”

বিন্দু ঘাড় কাঁত করলেও করবী বাঁধ সাধলো,
“চলুন, আমিও যাই।”

হীরণ অবাক হলো না। কেবল সম্মতি দিয়েই ব্রীজের বিপরীত পাশে চলে গেল। পেছনে গেল করবীও।

হীরণ আইসক্রিম নিতে-নিতে করবীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কী বলবে, বলো? নিশ্চয় কিছু বলার জন্যই আমার সাথে এসেছো। এতটুকু তোমাকে আমি চিনেছি।”

হীরণের আজকের আচরণ অবাকের উপর অবাক করল করবীকে। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। কিন্তু সেকেন্ডেই সামলে নিল আবার। গলা পরিষ্কার করে বলল,
“ধন্যবা…..”

কথা সম্পূর্ণ করতে দিল না হীরণ। হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল করবীকে। টাকা দোকানদারকে পরিশোধ করে অতঃপর পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল করবীর পানে,
“তোমার মনে হচ্ছে, আমি বিন্দুর সাথে এত আন্তরিকতা দেখাচ্ছি তুমি চেয়েছ বলে? উহু, মোটেও নয়। আমি বিন্দুকে বিন্দুর জন্যই পছন্দ করি। বিন্দুর সাথে আমার এই আন্তরিকতা কেবল বিন্দুর হাসির জন্যই। তোমার কথা রাখতে, কিংবা তোমার কথার জন্য না। আমি এতটাও হৃদয়হীন না যে একটা সদ্য মা-হারা মেয়ের সাথে কঠিন ব্যবহার করব। তবে রুবী, তোমাকে একটা কথা বলি…. আমার ভালোবাসার বিনিময়ে তুমি যে শর্তারোপ করেছ তা আমার ভালোবাসার জন্য অপমানের। আর যে আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, তাকে আমি ঠিক ভুলে যাব একদিন। মিলিয়ে নিও, রুবী। একদিন তোমাকে ভুলে গিয়ে আমি পৃথিবী থেকে একরাশ দুঃখ ছিঁড়ে ফেলে দিব।”

করবী নিখাদ হাসল, “আমিন।”

হীরণ আহত হলো। তারপর গটগট করে চলে গেল ব্রীজের ওপাশে। করবী হাসল। হাসির অন্তরালে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ এক শ্বাস। ব্রীজের ওপাশের দৃশ্যপটে তখন মুগ্ধতা ঝরছে। বিন্দু হাসছে। হুতুমকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খাচ্ছে হীরণ। করবী সেদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে আনমনে বলল,
“কোন জায়গায় আঘাত করলে মানুষকে দুর্বল করা যায় তা আমার জানা আছে, হীরণ। আর আমি সক্ষম। প্রত্যক্ষ ভাবে না হোক, পরোক্ষ ভাবেই আপনাকে আমি বুঝাবো বিন্দুর ভালোবাসা কতটা সুন্দর। যেমন সুন্দর এই আকাশ, মাটি, ঠিক ততটাই সুন্দর। আমি ক্ষত করার পর যখন বিন্দু প্রলেপ লাগাতে আসবে তখনই আপনি বুঝবেন, প্রলেপ লাগানো মানুষকেই জীবনে রাখা উত্তম সিদ্ধান্ত।”

করবীর ভাবনার মাঝে বিন্দুর ডাক এলো, “আপা, এইহানে আসো।”

হীরণ আবার সাথে-সাথে বিন্দুকে শাসন করল,
“তোরে বলছি না এমনে কথা বলবি না? হুতুমটাও তো এগুলো শিখবো।”

হীরণের মিষ্টি শাসনে জিভে কামড় দিল বিন্দু। বোকা বোকা হেসে বলল,
“তুমি আছো না, তুমি ওরে ঠিকটা শিখাইবা।”

মুহূর্ত আরও রঙিন হয়ে গেল। উদাস বিকেল প্রেমময় হয়ে গেল। বিন্দুর ব্যাথা কমে গেলো যেন অনেকটাই।

(২৬)

তিমির দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। ঘড়ির কাটায় অপেক্ষার সেকেন্ড পেরুচ্ছে খুব দ্রুত। তিমিরের সীমাহীন অপেক্ষাকে মুক্তি দিয়ে করবী বেরুল টিউশনের বাসা থেকে। তিমিরকে দেখে হাসল গাল ভোরে। দুপুরের রোদ তখন পাংশুটে গরমে নাজেহাল করছে চারপাশ। সেই গরমে করবীর মনে তিমিরের মুখ যেন একরাশ শীতের আকাশ হয়ে এলো।
করবী এগিয়ে এলো। কণ্ঠে খুশি, “এখানে যে?”
তিমির পাঞ্জাবীর হাতা গুটালো। সিল্কি চুল গুলো পেছন দিকে ঠেলে বলল,
“সত্যি বলব না মিথ্যে?”
করবী হাসল, “যা বলে খুশি হন।”
“তাহলে সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিলাম— তোমার অপেক্ষায় এই পথ চেয়ে ছিলাম।”

তিমিরের ছন্দে খিলখিল করে হাসল করবী। মুগ্ধতা ঝরে পড়ল টুপ করে গ্রীষ্মের আবহাওয়া জুড়ে।
“আমার অপেক্ষা?”

“হ্যাঁ, তাই তো বলল মন।”

“মনকে বারণ করতে পারেননি? এত অপেক্ষা কিন্তু ভালো নয়।”

“টুকটাক খারাপ হোক। শেষপাতে তোমার একবাটি হাসি পেলেই আমার তেতো অপেক্ষার শান্তি হবে।”

“একবাটি হাসি!” করবীর অবাক কণ্ঠ। ভ্রূদ্বয় কুঁচকেছে।
তিমির স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিল, “তুমি তো মেপে হাসো তাই একবাটিই বললাম। তাছাড়া সেদিন যে রূপ দেখিয়ে ছিলে! আমি বাবা এক বাটির বেশি চাওয়ার সাহস করতে পারছি না।”

তিমিরের কথায় মলিন হয়ে এলো করবীর মুখ-চোখ। সেদিনের আচরণের কথা চিন্তা করে লজ্জিতও হলো বেশ ভালো রকমে। একজনের রাগ আরেক জনকে দেখানো মোটেও সুন্দর কাজ না। করবীর দৃষ্টি নত হলো,
“সেদিন ব্যাক্তিগত কারণে কিছুটা ডিস্টার্ব ছিলাম।”

“সেটা তো সেদিনই চলে গিয়েছে। তাই বলে আজ হাসবে না আর?”

তিমিরের কথার ধরণের করবী না হেসে পারল না। তিমির তখন পকেট থেকে একটি কালো গোলাপ বের করল। করবীর দিকে এগিয়ে দিল নিঃসংকোচে,
“এটা কী নিবে একটু?”

“কোথায় পেলেন?”

“এইতো, সামনের একটি ডালে ঝুলে ছিল। ভাবলাম নিয়ে আসি।”

“গোলাপ ফুলের গাছ আছে এখানে?” করবীর নিষ্পাপ প্রশ্নে এবার তিমির শব্দ করে না হেসে পারল না। ততক্ষণে তার ঠাট্টাও বুঝে ফেলল করবী। দৃষ্টি লুকালো তাই তৎক্ষণাৎ। চোখ ঘুরিয়ে পথে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল, “মজা করলেন!”

“না তো! পুরোপুরি ব্যাপারটা আসলে মজা না। কিছুটা সত্যিও। আজকাল পথের মাঝে তো গোলাপ পাওয়া যাচ্ছে। জানো না?”

করবী ঠোঁট উল্টে বলে, “না তো!”

“তা-ও অবশ্য ঠিক, তোমার না জানারই কথা। গোলাপ কী আর জানবে, তাকে যে পথের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর ফুলটিই লাগে।”

আবারও তিমিরের বেসামাল ঠাট্টায় লজ্জায় লাল হলো করবী। লজ্জা লুকাতে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল। থেমে নেই তিমিরও। বেসামাল ঠাট্টায় উত্তপ্ত দুপুর সে করে ফেলল মুগ্ধ প্রহর।

প্রতি রাতের মতনই আজ রাতেও করবীর ঘুম ভেঙে গেল। বিদ্যুৎ নেই এলাকায়। চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত। ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে সে আবিষ্কার করল বারান্দায় থাকা চেয়ারটাতে। ঘাড় কাঁত করে ঘুমানোর ফলে ঘাড়ে বেশ ব্যাথাও অনুভব করল। রাতের সময়টা ঠিক কয়টায় ঘুরছে ঠাহর করতে পারল না সে। প্রায় রাতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। কিছু স্বপ্নে সে মা’কে দেখে। মায়ের চেহারা তার মনে নেই তাই স্বপ্নেও সেই মুখ অস্বচ্ছ। সে দেখে মা তাকে নিয়ে কোথাও একটা ঘুরতে যাচ্ছে, রাস্তায় সে পড়ে গেছে। তারপর যার হাত ধরে উঠে, সেই মানুষটা হয় বাবা। স্বপ্নের এই চরিত্র বদলের অর্থ বোধগম্য হয় না তার। মায়ের কথা মনে করার মতন তেমন জাঁকজমকপূর্ণ কোনো স্মৃতিও নেই জমা। এমনও না যে সারাদিন সে খুব মায়ের কথা ভাবে। তাহলে কেন এত পীড়াপীড়ি স্বপ্নে? উত্তর খুঁজে পায় না মেয়েটা।
হাত-পা ঝারা দিয়ে সে ওঠে দাঁড়াল। আড়মোড়া ভেঙে পা বাড়াল বাবার ঘরের দিকে। বাবা ঘুমিয়েছে কি-না দেখার জন্য। কিন্তু বাবার ঘরের সামনে গিয়েই পা থেমে গেল করবীর। বাবার ঘরের দরজা ভিজিয়ে রাখা। হালকা হলদেটে আলোর প্রতিবিম্ব ভেসে আসছে। করবী পায়ের গতি আরেকটু স্থির করল। ধীরে-ধীরে ভিজিয়ে রাখা দরজার ফাঁক গলিয়ে মাথা ঢুকাল। কিঞ্চিৎ অবাক হলো ভেতরের ঘটনা দেখে। তৈয়ব হোসেন খাটে বসে আছেন। হারিকেনের খুব ঢিমে আলোতে কিছু লিখছেন মনযোগ সহাকারে। লিখার মাঝে আবার চোখও মুছছেন। বাবা কি কাঁদছেন?

করবীর চিন্তা হলো খুব। একবার রুমে ঢুকতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে আর ঢুকল না সে। তৈয়ব হোসেনের সব ধ্যান যেন সেই লিখাতে। করবীও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল শেষটুকু দেখার জন্য। বেশ অনেকটা সময় পর তৈয়ব হোসেনের লিখা শেষ হলো। অতঃপর সেই লিখার কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে নিলেন ফতুয়ার বুকপকেটে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঢুকরে কেঁদে উঠে বললেন,
“তুমি আর ক’টা দিন থেকে গেলেও পারতে, সাহেবা।”

করবীর চোখও ভিজে উঠল। বাবা মা’কে চিঠি লিখছেন? মৃত মানুষকে কী চিঠি লিখা যায়? আচ্ছা! বাবাকে তো তার কখনোই জিজ্ঞেস করা হয়নি মা আদৌ মৃত কি-না জীবিত? কী অদ্ভুত! সে কখনো মায়ের কথা আবদার করে জানতে চায়নি কেন?

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
ষোল পর্বের বর্ধিতাংশ
কলমে: মম সাহা

(২৭)

সকাল হতেই নতুন সমস্যা তার দল-বল নিয়ে আগমন ঘটালো করবীদের দরজায়। নিচ তলার মহিলা সকাল সকাল এসে জানিয়ে গেলেন বাড়িওয়ালা বলেছে এ মাসের মাঝে করবীদের ঘর খালি করতে। দীর্ঘ চার-পাঁচ মাস আগে নাকি বলেছিল করবীকে ঘর ছাড়তে কিন্তু সে ছাড়েনি। এমনকি বাড়িওয়ালার সাথে আর দেখাও করেনি। নিচ তলার ভদ্রমহিলার কাছেই এতদিন ভাড়া দিয়েছিল। আজ সে মহিলা এসেই নোটিশ জানিয়ে গেল।
এমন কিছু ঘটতে পারে তা আগেই আন্দাজ করেছিল করবী কিন্তু এখনই যে ঘটবে তা বুঝতে পারেনি। এত শর্ট নোটিশে বাসা পাওয়াটাও তো কঠিন। তার উপর তাদের যা বাজেট, সে বাজেটে আদৌ এই শহরে বাসা পাওয়া যাবে! করবীর চিন্তিত মুখের আঁধার দূর করতে এগিয়ে এলো তার বাবা। মেয়ের হাতে এক জোড়া স্বর্ণের দুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এগুলো তোর বিয়ের জন্য আমি রেখে ছিলাম, মা। অথচ মাথার ছাঁদ বাঁচানো যখন সংকটের হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন নাহয় বিয়ের কথা পরে ভাবলাম? বিয়েই তো জীবনের সব না, তাই না?”

করবী হতবিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে চাইল, “তুমি তো কখনো এই দুল গুলোর ব্যাপারে বলোনি!”

“বলেনি। ভেবেছিলাম আমাদের অভাবের বিশাল থাবা থেকে এগুলো বাঁচিয়ে রাখব।”

“তাহলে বাঁচিয়ে রাখো, বাবা। তুমি নিশ্চয় শখ করে রেখেছিল!”

“সন্তানের সাথে জড়িত সবকিছুই শখের হয়, মা। তবে সবচেয়ে বেশি শখের হয় বেঁচে থাকাটা। আপাতত নাহয় বেঁচে থাকাটা বাঁচালাম। কী বলিস?”

করবী হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। তার কাছে বর্তমানে তেমন টাকা নেই যে নতুন বাসা দেখবে। টিউশনির যা বেতন পেয়েছিল তা দিয়ে বাজার করেছে, হুতুমের শরীরটা অসুস্থ হয়েছিল তাই ডাক্তার দেখিয়েছে, ঘর ভাড়াও দিয়েছে। হাতে সামান্য আছে। যা রেখেছিল আসা-যাওয়ার ভাড়া হিসেবে। সে টাকা দিয়ে তো আর ঘর ভাড়া করা যাবে না! বেশ অসহায় হয়েই করবী দুল জোড়া নিল। হতাশ স্বরে বলল,
“তোমারে ভালো জীবন দিতে না পারার জন্য ক্ষমা করো, আব্বু।”

এতো বড়ো মেয়ের বাচ্চামিতে হাসলেন তৈয়ব হোসেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুই-ই তো আমার জীবন, মা। এর চেয়ে ভালো জীবন তো আমার লাগবে না।”

করবী ভীষণ আবেগে বাবার পেট জড়িয়ে ধরল। বলল,
“পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা তুমি, আব্বু।”

_

বিন্দু বেরিয়েছে মাত্র কারখানা থেকে। বের হতে হতেই সময় ঘুরল নয়টার কাটায়। আজ আবার ধর্মঘট ছিল। রাস্তার মাঝে ঝামেলার অভাব নেই। কিন্তু তবুও জীবন বাজি রেখে আসতে হয়েছে পেটের দায়ে। কেবল সে না। তার মতন হাজার খানেক কর্মচারীই বেরিয়ে এসেছে জীবনের মায়া ত্যাগ করে।
বিন্দু রাস্তায় বেরিয়ে ফোনটা বের করল। করবী আপা তাকে নতুন ফোন দিয়েছিল আগের ফোনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে। আম্মা আবার কল দিয়ে না পেলে চিন্তা করতেন। কিন্তু আজ তো তার হয়ে চিন্তা করার কেউ নেই! আজ হয়তো তার দেরি দেখে অনবরত কলও কেউ দিচ্ছে না! হুট করে মাথার উপরের এমন বটবৃক্ষ হারিয়ে ভীষণ ক্লান্ত লাগে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনটিকে। তবুও তো বইতে হবে। তাছাড়া আর গতি যে নেই! আমাদের জীবনের সবচেয়ে নিদারুণ কষ্ট হলো, আমাদের মানুষ হারিয়েও বাঁচতে হয়।

বিন্দু ফোনটা অন করতেই দেখল করবীর আটটা মিসড কল উঠে আছে। এই মিসড কল গুলো দেখে আনমনেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল মেয়েটার। যাক, পৃথিবীতে তাকে নিয়েও চিন্তা করার মতন মানুষ আজও আছে! সে কল ব্যাক করতে নিবে তার আগেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“বিন্দুবালা, তোর এত দেরি লাগে? তুই জানছ না আমি একা থাকি? আমার ডর লাগে।”

বাচ্চা হুতুমের কণ্ঠ পেতেই চমকে উঠল বিন্দু। হতবিহ্বল হয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল একটা নীল রঙের হাঁটু সমান ফ্রক পরে, সোনালী চুল গুলো ছেড়ে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাটা। তার পেছনেই হেলান দিয়ে আছে হীরণ ভাই। বিন্দু দ্রুত দু’কদম এগিয়ে গেল। এই শূন্য সময়টাতে হুতুমের আগমনে যেন সকল শূন্যতা কেটে গেল তার। জাপটে ধরল সে হুতুমকে,
“তুই এইহানে ক্যান এত রাইতে?”

“তুই এত দেরি করছ দেইখ্যাই তো আমারে আইতে হইলো, বিন্দুবালা। বিন্দু’র মা তো আমারে কইয়া গেছিল, তোরে যেন আমি দেইখ্যা রাখি। আমি কী হেই কথা ফালাইতে পারি?”

হুতুমের পাকা-পাকা কথায় বিন্দুর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটে ঝুলে রইল কত যত্নের হাসি,
“পাকনা বুড়ি নাকি তুই? এট্টুক মাইয়্যা নাকি আমার যত্ন নিবো! বাপরে বাপ।”

হুতুম অসন্তুষ্ট হলো বিন্দুর হাসিতে। বিন্দুর বুক থেকে মাথা তুলে কোমড়ে দু’হাত রাখল। ঠোঁট, চোখ, মুখ ফুলিয়ে বলল,
“তুই কিন্তু আমারে অপমান করতাছোছ, বিন্দুবালা? বাণীর মা তো কয়, যত্ন নিতে বড়ো হওয়া লাগে না, ভালোবাসা থাকলেই না-কি হয়। দেহছ না? বাণীর মা ছুডু হইয়াও তার আব্বার যত্ন নেয়!”

বিন্দু চমকে তাকায়। হুতুমের চোখ-মুখের মায়ায় তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। এই ছোট্টো জাদুকর তার জীবনে না এলে তার কত সুন্দর জিনিস দেখা হতো না! ভাগ্যিস হুতুম এসেছিল!

বিন্দু এবং হুতুমের কথার মাঝে বাঁধ সাধল হীরণ। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“তোদের মন-প্রাণের কথা শেষ হইলে চল এবার। রাত যে বাড়তাছে সেদিকে কোনো খেয়াল নাই, তাই-না?”

হীরণকে দেখে এমনেতেই বিন্দু খুশিতে আহ্লাদী হয়ে ছিল। এখন যেন কথা বলার সুযোগ পেয়ে আহ্লাদে গদোগদো হেসে দিল,
“হীরণ ভাই, তুমি হুতুমরে নিয়া আইছো!”

বিন্দুর বোকাবোকা প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো হীরণ,
“না, হুতুম উইড়া উইড়া আসছে। ওর তো তোর মতন দুইডা ডানা আছে, তাই না? আহাম্মক।”

হীরণের দেওয়া ‘আহাম্মক’ সম্বোধনেও যেন বিন্দুর খুশি কমল না। বরং তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ল,
“তুমিও তাইলে আমার কথা চিন্তা করো, হীরণ ভাই?”

হীরণ এহেন প্রশ্নে যেন থমকে গেল। উত্তম জবাবটি খুঁজতে লাগল কিন্তু পেল না। সে সত্যিই কী বিন্দুর কথা ভাবে? না, আবার হয়তো – হ্যাঁ। কিন্তু সেটা বিন্দুর প্রতি ভালোবাসা থেকে না। বিন্দুর প্রতি স্নেহ থেকে, হুতুমের প্রতি মায়া থেকে। বরাবরই এই পরিবারটিকে তার কাছে অসহায় লাগতো। আর সেই অসহায় পরিবারের খুঁটি ছিলেন আমেনা খালা। তিনি মারা যাওয়ার পর পরিবারটা যেন ছাঁদ বিহীন হয়ে গেল। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় যেমন করে আঁকড়ে ধরে ছাঁদ বিহীন ঘরকে, তেমন করে যেন দুঃখ, কষ্ট মেয়ে গুলোকে আঁকড়ে ধরতে না পারে তাই কিছুটা ছাউনি হওয়ার চেষ্টা করছে কেবল। ছাঁদ হওয়ার ক্ষমতা তার নেই যে!
হীরণ ধ্যান ছেড়ে বেরুলো। কথা ঘুরিয়ে বলল,
“তুই আসছিলিস না বলে হুতুম, রুবীরা সবাই চিন্তা করছিল। তাই ভাবলাম এসে দেখি। তাই বইল্যা নিজেরে আবার নায়িকা ভাবা শুরু কইরা দিছ না। তোর তো আবার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি।”

হীরণের ধমকেও হাসি কমেনি বিন্দুর। মানুষটা যে একটু ভাবছে তা-ও বা কম কীসে? ভালোবাসার মানুষটা ভালো না বাসুক, একটু চোখ তুলে তাকালেই যেন রাজ্যের শান্তি। হীরণ শব্দ করে বাইক স্টার্ট দিতেই বিন্দু ছুটে গিয়ে বসল। হুতুম বসল হীরণের সামনে। হীরণে গলা জড়িয়ে ধরে কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আইচ্ছা মাস্তান, আমরা যারে ভালোবাসি হেরাও তো আমাগোরে ভালোবাসে, তাই না? যেমুন, বাণীর মা আমারে ভালোবাসে আমিও তারে ভালোবাসি। বিন্দুর মা আমারে ভালোবাসে আমিও তারে ভালোবাসি। বাণীর নানাভাই আমাকে ভালোবাসে আমিও তারে ভালোবাসি। তাইলে বিন্দুবালা তোমারে একটু ভালোবাসলে তুমি রাগ করো ক্যান? বিন্দুবালা কালা বইল্যা কী তুমি তারে ভালোবাসো না?

ছোটো হুতুমের এমন বিশাল কথা কোথায় গিয়ে যেন ধাক্কা খেল। হীরণ ঠিক ঠাহর করতে পারল। মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় যেন, লজ্জা, হতভম্বতা মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেলো। সত্যিই তো, সে আসলে বিন্দুকে ভালো কেন বাসতে পারে না? বিন্দুর গায়ের রঙের জন্য! না তো, তার তো এমন মানসিকতা কখনো ছিল না। তাহলে ভালোবাসতে না পারার কারণটা কী?

#চলবে?

#বুকপকেটের_বিরহিণী
মায়া পর্ব: ১৭
কলমে: মম সাহা

হীরণের চলন্ত বাইকের গতি ঘুরল। বাড়ির পথ না ধরে পথ ধরল অন্য কোথাও যাওয়ার। রাস্তাটা ঠিক চিনল না বিন্দু। চলন্ত বাইকে হীরণ ভাইয়ের শার্ট শক্ত করে ধরে রাখা বিন্দুর যখন টনক নড়ল ভিন্ন রাস্তা দেখে তখনই সে নিস্তব্ধতা ভেঙে চাপা আর্তনাদ করল,
“কই যাও হীরণ ভাই? কই যাও? এইডা তো বাড়ির রাস্তা না।”

হীরণের ধ্যান পথের দিকেই। জবাবে বলল, “তোকে ফেলে দিয়ে আসতে যাই। তুই এত জ্বালাছ। আমার আর সহ্য হয় না।”

বিন্দু আঁতকে উঠল আরও,
“তুমি সত্যিই আমারে ফালায় দিতে যাও?”

“তো! মিথ্যে করে আবার ফালানো যায় নাকি?”

হীরণের দুষ্টৃ কণ্ঠ ধরতে পারল না বিন্দু। বরং সে চোখ-মুখ শুকিয়ে ফেলল চিন্তায়। বোকা বোকা কণ্ঠে বলল,
“আমি কি তোমারে বেশি জ্বালাই?”

হীরণ জবাব দিল না বরং আড়ালে আরেকটু হাসল। বিন্দু মেয়েটা এত বোকা! তার জীবনে বোধহয় এতটা বোকা মানুষ সে কখনো দেখেনি। এই জটিল পৃথিবীতে আদৌ এত বোকা মানুষ বাঁচতে পারে? মোটেও না। এই কঠিন পৃথিবী বোকা মানুষদের জন্য জাহান্নাম। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয় তাদের। তবুও, কোথাও মন বলে এই সরলতা ভীষণ স্নিগ্ধ। এই সরলতায় মন ভালো হয়ে যায় টুপ করে।

বিন্দু থম মেরে গেল অনেকক্ষণ যাবত। সে হয়তো দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে। হীরণ ভাই যেহেতু কখনো তার সাথে ফাজলামো করে না তার মানে সত্যিই বলছে। কিন্তু বিন্দুর মন মানতে পারল না হীরণ ভাই তাকে ফেলে দেওয়ার মতন কঠিন কাজও করতে পারে। দ্বিধাদ্বন্দে মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেল। অবশেষে দীর্ঘক্ষণ বাইকটি চলার পর এসে থামল একটি ভিড়ে পরিপূর্ণ জায়গায়। বাইক থামতেই চমকাল বিন্দু। চারপাশ তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে শুধাল,
“এইহানে ক্যান আনছো, হীরণ ভাই?”

হীরণ বিন্দুর উত্তর না দিয়ে বাইক থেকে নামল। নামালো হুতুমকেও। হুতুমের হাত জড়িয়ে ধরল পরম দায়িত্ব অতঃপর জবাব দিল, “তোর নাকি মেলা ঘুরতে মন চায়? সেজন্য আনলাম।”

চারপাশে হৈচৈ, বিশৃঙ্খলা যুক্ত পরিবেশে হীরণের এই বাক্যগুলো যেন গ্রীষ্মের তাপদাহে শীতের নরম ছোঁয়া দেওয়ার মতন শীতল, অবিশ্বাস্যকর। বিন্দু চমকালো,
“তুমি কেমনে জানলা আমার মেলা পছন্দ?”

“তুই যেমন কইরা জানছ আমার মুরগীর কষা মাংস পছন্দ, তেমন কইরা। এবার চল ভেতরে।”

বিন্দুর বিস্ময়ের সীমা রইল না। হীরণ ভাই আজকাল তার এত যত্ন নিচ্ছে তা যেন বড়োই অকল্পনীয়। মা না থাকায় কী এত যত্ন পাচ্ছে সে! আম্মা না থাকারও কী সুবিধা আছে তবে? বিন্দুর বোকা মাথায় প্রশ্নের ঘুরপাক। হীরণ হুতুমের হাত ধরে এগিয়ে গেল সামনে। বিন্দু ফোন বের করতে করতে পেছনে পরে গেল তাদের থেকে। তবুও সে ফোন বের করল। আপার সতেরোটা মিসড কলের পরিবর্তে প্রথম কলটা দিল। এবং রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে করবীকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই প্রফুল্ল বদনে বলল,
“আপা, আমাগোরে যারা দুঃখের সময় যত্ন করে, তারা কী আমাগোরে ভালোবাসে কখনো-সখনো?”

বিন্দুর অদ্ভুত প্রশ্নে অপরপাশ নীরব থাকে। তারপর করবীর মেয়েলি হাসিটা পাওয়া যায়। রিনরিনে কণ্ঠে বিন্দুর মন আকাশ স্বচ্ছ করে দেওয়ার মতন জবাব আসে,
“যারা আমাদের যত্ন নেয় তারা আমাদের ভালো চায়। আর যারা আমাদের ভালো চায় তারা আমাদের ভালোবাসে। ভালো না বাসলে কী কেউ কারো ভালো চায়, বল?”

“তাইলে আপা, তুমি যে হীরণ ভাইয়ের পছন্দ জাইন্যা মুরগীর মাংস রাইন্ধ্যা আমার নাম কইরা তার কাছে পাডাইছো, তুমিও কী তবে হীরণ ভাইরে ভালোবাসো বইল্যাই যত্ন করার নাম কইরা পাডাইছো?”

বিন্দুর বোকা প্রশ্নের আস্তরণে অপরপাশ বহুক্ষণ নিশ্চুপ রয়। বিন্দুর এই অস্বচ্ছ মনের ভাব স্বচ্ছ করে না তার আপা। বরং মিছে ধমক দিয়ে কল কেটে দেয়। বিন্দুর মনে খচখচানি করা একটা কাঁটা বিঁধে থাকে শক্ত হয়ে। আপা সবকিছুর জবাব দিল কিন্তু ‘ভালোবাসে না’ কথাটা কেন বলতে পারল না? তবে কী….. বিন্দু আর ভাবে না। হীরণের তাড়ায় পা বাড়ায় মেলার ভেতরে। ভুলে যায় ফোনের ওপাশে ফেলা একটা মেয়ের দীর্ঘশ্বাস।

(২৮)

নতুন বাসা খুঁজতে ভালো ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল করবীকে। সেই ভোগান্তি থেকে তাকে উদ্ধার করল তিমির। বেশ ভালো মানের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিল করবীর সামর্থ্যের মধ্যেই। করবী সেই ফ্ল্যাটে বিন্দুদেরও যাওয়ার কথা বলল কিন্তু বাঁধ সাধলো বিন্দু। কান্নাকাটি করল অনেক মেয়েটা। কিন্তু এই এলাকা ছেড়েও সে যেতে পারবে না। কেন যেতে পারবে না তার উপযুক্ত কারণ যদিও সে দেখাতে পারেনি তবে করবী ভালো করেই জানে, আপার প্রতি ভালোবাসার চেয়েও হীরণের প্রতি ভালোবাসার ঘনত্ব বেশি মেয়েটার মনে। মেয়েটা ভালো করেই জানে, আপার সাথে দুরত্ব বাড়লেও ভালোবাসা কমবে না কিন্তু যদি হীরণের কাছ থেকে মেয়েটা দূরে চলে যায় তবে হয়তো কারণে-অকারণে লোকটা তাকে ভুলে যাবে। বিন্দু চায় না হীরণ ভাই তাকে ভুলুক। ভালো না বাসুক অন্তত মানুষটা তাকে একবেলা মনে করবে এতেই মেয়েটার ঢের চলে যাবে। আর বিন্দু সেই চলে যাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না।

পড়ন্ত সন্ধ্যা বুক পেতে দাঁড়িয়েছে ধরার অন্তরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে পড়ন্ত সন্ধ্যায় মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল করবী। আগামীকালই এই বাসাটা ছেড়ে চলে যাবে তারা। তারপর হয়তো সন্ধ্যা আরও দেখা হবে কিন্তু এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আর মুগ্ধ হওয়া হবে না। যে দেয়ালের কোল ঘেঁষে জন্ম নিয়েছে তাদের কত অভাবের গল্প, সে দেয়ালটি আর কয়েকদিন পর অন্য কারো স্মৃতি আটকাতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাদের পর এই শূন্য ঘরটিতে হয়তো নতুন কেউ আসবে। তাদের চেয়ে দ্বিগুণ পরিপূর্ণ রাখবে ঘরটিকে। ঘরটাও বোধহয় ভুলে যাবে একটি মেয়ে কিশোরী থেকে তরুণী হয়েছিল এই আধ-খষা বিল্ডিং-এর এই রুমটিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে করুন বাক্য হলো— এই পৃথিবী কোনো স্থান শূন্য রাখে না। যেমন তাদের অভাবে শূন্য থাকবে না এই প্রাচীর, এই বারান্দা, এই বিষাদ স্মৃতি জড়িয়ে রাখা ঘরটি।
এমন করেই নতুনের আবির্ভাবে ধুয়েমুছে যায় পুরোনো। এমন করেই মহাকাল লুকিয়ে যায় ইতিহাসে। করবীর মনে কেবল একটা প্রশ্নই বার-বার উঁকি দিচ্ছে, যে ছেলেটা তাকে একটু দেখবে বলে দূর ল্যাম্পপোস্টের সামনে রাতের পর রাত দাঁড়িয়ে থাকতো, সে ছেলেটা এরপর থেকে কোন অজুহাতে নিশি জাগবে? এই ছেলেটার বুকের একপাশ কী করবীর শূন্যতায় পুড়বে? নাকি পূরণ করার জন্য পৃথিবীর তাগিদে তার জীবনে নতুন কেউ আসবে? আরও গাঢ় ভাবে আরও গোপনে? করবীর মতন করে কী তবে ছেলেটা অন্য কাউকে ভালোবাসবে?
কথাটা ভাবতেই করবীর গা শিরশির করে উঠল। কী অদ্ভুত ভাবনা তার! যে ছেলেকে কখনো সে আনমনে ভাবেইনি, তার বুকের ভেতর কে থাকবে সেটা নিয়ে হা-হুতাশ করা কী ওর সাজে? মোটেও না। তবে ভালোবাসা পেতে পেতে একটা লোভের জন্ম নেয়-ই। এই পৃথিবীতে এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অভ্যাস কেই-বা কাটাতে চায়?

করবীর মন আতঙ্কিত হলো। এসব ভাবনা যে বড়োই হাস্যকর! বিন্দুর মতন পাগলাটে মেয়ের ভালোবাসা যে ছেলেটার জন্য, সে ছেলেটাকে করবী কখনোই ভালোবাসবে না। কখনোই না। করবীর নিজের ভাবনায় নিজেই মন খারাপ করল। আশেপাশে কাউকে খুঁজে না পেয়ে খাঁচায় থাকা বাণীর দিকে এগিয়ে গেল। অবুঝ প্রাণীটিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” বাণী, আমাদের ভালোবাসার প্রতি এতো লোভ জন্মায় কেন? কেন ভালোবাসা পেলে আমরা পাথর হয়ে থাকতে পারি না? মানুষ কী তবে ভালোবাসাতে আটকে যায়? মায়ার টান এতটা?”

করবীর মন খারাপ বাড়ে। আজ ভীষণ ভাবে সে অনুভব করে মা না থাকার যন্ত্রণা। আজ মা থাকলে সংশয় পরিষ্কার করা যেত। মা নিশ্চয় তার মন বুঝতো? মা নিশ্চয় বলতে পারতো, মায়া কাটে কীভাবে? কেন তার মা নেই? এত অভাবের মাঝে মা না থাকার মতন বড়ো অভাবটা সৃষ্টিকর্তা না দিলেও তো পারতেন। পারতেন না-কি?

নীরব সন্ধ্যা কেটে রাত নামল। ভাবনা তখনো টইটুম্বুর। আর সেই ভাবনার সুতো ছিঁড়তে ভেসে এলো হীরণের চিৎকার। ভয়ঙ্কর ভাবে লোকটা করবীকে ডাকছে। তবে কী ছেলেটা জেনে গেল, তার নিশি জাগরণে কারণ হারাতে চলছে?

#চলবে…..

#বুকপকেটের_বিরহিণী
১৭ এর বর্ধিতাংশ
কলমে: মম সাহা

শান্ত পরিবেশ মুহূর্তেই অশান্ত হৈচৈ-এ আবদ্ধ হয়ে গেল। করবী তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইল উদ্ভ্রান্ত হীরণের দিকে। ছেলেটা আজ নিজের মাঝে নেই যেন! চোখ-মুখ লাল টকটকে। কেমন দুলছে শরীর। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছেও। করবী পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে বলল,
“চিৎকার করবেন না এমন করে। আপনার জন্য আমি আবার মানুষের কাছে খারাপ হতে পারব না।”

“চিৎকার করবোই। একশবার করব। রুবী, তুমি আমারে ছাইড়া যাওয়ার দুঃসাহস কেন দেখাইলা? আমার দোষ কী বলো। বলো। ”

হীরণের গলা আরেকটু উঁচুতে ওঠল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিন্দু কাঁপছে ভয়ে। তাকে জাপ্টে ধরে কাঁপছে হুতুমও। হীরণের এমন ভয়ঙ্কর রূপ যে বড়োই অপরিচিত তাদের কাছে। করবীর মন ভীত হচ্ছে। মানুষ জড়ো হয়ে গেলে সমস্যা হবে। শেষ মুহূর্তে আবারও মানুষের কালি ছোড়াছুড়ি সে নিতে পারবে না।

“কথা বলছো না কেন? তুমি এই এলাকা ছেড়ে যাচ্ছ আর আমাকে জানাওনি! তুমি কী ভেবেছ আমি জানব না? ভালোবাসছি অনেক তাই তোমার এমন আচরণ? এত অবহেলা? ভালোবাসার বিনিময়েই কী এমন আঘাত প্রাপ্য আমি?”

করবী নিজেকে ধাতস্থ করল। শীতল কণ্ঠে বলল, “এখানে তো চিরজীবন আমি থাকতে পারব না, একদিন না একদিন যেতেই হতো।”

“তোমাকে দেখে আমার চোখের তৃষ্ণা মিটে। তুমি তা জানো। এবং সেজন্যই এই পদক্ষেপ তাই না?”

“চিরজীবন আমি আপনার চোখের তৃষ্ণা মেটানোর দায়ভার হয়ে তো থাকব না।”

“কেন রুবী তুমি এত কঠিন হচ্ছো? কেন? আমাকে একটু দয়া করা যায় না? আমি কী এতই খারাপ? আমাকে ভালো না বাসো অন্তত আমার থেকে ভালোবাসার সুযোগটুকু কেড়ে নিও না।”

হীরণের নিঃসংকোচ প্রেম নিবেদনে ভ্যাবাচেকা খেলো করবী। অসহায় চোখে তাকাল বিন্দুর দিকে। মেয়েটার চোখে জল। করবী আজ মাথা ঠাণ্ডা রাখল। রাগ করল না। চিৎকার করল না। বরং হীরণের কাছে এগিয়ে গেল দু’কদম। এই প্রথম সকল সংশয়, অস্বস্তি, বাঁধা-ব্যবধান ভেঙে করবী হাত রাখল হীরণের হাতের বাহুতে। শীতলের থেকেও শীতল কণ্ঠে বলল,
“তোমার জীবন আমার জন্য থেমে থাকবে না, হুতুমের মাস্তান। বরং আমি নামক অস্বচ্ছ আদল স্মৃতি থেকে মুছে ফেললেই দেখবে তোমার জন্য একটি মেয়ে আনমনে সন্ধ্যা কাটায়। তোমার কষ্টে কেউ কাঁদে। তোমার খুশিতে কেউ হাসে। এত বড়ো জীবন আমাদের, কাউকে একপাক্ষিক ভালোবেসে কাটানো যে সহজ নয় এবং সম্ভবও নয়। জীবনকে সুন্দর করতে কারো নিখাঁদ ভালোবাসা প্রয়োজন। আর আমি জানি, তোমার জন্য কেউ হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে তুমি কেন বোকা হচ্ছো? ভালোবাসা যদি ভিক্ষার দান হতো, তবে আমি অনায়াসে তা দিতে রাজি ছিলাম কিন্তু তা যে সম্ভব নয়। আমাকে ছাড়াও তোমার পৃথিবী অনেক বড়ো। একবার সে পৃথিবী দেখো, মাস্তান। দেখবে তোমার এই আকুতি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।”

সকল দেয়াল ছিন্ন করে বখাটে ছেলেটির প্রতি করবীর এমন কোমলতা যেন ছিল বহু সাধনার এক পশলা বৃষ্টির ন্যায়। এবং সে বৃষ্টি শীতল করে দিল সব। অশান্ত পরিবেশ, অশান্ত ছেলেটিকেও। হীরণ থেমে গেলে, চুপ হয়ে গেল তার চিৎকার-চেঁচামেচি, সকল অভিযোগ। করবী এবার ছুটে চলে গেল বিল্ডিং এর ভেতর। হীরণ দাঁড়িয়ে রইল করুণ হাসি নিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সবচেয়ে ঝলমল করা তারাটার উদ্দেশ্যে বলল,
“আম্মা, রুবী বড়ো চালাক। দেখলে? ও জানে আমার রাগ পানি কীভাবে হয়! ও সব জানে, আম্মা, সব জানে। কেবল এতটুকুই জানল না, যতটুকু জানলে ওর ভালোবাসা আমি হতাম। আম্মা, মায়ের পর আমরা যে নারীরে ভালোবাসি, সে-ই নারী কতটা সৌভাগ্যবতী তাই না বলো? তবুও আমার রুবী বুঝল না। কেমন অনায়াসে সে এমন সৌভাগ্য ঠেলে দিল অবলীলায়! দেখলে আম্মা, আমার রুবী কত্তো বোকা! কত্ত বোকা!”

চিরজীবনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে থাকা মায়ের দিকে ব্যাথার বাণ ছুঁড়ে মেরে হু হা করে হেসে উঠল হীরণ। বিন্দু কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখল। কেবল একা বিন্দু নয় অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বোকা রুবীটাও দেখল, কাঁদল। দু’হাতে মোনাজাত করল, তাকে অসম্ভব ভালোবাসা ছেলেটা ভালো থাকুক। ভুলে থাকুক।

মাঝ রাতে তুমুল বর্ষণ হলো। ভিজে একাকার হলো হীরণ। সে নড়ল না। এই একটা রাত-ই তো তার রুবীর নিঃশ্বাসের আশেপাশে থেকে কাটাবে। তারপর তো রুবী অনেক দূর, বহুদূরে চলে যাবে। চাতক পাখির ন্যায় জেগে রইল বিন্দুও। ভয়ে ঘেঁষতে পারেনি হীরণের কাছে তবে দুঃখের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যে মানুষটা বিন্দুর মতন মেয়ের মেলা ঘুরার ইচ্ছে পূরণ করেছে সে মানুষটার দুঃখে দূরের সঙ্গী হবে না সে! এতটা পাষাণ যে বিন্দু নয়। শূন্য রাস্তা দেখল, কত কাতরতায় ভিজছে দু’জন মানব-মানবী। হীরণের মনের কোথাও ছিল হয়তো রুবী তার মাথায় ছাতা ধরতে আসবে কিন্তু সে ভুল। তার বোকা রুবী ছাতা হয়নি, না সঙ্গী হয়েছে। হীরণের গলা ভেঙে গিয়েছে টানা ভিজতে-ভিজতে। সেই ভাঙা গলায় অনেকক্ষণ পর বিন্দুর উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই ভিজছিস কেন?”

“তুমি ভিজছো বলে।” বিন্দুর সহজ-সরল উক্তিতে হাসল ছেলেটা,
“আমি না-হয় প্রেম হারানোর শোকে ভিজছি। তোর কী দুঃখ?”

“তোমার দুঃখই তো আমার দুঃখ, হীরণ ভাই।”

হীরণ থমকে গেল। সহজ-সরল বিন্দুর দিকে তাকিয়ে রইল বহুক্ষণ। তার এই শূন্য জীবনে কেউ তো এমন করে তার দুঃখে দুঃখী হলো না! তবে এই মেয়েটা কেন এমন? তবে কী খুব গোপনে তার জন্য ছাতা ধরার মানুষ পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে?

এই ভালোবাসায় অবুঝ দু’টো ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল করবী। ভিজে একাকার তার দেহ। যে আজ বহুদিন যাবত ভিজছে নিঃসঙ্গ। ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়া হীরণেরও শেষবেলার সঙ্গী আছে। কেবল সঙ্গীহীন রয়ে গেল করবী। এই বিশাল পৃথিবীতে মেয়েটার কেউ নেই। কেউ না। অথচ কেউ জানলোও না সেই ছোটোবেলা থেকে একটি মেয়ে যুদ্ধ করতে করতে আজ ক্লান্ত। জানবেই বা কীভাবে? করবী যে চিৎকার করতে জানেনা, কাঁদতে জানেনা। তাই মানুষ তার কষ্ট মাপতেও জানেনা।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে