#বুকপকেটের_বিরহিণী
পঞ্চদশ পর্ব:
কলমে: মম সাহা
(২৩)
সকাল হতেই চুলায় চায়ের পাত্র উঠেছে। তিমিরদের আবার চা-ছাড়া সকাল ভালো কাটে না। ড্রয়িং রুমে টিভির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিদিশাই টিভি অন করে রেখেছে। এটা ওর প্রাত্যাহিক অভ্যাস। যখন ওর কাজ করার সময় আশেপাশে কেউ না থাকবে, তখনই ও টিভি অন করে রাখে। এতে ওর মনেহয় যে ওর সাথে কেউ কথা বলছে। ও একা নয়। আজ আবার কাজের আন্টিও আসেননি। তাই ও আরও একা হয়ে গিয়েছে। তার উপর তার শাশুড়ির বাতের ব্যাথা বেড়েছে। সেজন্য ভদ্রমহিলা আর বিছানা থেকে নড়তে পারছেন না। তন্মধ্যেই ওদের বাড়িতে থাকা ল্যান্ডফোনটি বেজে উঠল। সচারাচর ল্যান্ড ফেনে তেমন কেউ কল দেয় না। আধুনিকায়নের যুগে যেখানে স্মার্ট ফোন ব্যবহার হয় হাতে-হাতে সেখানে ল্যান্ড ফোনেরই-বা কী প্রয়োজন পরে! ফোনটা কেবল ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই রাখা। কেমন নবাবিয়ানা প্রকাশ পায়!
বিদিশা টিভির শব্দে প্রথম বার শুনতে পেল না। কিন্তু দ্বিতীয় বার ঠিক শুনল। দ্রুত ছুটে গিয়ে রিসিভ করল ফোনটা। তখনই অপর পাশ থেকে ভেসে এলো মেয়েলি মৃদু কণ্ঠ,
“হ্যালো…..”
মেয়েলি কণ্ঠটি বড়ো পরিচিত ঠেকল বিদিশার কাছে। কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারল না কার কণ্ঠ। তাই সে শুধাল, “কে?”
জবাব এলো, “ভাবি বলছেন?”
বিদিশা এবার চমকালো। মেয়েলি কণ্ঠের অধিকারীনি তাহলে তাকে চেনে! বিদিশা কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হ্যাঁ?”
“ভালো আছেন, ভাবি?”
“এই তো ভালো। কে বলছিলেন ঠিক চিনলাম না!”
“আমি আশাবরী। তিমিরের…. ”
বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ হতে দিল না বিদিশা। মুখ-চোখ শক্ত করে বলল, “আপনি ভাইয়ার কেউ না। এ নাম্বারে কেন কল দিয়েছেন?”
বিদিশার হুট করে কণ্ঠ বদলে হয়তো অপরপক্ষ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
“কেউ না তা তো জানি। আসলে কল দিয়েছিলাম ভিন্ন কারণে। সেদিন কলেজে গিয়েছিলাম আমার ইন্টারের মার্কশীট, সার্টিফিকেট গুলো আনতে। কাগজ গুলো দরকার। কিন্তু কতৃপক্ষ হেয়ালি করছেন। আমার খুব দরকার সেগুলো। ভেবে ছিলাম তিমির তো পুরোনো স্টুডেন্ট। তা-ও আবার সেই ভার্সিটির। তিমির একটু ব্যবস্থা করে দিলে কাগজ গুলো দ্রুত পেতাম।”
“ভাইয়া এখন এ-শহরে থাকেন না। তাছাড়া আপনারাও তো এ-শহর ছেড়ে ছিলেন! আবার এলেন কেন?”
“ভয় পাবেন না। শহর ছেড়েছি আবার শহরে ফিরে এসেছি বলে ভাববেন না মানুষদের কাছেও ফিরে আসব। শহর আমাকে ভুলেনি। তার স্মৃতিতে আজও আমি ভীষণ সতেজ। তাই তার কাছে আসতে হয়েছে। মানুষের মনের ক্ষেত্রে তো তা-না। মানুষের চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল করে ফেলে। তাই ফিরে আসার চান্স নেই। তাছাড়া সংসারে আমার শিকড় বহুদূর চলে গেছে। সেটা ছিন্ন করে আসা সম্ভব না।”
“কিন্তু আপনার বাতাসও এ শহরে বইলে কিছু মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে। বুঝেন না এটা?”
“ভাবি, যদিও আপনি আমাকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, কিন্তু দুনিয়া জানে আমি শেষবেলা অব্দি যু দ্ধ করেছি। কারো বেঁচে থাকা দায় করার কোনো ইচ্ছে আমার কখনো ছিল না। যাই হোক, রাখছি তবে।”
“আর কখনো কল দিবেন না।”
“চিন্তা করবেন না। দিবো না। আমি কারো জীবনের কাঁটা হতে চাইনি। ফুল হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম, ভাবি।”
কথাটি শেষ করে বিনা অপেক্ষায় মেয়েটি ফোন কাটল। বিদিশা দাঁড়িয়ে রইল স্থির। সে আশাবরীকে এভাবে বলতে চায়নি। মেয়েটাকে সে কখনোই সামনে থেকে দেখেনি। ছবি দেখেছে অনেকবার। আর দু একবার মেয়েটার গান শুনেছিল তিমিরের ফোনে। সে আসার আগেই আশাবরীর চাপ্টার এই পরিবারের থেকে মুছে গিয়েছিল। তাই নতুন করে আর পরিচয় হওয়া হয়নি।
নিজের স্থির ভাব কোনোমতে ধামাচাপা দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে তেল গরম করল সে। শাশুড়ির পায়ে মালিশ করার জন্য। তেল গরম করেই শাশুড়ির ঘরে প্রবেশ করল সে। ভদ্রমহিলা তখন চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমিয়ে গিয়েছে কি-না বুঝার উপায় নেই। বিদিশা শব্দ বিহীন মাটিতে গিয়ে বসল। হাত রাখল শাশুড়ির পায়ে৷ ঠিক তখনই তড়াক করে ওঠে বসল তাসনীম বেগম। কণ্ঠস্বর তার গম্ভীর,
“কে কল করেছিল?”
বিদিশা ভড়কালো না মোটেও। বরং নরম কণ্ঠে বলল, “আশাবরী।”
“তুমি তক্ষুনি কয়টা কড়া কথা কেন বললে না ওকে?”
শাশুড়ির তেজীয়ান কণ্ঠের বিপরীতে হাসল মেয়েটা। বলল,
“কতটুকু কড়া কথা বলব, মা? যতটুকু কড়া কথা বললে মানুষ একজন মানুষকে ছাড়ার ক্ষমতা রাখে, ততটুকু কড়া কথা আপনি তাকে বহুবছর আগেই তো বলে ফেলে ছিলেন।”
তাসনীম বেগম তার পুত্রবধূর এহেন শীতল অথচ তীক্ষ্ণ কথায় হতভম্ব হলেন,
“তুমিও কী আমাকে দোষ দিচ্ছ?”
বিদিশা জবাব দিল না। স্থির দৃষ্টি তার শাশুড়ির পায়ের দিকে। নরম হাতে সেখানে অবিরাম মালিশ করে যাচ্ছে। তাসনীম বেগম তখনও প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
বেশখানিকটা সময় পর বিদিশা উত্তর দিল,
“আপনি সন্তানের ভালোই চেয়ে ছিলেন আমি জানি, মা। কিন্তু কী লাভ হলো সে ভালো চেয়ে? বড়ো ছেলে তো রাগ করে দেশের বাহিরেই চলে গেল। ছোটোজন যা-ও আপনার কাছে রইল তাও যোজন যোজন দূরের হয়ে। শেষ পর্যন্ত সবার ভালো করতে গিয়ে কেমন নিষ্ঠুর করে দিলেন সম্পর্ক গুলো! সেই আফসোস থাকেই, মা।”
বিদিশার কথা শেষ হতেই তাসনীম বেগম মেয়েটার হাতটা টেনে ধরলেন। আফসোস করে বললেন,
“আর কার সাথে কী অন্যায় করেছি আমি জানিনা। তবে তোমার সাথে আমি অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করো।”
বিদিশা আর কথা বলল না। তাকিয়ে রইল খুব দূরে নির্নিমেষ। সেই গ্রাম, সেই নতুন প্রেমে পড়ার ক্ষণ ভেসে উঠে স্মৃতির পাতায়। যা আজ নিছক গল্প। দৃষ্টিরা তার মৃত।
(২৪)
করবী নিজের হাতে হুতুমকে গোসল করিয়ে দিয়েছে আজ। নতুন একটা ফ্রক পরিয়েছে। বাচ্চাটা এতেই ভীষণ খুশি। সবুজ রঙের ফ্রকটা পরে ছুটে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। খেলার ছলে ভুলে গিয়েছে প্রিয় মানুষ হারানোর শোক।
কিন্তু বিন্দু বাচ্চা নয়, তাই নতুন ফ্রক কিংবা কোনো বাহানায় মেয়েটার শোক ভুলানো সম্ভব হচ্ছে না। কেমন উদাস থাকে অতটুকুন মেয়েটার মন! ঝলমল করে হাসে না, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে না তার উপর। তবে শোকও দেখায় না আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে। কেঁদেকেটে বালিশও ভেজায় না। কেবল চুপ করে থাকে। আজ করবী ভেবেছে শপিং করতে যাবে। বিন্দুর শাড়ি পছন্দ কিন্তু কখনো মেয়েটা কোনো শাড়ি পরেনি। তাই করবী ওর জন্য শাড়ি আনবে। একদিন আমেনা খালাই বলে ছিলেন, বিন্দুর শাড়ির প্রতি আলাদা আগ্রহ। আর বিন্দুও একদিন বলেছিল সে শাড়ি পরবে, হীরণ ভাই পাঞ্জাবি পরবে এবং দু’জন ঘুরতে যাবে। হয়তো এই একটা উপায়ে মেয়েটাকে খুশি করা যাবে!
যেমন ভাবনা, তেমর কাজ। করবী তার ঘরের মোটামুটি রকমের আলনাটা বিক্রি করে দিল। কাঠের আলনা, কেনার সময় কিনেছিল সাড়ে এগারো হাজার টাকা দিয়ে কিন্তু বিক্রি করল মাত্র তেইশো সত্তর টাকায়। করবীর হাত ফাঁকা। তেমন টাকা নেই। তাই শাড়ি কেনার টাকাটা জুগালো বড়ো মায়া ত্যাগ করে। আলনাটা তার ভীষণ পছন্দের ছিল কি-না! একটা পছন্দ ত্যাগ করে আরেকটা পছন্দের কাজ করবে। তাতে আফসোস কিসের? বিন্দু তার শখের মানুষ। মেয়েটার সুখের জন্য সে সব করবে।
বিন্দু এবং করবী মিলে বড়ো রাস্তায় গেলো। শপিংমল থেকে একটা শাড়ি কিনল, তার সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবিও কিনলো। শপিং করে বের হওয়ার সময়ই পেছন থেকে তার ডাক ভেসে এলো,
“করবী না?”
করবী পেছন ফিরে তাকাল। এক দেখায় চিনতে পারল না মুখটা। কিছুক্ষণ ভেবে অতঃপর বলল,
“চিনলাম না যে!”
বোরকা পরিহিতা নারীটি তখন এগিয়ে এলো করবীর দিকে। হাসি-হাসি কণ্ঠে বলল,
“আশাবরী, চিনেছ?”
করবী কতক্ষণ ভাবল। তারপর হুট করে মনে পড়তেই হাসল খানিক,
“আশা! ভালো আছেন? আপনাদের ছোট্টো করবী ভালো আছে?”
আশাবরী হাসল। জবাব দিল, “ছোটো করবী বড়ো হয়েছে। ভালো আছে।”
তারপর আরও টুকটাক কথা আদান-প্রদান হলো তাদের ভেতর৷ আদান-প্রদান হলো বাড়ির ঠিকানা এবং নাম্বারও। করবী প্রস্থান নিল বিদায় জানিয়ে। আশা তাকিয়ে রইল সে প্রস্থানের দিকে। সে মনে-মনে কত খুঁজেছিল মেয়েটাকে! অবশেষে পেল!
অপরদিকে করবী বের হয়েই হীরণকে কল দিল, গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার জন্য একটা কাজ করে পারবেন?”
“একবার বলে দেখো, জান দিয়ে দিব।”
হীরণের কথার বিপরীতে তাচ্ছিল্য হাসল করবী,
“যার জন্য জান দিতে পারবেন তারই মানহানি করতে একবারও ভাবেননি। যাই হোক, আমি চাই আমার জন্য আপনি আরেকবার ভালোবাসুন অন্য কাউকে। যে আপনাকে আপনার চেয়েও ভালোবাসে।”
করবীর উত্তরে নীরব হয়ে গেল হীরণ। এরপর হতাশ স্বরে বলল,
“জান দিয়ে দিব বলাতে সত্যি সত্যিই যে জান কেড়ে নিতে চাইবে ভাবিনি। তোমারে রেখে অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার কাছে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মতনই নিষ্ঠুর। বিসর্জনের ব্যাথা আমি সইতে পারব না, রুবী।”
#চলবে…….