বিসর্জন পঞ্চম পর্ব

0
1764

বিসর্জন পঞ্চম পর্ব

তার মানে চাকরিটা আমার হয়ে গেছে।বাবা মা কে খবরটা জানালাম ওনারা খুব খুশি হয়েছেন।তবে বাবাকে দেখে মনে হল বাবা একটু বেশিই খুশি হয়েছেন।হয়তো এটা ভেবেই বাবা বেশি খুশি হয়েছেন যে আমাকে আর ওনার টাকা দিতে হবে না।

সাথে সাথে আঙ্কেলকেও খবরটা জানালাম ওনিও খুব খুশি হয়েছেন খবরটা শুনে।

আগামী মাসের এক তারিখে চাকরিতে জয়েন দিতে হবে।তাই সবকিছু গুছগাছ করে নিলাম। যাওয়ার আগে একবার আঙ্কেলের সাথে দেখা করে গেলে ভাল হয়।

তার পরের দিনেই চলে গেলাম ওনার সাথে দেখা করতে।আমাকে দেখে আঙ্কেল খুব খুব হল।তারপর চাকরির ব্যাপারে জিগ্যেস করল।এর ভেতরেই আমি জিজ্ঞাস করলাম আঙ্কেল লিনা বাসায় নেই ?

– না বাবা,লিনা তো বাসায় নেই।ও তো ঢাকায় চলে গেছে।

লিনা বাসায় নেই কথাটা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।

– তোমার চাকরির পোস্টিং কোথায় হয়েছে বাবা ?

“ঢাকায় হয়েছে”

– ওহ্ তাহলে তো ভালোই হয়েছে।লিনাও ঢাকায় থাকে তোমারও সেখানেই পোস্টিং হল।দুজন একি শহরে থাকবে।

আঙ্কেল আপনার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।আপনি আমাকে ঐ সময় টাকা টা না দিলে চাকরিটা আমার হতো না।

– এভাবে বলো না বাবা।আমার কাছে সে সময় টাকা টা ছিল তাই তোমাকে টাকাটা দিয়ে একটু সাহায্য করছি।আর বাকি সব কৃতিত্বই তো তোমার।

আঙ্কেল আপনাকে ঘিরে যে আমার মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে,,,,

– হম আমি যানি আমাকে নিয়ে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে।

তবে শুনো আমি তোমাকে কিছু কথা বলি।এর ভিতরেই হয়তো তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে,,,,

লিজার বয়স তখন ছয় বছর আর লিনার বয়স সারে তিন বছর ঠিক তখনেই তাদের মা মারা যায়।তখন আমি মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম।তখন অনেকেই আমাকে বলেছিল আমি যেন আরেকটা বিয়ে করে নেই।কিন্তু আমি আমার মেয়েদের কথা চিন্তা করেই বিয়েটা করিনি।

তখন আমার ছিল বিশাল ব্যবসা।ব্যবসাতে সময় দিতে গেলে মেয়েদের সময় দিতে পারি না।আর তখন মেয়েরাও আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না।তাই নিজেকে ব্যবসা থেকে গুটিয়ে নিলাম।সবসময় মেয়েদের কাছেই থাকতাম।
তখন দুই মেয়েকে ঘিরেই ছিল আমার পৃথিবী।

তারপর আস্তে আস্তে মেয়েরাও বড় হল বুঝতে শিখলো আমিই তাদের মা আমিই তাদের বাবা।

আমার দুই মেয়েই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল।তাই আমারো ইচ্ছা ছিল আমার দুই মেয়েকেই পড়াশোনা শিখিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলবো।

বড় মেয়েটা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে ভর্তি হওয়ার তিন বছর পর যখন ছোট মেয়েটা একদিন ফোন দিয়ে বলল বাবা আপুর মত আমিও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি।সেদিন আমার মনে হয়েছিল হ্যাঁ,আমি পেরেছি আমার মেয়েদের কে সেভাবেই গড়ে তুলতে।

বিগত এক বছর ধরেই বিভিন্ন জায়গা থেকেই অনেক ছেলের বাবাই মেয়েদের বিয়ের সমন্ধ নিয়ে এসেছে আমার কাছে।সেখানে অনেক বড় ধরেনের চাকরি জীবি ছেলে ছিল,অনেক ধনী পরিবারের ছেলে ছিল।তবে সেই ছেলেদের মধ্যে কোন ছেলেকেই আমার মেয়ের যোগ্য হিসাবে আমার কাছে মনে হয়নি।

এর মধ্যেই হটাৎ করে একদিন তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে আসলে আমাদের বাসায়।তুমি তোমার সমস্যার কথা আমাকে খুব সহজেই অকপটে বলে দিলে।কোন কিছুই আড়াল করোনি আমার থেকে।তোমার এই গুনটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।যেহেতু একটা সময় আমি ব্যবসা করেছি তাই মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না।তাই হয়তো সেদিন এতকিছু না ভেবেই তোমার হাতে টাকাটা তুলে দিয়েছিলাম।

তুমি সেদিন চলে যাওয়ার পরেও আমি খুঁজ নিয়ে জেনেছি টাকাটার তোমার খুব প্রয়োজন ছিল সেদিন আর তুমি মানুষ হিসেবেও নাকি খুব ভালো।তারপর আমার মনে হল আমি মানুষ চিনতে মোটেও ভুল করিনি।

তারপর তুমি যখন আমার বাসায় এসে লিজা কে দেখে গিয়ে বললে তুমি লিজাকে নয় লিনাকে বিয়ে করতে চাও।তখন এটা শুনে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম।

আমার বড় মেয়ে লিজা শান্ত প্রকৃতির।রূপে,গুনে শিক্ষায় দিক্ষায় লিনার থেকে লিজা এগিয়ে।লিনাও ভালো তবে ও একটু আনমনা আর ভাবুক প্রকৃতির।

লিজাকে পছন্দ না হয়ে তোমার লিনাকে পছন্দ হয়ে গেল।এমনটা হওয়ার কোন কারন আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।আর তুমিও আমাকে এমন ভাবে বললে আমি খুব দ্বিধা দ্বন্ধে পরে গেছিলাম এটা নিয়ে।কি করব ভেবেই পাচ্ছিলাম না।

তারপর ভবিষ্যতের কথা চিন্তে করে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম।লিনাকেই তোমার কাছে বিয়ে দিব।

তবে এটার জন্য যে আমার বড় মেয়ে লিজা একটু কষ্ট পেয়েছে এটা আমি ঠিকি বুঝতে পেরেছি।তবে এই কষ্ট টা সাময়িক।কিছুদিন পরে হয়তো আর থাকেবে না।

সেদিন যদি আমি তোমার কথা না ভেবেই লিজাকে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম তাহলে এটা তোমাদের বিবাহ পরবর্তী জীবনে বিরুপ প্রভাব ফেলতো।

তাই আমি আমার ছোট মেয়েকেই তোমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছি।আর তুমি সেদিন যে সৎ সাহস নিয়ে আমাকে কথাটা বলেছিলে।সেদিন তোমার ঐ সৎ সাহসটাকে আমি সম্মান করেছিলাম।

তুমি চাইলেই সেদিন তোমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার দেওয়া টাকার কথা চিন্তা করে বিয়েটা করে নিতে পারতে।কিন্তু,তুমি তা করোনি।এই বিষটা আমার খুব ভালো লেগেছে।

আর বিয়ের পরে মেয়ের বাবা থেকে জোর করে যে টাকা আদায় করে নেওয়া হয় সেটাকে যৌতুক বলে।এখনো কিন্তু তোমাদের বিয়ে হয়নি।আর সেদিনের দেওয়া টাকাটা আমি কিন্তু তোমাকে যৌতুক হিসাবে দেই নি।তোমার বিপদে আমি শুধু তোমাকে সাহায্যে করেছি মাত্র।আর কিছু না।

তোমার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছিল সেদিন।আর সেই ভালো লাগা থেকেই হয়তো সেদিন তোমাকে টাকাটা আমি দিয়েছি।

আঙ্কেল আমার একটা কথা আপনাকে রাখতে হবে।

– কি কথা ?

আমার আর লিনার বিয়ের আগেই আমি আপনাকে টাকা টা ফেরৎ দিতে চাই।

– সে সব পরে দেখা দেখা যাবে বাবা।আগে তুমি গিয়ে আগে চাকরিতে জয়েন দাও।

আঙ্কেল এর থেকে এতগুলি কথা শুনে সেদিনের পর থেকে ওনার প্রতি আমার সম্মান বোধ আরও কয়েক গুন বেড়ে গেছে।সত্যিই ওনি একজন অসাধারণ মনের মানুষ।ওনাকে খুব কাছ থেকে না দেখলে আর ওনার বলা কথা গুলি না শুনলে এটা হয়তো কোন দিন জানতেই পারতাম না।

সেদিন যখন ওনার থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবো তখন ওনি আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেছিলেন এটা তুমি রাখো।

টাকাটা আমি নিতে চাইনি।কিন্তু,ওনার সাথে আমি পেরে উঠিনি।তারপর একরকম বাধ্য হয়েই টাকাটা আমাকে নিতে হল।

আমার কাছে লিনার ফোন নাম্বার নেই।আঙ্কেলের থেকে কিভাবে ফোন নাম্বার চাইবো এটা চিন্তা করতেই আঙ্কেল বলে ফেলল তোমার কাছে হয়তো লিনার ফোন নাম্বারটা নেই।তুমি ওর ফোন নাম্বারটা নিয়ে যাও,,,

ঢাকায় এসে চাকরিতে জয়েন করেছি এক সপ্তাহ হল।নতুন এসেছি তো তাই এই এক সপ্তাহে কাজের চাপটা আমার কাছে বেশিই মনে হয়েছিল।

আজকে ছুটির দিন হওয়ায় অফিস বন্ধ ছিল।তাই সকাল থেকেই কয়েক বার লিনার নাম্বারটা ফোনে চেপেছি কিন্তু কল দিতে পারিনি।

তাই রাতের বেলা সাহস করে কল দিয়েই ফেললাম।দুইবার রিং হওয়ার পর তৃতীয় বারেই মাথায় ফোন রিসিভ করল,,,,

– হ্যাঁলো,,,,, !!

ভালো আছেন ?

– কে বলছেন ?

যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

– ওহ্,,,আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন ?

আপনার বাবার থেকে নাম্বারটা পেয়েছি।

– তো ফোন দিয়েছেন কেন ?

চলবে…..

লেখা || Tuhin Ahamed

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে