#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
দশম পর্ব:
(১৭)
বৃক্ষের যৌবন তখন বৃষ্টির জলে ধুয়ে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতম হয়ে উঠেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে বৃষ্টির অবশিষ্ট ফোঁটা গুলো। মনে হচ্ছে যেন শিশির বিন্দু। দুপুর হলেও আকাশ মুখে ফুটেনি হাসি। মেঘেদের অগোছালো জমাটবদ্ধতার কারণে চারপাশ ঢেকে আছে তুমুল আঁধারে। তবে বৃষ্টি নেই এখন। বৃষ্টির অদ্ভুত গন্ধটি মাটি থেকে উঠে এসে পরিবেশে একটি মায়াময় আবহ তৈরী করেছে।
করবী শুয়ে আছে তার রুমে। অন্ধকার রুমটা বৃষ্টির কল্যানে কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে প্রায়। যদিও বিন্দু কিছুক্ষণ আগে মুছে গিয়েছিল তাও লাভ হয়নি। মোছার পর আরেকবার দমফাটা বৃষ্টি এলো, অতঃপর যেমনের রুম তেমন হয়ে গিয়েছে।
রান্নাঘর থেকে তেলের ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে বাসন-কোসনের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। বাবা বোধহয় রান্না করছেন। মাছ ভাজার কড়া ঘ্রাণটা করবীর অসুস্থ নাকে এসে লাগছে। গা গুলাচ্ছে তার। জ্বর এলেই তার কোনো খাবারের গন্ধ সহ্য হয় না। বমি পায়। মাঝে মাঝে তো বমি করে ভাসিয়ে দেয়। তবে সচারাচর তার শরীর খুব সহজে অসুস্থ হয় না। এবার কেন হলো কে জানে!
শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যাথা হয়ে যাওয়ায় উঠে বসল সে। অসুস্থ পায়ে নড়বড়ে ভাবে দাঁড়াল মেঝেতে।
করবীর জ্বর নিয়ে কাটলো দু’দিন। শুধু কী তাই? এই দু’দিন সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত কেটেছে হীরণের। কখনো বাজার করেছে, কখনো ঔষুধ এনেছে, কখনো দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কেবল জ্বর কমার অপেক্ষা করেছে।
করবীর আজ জ্বরটা কিছুটা কমেছে। শরীরের উত্তাপও ক্ষীণ। জ্বরে মেয়েটার চেহারায় দেখা দিয়েছে মলিনতার ছাপ। চোখের নিচে পড়েছে অস্বচ্ছ কালির প্রলেপ। মনে হচ্ছে যত্নের কাজল অযত্নে লেপ্টে গেছে। তন্মধ্যেই করবীর ভাঙাচোরা মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠল। করবী ডান-বামে তাকিয়ে মোবাইলটা আবিষ্কার করল টেবিলের উপর। অসুস্থ পায়ে, দুর্বল শরীরটা টেনে নিয়ে খুব কষ্টে সে টেবিলের সামনে গেলো। অপরিচিত নাম্বারটি চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকালো। ফোনটা রিসিভ করার আগেই কেটে গেল। করবী মোবাইলটা আবার আগের স্থানে রাখতে নিলেই নতুন উদ্যমে বেজে উঠল কল। এবার কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেই রিসিভ করল সে। কল রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে একটি গম্ভীর পুরুষালী ভরাট কণ্ঠ ভেসে এলো,
“রক্তকরবী, বলছো?”
করবীর প্রথমে ঠিক বোধগম্য হলো না মানুষটা কে! কিন্তু কণ্ঠ শোনাল বেশ পরিচিত। সে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে জবাব দিল,
“জি? কে বলছেন?”
প্রশ্নের জবাবে অপর পাশে কেবল নীরবতা পাওয়া গেলো। তারপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা পেরিয়েই অপর পাশ আবার সরব হলো,
“তিমির। তুমি অসুস্থ?”
তিমির নামটা প্রতিধ্বনিত হতেই করবী হাত কেঁপে উঠল কিঞ্চিৎ। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের গুঞ্জন বাড়ল দ্রুত গতিতে। নিজেকে সামলালো সে খুব কষ্টে। আধো আধো ভাঙা কণ্ঠে জবাব দিল,
“এই আরকি, সামান্য।”
“অসুস্থতা নিয়ে বেড়াতে যাবার কী প্রয়োজন ছিল?”
তিমিরের অদ্ভুত প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো করবী। অবাক কণ্ঠে বলল,
“কখন বেড়াতে গেলাম?”
এবার যেন তিমিরও কিঞ্চিৎ থমকালো। অতঃপর সাবলীল ভাবে বলল,
“তুমি নাকি বাসায় নেই, বেড়াতে গিয়েছ! গতকাল তোমাদের বাড়ির সামনে গিয়ে ছিলাম। তখন একটি লোক জানাল।”
করবী যেন খুব সহজে বুঝতে পারল কাজটি কে করেছে। তবুও সে সংশয় ঝারার জন্য বলল,
“লোক বলতে? মধ্যবয়স্ক কেউ?”
“না। ইয়াং ছেলে। তোমাদের বাসার সামনে বাইক নিয়ে বসে ছিল।”
করবী মানুষটাকে চিনতে পেরে তপ্ত একটি শ্বাস ফেলল। কোনোরকমে কথা ঘুরিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, একটি প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান ছিল তাই যেতে হয়েছে।”
“সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার জন্য এমন ঠান্ডা লেগেছে?”
“ঐ আরকি।”
“তাহলে ঠিক আছে। ভবিষ্যতে আমি নাহয় ছাতা হলাম। ভেজার সঙ্গী তো অনেক হয়, ছাতা হতেই বা ক’জন পারে! জ্বর আর ছুঁতে পারবে না তোমায়। এই আমি কথা দিলাম এক দুপুরে। এই কথা চিরদিন থাকবে, যেমন করে থাকে দুপুর সকালের পরে।”
ভালো লাগার শিরশির অনুভূতিতে করবীর অসুস্থ শরীর ভোরে উঠল। মন তড়িৎ গতিতে সুস্থ হয়ে গেলো। কিন্তু সে বুঝত দিলো না তা বিপরীত পক্ষের মানুষটিকে। বরং খুব দ্রুত ‘রাখছি’ বলেই বিচ্ছিন্ন করল কলটি। বারান্দার কোল ঘেঁষে বিদ্যুৎ চমকানোর জ্বলজ্বল আলোটি এসে ছুঁয়ে গেলো করবীর মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া চোখ গুলোকে।
করবীর মুগ্ধতা কেটে গেল বাবার কথার শব্দে। বাহির ঘর থেকে বাবা যেন কার সাথে কথা বলছেন! করবী অপেক্ষা করল না। অসুস্থ শরীর নিয়েই এগিয়ে গেল রুমের বাহিরে। দেখল হীরণ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ শুকিয়ে আছে ছেলেটার। তৈয়ব হোসেন ব্যস্ত স্বরে বলছেন,
“এলে আবার চলে যাচ্ছ যে, বাবা? করবী কী ঘুমে এখনো? কথা বললে না যে ওর সাথে!”
হীরণের যে রাজ্যের ব্যস্ততা। যেতে-যেতে বলল,
“একটা কাজ পড়েছে। যেতে হবে, চাচা।”
কথা বলে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো ছেলেটা। তৈয়ব হোসেন ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বেশ প্রসন্ন স্বরে বলল,
“ছেলেটা না থাকলে যে কী হতো! নিজের ছেলের মতন সাহায্য করেছে।”
করবী নিশ্চুপে সবটা দেখল। হীরণ কী ওর কথা বলার সময় শুনেছিল সবটা? হয়তো তাই চলে যাচ্ছে! করবী ফিরে এলো ঘরে। হীরণের প্রতি ওর কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা অথচ ওর কোনোরকমের অনুভূতিই কাজ করে না ছেলেটার জন্য!
সিঁড়ি দিয়ে নামতেই বিন্দুর সাথে মুখোমুখি হলো হীরণ। বিন্দু গলা উঁচু করে কথা বলার আগেই লোকটা মুখ লুকিয়ে পালাল। বিন্দুর মনে হলো হীরণ ভাইয়ের চোখে যেন রাজ্যের অশ্রু। হীরণ ভাইয়ের কী আজ মন খারাপ! কাঁদছিলো কী সে? এ নিয়ে চিন্তা হলো মেয়েটার খুব।
কী অদ্ভুত তাই না? যারে আমরা চাই সে মূল্য দেয় না, আর যারে চাই না সে আমাদেরকে তার জীবন ভেবে বসে থাকে!
#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
একাদশ পর্ব:
(১৮)
বাহিরে আঁধার করা দুপুর দেখেই খিচুড়ি চড়েছে চুলোয়। তার ঘ্রাণে জুড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশ। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে কেবল অথচ বৃষ্টি নেই। বাতাসও নেই। কেবল থম মেরে থাকা এক গম্ভীর প্রকৃতি।
তিমির তার বারান্দায় থাকা ইজিচেয়ারটা ঘরে নিয়ে এলো। নাহয় বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাবে। এটা তার ভীষণ প্রিয় একটা বস্তু। চেয়ারটি এনে, একপাশে রাখতেই ঘরে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল তার মা তাসনীম বেগম দাঁড়িয়ে আছেন খাটের সাথে। তিমিরের শীতল মেজাজে দপ করেই আগুন জ্বলে উঠল। সে শরীর ঘুরিয়ে আবারও বারান্দায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই তাসনীম বেগম ডাকলেন ছেলেকে,
“শোন তিমির, কথা ছিল।”
তিমিরের বড়ো ইচ্ছে হলো অভদ্র হতে। মায়ের কথা না শোনার ভাণ করতে। কিন্তু শেষবেলায় গিয়ে সে অভদ্র হতে পারল না। অনিচ্ছা স্বত্তেও দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেকে দাঁড়াতে দেখে যেন কিছুটা ভরসা পেলেন তাসনীম বেগম। বললেন,
“কেমন কাটছে তোর দিনকাল?”
“এটা নিশ্চয় আপনার কথা না? যা বলার ভাবভঙ্গিমা ছাড়ায় বলুন।”
ছেলের কথার ধাঁচ বেশ মানে লাগল তাসনীম বেগমের। তিনি রেগে গেলেন কিছুটা,
“মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
“মা! কে মা?” তিমিরের কণ্ঠে শ্লেষাত্মক প্রশ্নটি শুনে হতভম্ব হলেন তাসনীম বেগম। কিংকর্তব্যবিমুঢ় কণ্ঠে বললেন,
“কে তোর মা, তা ভুলে যাচ্ছিস নাকি?”
“কেবল ভুলে যাচ্ছি না, অলরেডি ভুলে গিয়েছি। বুজেছেন আপনি?”
“তুই আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারিস না।”
“পারি, পারি। একশবার পারি। হাজারবার পারি।”
তিমিরের কণ্ঠের উগ্রতা আকাশ ছুঁলো। সাথে বিশাল দা ন বী য় এক লাথিও পড়ল তার পছন্দের ইজি চেয়ারটায়। এমন ভয়ঙ্কর লাথিতে শখের চেয়ারটি শব্দ করেই আছাড় খেল এবং ভেঙে গেলো তার একটি পায়া।
এমন বিশাল শব্দে ছুটে এলো তিমিরের ভাবী বিদিশা। হতভম্ব শাশুড়ি এবং উগ্র তিমিরকে দেখে তার যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে। কিন্তু তিমিরের পছন্দের চেয়ারটির এমন দশা দেখে বেশ চমকালো সে। অবাক স্বরে বলল,
“কী করলে এটা তুমি, ভাইয়া! তোমার শখের চেয়ারটি…..”
“এই একমাত্র নারী যার জন্য আমাকে আমার সকল শখের জিনিস খোয়াতে হয়েছে এবং হবে। উনি কখনো আমার স্বস্তি, আমার সুখ সহ্য করতে পারেননি। কখনো না।”
কথা শেষ করেই গটগট করে বেরিয়ে গেল তিমির। তাসনীম বেগম পিছু ডাকলেন না। তার মুখ রইল শক্ত, কঠিন এবং নিরুত্তর। বিদিশা গিয়ে চেয়ারটা উঠিয়ে ঠিক জায়গায় রাখল কোনোমতে হেলিয়ে। বারান্দার দরজাটা টেনে লাগিয়ে দিল নিঃশব্দে। শাশুড়ির দিকে না তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরেই বলল,
“আম্মু, ঘরে যান।”
“তুমি দেখলে বউ! ও কেমন করল আমার সাথে! আমি কী ভুল করেছি বলো তো? নিজের সন্তানের জীবনের সিদ্ধান্ত কি আমি নিতে পারি না?”
“পারেন আম্মৃ, অবশ্যই পারেন। ঠিক ততক্ষণ অব্দি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যতক্ষণ অব্দি সেই সিদ্ধান্ত সন্তানের আত্মাকে মেরে না ফেলে। কিন্তু যখন বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত সন্তানের সবচেয়ে প্রিয় সুখ কেড়ে নেয়, তখন সেটা আর সিদ্ধান্ত হয় না, আম্মু। তখন সেটা হয় ভুল।”
“তোমার মনেহয়, বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায়? ভুল সিদ্ধান্ত নেয়?”
বিদিশা হাসল। উত্তর দিল না আর। তার শাশুড়ি একরোখা মানুষ। তিনি বরাবরই মনে করেন বাবা-মা কখনো ভুল হতে পারেন না। অথচ উনার এই ভাবনা যে বিরাট ভুল সেটা উনি মানতেই চান না কখনোই। তিনি বুঝতেই চান না, বাবা-মাও মানুষ এবং মানুষ মাত্রই ভুল। সবসময় বাবা-মা সঠিক হবেন তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর একমাত্র এই কারণে তাসনীম বেগম আর তার সন্তানের মাঝে এত বড়ো দেয়াল তৈরী হয়ে গিয়েছে। যখন একটা সম্পর্কে দু’জনের মাঝে অন্তত একজনের যদি মাথা নত করার বা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে তাহলে সেটা যত মধুর সম্পর্কই হোক না কেন, বেলা শেষে সেটারও ঘূণে ধরবেই।
তাসনীম বেগম তার পুত্রবধূর উত্তর শোনারও অপেক্ষা করলেন না। বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেলেন নিজের ঘরে। বিদিশা নিস্তব্ধ হাতে তিমিরের গোছানো ঘরটা আরেকটু গুছিয়ে দিল। এই পরিবারটি সুন্দর হতে পারতো আরও অথচ সামান্য রাগ,ক্ষোভের জন্য আজ কেমন ছন্নছাড়া সব!
(১৯)
করবীর জ্বরটি বেশ শক্ত-পোক্ত ভাবেই শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে বাসা বেঁধেছে বলে ডাক্তার নিজেই বললেন তাকে কিছু টেস্ট করাতে। জ্বর কিছুটা কম থাকায় করবী টেস্ট করাতে রাজি হয় না। তাছাড়া টাকা-পয়সারও একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু করবীর এই সিদ্ধান্তে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল বিন্দু এবং হীরণ। বিকেল হতেই বিন্দু এসে উপস্থিত। করবীর না করা স্বত্তেও জোর করে করবীকে তৈরী করিয়ে নিল। তারপর ছুটল হসপিটালের উদ্দেশ্য। করবী সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে আসেই দেখে হীরণ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছে ছোটো হুতুম ও বাণীও। করবী ভ্রু কুঁচকালো, বাণীকে শুধাল,
”তুই এখানে কেন?”
বাণীকে করা প্রশ্নের উত্তর দিল হুতুম,
“বাণীর মা, বাণীরে আমি আনছি। আমরা সবাই গেলে বাণী একলা কষ্ট পাইবো না? ও তো ভাববো ওরে আমরা ভালা পাই না। সেইজন্যই তো আমি নিয়া আসলাম ওরে।”
বাণী মনের আনন্দে পাখা ঝাপটে বলল, “ঠিক, ঠিক।”
করবী এবার হীরণের দিকে তাকাল। দৃষ্টি হলো কঠিন। কণ্ঠেও শক্ত ভাব রেখে বলল,
“আপনি এখানে কেন?”
হীরণ হুতুমের ছোটো হাতটা নাড়ানোতে মনযোগ দিয়ে উত্তর দিল,
“বিন্দু একলা পারবে না তোমাকে নিতে।”
“আপনাকে তো কেউ আসতে বলেনি।”
“তোমার মনে হয় আমাকে কেউ কিছু করতে বলার পর আমি সেটা করব?”
করবী কথা বাড়াল না। এক পা আগাতে নিয়ে সে অনুভব করল তার মাথা আকষ্মিক ঘুরে উঠছে। চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসতেই সে আঁকড়ে ধরল হীরণের হাত।
করবীর এ অবস্থা দেখে হীরণও জাপ্টে ধরল তাকে। এগিয়ে এলো বিন্দু। চোখে-মুখে তার একরাশ চিন্তা,
“কী হলো, আপা! কী হলো?”
করবী সময় নিয়ে সামলালো নিজেকে। দিকভ্রান্ত দেখা গেল হীরণকেও। বিড়বিড় করল চিন্তায়,
“কী যে এক জ্বর দিলো তোমারে! আমার একদম ভালো লাগছে না তোমায় এমন দেখতে। এই জ্বর আমাকে দিতো তা-ও তুমি সুস্থ থাকতে। পাগল পাগল লাগে নিজেকে, তোমায় এ অবস্থায় দেখে।”
হীরণের বিড়বিড় করে বলা কথাটা ততটাও ধীর ছিল না। যার ফলস্বরূপ তা করবী ও বিন্দু দু’জনেই শুনতে পেল। করবী এই অসুস্থ অবস্থাতেও জেদ দেখালো, ছাড়িয়ে নিতে চাইল হাত। কিন্তু মুঠো শক্ত রাখল হীরণ। যেন তার অধিকার আছে এই শক্ত মুঠো করে ধরে রাখার।
সবটাই নীরব চোখে দেখল বিন্দু। নৈশব্দে হাসল। কেমন এক ঘোর লাগা কণ্ঠে করবীর উদ্দেশ্যে বলল,
“আহা আপা, হাতটা ছাড়াইতে চাইতাছো ক্যান? থাক না এমন। একজনের রোগে-শোকে আরেকজনের পাগল পাগল লাগবো, এমন মানুষ কী সবাই পায় বলো? তোমার তো হেই ভাগ্য হইছে। আর তুমি কি-না রাগ দেহাও!”
করবী অসহায় চোখে দেখল বিন্দুকে। আর কেউ না জানুক, সে তো জানে বিন্দু হীরণকে কতটা পছন্দ করে। মেয়েটা নিশ্চয় ভীষণ কষ্ট থেকে এই কথাটা বলেছে।
হীরণও কী বুঝল বিন্দুর ব্যাথা! মনেহয় তো না। সে আগের মতনই শক্ত হাতে ধরে রইল করবীকে। বাণী তার চঞ্চল কণ্ঠে বলতে লাগল,
“বোকা হীরণ, বোকা হীরণ।”
তন্মধ্যেই করবীদের বাড়ির নিচতলার রুম থেকে ভাড়াটিয়া মহিলা বেরিয়ে এলেন। হীরণের হাতের মুঠোয় করবীর হাতটা দেখে কেমন নাক-মুখ কপালে উঠালেন। ‘হায় হায়’ করে বললেন,
“এহনের মাইয়্যা গো তো শরম লজ্জা বলতে কিছুই নাই। পরপুরুষের হাত ধইরা রাখছে কেমনে, দেহো! আর আমাগো সময়, আমরা জামাইয়ের দিকেও চোখ তুইল্যাই তাকাই নাই। হাত ধরমু তো দূরের কথা।”
মহিলার এমন লাগামহীন কথায় করবীর রাগ হলো। সে টেনে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইল। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে, তাদের দু’জনের হাতের মুঠটি শক্ত করে ধরল বিন্দু। বোকা বোকা হেসে মহিলাকে বলল,
“আপনার যেন কয়ডা পোলাপান, চাচী?”
এহেন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে অবাক হলেন মহিলা। কপাল আগের ন্যায় কুঁচকে রেখেই বললেন,
“সাত মাইয়া, তিন পোলা। মোট দশজন।”
“আর একটা বাদ রাখলে কেন? আর একটা হলেই তো এগারো জনের একটা ফুটবল টিম হয়ে যেত।”
হীরণের ঠোঁটকাটা ঠাট্টায় চোখ বড়ো বড়ো করল করবী। কিন্তু মহিলা বোধহয় মশকরাটা ধরতে পারলেন না। সে বেশ দুঃখী দুঃখী হয়ে বললেন,
“আছিলো বাপজান, আরও দুইটা মাইয়া হইছিলো। কিন্তু ওরা জন্মের পরই মইরা গেছে। নাহয় আইজ বারোডা পোলাপাইন থাকত আমার।”
এবার হীরণের চেয়েও আরেকটু বেশি ঠোঁটকাটা হলো বিন্দু, তার ডাগর ডাগর নয়ন যুগল মেলে দুষ্টু কণ্ঠে বলল,
“ভাগ্যিস চাচী, আপনাগো যুগে আপনারা শরম পাইতেন। জামাইয়ের দিকে চোখ তুইল্যা তাকাইতেন না। হাত না ধইরাই যার বারোডা পোলাপাইন হইছে, হাত ধরলে জানি তার কী হইতো! দেশের অর্ধেক ভাগে তাইলে খালি আপনাগো পোলাপানই থাকতো।”
বিন্দুর এমন ঠাট্টায় হা হা করে হেসে উঠল হীরণ। বিন্দুর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বাহবাও দিল সে। এবার শরম পেলো মহিলাও। দ্রুত সে বকতে বকতে স্থান ত্যাগ করল। করবী হতবিহ্বল হয়ে গেল। ধমকে বলল,
“অসভ্য হচ্ছিস, বিন্দু!”
কিন্তু সেই কথা শোনার সময় কী আর বিন্দুর আছে? সে হীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে, মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“হীরণ ভাইয়ের এমুন হাসি দেখতে আমি অসইভ্যর চেয়ে বেশি কিছুও হইতে রাজি আছি, আপা।”
করবী হতাশ হলো। ভালোবাসা যে ভীষণ অন্ধ, তার প্রমাণ তো বিন্দুও। নাহয় এতটা বোকা বোকা মুগ্ধতা কারো মাঝে থাকে আদৌও?
#চলবে………