বীলাসীর কষ্ট

0
1270
মা যখন আমাদের ফেলে চলে যান, তখন আমার বয়স ছিল দশবছর। মা আমাদের ভালোবাসাকে ভুলে গিয়ে, অন্যকাউকে ভালোবেসে, আমাদেরকে ফেলে চলে যান। বাবা তখন নির্লিপ্ত গলায় বলতো, “এটা হতেই পারে। ভালোবাসা কি জোড় জবরদস্তি করে হয়রে বাপ! অন্যকাউকে ভালোবাসতেই পারে, চলে যেতেই পারে।ব্যাপার না।” ছোট্ট আমি খুব চিন্তিত মুখ নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করতাম, “আমাদের কি এখন তাহলে মাকে ঘৃণা করা উচিৎ বাবা?” “কেন ঘৃণা করবো! কোন দরকার নাই নিজেকে নিজে কষ্ট দেবার। কাউকে ঘৃণা করাটা খুব কষ্টের। আমরা মাকে ভালোবাসব, ঘৃণা নয়। ভালোবাসাতে একটা সুখ সুখ আমেজ থাকে আর ঘৃণাতে থাকে কষ্ট। সুখের আমেজটা আমরা ষোলআনা ভোগ করব, নিজেকে সুখী করব”।
বাবা আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলতো। আমি বাবার বিশাল বুকে মাথা রেখে সুখী হবার মন্ত্র শুনতে শুনতে শান্তিতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতাম। বাবা অদ্ভুত সব কথা বলতো। বাবা সবকিছুই হালকাভাবে নিতো। অনেকটা নদীর মতো। নদীর পানিতে কত কিছু ভেসে যায়! তবুও নদীটা নদীর মতোই থাকে! নোংরা পানিটা কখনোই নদীটার নাম বদলাতে পারেনা! কী অদ্ভুত তাইনা! আমার বাবাকে সবাই পাগল বলতো। পাগলরা সুখী হয়। সত্যিই সুখী ছিলাম আমরা বাবাছেলে। বাবা আমাকে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিতে দিতে মায়ের গল্প বলতো। প্রতিদিনই আলুর ডাল আর আলুভর্তা রান্না হত আমাদের বাসায়। ধোঁয়া উঠা গরম গরম ভাত মেখে আমার মুখে তুলে দিতে দিতে কত শত গল্প করত বাবা! আমি একটার পর একটা প্রশ্ন করতাম মাকে নিয়ে। আর বাবা সব প্রশ্নের উত্তরই সুন্দর করে আমাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলত। বাবা একটুও বিরক্ত হতনা আমার এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে। আমার ভীষণ মন খারাপ হতো মায়ের জন্য। আমি আড়ালে কাঁদতাম মাকে মনেকরে। বাবা যাতে দেখতে না পান সেজন্য আমি আড়ালে চোখ মুছে, কলের পানিতে মুখ ধুয়ে তারপর বাবার সামনে যেতাম। ভীষণ রাগ হতো মায়ের উপর। বাবা কিন্তু সবই বুঝতে পারতেন আমার মনের অবস্থা। কি অদ্ভুত এক সহজ গলায় বাবা আমাকে বলতেন তখন, “গভীর ঘন জঙ্গলের ভিতরেও কি অদ্ভুত একটা সোজা রাস্তা থাকেরে বাপ! কিন্তু আমরা দেখিনা! আমরা জটিল করে ভাবি বলেই জীবনটা এত কষ্টের লাগে। জীবনটা খুব সোজা, একেবারে পানির মতই সোজা। জংগলের সেই পুরোনো রাস্তাটার মতোই সোজা”। আমার লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না দেখে বাবা বলতো, “এই যে তুই হাবিজাবি রাগদুঃখ মনে ভিতরে নিয়ে চোখ মুছে মুখ ধুয়ে আসলি, এই সব কি ধরা যায়? ছোঁয়া যায়? যায়নারে বাপ। সবটাই বাতাস। এইসব দুঃখটুক্ষ সবটাই বাতাস। বাতাস থেকে শুধু বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিবি, জীবন নিবি। দুঃখ নিবি না, কষ্ট নিবি না”। আমি আবারো মাকে মনে করতাম, আমার মনটা ভীষণ খারাপ হতো মায়ের জন্য। বাচ্চা ছিলামতো, তাই। আবার অন্যদিকে বাবার জন্য ভীষণ মায়া হতো। বাবাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করত বেশি বেশি করে। সেই ছোট্টআমি ঠিকই বুঝতাম, মা এখন অতীত আর বাবা বর্তমান! বুঝতে পারতাম অতীত শুধুই মন খারাপ করায় আর বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে হয়। আর আমার বাবার মতে, “যে কষ্ট ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না সেসব অর্থহীন”। আমাদের বাপছেলের মূল্যবান সেসব দিনগুলোতে প্রতিদিনই আলুভর্তা আর আলুর ডাল রান্না হতো।গরম গরম নরম সাদা ভাতের সাথে আলুর ডাল আর আলুভর্তা মেখে মেখে আমার মুখে তুলে দিতো বাবা। অসাধারণ ছিল বাবার হাতের আলু মাখানো ভাতের লোকমাগুলো। কোন কোন দিন আবার ফুটন্ত ডালে বাবা দুইটা ডিম ভেঙ্গে ছেড়ে দিতেন। ডালের সাথে ডিমও রান্না হয়ে যেত। অপূর্ব স্বাদের ছিল সেসব ছোট ছোট লোকমা। বাবাকে দেখে দেখে দশ বছর বয়সেই আমি শিখে ফেলি অসাধারন স্বাদের এই রান্নাটি। ভীষণ সহজ ছিল রান্নার কাজটা অবশ্য। চাল আর আলু ধুয়ে, একটা পাতিলে নিয়ে পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলেই অর্ধেক কাজ শেষ। তারপর ভাতসেদ্ধর ভেতর থেকে আলুসেদ্ধ বের করে, লবণ, পেঁয়াজ আর সর্ষেরতেল দিয়ে মাখালেই আলুভর্তা প্রস্তুত। সেই আলুভর্তার অর্ধেক আবার দুই মগ পানির সাথে ঝাঁকিয়ে গরম তেলে রসুন লাল করে ভেঁজে বাগাড় দিলেই আলুর ডাল প্রস্তুত। বাবা কথা বলতে বলতে নিপুণ এক শিল্পীর মত এই কাজগুলো করে যেতেন আর আমি অবাক দর্শক হয়ে বাবার মুখের দিকে, হাতের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম।
বাবার রান্না দেখে দেখে আমার শেখা হয়ে যায়, সাদামাঠা একটা আলুসেদ্ধ থেকেও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ নেয়া যায়! বাবাকে দেখে দেখে আমার শেখা হয়ে যেতো, জীবনটা এভাবে দেখলেও অনেকটা সোজা লাগে! আমি আর বাবা তখন থাকতাম রেলস্টেশনের কাছাকাছি একটা বিল্ডিং এর চিলেকোটার একরুমের একটা বাসাতে। মা চলে যাবার পর বাবা আমাদের পুরোনো বাসা পাল্টে, স্টেশনের কাছাকাছি একটা বিল্ডিঙের চিলেকোটায় একরুমের একটা বাসা ভাড়া নেন। আমরা আগের সবকিছু ফেলে এসে একটা রুমের সেই বাসায় নতুন করে আমাদের বাবাছেলের নতুন জীবন শুরু করি। আমাদের নতুন সংসারের জন্য আমি আর বাবা বাজারে গিয়ে দুজন মিলে পছন্দ করে করে নতুন নতুন হাড়িপাতিল কিনি, দুজনের জন্য দুইটা প্লেট আর দুইটা মগ, নতুন বিছানার চাদর কিনি, আরো অনেক অনেক বাজার করি আমাদের বাপছেলের ছোট্ট সংসারের জন্য। মায়ের পছন্দের সব জিনিস আমরা আগের বাসায় রেখে এসেছি। বাবা বলত, “যেসব জিনিসের সাথে কষ্ট লেগে থাকে, সেসব কষ্ট পিছনে ফেলে হাঁটা ধরবি বাপ। যে কষ্টগুলো ধরা যায়, ছোঁয়া যায় সেসব থেকে দুরে থাকবি। দেখবি জীবনটা অনেক সুন্দর”! নতুন এলাকায়, নতুন স্কুলে ভর্তি হবার পর আমার নতুন নতুন সব বন্ধু হয়। কিভাবে কিভাবে যেন মায়ের কথা, মাকে ছাড়া আমাদের ছোট্ট সংসারের কথা ওরা জেনে গিয়েছিল। বন্ধুরা মুখে অদ্ভুত একটা হাসি টেনে আমাকে জিজ্ঞেস করত, “আবিদ, তোর মা কই গেল রে? প্রেম করে নাকি ভাগছে! অন্য বেডার লগে”! বিকেলে খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেয়ে মাঠের পাশে রিপনদের বাসায় ব্যান্ডেজ লাগাতে যেতাম মাঝে মাঝে। রিপনের মা আহারে আহারে বলতে বলতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, “মাকে মনে পরে বাবা”? এমনকি কোন কোন দিন ক্লাসে পড়া না পারলে বিমল স্যারও চিবিয়ে চিবিয়ে সবার সামনে বলত, “মা তো ভাগছে অন্য মানুষের সাথে, ছেলে আর মানুষ হবে কেমনে”? সবাই কেমন যেন অদ্ভুত এক অস্ত্র পেয়েছিল আমাকে কাবু করার! মাকে নিয়ে এসব কথা বলেই ওরা হাসত কেমন জানি অদ্ভুত করে! সেসব হাসি নিষ্পাপ ছিলনা। ওদের ভীষণ অসুন্দর লাগত। সেই হাসিতে কুৎসিত শ্যাওলার মতন একটা জিনিস থাকত, আমার গা গুলিয়ে আসত। ওরা হাসলে আমি দেখাতাম, নোংরা শ্যাওলা ওদের চোখে মুখে লেপটে আছে! কেন জানিনা আমার অন্যরকম একটা মায়া হত ওদের জন্য! বাবা আমাকে বলত, “নিরস্ত্র মানুষকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে আসা মানুষগুলো বোকা হয়রে বাপ! ভীষণ বোকা হয় ওরা। বোকা মানুষদের মায়া করবি, ভয় করবিনা”। আমি ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের সাথে মোকাবেলা করতাম। আমি শান্ত কণ্ঠে, ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলতাম, “হ্যাঁ, ভালবেসেই মা অন্যকাউকে আপন করেছে। তাতে কি? মা ভাল আছে। আমরাও ভাল আছি। ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না এসব জিনিস নিয়ে আমরা ভাবিনা”। তারপর বন্ধুরা ধীরে ধীরে এসব কথা আর বলতোনা। রিপনের মা অথবা বিমল স্যারও আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছিল মনেহয়। কারণ ওদের হাসিগুলো আমার কাছে মিষ্টি লাগতে শুরু করেছিল। বাবা বলত, “ভালবাসা বুঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, তাঁর হাসি। কারো হাসি মিষ্টি লাগলেই বুঝতে হবে সে ভালবেসে হাসছে”। তারপরতো আমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো তরতর করে বয়ে যেতে লাগল। আমরা পাগল বাপছেলে পাথরের মত কঠিন কঠিন সব দুঃখ কষ্টকে টুকরো টুকরো করে, মিহি পেস্ট বানিয়ে, এবড়ো খেবড়ো চলার পথে প্রলেপ দেয়ার কাজে, মসৃণ করার কাজে ব্যবহার করতাম। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষকে বেঁচে থাকার কথা শোনাতাম। কেউ পাগল বলত, কেউ আবার অবাক হয়ে শুনত। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিতার সাথে আমার প্রেম হয়। আমি ভালবাসি নিতাকে, নিতা আমাকে। বাবা আমাকে বলে, “ভালোবাসা হতে হবে শুধুই ভালোবাসা। ছোট ছোট গল্পের মতো। কিছু গল্প ধরা যাবে, ছোঁয়া যাবে। কিছু গল্প অধরা থেকে যাবে। সেই অধরা গল্পগুলোকে বাতাসে উড়িয়ে দিতে হবে। ভালোবেসে সুখী হতে হবে, নিজেকে নিজে সুখ দিতে হবে”। নিতা একসময় হারিয়ে যায়। অধরা ভালবাসা হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। ব্যাপার না। কিছু গল্পতো অধরাই থাকে। যেসব গল্প আমি ছুঁয়েছিলাম সেসব নিয়েই আমি সুখী হই। আমি আবারো প্রমাণ করি, সব কষ্টই বিলাসিতা! অলস অবসরের সঙ্গী। নিজেকে ভাল রাখার মন্ত্র হচ্ছে ভালবাসা। কষ্টগুলোকে বিলাসিতার তালিকাতেই আমি রাখি। টাকা দিয়ে কষ্টের গান কিনি, কষ্টের গল্প পড়ি। আবার অধরা সেসব কষ্ট থেকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায় এমন কিছু সুখ সুখ আমেজের ভালবাসা বানিয়ে ফেলি। আমার মতে, আমি পৃথিবীর ভীষণ রকমের একজন সুখী মানুষ। আমাকে কেউ কেউ পাগলও বলে, আমার বাবার মত। বাবাকে যে সবাই পাগল বলত। বাবা তখন হাসত। বাবা বলত, “পাগল হলেও আমরা ভালই আছি। পাগলরাই সবচেয়ে সুখী মানুষ। পাগলরাই পারে বাতাস থেকে সুখটান দেবার পর কষ্টগুলোকে ধোঁয়ার মত উড়িয়ে দিতে”। বিলাসী কষ্ট! ** ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না এসব কষ্ট বিলাসিতার তালিকায় থাকুক। গালে ছুঁয়ে থাকে, ঠোঁটে লেপটে থাকে, চোখে চকচকে হাসি হয়ে থাকে এমন সব ভালবাসায় জড়িয়ে থাকুক সবার নতুন বছর ❤️❤️। **Repost

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে