বিষাদ
আমি এসেছি একটা বিয়েবাড়িতে। নাহ, ঠিক বিয়ে বাড়ি বলা এখন ঠিক না, কমিউনিটি সেন্টার । শহরে বিয়ে বাড়ির উৎসবের আমেজ এখন কমিউনিটি সেন্টারে সীমাবদ্ধ। দুয়েকদিন বাসায় গেস্ট থাকলেও রিসিপশনের পরের দিন বলতে গেলে বাসা ফাঁকা হয়ে যায়।
অথচ আমাদের ছোটবেলায় বিয়ে মানে একমাস ধরে বাড়িতে মেহমান থাকবে। খালা, মামা, ফুপু, চাচীরা বাড়ি ভরা থাকবেন অন্তত পনের দিন। বাড়িতে ঘুমানোর জায়গা না হলে পাড়া প্রতিবেশীরা সানন্দেই ডেকে নিয়ে যেত। আর প্রাইভেসি! এই অদ্ভুত শব্দটাই ছিল না। দল বেধে সবাই এক খাটে ঘুমিয়ে পরতাম। মা খালা ফুপু চাচীরা প্রয়োজনে মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে পরতেন! প্রতিবেলায় পাত পড়তো পঁচিশ থেকে ত্রিশ জনের। পিঠে বানানো হতো রাত জেগে, উঠানে বসে বা বারান্দায় বসে। বেশিদিন আগের কথাও নয়, এই পনের বিশ বছর হবে! শহরতলীতে এখনো হয় এমন! আমি ঢাকার বাইরে যাই না অনেক বছর! বাইরে বলতে বছরে দুয়েকবার ছেলেদের নিয়ে স্বামীর সাথে কক্সবাজার বা সিলেট যাওয়া হয়! আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়ানোর চল তো এখন উঠেই গিয়েছে। এসব ভাবছিলাম স্টেজের সামনে দেয়া সোফার এক কর্নারে বসে। বর বউ আসেনি এখনো না কি! পাশ থেকে শুনলাম তারা কাপল শ্যুট করতে ছাদে গিয়েছে। এই এক বিষয় হয়েছে এখন! বিয়ে বাড়িতে বর বউ ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে! আর অতিথিরা সেলফি তুলে যায় !
আমি যার বিয়েতে এসেছি, তাকে চিনি না। কলিগের আত্মীয়, তার রিসেপশন। এমন বিয়ে টিয়েতে আমি যাই না খুব একটা। কলিগ খুব করে বলল, আপনি সেলিব্রিটি মানুষ, সবাই খুশী হবে আপনাকে দেখলে। আরে ভাই, আমি কি ওইরকম সেলিব্রিটি না কি! সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে হাজার বিশেক মানুষ আমাকে চিনে, আমাকে চিনে না বলে আমার লেখা চিনে বলাই ভাল। গত দুই বইমেলায় গোটা দুয়েক বই বের হয়েছে এটুকুই।
তাও এত জোর করল যে এড়াতে পারলাম না।
আমাকে যে মানুষ চেনে না তার প্রমাণ দেখাই যাচ্ছে। কলিগের দেখা নেই এখনো। গেটে চা কফির ব্যবস্থা আছে। সব গেস্টকে চা কফি অফার করলেও আমাকে কেউ কিছু বলেনি এখনো। আর বলবেই বা বি, আমাকে তো কোন পক্ষের লোকই চিনে না!
পিছনে দুজন মহিলা কফি নিয়ে এসে বসেছে। আরও বলছে শুনলাম, তাড়াতাড়ি শেষ কর, ওইদিকে ভাপা পিঠে আছে, ফুসকা চটপটিও আছে। তাড়াতাড়ি না গেলে শেষ হয়ে যাবে!
এটাও আধুনিক চল। গেস্ট দের জন্য পিঠা, চা, কফি, ফুসকা চটপটির ব্যবস্থা করা থাকে অনেক জায়গায়ই।
আমাদের সে আমলে ছিল শরবত মিষ্টি আর চিনির শিরায় ভেজানো নকশী করা পাকন পিঠে। শুরুর আপ্যায়নটা এটা দিয়েই করা হতো।
কমিউনিটি সেন্টারে সাউন্ড সিস্টেম ভাল না। অযাচিত শব্দে মাথা ধরে যাচ্ছে আমার। উঠে গিয়ে কফির লাইনে দাড়ালাম। ভাগ্য ভাল ছিল, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না! কফি নিয়ে একটু সাইডে চলে এলাম। আমার কলিগের সাথে দেখা হলো তখনই। তিনি আমাকে দেখে মহা খুশি হলেন, কয়েকজনের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন, ইনি অনন্যা চৌধুরী, ফেসবুক সেলিব্রিটি। এনার বইও আছে কয়েকটা। আমি বিব্রত বোধ করতে লাগলাম! যাদের সাথে আলাপ করালেন, তারা আমাকে চিনলেন বলে মনে হলো না। একজন বললেন, তা আপনি লিখেন নাকি?? কি লিখেন? গল্প না কবিতা??
আমি উত্তর দিলাম, আমি আসলে গল্প কবিতা লিখি না, সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গে লিখি!! তিনি বললেন, ওহহ আচ্ছা!! এখনকার জেনারেশন লিখতে পারে নাকি!!
লিখে গেছেন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ!! পারবে এরকম লিখতে!! এমন আঁতেল টাইপের প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন! তবুও বললাম, জি আমি গল্প কবিতা না লিখলেও বর্তমানে অনেকেই ভাল লিখছে!!
যাই হোক তার কাছে শুনলাম, বাংলাদেশের কোন লেখকই লেখার টেকনিক বোঝে না! আমার আর ভাল লাগছিল না, তাড়া আছে বলে সরে পড়লাম ওখান থেকে।এমন লোকের সাথে তর্ক করা নিতান্ত বোকামি! খাবার সার্ভ করে দিয়েছিল। আমার কলিগ আমাকে নিয়ে একটা টেবিলে বসিয়ে দিলেন! এটাও খুব আজব লাগে আমার! কেউ কাউকে চেনে না, যে যার সুবিধা মতো নিতান্ত অপরিচিত একজনের সাথে বসে পরে খেতে! যাই হোক, টেবিলে টিকিয়া আর বিরিয়ানি দেয়া ছিল। আটটা চেয়ার হিসেব করে আটটা টিকিয়া দেয়া। যে মহিলা আমার সামনে বসেছেন, তার ছেলে মেয়েকে দুটো করে টিকিয়া দিয়ে দিলেন! মানুষের কমনসেন্সের অভাব আর কি! বেয়ারা এলে আবার টিকিয়া দিতে বললাম!
খাওয়ার মাঝে কলিগ এসে দুবার খোঁজ নিয়ে গেলেন। খাওয়া শেষ করে উঠে বসলাম আবার স্টেজের সামনে।
একজন ছোকরা মত লোক এসে বললেন, ম্যাডাম আমি আপনাকে চিনি! আপনার লেখা গল্প কবিতা আমার খুবই পছন্দ! যাই হোক, আমার সেই লেভেলের ভক্ত! পেয়ে আমি কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম!
হঠাৎ শুনি একটু হইচই!! কি হয়েছে বুঝতে সময় লাগলো! বর বউ এতক্ষন স্টেজে ছিল, এখন এন্ট্রি নিয়ে ঢুকবে, ভিডিও করা হবে!
যাই হোক, হিন্দি বাংলা গানে নেচে-কুঁদে বর বউ এর এন্ট্রি নেয়া শেষ হলো।
পিছন থেকে আবার সেই মহিলা দুজন বলছে, তাড়াতাড়ি চল, বর বউ খেতে বসলে আর সেলফি তোলাই হবে না!! তারা স্টেজের দিকে এগুলেন বর বউয়ের সাথে সেলফি তুলতে। আর একজন মধ্যবয়েসী ভদ্রলোক কাউকে বলছেন, ধূর,৷ খাসীর মাংসটা একদম গলিয়ে ফেলেছে!
বউয়ের বাবা মুখে হাসি ধরে রেখে সবাইকে আপ্যায়ন করছেন, কিন্তু আমি তার ভিতরে গভীর বিষাদ দেখতে পেলাম। আজই অফিসিয়ালি মেয়েটা পরের ঘরে চলে যাবে। হয়ত রান্না জানে না ভাল, সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনা, বাবার কাছের আল্লাদী গুলো পরের ঘরে ন্যাকামী হয়ে যাবে কাল থেকে। মনে পরলো পনের বছর আগে আমার বিয়ের দিনে বাবার মুখটা! এত আয়োজন, এত পরিবর্তন সব কিছুর ভীরে বাবারা বাবাই থেকে যায়!
কলিগের সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। কমিউনিটি সেন্টার পিছনে ফেলে আমার গাড়ি ছুটে চলছে রাস্তায়। রাত বাড়ছে। ঝলমলে আলোয় ঢাকা উৎসবে মেয়ের বাবার বিষাদগুলো কেমন চাপা পরে যায় এই শহরে। প্রদীপের নিচের আঁধারের মতো।
#ছোটগল্প
বিষাদ
@শানজানা আলম
২৬/০৪/১৯
( প্রিয় পাঠক আপনাদের যদি আমার গল্প পরে ভালোলেগে থাকে তাহলে আরো নতুন নতুন গল্প পড়ার জন্য আমার facebook id follow করে রাখতে পারেন, কারণ আমার facebook id তে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গল্প, কবিতা Publish করা হয়।)
Facebook Id link ???
https://www.facebook.com/shanjana.alam