#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: চতুর্দশ
কলমে: মম সাহা
জীবনে কত ধরণেরই স্মৃতি থাকে। কিন্তু কারো মৃত স্মৃতি করবীর ভাণ্ডারে নেই। ছোটোবেলা থেকে একা একা থাকার ফলে কখনো, কোনো কাছের মানুষকে মৃত অবস্থায় সে দেখেনি। তাই কোনো আপন মানুষের মৃতদেহ ঠিক কতটুকু যন্ত্রণা দেয়, তা সম্পর্কে তার ধারণা নেই বললেই চলে। এবং সেই ধারণা না থাকায় সে এলাকার ভীড়ের ভেতর আবছা ভাবে লাশ বাহী খাটটা দেখেই বড়ো দমবন্ধকর অনুভূতি অনুভব করল। একবার ভাবল টিউশন করাতে চলে যাবে। সন্ধ্যার দিকে ফিরতে ফিরতে নিশ্চয় লাশটি কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু পরক্ষণেই যেন কি ভেবে আর গেল না। বরং ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে নিজের বিল্ডিং এর দিকে পা বাড়াল। আমেনা খালা তো বললেনই, বিন্দু অপেক্ষা করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বিন্দুর কাছে যাওয়া বেশি ভালো মনে হলো তার।
কিন্তু করবী ভাবনা অনুযায়ী পাশ কাটিয়ে শেষমেশ আর যেতে পারল না। তার আগেই গগণ বিদারক চিৎকারের কণ্ঠটি তার ভীষণ পরিচিত মনে হলো। থেমে গেল করবীর পা। অতঃপর দ্রুত ভীড় ঠেলে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল লাশটির সামনে। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশটি দেখে পা কাঁপে করবীর। শরীরও যেন ঝাঁকিয়ে উঠে কেমন করে। মাথা ঘুরিয়ে যায় কড়া আতুরের ঘ্রাণে। করবী অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল কেবল, “আমেনা খালা!”
করবীর যেন বিশ্বাস হতে চায় না। লাশটি তার আমেনা খালার। কই, একটু আগেই তো সে আমেনা খালার সাথে কথা বলল! আমেনা খালা তাকে কতই না আদর করলেন! ওর কী মতিভ্রম হচ্ছে? ভুল দেখছে কী? নাহলে আধাঘন্টা আগেও যে মানুষটারে চোখের সামনে দেখলো সে মানুষটা কীভাবে লাশ হবে? এটা কী আদৌ সম্ভব?
করবীর ভাবনার মাঝে কেউ একজন ছুটে এসে আকস্মিক জড়িয়ে ধরল তাকে। করবীর ভাবনা ছুটল, বি স্ফো রিত নয়ন যুগল মেলে সে বুকের মাঝে থাকা মানুষটার দিকে চাইল। বিন্দু মেয়েটা জাপটে ধরেছে তাকে। কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা! করবীর মায়া হলে। হাত রাখল বিন্দুর মাথায়। অবাকের ছায়া কণ্ঠে ধরে রেখেই উদাস কণ্ঠে শুধাল,
“খালার কী হয়েছিল? কীভাবে হলো?”
বিন্দুর কাঁদতে কাঁদতে দম বন্ধের উপক্রম হলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
” জানিনা আপা, জানিনা। কাইল রাইতেও তো দেখলাম সুস্থ আছে। কিন্তু আইজ সকালে ঘুম থেইকা জাগাইতে গিয়া দেহি আম্মা নড়েচড়ে না। ঠান্ডা হইয়া আছে তার শরীর। আমার আম্মা আমারে ফাঁকি দিল, আপা? আমার আম্মা আমারে একলা কইরা দিতে পারল?”
করবীর ভীষণ কান্না এলো। বাঁধ ভাঙা কান্না। যতদিন যাবত চেনে আমেনা খালাকে, মহিলা রাগী কিন্তু ভীষণ ভালোও। করবী মায়ের আদর চিনতো না, আমেনা খালা শিখেয়েছিল সে আদর। অথচ সে মানুষটা কি-না আর নেই? তাও কিছুক্ষণ আগেও যে মানুষটার সাথে তার এত কথা হলো!
বিন্দুর কান্নার দাপট বাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে কত কথা বলল! কোন গরমে বিন্দু গ্রামের এক বাড়ি থেকে আম চুরি করেছিল বিধায় তার আম্মা তার হয়ে ঝগড়া করেছিল! কোন শীতে বিন্দুর ভীষণ জ্বর হয়েছিল বিধায় আম্মা সেই ভোরের কুয়াশায় খালি পায়ে হেঁটে মেয়ের নামে মানত করতে গিয়েছি শীত উপেক্ষা করে। শীত, গ্রীষ্ম- এর সব গল্পই বলল। গলিতে ভীড় ধীরে ধীরে কমলো। বিন্দুর আহাজারি নীরবে শুনল করবী। আটকালো না মেয়েটাকে। ছোট্টো হুতুমও কী ভীষণ কান্না! মৃত্যুর মতন ভারী শব্দটাও যেন বাচ্চা মেয়েটি উপলব্ধি করতে পারছিল।
করবী কেবল এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল খালার ফ্যাকাশে মুখটির দিকে। সবটাই যেন মিথ্যে মনে হচ্ছে তার। চোখের সামনে কত স্নেহের দৃশ্য ভেসে উঠলো! একবার করবীর হাত পুড়ে গিয়েছিল রান্না করতে গিয়ে। এই খালাই দুনিয়ার ছুটোছুটি করেছে তাকে নিয়ে। যার জন্য খালার এক বাসার কাজও ছাড়তে হয়েছিল অতিরিক্ত বন্ধ দিয়েছে বলে।
আবার কখনো কখনো খালা শুটকি ভর্তা করে করবীকে ডেকে পাঠাতেন। করবী গেলে পাটার মাঝে ভাত মেখে করবী, বিন্দু এবং হুতুমকে মুখে তুলিয়ে খাইয়ে দিতেন। আবার আদর করে বলতেন, “পাটা মোছা ভাত যেই মজা! তুমি না আইলে বিন্দু ওগোরেও খাইওয়াইতে পারি না। তোমার তো এইডা খুব পছন্দের।”
আবার কোনোদিন যদি মাছ রান্না হতো বিন্দুদের ঘরে, করবীর জন্য একটা টুকরো হলেও রাখতো।
সব সুন্দর স্মৃতি ভেসে উঠলো চোখের উপর! ভুল করেও কোনো খারাপ স্মৃতি আশেপাশেও এলো না। মৃত্যু কত পবিত্র! সে যাকে ছুঁয়ে যায় তার সকল খারাপ কাজই মানুষ ভুলে যায়। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে কখনো মানুষ সেই মৃত ব্যাক্তি সম্পর্কে খারাপ কথা ভাবতেও পারে না।
ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে রাত হলো। লাশ নেওয়ার মতন মানুষ বিন্দুদের এই শহরে নেই। সেই ভাবনায় যখনই করবীর মন ভীত হলো ঠিক তখনই হীরণ উপস্থিত। সাদা পাঞ্জাবি পরনে তার। তার সাথে আরও ছেলেপেলেও এসেছে। হীরণ আজ চোখে চোখ রাখেনি। এসেই মাথা নিচু করে এক সাইডে দাঁড়াল। তার সঙ্গের একটি ছেলে এসে করবীকে ডাকল,
“আপু, লাশটি তো নিতে হবে। রাত হচ্ছে। আমরা সব বন্দোবস্ত করে এসেছি। আপনারা অনুমতি দিলেই নিয়ে যাবো।”
করবী উত্তরের আশায় তাকাল বিন্দুর দিকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত প্রায়। চোখ ফুলে গেছে অনেক। কিন্তু কণ্ঠে তেজ,
“হীরণ ভাইয়ের সাহায্য লাগব না। হেয় যেন এইখান থেকে চইল্যা যায়।”
হীরণের চোখ অত্যাধিক লাল। সেই লাল আস্তরণের নিচে তুমুল অনুশোচনা গ্রাস করে আছে। করবী বুদ্ধিমতী। বিন্দুর চেয়ে তার বয়স বেশি। তার বোঝার ক্ষমতাও বেশি। হীরণের প্রতি বিন্দুর অভিমান আছে আর তার হলো রাগ আছে। অভিমানের চেয়ে রাগের তেজ বেশি। তবুও করবী এই মুহূর্তে কোনোরকম রাগারাগিতে গেল না। বরং বিন্দুকে আগলে ধরল, ভরসা দিল,
“খালার শেষ কাজটা ভালো ভাবে সম্পন্ন হোক, বিন্দু। এখন জেদ দেখাস না।”
বিন্দুর অভিমানী চোখ টলমল করে উঠল। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে বলল,
“এই হীরণ ভাইয়ের লাইগ্যা আমার আম্মা এই কয়টা দিন অনুশোচনায় পুইড়া মরছে। প্রতিদিন খালি কইছে ‘বিন্দুরে, মা হারা মাইয়াড্যারে এমনে সবার সামনে সম্মানহানি কইরা আমি বড়ো পাপ করছি। আমার এই পাপের ক্ষমা হইবো না। মাইয়াড্যা ফুলের মতন পবিত্র কিন্তু আমার লাইগ্যা তার চরিত্র নিয়া এলাকার মানুষ কথা কওয়ার সাহস পায়ছে। আমার এই পাপ আল্লাহ্ ক্ষমা করবো না’- এসব বলে এ ক’টা দিন আম্মা কত অনুশোচনা করছে গো, আপা। আমার আম্মা এই অনুশোচনায় তো মরলো। আপা তুমি আমার আম্মাডারে মাফ কইরো।”
করবীও বিন্দুর কান্নায় সাথী হলো। ভেঙে আসা কণ্ঠে বলল,
“আমি খালারে ক্ষমা করে দিছি, বিন্দু। তুই এসব বলিস না।”
বিন্দুকে থামিয়ে করবী অনুমতি দিল হীরণকে। হীরণ লাশের খাটটা ধরতে নিয়েও থেমে গেলো। হাঁটু মুড়ে বসল বিন্দুর সামনে। বিন্দুর দু’হাত আকড়ে ধরল নিঃসংকোচে। হীরণ কাঁদছে। অনুতপ্ত স্বরে বলল,
“আমারে ক্ষমা করিস, বিন্দু। আমি পাপী মানুষ, আমারে ক্ষমা করিস। মায়ের লাশ কাঁধে নেওয়া যন্ত্রণা অনেক। সে যন্ত্রণা আমি জানি। তুই কাঁদিস না, বিন্দু। আমরা আছি সবাই তোর সাথে।”
হীরণ কথা শেষ করতেই বিন্দু স্থান, কাল, পাত্র ভুলে ধপ করেই জড়িয়ে ধরল হীরণ ভাইকে। কী সে কান্না মেয়েটার! হীরণ আজ বাঁধা দিল না। বেশ খানিকক্ষণ কান্নার পর করবী বিন্দুকে টেনে নিল নিজের কাছে হীরণের ইশারায়। অতঃপর লাশ নিয়ে হীরণরা যাত্রা শুরু করল। বিন্দুর কণ্ঠ যেন ছিঁড়ে যায় এমন চিৎকার করল মেয়েটা। কাঁদল করবীও। একহাতে বিন্দু আরেক হাতে হুতুমকে জড়িয়ে রাখল সে। বিন্দুর সে কী আহাজারি!
” আম্মা, আম্মা গো, তোমারে কহনো সুখ দিতে পারি নাই। আমি তো জানি, তুমি কত কষ্ট নিয়া পৃথিবী ছাড়লা! আম্মা, আমি তোমার অক্ষম সন্তান গো। আমার জন্য গ্রাম ছাড়লা এখন ছাড়লা পৃথিবী। আমি তোমারে এমনই অশান্তি দিলাম জীবনে!”
হুতুম মেয়েটা করবীর পেট জড়িয়ে কাঁদলো। বার বার করবীকে প্রশ্ন করল, “বিন্দুর মা তো চইল্যা গেল, এহন আমার ঘুম না আইলে কে ঘুম পারাইবো? বাণীর মা, মানুষ মইরা যায় ক্যান? আল্লাহ কী জানেনা? মানুষ মইরা গেলে আমাগো কষ্ট হয়!”
করবী স্বান্তনার ভাষা পেল না। হীরণদের ভীড় কমতেই করবী খেয়াল করল দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে আমেনা খালা। পান খাওয়া দাঁত তার! কী নিখাঁদ হাসি! দু’হাতে বিদায় নিচ্ছে। চোখ দিয়ে ইশারা করে কী যেন বলছে! করবী ফ্যালফ্যাল করে সেখানে তাকিয়ে রইল। ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেনা খালাই তো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। করবী নীরবে দেখল। তার হাতেই যেন হুতুম আর বিন্দুর দায়িত্ব দিয়ে খুশি হলেন মানুষটা। করবী জানে, খালাকে কেবল সেই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে? তার উত্তর নেই। কারণ আধ্যাত্মিক কিছু জিনিসের কখনো বিশ্লেষণ হয় না।
#চলবে….